সেদিন কলেজের প্রথম ক্লাসটি ছিল বাংলা ক্লাস। প্রিয় বিদ্যুৎ স্যার চলে এসেছেন ক্লাসে। বন্ধুর মত আচরণ এবং ক্লাসকে মাতিয়ে রাখার মতো দুর্লভ শিক্ষকদের একজন তিনি। ভীষণ জ্ঞানীও বটে। অত্যন্ত গ্রিক ভঙ্গিতে, সারা ক্লাসরুমের এদিক থেকে ওদিক হাঁটতে হাঁটতে পড়ানো মানুষটি কোনও বই ছাড়াই তিনটি শব্দ লিখলেন বোর্ডে: কিংবদন্তি (Myth), ইতিহাস, এবং ঐতিহ্য। ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ কবিতাটি শুরু করার ঠিক আগে, চোখে তাঁর চিরন্তন রহস্যের চিহ্ন। কী যেন একটা ভেবে, একটি রোমাঞ্চের দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবার উদ্দেশ্যে বললেন, “কে আমাকে এই শব্দ তিনটির অর্থ বোঝাতে পারবে? আজকে ক্লাসটা কে নিতে পারবে আমি দেখতে চাই।”
ক্লাসের রসিক ছাত্র সামারুল উত্তর দিল, “স্যার, মিথ মানে মিথ্যা, ইতিহাস মানে পূর্বে ঘটিত কিছু ঘটনা আর ঐতিহ্য হল সংস্কৃতির একটা প্রতিশব্দ।”
উঁহু! হয়নি। বোঝা গেল স্যারের হাসি দেখে। একাধারে উত্তর আসতে লাগল। শোভন বলল, “কিংবদন্তি অর্থ লেজেন্ড, মানে যিনি তাঁর ক্যারিয়ারে অনেক নাম করেছেন এমন কেউ। ইতিহাস ঘটে যাওয়া, সাল-তারিখ সমেত লিপিবদ্ধ করা সত্য ঘটনা, আর ঐতিহ্য হল সংস্কৃতি।” না! এবারও না। এদিকে প্রান্তর দাঁড়িয়ে কী বলতে গেল তা-ই ভুলে গেছে। এভাবে এক এক করে কেউ পারল না। রীতিমতো হাঁপিয়ে গিয়ে হাল ছেড়ে দিল সবাই। খশখশ শব্দ করে চলে উঠল চক: কিংবদন্তি= জনশ্রুতি, ইতিহাস= প্রমাণস্বরূপ ঘটনা, ঐতিহ্য= যা আমরা পরম্পরা হিসেবে গ্রহণ করি।
আমি কয়েকদিন আগেও জানতাম (এবং আমার বিশ্বাস তোমাদের অনেকের ক্ষেত্রেও তাই) যে কিংবদন্তি বা মিথ দু’টি আলাদা শব্দ এবং মিথ অর্থ মিথ্যা ঘটনা, আর কিংবদন্তি দানবিক গুণের মানুষদেরকে বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। এখন দেখছি ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আজ এটা নিয়েই আলোচনা করব।
মিথ কী
সিসিফাসকে একটি বিরাট পাথরকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যেতে হবে পর্বতের চূড়ায়। জিউসের প্রদত্ত শাস্তি। ইসোপুসের কন্যা ইজিনাকে জিউস অপহরণ করেন। ঘটনাটি গুপ্ত হবার কথা, তবে সিসিফাস তার শহরের একমাত্র মানুষ যিনি নিজের চোখে এই ঘটনাটি হতে দেখেন। ইসোপুসকে বললেও সিসিফাস বিনিময়ে কিছু দরকার। শর্ত হল ঘটনাটি ইসোপুসকে তিনি বলবেন যদি ইসোপুস করিন্থের দুর্গে জল দেন। স্বর্গীয় বজ্রপাতকে সিসিফাস জলরূপে পছন্দ করে। শর্তানুরূপ জল দেওয়া মাত্রই সিসিফাস গ্রিক দেবতাদের প্রধান, জিউসের বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে উঠলেন। জিউস গ্রিক দেবতাদের মধ্যে সর্বশক্তিমান, তার কানে পড়তেই সিসিফাসের শাস্তি আরম্ভ হয়। ভারী পাথর পর্বতে ঠেলে ওঠানোর পাথেয় শাস্তি। সিসিফাস প্রত্যেকবারই পাথরটিকে পর্বতের চূড়ায় উঠাতে ব্যর্থ হয়। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন পাথরটি গড়িয়ে যাচ্ছে সেই সমতলে। ব্যর্থতার মাঝেও তিনি থামেন না। অবিরাম, সর্বক্ষণের জন্য নিজের পরাজয় না মেনে পাথর ও পর্বতের লড়াই তার জন্য একটি ধর্ম হয়ে গেছে।
উপরের ঘটনাটি একটি কিংবদন্তি, মিথ। এর কোনও দৃষ্টান্ত নেই। কোনও প্রমাণ নেই। এটি কারোর কারোর জন্য সত্য। কেউ কেউ এই ঘটনাটিকে বিশ্বাস করেন। অতএব এটি হয়ে উঠছে সেই মানুষের ব্যক্তিগত সত্য। কোনও নৈতিক শিক্ষা গল্পে উপনীত হবার একটি পদক্ষেপমাত্র। ফলে, কারোর কারোর জন্য এই গল্পটি ‘তার পৃথিবী’কে চেনার আদর্শিক পথ, যা ‘আদত পৃথিবী’ হতে অনেক বেশি আলাদা।
এই ‘আদত পৃথিবী’ ও ‘কারোর পৃথিবী’ এর পার্থক্য যদি তুমি বুঝে থাকো, তবে তুমি অবশ্যই কিংবদন্তি ও ইতিহাসের মধ্যকার পার্থক্য জানো। তবুও খুলে বলি।
জিউসের প্রদত্ত শাস্তিতে সিসিফাস
আগে ইতিহাসের সঙ্গে ‘আদত পৃথিবী’র সম্পর্কটি বুঝে নিই। ‘পৃথিবী’ শব্দটি শোনা মাত্রই একটি কৃষ্ণ পরিমন্ডলে গোলাকার নীল-সবুজ-আবছা আকাশী রঙের বস্তু ভেসে আসে আমাদের চোখের সামনে। এবং তা সবার ক্ষেত্রেই ভেসে ওঠে। কারণ পৃথিবী একটি অবজেকট হিসেবে প্রত্যেকের কাছেই এক। দেখতে এক। কাঠামোর দিক থেকেও এক। কিন্তু ‘কারোর পৃথিবী’ মাত্রই সে পৃথিবী ব্যক্তিগত; বিমূর্ত। এখানে হয়তো আমার পৃথিবীর সঙ্গে পিকাসোর পৃথিবীর মিল নেই। আমার পৃথিবীকে বোঝার জন্য যে আখ্যানের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যে গল্পের ঝুলিটির ভেতরে উঁকি মেরে দেখতে হয়, তা আমার পৃথিবী। পিকাসোর জন্য কিউবিস্ট শিল্প তাঁর ব্যক্তিগত সত্য, ব্যক্তিগত পৃথিবী। ফলে পিকাসোর সঙ্গে আমার ব্যক্তি সত্যের মিল থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। কাজেই মিথ ও ইতিহাসের সূক্ষ্ম পার্থক্য ও ঐতিহ্যের অর্থ দাঁড়াচ্ছে:
মিথ বা কিংবদন্তি: ব্যক্তিগত সত্য, তথ্যের প্রমাণ নেই (বিশেষ প্রয়োজনও নেই), সত্য-মিথ্যা বিবেচনার ঊর্ধ্বে, সাবজেকটিভ, ব্যক্তির একান্ত বিশ্বাসের স্থান।
ইতিহাস: প্রমাণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সবার জন্যই সত্য, অবজেকটিভ এবং বিশ্বাসের স্থান নেই।
ঐতিহ্য: কোনও ঐতিহাসিক বা মিথিকাল গল্প যা আমরা পরম্পরা হিসেবে গ্রহণ করি। যেমন: বৈশাখী মেলা।
কোর্সটি করে যা শিখবেন:
Personal Finance Course
মিথ বা কিংবদন্তি কীভাবে তৈরি হয়?
বোঝাতে গেলে আমার স্কুলজীবনের একটা ঘটনা না বললেই নয়। আমি তখন আমার স্কুলের ইংরেজি ক্লাবের সদ্য সম্পাদক হিসেবে কাজ করছি। করিডোরে হাঁটছি, হাতে প্রায় সত্তরটি কাগজের ঢের নিয়ে। আমাদের ক্লাবের মডারেটরকে প্রয়োজন ছিল। লেখাগুলো নিয়ে এই স্টেজে কী করব, সেটার নির্দেশনার দরকার ছিল। এরই মধ্যে হঠাৎ বাসা থেকে ফোন এল। জরুরি কাজ, বাসায় যেতে হবে। বন্ধু ইয়াফকে বুঝিয়ে বললাম, “স্যারকে একটু জিজ্ঞেস কর এই স্টেজে কী করতে হবে।” ইয়াফ অলস ছেলে; তবে কিছুই করার ছিল না।
আরো পড়ুন: মিশরীয় মিথ: পৃথিবী কিভাবে এলো
পরের দিন স্যার এসেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “বক্তৃতা কোন উপলক্ষ্যে দিতে হবে?” শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। বললাম, “বক্তৃতা! বক্তৃতা কীসের, স্যার?”
– কেন! তুমি না কাল রিফাতকে দিয়ে বলালে আমার নাকি স্টেজে কিছু বলার আছে?
– স্যার, আমি ইয়াফকে বলেছিলাম লেখাগুলোর ব্যাপারে।
– কিন্তু ইয়াফ তো আসেনি। রিফাত বলেছিল।
পরে ইয়াফকে ঘটনাটি বললে জানতে পারি ও আমার বার্তা দিয়েছে সন্দীপকে। সন্দীপ আবার ওই বার্তা দিয়েছে মৃন্ময়কে, মৃন্ময় দিয়েছে সাদাতকে এবং সাদাত ঐ বার্তা দিয়েছে রিফাতকে। ফলে আসল বার্তাটি তার আদত রূপ হারিয়ে গেল। এদের অলসতার কারণে ‘লেখাগুলোর এই স্টেজে কী করব’ হয়ে গেল, ‘লেখাগুলো স্টেজে বলতে হবে।’
গ্রিসের মিথিকাল চরিত্রগুলো
মিথ জিনিসটিও এমনই। interpretation এর উপরেই টিকে থাকে। কোনও নির্দিষ্ট দেশে, শহরে, গ্রামে যার যার নিজস্ব মিথ বা কিংবদন্তি থাকে। যার যার পূর্বসূরীদেরকে ঘিরে, তাদের ঘটনাগুলোকে বোঝার প্রয়াস থেকে যে এক প্রকার জনশ্রুতি তৈরি হয়, তাই মিথ। এখন তোমার মনে প্রশ্ন আসতে পারে এই ঘটনাটি কেন সত্য-মিথ্যা বিবেচনার ঊর্ধ্বে। আরেকটি গল্প বলি। দাদুর কাছে গল্প শুনেছিলাম।
একবার আফ্রিকার জঙ্গলে ঈগলের দল খাদ্য সংকটে পড়ল। তখন জঙ্গলের সিংহভাগ খাদ্য চলে যেত সিংহ, অর্থাৎ জঙ্গলের রাজার কাছে। ঈগল জানত সে সিংহকে পরাস্থ করতে পারবে। ফলে ঈগল সিংহের সাথে লড়াই করবে, এমনটা জানিয়ে দিল সিংহকে। সারা জঙ্গলে হুড়হুড় করে ছড়িয়ে পড়ল লড়াইয়ের দস্তান। সিংহ ও ঈগলের অশেষ প্রস্তুতির পর লড়াই শুরু হল। দেখতে দেখতেই ঈগল সিংহকে হারিয়ে দিয়ে হয়ে গেল জঙ্গলের নতুন রাজা, সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণী।
আচ্ছা, ঈগল কীভাবে সিংহকে হারাতে পারে? অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কিন্তু এর মধ্যেও বিশ্বাসযোগ্যতা আছে। অত্যন্ত বিখ্যাত এই লোককাহিনী একটি মিথ এবং মিথোলজিস্টরা এর একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছেন।
মিথোলজি বোঝার কিছু মেথড ব্যবহার করে তাঁরা এমনটা বলেন, যে আগেরকার দিনে জঙ্গলের মানবগোষ্ঠী তাদের বংশের পরিচয় জাহির করত পশুপাখিদের নাম দিয়ে। ফলে গল্পটি বিশ্লেষণ করলে দাঁড়াচ্ছে: এই ঈগল বা সিংহ সত্যিকার অর্থে পাখি বা পশু নয়; বরং ঈগল বংশের লোকরা সিংহ বংশের লোকদের পরাস্ত করে ঐ জঙ্গলের বেশিরভাগ সম্পদের উপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে নেয়। যে গল্পটি মিথোলজিস্টদের মতে, সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে হতে আমার দাদুর শোনানো গল্পের রূপ নিয়েছে। ঠিক আমার স্কুলজীবনের ঘটনাটির মতো।
এভাবেই আরো অনেক গল্প, যেমন গ্রিক মিথোলজির সকল দেবতা বা দেবীদের অবজেকটিভ অস্তিত্বকে অস্বীকার না করে অনেকে বলেন এই জিউস, জেসন, অ্যাফ্রোদিতি, আরেস প্রত্যেকেই তৎকালীন গ্রিক সমাজের প্রভাবশালী মানুষ ছিলেন যাদের প্রতি গ্রিক মানুষকের অগাধ ভক্তি ছিল। তাদের গুণাগুণ বোঝাতে অনেক রূপক, উপমা, অর্থ মানুষের কাছে দিনদিন আক্ষরিক হয়ে ওঠে। গুণাগুণ রূপ নেয় দৈব শক্তিতে। দিনের পর দিন নানা মানুষের interpretation হয়ে ওঠে একটি সুসজ্জিত মহাগল্প।এজন্য মিথ বা কিংবদন্তির এই ব্যাখ্যাগুলো কেবলই কিছু অনুমানমাত্র। এগুলো শতভাগ সত্য, বা শতভাগ মিথ্যা, এমনটি কেউই দাবি করতে পারবে না। করা সম্ভবও না। এগুলো একটি জাতি, গ্রাম, শহরের সত্য। তাদের ব্যক্তিগত সত্য। যেহেতু এটি সাবজেকটিভ সত্য, সেহেতু এর অবজেকটিভ সত্যতা বা প্রমাণ নিয়ে আধিক্যের কোনও প্রয়োজন নেই। এজন্য মিথোলজি এই লোককথা, গল্পকে জানা ও বোঝার চেষ্টা করে। প্রমাণ করার প্রচেষ্টা চালায় না। নানারকমের interpretation-ই এখানে মুখ্য ব্যাপার।
ইতিহাস
নভেম্বর, ১৯৬৮। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের স্বৈরাচারিতা ও ছাত্র অসন্তোষকে কেন্দ্র করে বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে নগরকেন্দ্রিক আন্দোলন। শুরু আন্দোলন হলে ধীরে ধীরে এই আন্দোলন রূপ নেয় সংগ্রামের। একেক করে যোগ হতে থাকে দেশের প্রত্যেকটি রণক্লান্ত-প্রবণ মানুষ। সংগ্রামে শ্রমিক থেকে শুরু করে কৃষক, এমনকি রাজনীতি নিয়ে ওয়াকিবহাল না-থাকা মানুষও। দাবি- আইয়ুব খান সরকারের পতন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের উপর সবদিক থেকে নিপীড়ন, অবজ্ঞা, বঞ্চনার প্রতিবাদে অবশেষে ১৯৬৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি যখন এই সংগ্রাম এক নতুন মাত্রা যোগ করে, তখন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বলেন তিনি আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না।
উক্ত ঘটনাটি বা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান আমার ব্যক্তিগত সত্য নয়। বাংলাদেশের গৌরবের স্থান হলেও দিনশেষে এটি বাংলাদেশের একান্ত ব্যক্তিগত সত্যও নয়। এর নিদর্শন আছ। প্রমাণ আছে। এটি সর্বজনস্বীকৃত। ফলে উপরে যে ঘটনাটি আমাদের দেশে ঘটে গেছে, তা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।
এখন আশা করা যাচ্ছে ইতিহাস ও কিংবদন্তি নিয়ে কেউ এলোমেলো করে ফেলবে না। ইতিহাসের গুরুত্বের জায়গা আমরা প্রত্যেকেই কমবেশি জানি। জাতিসত্তার, চেতনার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানকে অস্বীকার করা যায় না।
মিথ কেন?
পৃথিবীর জানা-শোনা প্রায় পুরোটুকু অর্জন করে আলেকজান্ডার দি গ্রেট কৌতূহল নিয়ে চলে আসেন ভারতবর্ষে আসেন। একদিন ভারতের একটি ঘন জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে গেলেন তিনি। পথ খুঁজছেন। এমনই সময় লক্ষ করলেন একজন অর্ধনগ্ন ভারতীয় সাধু গভীর ধ্যানে বসে আছেন। চোখ সূর্যের তাপ অনুভব করছেন। দ্য গ্রেট তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এই ঘন জঙ্গলে কী করছো?’ সাধু ধীরে, শান্তভাবে আলেকজান্ডারকে বলেন, ‘আমি শূন্যতাকে অনুভব করছি। তুমি ঘন জঙ্গলে হাতে একটি তলোয়ার নিয়ে কী করছো?’ আলেকজান্ডার বললেন, ‘আমি পৃথিবী জয় করতে এসেছি।’ দু’জন যেন একে-অপরের কথা শুনে হেসে কূল পাচ্ছেন না। আলেকজান্ডার ভাবলেন, ‘কিছু না করে শূন্যতা অনুভব করার কি কোনও মানে আছে!’ আবার ওদিকে সাধুটি ভাবলো, ‘পৃথিবী জয় করে এই ক্ষণস্থায়ী মানুষ কী করবে? এর কি মানে হয়?’
মজার বিষয় হচ্ছে আলেকজান্ডার যে ব্যক্তিগত সত্যের মধ্যে দিয়ে নিজেকে পরিচালিত করেন, যে মিথ তাঁকে জীবনে একটি অনুপ্রেরণা দেয়, তা সম্পর্কে সাধুটি ওয়াকিবহাল না। আবার সাধুর বৈদিক দর্শনের সাথে, তাঁর ব্যক্তিগত সত্যের সাথে আলেকজান্ডারের সম্পর্ক নেই। তিনি অ্যারিস্টটল, তাঁর শিক্ষকের কাছ থেকে যা শেখেন তা ঐ সাধুর ব্যক্তিগত সত্য থেকে পুরো আলাদা। অ্যারিস্টটল আলেকজান্ডারকে শিক্ষা দেন হোমারের ইলিয়ড সম্পর্কে- যেখানে আকিলিস নামক এক কাল্পনিক যোদ্ধার আদর্শ বিরাট প্রভাব ফেলে আলেকজান্ডারের মনে। অর্থাৎ এই হোমারের গল্পে আকিলিসের আদর্শ হয়ে ওঠে আলেকজান্ডারের জীবনকথা। আবার বেদের গভীর জ্ঞান, দর্শন সাধু মানুষটিকে হতে শেখায় বিশ্বসাক্ষী হতে।
আরো পড়ুন: সত্য মিথ্যার চন্দ্রাভিযান: কন্সপিরেসি থিওরি পর্ব-৭
এভাবেই অনেকসময় কিংবদন্তি একটি নির্দিষ্ট জনপদের জন্য সত্য হলেও এর দীক্ষার ও শিক্ষার জায়গা সার্বজনীন। অনেকেই গ্রিসের বাসিন্দা নন। তবুও আলেকজান্ডারের জয়ের গল্প অনেকের জন্য প্রেরণার উৎস। তুমি আফ্রিকায় থাকো না, তবুও তুমি আফ্রিকার মিথোলজি পড়ছো। আবার চৈনিক কিংবদন্তিও তোমার কাছে সমান তালে মজার। কেন? কারণ মানুষ তার সংস্কৃতিকে, তার ব্যক্তিগত জগৎ কীভাবে জ্ঞান করে, তা জানার মধ্যে একটি রোমাঞ্চের গন্ধ আছে।
সাহিত্যেও মিথ বা কিংবদন্তির এক স্বতন্ত্র মূল্য আছে। একটি ধরাছোঁয়ার-বাইরে থাকা সময়ের সাক্ষী বহনের প্রচেষ্টা মিথের ভেতরে পাওয়া যায়। যে উপমা, রূপকের মধ্য দিয়ে একজন লেখক একটি গল্প বলেন, সেই সত্যের মধ্যেই তার বসবাস।
আমেরিকান হেরিটেজ ডিকশনারির মতে কিংবদন্তি ‘A story presented as historical, dealing with traditions specific to a culture or a group of people.
অর্থাৎ মিথ একটি সংস্কৃতির জন্য মুখ্য একটি বিষয়। ইতিহাস কেবল কিছু দৃষ্টান্তের তৈরি। ইতিহাস পড়ে আমরা পৃথিবীর উপরের স্তরের কথা জানতে তো পারব। কিন্তু মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ফ্যান্টাসি, তাঁদের ভীতি, আকাঙ্ক্ষা, মনের গভীরতম কথাগুলো জানব কী করে? সেখানেই মিথের কাজ। ইতিহাসে আবেগের স্থান বড় সামান্যই। ফলে গল্পগুলোকে সাদরে গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। অতএব, তোমার কখনও যদি অন্য কোনও দেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়, তবে বুঝতে শিখবে তার দেশের কিংবদন্তিগুলোকে। যেখানে সেই গল্পগুলোও মানুষের কাছে পবিত্র। বুঝতে শিখবে তার ঐতিহ্যকে, অর্থাৎ এই কিংবদন্তির কোন কোন বিষয়বস্তু তারা গ্রহণ করেছে পরম্পরা হিসেবে।
যখন তা কোনও আদর্শিক ফ্রেমের বাইরে থেকে বুঝতে শিখবে, তখন যা হবে তা নিতান্তই অমায়িক! ঠিক-বেঠিকের তর্কে জড়ালে পরবর্তী প্রজন্মকে গল্প শোনাবে কে? সত্যি বলতে, সত্যমিথ্যার এই পাশাখেলার মধ্যেই আড়াল করা ব্রহ্মান্ডের চরমসত্যগুলো। নিজেই ভাবো! কে দেখে সত্যের সবটা? সমুদ্রের দেবতা বরুণের শ’খানেক চোখ, ইন্দ্রের সহস্রাধিক। আমাদের কয়টি?
আমাদের কোর্সগুলোতে ভর্তি হতে ক্লিক করুন:
- Communication Masterclass by Tahsan Khan
- Facebook Marketing Course by Ayman Sadik and Sadman Sadik
- ঘরে বসে Freelancing by Joyeta Banerjee
- ঘরে বসে Spoken English Course by Munzereen Shahid
- Microsoft Office 3 in 1 Bundle
- Microsoft Word Course by Sadman Sadik
- Microsoft Excel Premium Course
- Microsoft PowerPoint Course by Sadman Sadik
১০ মিনিট স্কুলের ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে ভিজিট করুন: www.10minuteschool.com
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন