আমরা যারা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী, তারা অবশ্যই “পর্যায় সারণি” নামের একটি টেবিল বা চার্টের কথা জানি। রসায়ন পড়ার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মৌলগুলোকে একটি নির্দিষ্ট ক্রমানুসারে সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই পর্যায় সারণি বা Periodic Table। মৌলগুলোর ব্যাপারে যাতে আমরা সহজেই জানতে ও শিখতে পারি সেজন্য এই পর্যায় সারণি ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে পর্যায় সারণিতে মোট ১১৮টি মৌলের নাম লেখা রয়েছে। তবে একদম শুরুতে কিন্তু এমনটি ছিলো না। সময়ের সাথে সাথে মানুষ বিভিন্ন নতুন মৌলের সাথে পরিচিত হয় এবং সেগুলোর নাম পর্যায় সারণিতে স্থান পেতে থাকে। পর্যায় সারণি তৈরির ইতিহাস, এর পরিচিতি, ব্যবহার, বৈশিষ্ট্য এবং পর্যায় সারণি মনে রাখার কৌশল নিয়েই আজ আমরা আলোচনা করবো।
বর্তমান পর্যায় সারণি
Source: Business Wire
পর্যায় সারণি -এর ইতিহাস
শুরুতেই আসা যাক পর্যায় সারণির ইতিহাস নিয়ে। আগের যুগে রসায়নবিদরা অল্প কয়টি মৌল নিয়ে তাদের গবেষণা চালাতো। তখনকার সময়ে এতো মৌল আবিষ্কারও হয় নি। অল্প কয়টি মৌল থাকায় বিজ্ঞানীদের কাজ করতেও তেমন সমস্যা হতো না। পর্যায় সারণি বা Periodic Table তৈরির চিন্তা-ভাবনার সূচনা করে দেয়ার প্রথম কৃতিত্ব দিতে হয় ফরাসি রসায়নবিদ ল্যাভয়সিয়েকে। ১৭৮৯ সালে তিনিই প্রথম ধাতব ধর্মের ভিত্তিতে কিছু মৌলকে পৃথক করেন। সে সময় অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন, ফসফরাস, মার্কারি, জিংক এবং সালফার ইত্যাদি মৌলিক পদার্থ নিয়ে বিজ্ঞানীরা কাজ চালাতো। ল্যাভয়সিয়ে ধাতু এবং অধাতু এই দুই ভাগে ৮টি মৌলকে পৃথক করেন। তার সময় থেকেই মৌলগুলোকে ধর্মের ভিত্তিতে পৃথক করার চিন্তা শুরু হয়।
ল্যাভয়সিয়ের এই মৌল পৃথক করার ধারণা দেয়ার ৪০ বছর পর ১৮২৯ সালে জার্মান বিজ্ঞানী ইয়োহার ওলফগান ডোবেরাইনার নতুন একটি ধারণা দেন। একই রকমের ধর্ম প্রদর্শন করে এমন তিনটি করে মৌলিক পদার্থকে তিনি একত্রিত করেন। এমন মৌলগুলো হলো
- ক্লোরিন, ব্রোমিন ও আয়োডিন
- ক্যালসিয়াম, স্ট্রনটিয়াম ও বেরিয়াম
- সালফার, সেলেনিয়াম ও টেলুরিয়াম
- লিথিয়াম, সোডিয়াম ও পটাসিয়াম
কোর্সটিতে শিক্ষার্থীরা পাবে:
HSC 2024 ক্র্যাশ কোর্স - প্রথম পত্র [বিজ্ঞান বিভাগ]
মৌলগুলোকে তাদের পারমাণবিক ভর অনুসারে সাজালে দেখা যায় দ্বিতীয় মৌলের পারমাণবিক ভর প্রথম ও তৃতীয় মৌলের পারমাণবিক ভরের যোগফলের অর্ধেক বা তার কাছাকাছি। তিনি এর নাম দিলের ডোবেরাইনারের ত্রয়ীসূত্র। ক্লোরিন, ব্রোমিন ও আয়োডিন হলো ডোবেরাইনারের প্রথম ত্রয়ী মৌল।
ত্রয়ীসূত্র আবিষ্কারের প্রায় সাড়ে তিন দশক পর ১৮৬৪ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন নিউল্যান্ড নতুন একটি ধারণা দেন পারমাণবিক মৌলের ব্যাপারে। তিনি বলেন, মৌলগুলোকে যদি তাদের পারমাণবিক ভরের ভিত্তিতে ছোট থেকে বড় ক্রমানুসারে সাজানো হয়, তাহলে যেকোনো একটি মৌলের ধর্ম তার পরবর্তী অষ্টম মৌলের সাথে মিলে যায়। অর্থাৎ আটটি মৌল পর পর যেকোনো দুটি মৌলের পারমাণবিক ধর্ম হুবহু মিলে যায়। এই ধারণার নাম হলো নিউল্যান্ডের অষ্টক সূত্র। এখানে উল্লেখ্য যে, গবেষণা করার সময় নিউল্যান্ড ৬২টি মৌল নিয়ে কাজ করেছিলো।
প্রায় একই সময়ে জার্মান বিজ্ঞানী জুলিয়াস লুথার মেয়ার, নিউল্যান্ডের মতোই একটি ধারণা দেন। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, যদি মৌলগুলোকে তাদের পারমাণবিক ভরের ভিত্তিতে সাজানো হয়, তাহলে নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর মৌলগুলোর ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মের মাঝে সাদৃশ্য দেখা যায়। তবে মেয়ার যখন কাজ করেছিলেন, তখন তার কাছে মাত্র ২৮টি মৌলের হিসাব ছিলো।
পরবর্তীতে ১৮৬৯ সালে রাশিয়ান বিজ্ঞানী ডিমিত্রি মেন্ডেলিফ মৌলের ধর্ম পর্যালোচনা করে নতুন একটি পর্যায় সূত্র প্রদান করেন। সূত্রটি হলো “মৌলসমূহের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মাবলি তাদের পারমাণবিক ভর বৃদ্ধির সাথে পর্যায়ক্রমে আবর্তিত হয়।”
এই সূত্র ধরে মেন্ডেলিফ তখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ৬৩টি মৌল নিয়ে একটি ছক তৈরি করেন যেখানে ১২টি আনুভূমিক সারি আর ৮টি খাড়া কলাম ছিলো। পারমাণবিক ভরের বৃদ্ধি অনুসারে সাজিয়ে দেখানো হয় যে, একই কলাম বরাবর সকল মৌলগুলোর ধর্ম একই রকমের এবং একটি সারির প্রথম মৌল থেকে শেষ মৌল পর্যন্ত মৌলগুলোর ধর্মের ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন ঘটে। এই ছকের নামই পরবর্তীতে দেয়া হয় “পর্যায় সারণি”।
HSC 23 শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি কোর্স (বিজ্ঞান বিভাগ)
কোর্সটিতে শিক্ষার্থীরা পাবে:
মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণিতে মজার একটি ব্যাপার হলো, তিনি কিছু জায়গায় ফাঁকা ঘর রেখে দিয়েছিলেন। এই ঘরগুলোর জন্য তিনি কিছু ভবিষ্যৎবাণী করে রেখেছিলেন। মেন্ডেলিফ তার পর্যায় সারণিতে ৩টি ফাঁকা জায়গায় যেসব মৌল আসবে বলে ধারণা করেছিলেন সেগুলো হলো, ইকা-সিলিকন (জার্মেনিয়াম), ইকা-অ্যালুমিনিয়াম (গ্যালিয়াম) এবং ইকা-বোরন (স্ক্যান্ডিয়াম)। “ইকা” এর অর্থ হলো “মতো”। অর্থাৎ তিনি বলে গিয়েছিলেন সিলিকন, অ্যালুমিনিয়াম এবং বোরনের মতো কিছু মৌল পরবর্তীতে আবিষ্কৃত হবে। এগুলোর বর্তমান নাম ব্র্যাকেটেই উল্লেখ করা হয়েছে।
মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণির সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো, মৌলগুলোকে একটু সুবিন্যস্ত উপায়ে সাজানো সম্ভব হয়েছিলো। তবে ওনার এই সারণিতে থাকা সমস্যাগুলোর একটি হলো কিছু মৌল তাদের ভর অনুসারে বসানোর পরেও তার আশেপাশের বাকি মৌলগুলোর মতো ধর্ম প্রদর্শন করছে না। যেমন আর্গন এবং পটাসিয়ামকে তাদের পারমাণবিক ভর অনুসারে সাজালে তারা নিজ নিজ ধর্ম প্রদর্শনকারী গ্রুপে অবস্থান করে না। তাই সেখানে মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণির একটি সীমাবদ্ধতা দেখা যায়।
মেন্ডেলিফের সময়ে পর্যায় সারণি; Image Source: The Royal Society of Chemistry
পরবর্তীতে ১৯১৩ সালে যখন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হেনরি মোসলে পারমাণবিক ভরের বদলে পারমাণবিক সংখ্যা ব্যবহার করে মৌলগুলোকে পর্যায় সারণিতে সাজানোর প্রস্তাব দেন তখন এই সমস্যাগুলোর সমাধান হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক রসায়ন ও ফলিত রসায়ন সংস্থা (International Union of Pure and Applied Chemistry বা IUPAC) আন্তর্জাতিকভাবে রসায়ন ও ফলিত রসায়নের বিভিন্ন নিয়মকানুন, ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনের কোনটি গ্রহণ করা যায় এবং কোনটি বর্জন করা উচিত এই বিষয়গুলো দেখা শোনা এবং নিয়ন্ত্রণ করে।
আরো পড়ুন: এসএসসি-তে রসায়ন জয় করতে যা প্রয়োজন
পর্যায় সারণি -এর কিছু বৈশিষ্ট্য
বর্তমানে পর্যায় সারণিতে মোট ১১৮টি মৌলের নাম লেখা আছে। পরবর্তী লেখা পড়ার আগে সামনে একটি পর্যায় সারণির মডেল বের করে নিলে ভালো হয়। পর্যায় সারণির দিকে তাকালেই আমরা কিছু বৈশিষ্ট্য খেয়াল করতে পারবো। যেমন:
- পর্যায় সারণিতে বাম থেকে ডান পর্যন্ত ৭টি পর্যায় বা আনুভূমিক সারি এবং উপর থেকে নিচে ১৮টি গ্রুপ বা খারা স্তম্ভ আছে।
- প্রতিটি পর্যায় বাম দিকে গ্রুপ ১ থেকে শুরু করে ডানদিকে গ্রুপ ১৮ পর্যন্ত বিস্তৃত।
- মূল পর্যায় সারণির নিচে আলাদাভাবে ল্যান্থানাইড ও অ্যাক্টিনাইড সারির মৌল হিসেবে দেখানো হলেও এগুলো যথাক্রমে ৬ এবং ৭ পর্যায়ের অংশ।
পর্যায় |
মৌলের সংখ্যা |
পর্যায় ১ |
২টি মৌল |
পর্যায় ২ এবং ৩ |
৮টি মৌল |
পর্যায় ৪ এবং ৫ |
১৮টি মৌল |
পর্যায় ৬ এবং ৭ |
৩২টি মৌল |
গ্রুপ |
মৌলের সংখ্যা |
গ্রুপ ১ |
৭টি মৌল |
গ্রুপ ২ |
৬টি মৌল |
গ্রুপ ৩ |
৩২টি মৌল |
গ্রুপ ৪ থেকে ১২ পর্যন্ত |
প্রতি গ্রুপে ৪টি করে মৌল |
গ্রুপ ১৩ থেকে ১৭ পর্যন্ত |
প্রতি গ্রুপে ৬টি করে মৌল |
গ্রুপ ১৮ |
৭টি মৌল |
মেডিকেল এডমিশন কোর্স ২০২২
কোর্সটিতে যা যা থাকছে
পর্যায় সারণি মনে রাখার কৌশল: মৌলের নাম মনে রাখার ছন্দ
এগুলো ছিলো পর্যায় সারণির সাধারণ পরিচয়। এবার আসি মৌলগুলোর ব্যাপারে। এতোগুলো মৌলের নাম সহজে মনে রাখা কিন্তু সম্ভব না। কিন্তু পরীক্ষার জন্য হোক বা অন্য যেকোনো কাজে, পর্যায় সারণি -এর মৌলগুলোর নাম ও পর্যায় সারণিতে এদের স্থান মনে রাখা জরুরি। তবে কিছু পর্যায় সারণি মনে রাখার কৌশল আছে যার মাধ্যমে আমরা সহজেই মৌলগুলোর নাম মনে রাখতে পারি। এর মাঝে একটি উপায় হলো ছন্দের মাধ্যমে মৌলগুলোর নাম মনে রাখা। কবিতা কিংবা গানের ছন্দ মনে রাখা আমাদের জন্য খুবই সহজ কাজগুলোর একটি। হালকা চর্চা করলেই এগুলো সহজে আমাদের মনে পড়ে। তাই কিছু ছন্দের মাধ্যমে আমরা পর্যায় সারণির মৌলগুলোর নাম মনে রাখার চেষ্টা করবো।
গ্রুপ ১ – হায় – H – হাইড্রোজেন
লি – Li – লিথিয়াম
না – Na – সোডিয়াম
কে – K – পটাশিয়াম
রুবি – Rb – রুবিডিয়াম
ছেঁচে – Cs – সিজিয়াম
ফেলেছে – Fr – ফ্রানসিয়াম
গ্রুপ ২ – বিরিয়ানি – Be – বেরিলিয়াম
মোগলাই – Mg – ম্যাগনেসিয়াম
কাবাব – Ca – ক্যালসিয়াম
সরিয়ে – Sr – স্ট্রোনসিয়াম
বাটিতে – Ba – বেরিয়াম
রাখো – Ra – রেডিয়াম
গ্রুপ ১৩ – বো – B – বোরন
য়াল – Al – অ্যালুমিনিয়াম
গেলো – Ga – গ্যালিয়াম
ইন্ডিয়া – In – ইনডিয়াম
তেও যাই – Ti – থ্যালিয়াম
গ্রুপ ১৪ – কাল – C – কার্বন
সিলেট – Si – সিলিকন
গেলে – Ge – জারমেনিয়াম
স্বর্ন – Sn – টিন
পাবো – Pb – লেড
গ্রুপ ১৫ – নানা – N – নাইট্রোজেন
পাটেকার – P – ফসফরাস
আসলো – As – আর্সেনিক
সব – Sb – অ্যান্টিমনি
বিলিয়ে – Bi – বিসমাথ
গ্রুপ ১৬ – ও – O – অক্সিজেন
এস – S – সালফার
এস সি – Se – সেলেনিয়াম
তে – Te – টেলুরিয়াম
পড়ে – Po – পোলোনিয়াম
গ্রুপ ১৭ – ফকিরা – F – ফ্লোরিন
কালু – Cl – ক্লোরিন
বরিসাল থেকে – Br – ব্রোমিন
ইস্টিমারে – I – আয়োডিন
আসতেসে – At – অ্যাস্টাটিন
গ্রুপ ১৮ – হিলি – He – হিলিয়াম
নিয়ন্তা – Ne – নিয়ন
আর – Ar – আর্গন
কিশোর – Kr – ক্রিপ্টন
যাবে – Xe – জেনন
রংপুর – Rn – রেডন
পর্যায় ৩ – না – Na – সোডিয়াম
মাযে – Mg – ম্যাগনেসিয়াম
এসে – Al – অ্যালুমিনিয়াম
সিজদায় – Si – সিলিকন
পড়ে – P – ফসফরাস
সবাই – S – সালফার
কালেমা – Cl – ক্লোরিন
আওড়ায় – Ar – আর্গন
এভাবেই পর্যায় সারণি মনে রাখার কৌশল ব্যবহার করে বিভিন্ন ছন্দের সাথে পড়লে আমরা সহজেই মৌলগুলোর নাম ও কোন পর্যায়ের কোন গ্রুপে আছে তা বলে ফেলতে পারবো।
তথ্যসূত্রঃ
১. রসায়ন (নবম – দশম শ্রেণি), এনসিটিবি
আমাদের কোর্সগুলোতে ভর্তি হতে ক্লিক করুন:
- HSC Bangla Course
- English Grammar Crash Course
- HSC 2022 ফাইনাল মডেল টেস্ট [বিজ্ঞান বিভাগ]
- HSC 2022 শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি কোর্স [বিজ্ঞান বিভাগ]
- HSC 2023 শর্ট সিলেবাস ক্র্যাশ কোর্স [বিজ্ঞান বিভাগ]
- SSC 2022 শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি কোর্স [বিজ্ঞান বিভাগ]
- SSC – শর্ট সিলেবাস টেস্ট পেপার সল্ভ কোর্স (Bangla, English, General Math, ICT)
- SSC – শর্ট সিলেবাস টেস্ট পেপার সল্ভ কোর্স (Physics, Chemistry, Biology, Higher Math)
- SSC – শর্ট সিলেবাস টেস্ট পেপার সল্ভ কোর্স (Accounting, Finance, Economics)
- Microsoft Office 3 in 1 Bundle
- Microsoft Excel Premium Course
- Microsoft Word Course by Sadman Sadik
- Microsoft PowerPoint Course by Sadman Sadik
- ঘরে বসে Spoken English Course by Munzereen Shahid
আপনার কমেন্ট লিখুন