একটি ছোটো গল্প দিয়ে শুরু করছি।
দক্ষিণ আফ্রিকার বতসোয়ানার এনিম্যাল ক্যাম্পে একজন পর্যটক জেব্রা, হাতি, মহিষ দেখতে দেখতে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। হঠাত তিনি লক্ষ্য করলেন, দুটি হাতিকে ছোট দুটি রশি দিয়ে তাদের এক পা বেঁধে রাখা হয়েছে খুঁটির সাথে। হাতি দুটোর তুলনায় রশিগুলো একেবারে নগন্য, চাইলেই তারা সামান্য শক্তি প্রয়োগ করে ছুটে পালাতে পারে ক্যাম্প থেকে। কিন্তু হাতি দুটির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই, তারা নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে আছে একই স্থানে।
কৌতুহলবশত পর্যটক এগিয়ে গিয়ে ওই স্থানে অবস্থানরত প্রশিক্ষককে প্রশ্ন করে বসলেন।
উত্তরে প্রশিক্ষক জানালেন, ছোট থাকতে হাতিগুলোকে এই রশি দিয়েই বেঁধে রাখা হতো, যাতে তারা ছুটে যেতে না পারে। তখন এই রশিগুলো তাদের শরীর আটকে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিলো। সময়ের সাথে সাথে হাতিগুলো দেহে বড় হয়ে গেলেও, তাদের মনে এই বিশ্বাস ঢুকে যায় যে তাদের পক্ষে এই রশি ছিঁড়ে পালানো সম্ভব না। তাই তারা শক্তিসামর্থ্য অর্জন করেও আর চেষ্টা করে না পালানোর।
উপরের গল্পটি আমাদের জীবনের এক ভীষণ সত্যকে তুলে ধরে। “তোমাকে দিয়ে কিছু হবেনা”, “এই পেশায় যাওয়া এত সহজ না”, “এই কাজের কোনো ভবিষ্যৎ নেই”- এধরণের পারিপার্শ্বিক মন্তব্য আমাদের মনে এমনভাবে গেঁথে যায় যে, এর থেকে বেরোনোর চিন্তাশক্তিও হারিয়ে ফেলি আমরা! এভাবেই আমরা সৃষ্টিশীল কাজগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে শুধু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার উদ্দেশ্যে পড়ালেখায় ঝাঁপ দেই। এধরনের মানসিকতাই আমাদের নিজের পছন্দ অনুযায়ী পেশা নির্বাচনে বাঁধা দেয়। বোর্ড এক্সাম, এডমিশন টেস্টের পেছনে অন্ধভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে এক পর্যায়ে নিজের আগ্রহের জায়গাগুলো হারিয়ে ফেলি। যার কারণে যখন কাউকে প্রশ্ন করা হয় কী হতে চাও, এর উত্তর দিতে বেশ কাঠখড় পোহাতে হয়। এ কারণে ভবিষ্যৎ পেশা নির্বাচনের চিন্তাভাবনা স্কুলজীবন থেকেই শুরু করা উচিত বলে মনে করি। চলো জেনে নেই ভবিষ্যৎ পেশা নির্বাচনে কী কী বিষয় লক্ষ রাখা দরকার।
১। নিজেকে যাচাই করা
সঠিক পেশা নির্বাচনে প্রথম ধাপ হলো নিজেকে যাচাই করা। অর্থাৎ নিজের আগ্রহের জায়গাগুলো খুঁজে বের করা, স্বাভাবিক ক্ষমতা, ছোটবড় দক্ষতা, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি যাচাই করা। এরপর সেই অনুযায়ী পেশা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। জীবনে সফল হতে হলে এমন কাজ বেছে নেয়া উচিত যেই কাজ আগ্রহ কিংবা ভালোবাসা থেকে করা যায়! এতে সেই নির্দিষ্ট কাজকে কখনো ‘কাজ’ মনে হবে না, অযথা একঘেয়েমি জেঁকে বসবেনা।
আগ্রহের জায়গাটি খুঁজে বের করার সবচেয়ে সহজ একটি উপায় হলো, চোখ বন্ধ করে কল্পনা করো যদি তোমাকে কখনো কোনো কাজ করতে না হতো তবে তুমি কী করতে? এই প্রশ্নের উত্তর থেকেই তুমি নিজেই যাচাই করে নিতে পারবে আসলে কোণ কাজটি তোমার সবচেয়ে প্রিয়। সেই কাজটির সাথে কোন ক্যারিয়ারের অপশনটি মিলে যায়, তা ভেবে বের করে ফেলো!
২। কাজের ধরন এবং পরিবেশ নির্ধারণ
পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কাজের পরিবেশ নির্ধারণ করা। তোমাকে ভেবে দেখতে হবে তোমার সুবিধাজনক পজিশন কীরকম অর্থাৎ কোন পরিবেশে কাজ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করবে তুমি। যেমন, যারা ঘরে বসে নিরিবিলি কাজ করার পক্ষে তারা ফ্রিল্যান্সিং এর মত পেশা বেছে নিতে পারো। আবার যারা এক্সট্রোভার্ট, যারা মানুষের সাথে মিশতে কথা বলতে পছন্দ করো এবং যোগাযোগ দক্ষতা ভালো তারা মার্কেটিং এবং অন্যান্য কর্পোরেট জবের দিকে ঝুঁকতে পারো।
৩। লিস্ট করা
নিজেকে যাচাই করার জন্য বেশ কিছু ওয়েবসাইট কিংবা অ্যাপ আছে যেমন, PathSource, Skills matcher, Socanu, O*NET Interests Profiler, Keirsey Temperament Sorter ইত্যাদি। এখানে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে জেনে নেয়া যাবে নিজের ব্যক্তিত্ব, আগ্রহের জায়গাগুলোকে। তাছাড়া সেই অনুযায়ী যত পেশা আছে তার ধারণা পাওয়া যাবে। টেস্টগুলো করার পর আগ্রহের সাথে মিল রেখে বেশ কিছু ক্যারিয়ার অপশনের সাজেশন দেখতে পারবে। এমনকি সেই পেশায় যেতে হলে কোন কোন পথ অবলম্বন করতে হবে তাও জেনে নিতে পারবে। তবে যেকোনো একটা টেস্ট না নিয়ে বিভিন্ন ক্যারিয়ার টেস্ট অ্যাপ ব্যবহার করে কয়েকটি ফলাফল যাচাই করার মাধ্যমে একটি লিস্ট তৈরি করে নিতে পারো।
এবার একটু লিস্ট এ চোখ বুলিয়ে দেখো তো, পছন্দের কোনো পেশা খুঁজে পাও কিনা?
এমন কাজ যদি থাকে যেগুলো করতে অনীহা কাজ করছে তবে সেগুলো লিস্ট থেকে ছাঁটাই করে ফেলো। এরপর একটি শর্ট লিস্ট করে ফেলো যেখানে সর্বোচ্চ পাঁচটি পেশার নাম থাকবে।
৪। রিসার্চ করা
ঐ নির্দিষ্ট বিষয় বা পেশাগুলো সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে হবে অর্থাৎ রিসার্চ করতে হবে। এক্ষেত্রে দারুন একটি উপায় হলো ওই পেশায় কর্মরত মানুষের সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলা, যেটাকে বলা হয় ‘ইনফরমাল ইন্টারভিউ’ নেয়া। পাশাপাশি ঐ পেশার কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা পেতে সেখানে সরাসরি যেয়ে কথা বলতে পারো। তবে অবশ্যই ঐ ব্যক্তির এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে সময় হাতে নিয়ে যেতে হবে। এতে কাজের ধরন, পরিবেশ সবকিছু সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। এরপর সবকিছু যাচাই করে পছন্দের পেশাটিকে বেছে নিতে হবে যাকে লক্ষ্য হিসেবে রেখে পড়াশুনা, এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটি চালিয়ে যেতে হবে।
৫। শর্ট টার্ম ও লং টার্ম প্ল্যানিং
পেশা বেছে নেয়ার পর প্রয়োজন কিছু ছোট ও বড় গোল নির্ধারণ করা। গোলগুলোকে দুইটি ভাগে ভাগ করে নিতে হবে-লং টার্ম ও শর্ট টার্ম। মূল উদেশ্যে পৌছানোর জন্য যেসকল ধাপ পার করতে হবে, যেসকল দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন সেগুলোকে শর্ট টার্ম প্ল্যানিং এর আওতাভুক্ত করতে হবে। সাধারণত যেসকল কাজ ৫-৬মাসের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব সেগুলোকে শর্ট টার্মে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর পরের ধাপগুলো যেগুলো সম্পন্ন করতে ৩-৫বছর লাগতে পারে সেগুলোকে লং টার্ম প্ল্যানিং এ সাজিয়ে একটি খসড়া তৈরি করতে হবে যা লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য এক ধরনের রোডম্যাপ হিসেবে কাজ করবে। তাছাড়া মূল লক্ষ্যে পৌঁছানোর পুরো প্রক্রিয়াতে কি কি বাধা-বিপত্তি আসার সম্ভাবনা রয়েছে সেগুলোও খসড়া পরিকল্পনায় টুকে রাখতে পারো। এভাবে একটি ক্যারিয়ার একশন প্ল্যান তৈরি করে ফেলো এবং সেই রোডম্যাপ অনুসরণ করে এগিয়ে যাও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে।
দেখবে, লক্ষ্য স্থির করার পর দেখবে তুমি দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ করতে পারছো! আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে গেলেই যেকোনো কাজে সফল হওয়া সম্ভব।
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন