সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণ অংশে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের ব-দ্বীপ এলাকায় অবস্থিত পৃথিবীর বৃহত্তম জোয়ারধৌত গরান বনভূমি (mangrove forest)। স্থানীয়ভাবে অনেকের কাছে এটি পরিচিত শুলোবন হিসেবে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জীববৈচিত্র্যে ভরপুর ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ হওয়ায় ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো এই বনটিকে “ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইট” হিসেবে ঘোষণা দেয়। প্রাকৃতিক রহস্যেঘেরা ভয়ংকর সুন্দর এই বনটিকে নিয়েই আজকের এই লেখা।
সুন্দরবনের নামকরণ:
সুন্দরবন শব্দটির আক্ষরিক অর্থ সুন্দর জঙ্গল বা সুন্দর বনভূমি। কিন্তু অনেকের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে সবুজে মোড়া এই বনটির নাম সুন্দরবন হলো কীভাবে?
সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয় সুন্দরী গাছ নামক এক প্রজাতির গাছের প্রাচুর্যতার কারণে এর নামকরণ করা হয়েছে সুন্দরবন। আবার অনেকের ধারণা হয়তো এর নামকরণ হয়েছে “সমুদ্র বন” বা “চন্দ্র-বান্ধে(বাঁধে)” নামক প্রাচীন আদিবাসী থেকে। এছাড়াও এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেও এর নামকরণ এমন হতে পারে বলে মনে করেন অনেকে।
সুন্দরবনের আয়তন ও অবস্থান:
মোট ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশে এবং বাকি অংশ রয়েছে ভারতে। ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা ও মেঘনা নদীত্রয়ের অববাহিকার ব-দ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলায় এবং ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগণা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জুড়ে বিস্তৃত।
সুন্দরবনকে জালের মত জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপমালা। মোট বনভূমির ৩১.১ শতাংশ অর্থাৎ ১,৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদী-নালা, খাঁড়ি, বিল মিলিয়ে জলাকীর্ণ অঞ্চল।
উদ্ভিদ ও প্রাণী:
সুন্দরবনের নাম শুনলেই সবার প্রথমে যেই জিনিসটা মাথায় আসে সেটা হচ্ছে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সুন্দরবনে গিয়ে সবাই বাঘের দেখা পেতে চায়। কিন্তু বাঘ দেখার সৌভাগ্য হয় খুব কম মানুষেরই।
২০১৫ সালের জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনে মোট ১৮০টি বাঘ রয়েছে যার মধ্যে বাংলাদেশের সীমানায় আছে ১০৬টি আর ভারতে আছে ৭৪টি। তবে বন বিভাগের তথ্যমতে ২০১৫ সালের পরে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে আরো একটি জরিপ চালানো হয়, সেই জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে এখন বাঘের সংখ্যা ১১৪টি। এই বাঘ ছাড়াও সুন্দরবনে রয়েছে বানর, হরিণ, বনমোরগ, কুমির, ডলফিন, অজগর আর বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী।
সুন্দরবনের প্রধান বনজ বৈচিত্র্যের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে সুন্দরী, গেওয়া, গরান এবং কেওড়া গাছ। এছাড়াও প্রায় তিন শতাধিক প্রজাতির গাছ রয়েছে সুন্দরবনে। রয়েছে আড়াই শতাধিক প্রজাতির পাখি, দুই শতাধিক প্রজাতির মাছ, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪২ প্রজাতির বন্যপ্রাণীসহ ৩২ প্রজাতির চিংড়ি।
সুন্দরবন ভ্রমণ:
এবার আসি সুন্দরবন ভ্রমণ সম্পর্কে। সুন্দরবনে যেতে চাইলে আপনি কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন, কোন কোন স্পটে যেতে পারবেন সে সম্পর্কে কিছু তথ্য চলুন জেনে নেই।
ভ্রমণের সময়:
বছরের যেকোনো সময়ই আপনি চাইলে যেতে পারবেন সুন্দরবনে। তবে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সুন্দরবন ভ্রমণের উত্তম সময়। এ সময়ই সবচেয়ে বেশি পর্যটক ঘুরতে আসেন ভয়ংকর সুন্দর এই বনে।
যে যে জায়গায় যেতে পারবেন:
সুন্দরবনে রয়েছে বেশ কিছু মনোমুগ্ধকর জায়গা। এর মধ্যে রয়েছে কটকা সি বিচ, হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চর, টাইগার পয়েন্ট, জামতলা সি বিচ, কচিখালী, ডিমের চর, করমজল, হাড়বাড়িয়া ইত্যাদি।
আপনি যদি তিন চার দিন সময় নিয়ে যেতে পারেন তাহলে কটকা, টাইগার পয়েন্ট, হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চর, কচিখালী এই সবগুলো স্পটেই যেতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে আপনি বড় কোনো গ্রুপের সাথে বা ট্যুর এজেন্সির মাধ্যমে যেতে হবে সেক্ষেত্রে খরচও অনেক কম পড়বে। তখন আপনি মোটামুটি পাঁচ ছয় হাজার টাকায়ই ঘুরে আসতে পারবেন।
আর যদি হাতে সময় কম থাকে তাহলে একদিনের মধ্যে ঘুরে আসতে পারেন করমজল আর হাড়বাড়িয়া থেকে। এক্ষেত্রে বেশি মানুষ না হলেও হয়। কয়েকজন মিলেই খুব কম খরচে ঘুরে আসতে পারবেন এই দুইটি স্পট।
আরো পড়ুন: এশিয়া মহাদেশ: জেনে নিন বিস্তারিত
যেভাবে যাবেন:
আপনি চাইলে বিভিন্ন ট্যুর এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করে তাদের কারো মাধ্যমে যেতে পারবেন সুন্দরবনে। সেক্ষেত্রে তারাই আপনার সবকিছুর দায়িত্ব নেবে। এছাড়া নিজেরাও আলাদা আলাদা সবকিছু ঠিক করে যেতে পারেন। ট্যুর এজেন্সির নাম্বার ফেসবুকের বিভিন্ন ট্যুর গ্রুপ আর পেজেই পেয়ে যাবেন। যদি তিন চারদিনের জন্য এবং অনেকগুলো স্পটে যেতে চান তাহলে এজেন্সির মাধ্যমে যাওয়াটাই ভালো। তাহলে আপনি ট্যুরটা কোনোরকম চিন্তা ছাড়া শান্তিমত শেষ করে আসতে পারবেন।
যারা আলাদা নিজেরা যেতে চান এবং বিভিন্ন স্পটে যেতে চান তারা আগে থেকেই লঞ্চ ঠিক করে রাখতে হবে। খুলনা লঞ্চঘাট থেকে সেই লঞ্চে করে যেতে হবে সুন্দরবনে।
আর যারা এক দুইদিনের জন্য সুন্দরবনে যেতে চান তারা সুন্দরবন যেতে চাইলে আগে খুলনায় যেতে হবে। ঢাকার বিভিন্ন বাস স্টেশন থেকে খুলনার বাস পাওয়া যায়। এছাড়া আপনি চাইলে ট্রেনেও খুলনায় যেতে পারবেন। যারা প্লেনে যেতে চান তাদের প্রথমে যশোর যেতে হবে, তারপর সেখান থেকে যেতে হবে খুলনায়। করমজল আর হাড়বাড়িয়া পয়েন্টে যেতে চাইলে আপনি খুলনা শহর থেকে সকালে বের হয়ে সন্ধ্যার মধ্যে ঘুরে আবার খুলনায় ফিরে আসতে পারবেন।
করমজল আর হাড়বাড়িয়া যাওয়ার সময় খুলনা থেকে প্রথমে বাসে যেতে হবে মংলায়। ভাড়া ৮০/৯০ টাকা। তারপর মংলায় নেমে ট্রলার ভাড়া করে যেতে হবে করমজল আর হাড়বাড়িয়া। শুধু করমজল যেতে চাইলে যাওয়া আসা মিলে মোট ১০০০ টাকায়ই ট্রলার পেয়ে যাবেন। আর হাড়বাড়িয়া, করমজল দুই পয়েন্টে গেলে ট্রলার ভাড়া আর একটু বেশি দিতে হবে। তারপর সন্ধ্যার মধ্যে খুলনায় ফিরে আপনি চাইলে রাতের বাসে বা ট্রেনে বাসায় ফিরেও যেতে পারবেন।
কোর্সটিতে যা যা পাচ্ছেন:
বিসিএস প্রিলি লাইভ কোর্স
কোথায় থাকবেন:
খুলনায় খুব ভালো কিছু হোটেল রয়েছে। এছাড়াও আপনি চাইলে মংলায়ও থাকতে পারবেন। যদিও মংলায় থাকার হোটেল খুব একটা ভালো না। তাই যদি থাকতে চান মংলায় না থেকে খুলনায় ফিরে খুলনায় থাকাই ভালো হবে।
এবার তাহলে চলুন সুন্দরবনের বিভিন্ন স্পট সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে আসি।
কটকা সি বিচ: খুলনা শহর থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার এবং মংলা থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত কটকা। কটকার অন্যতম আকর্ষণ হলো চিত্রা হরিণের দল। যখন কটকার কাছাকাছি পৌঁছাবেন তখন লঞ্চ থেকেই বনের দুপাশে দেখতে পাবেন হরিণের দল। কটকার মেইন পয়েন্টের একপাশে রয়েছে কটকা সি বিচ আর অপরপাশে কটকা অভয়ারণ্য। মেইন পয়েন্ট থেকে ৩০ মিনিটের মতো বনের ভেতর দিয়ে হাঁটলেই আপনি পৌঁছে যাবেন কটকা সি বিচে৷
কটকা অভয়ারণ্য: কটকায় যেখানে লঞ্চ থামাবে তার যেপাশে কটকা সি বিচ তার অপরপাশেই কটকা অভয়ারণ্য। অনেকে আবার এটাকে চিনে টাইগার পয়েন্ট হিসেবে। এখানে আপনি মোটামুটি কাছ থেকেই হরিণের দল দেখতে পারবেন। যদিও একদম কাছে যেতে পারবেন না, কাছে গেলেই ওরা দৌড়ে ঢুকে যাবে বনের ভেতরে। এছাড়াও যখন হাঁটবেন হয়তো দেখতে পাবেন আপনার সাথে সাথে বানরও হেঁটে বেড়াচ্ছে বা দৌড়াচ্ছে আপনার আশেপাশেই। আর যেহেতু এই দু’টি স্পট একই জায়গায় চেষ্টা করবেন সকাল সকাল কটকা সি বিচে ঘুরে আসতে আর দুপুরের পরে কটকা অভয়ারণ্যে যেতে।
হিরণ পয়েন্ট: হিরণ পয়েন্টে গেলেই দেখতে পাবেন লেখা আছে ‘নীলকমলে স্বাগতম’। অবাক হওয়ার কিছু নেই, নীলকমল হিরণ পয়েন্টেরই আরেক নাম। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ এই জায়গাটাকে চিনে হিরণ পয়েন্ট নামেই। হিরণ পয়েন্টে গেলেই কাঠের একটি ট্রেইল পাবেন। এই ট্রেইলটি ধরে বনের ভেতরে অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারবেন, নিজের কাছেই তখন মনে হবে হয়তো হারিয়ে যাচ্ছেন গহীন বনে।
দুবলার চর: কটকা থেকে ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে দুবলার চরের অবস্থান। অনেকে আবার এটাকে চিনে শুঁটকি পল্লী হিসেবেও। নানা প্রজাতির মাছ আর কাঁকড়া পাওয়া যায় এখানে। দুবলার চরে নামলেই দেখতে পারবেন খালি শুঁটকি আর শুঁটকি। তবে জায়গাটা এককথায় অসাধারণ। বিকেলের দিকে দুবলার চরে যেতে পারলে সময়টা ভালোই কাটবে। এই চরে নেমে ১০ মিনিটের মতো হাঁটলে একটি বাজার পাবেন। অনেকে বলে এই বাজারের নাম নিউমার্কেট। সন্ধ্যার পরে চাইলে সেখান থেকে ঘুরেও আসতে পারেন।
করমজল: মংলা ঘাট থেকে ট্রলারে করেই যেতে পারবেন করমজলে। মংলা ঘাট থেকে করমজল যেতে সময় লাগে দেড় ঘণ্টার মতো। করমজলে নেমেই দেখতে পাবেন সুন্দরবনের বড় একটি মানচিত্র। তারপর সামনে এগোলেই দেখতে পাবেন দেয়ালে, গাছে সব জায়গায় বানর ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর সামনেই পাবেন কাঠের ট্রেইল। ট্রেইলের একপাশ দিয়ে হাঁটা শুরু করে বনের ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে দেখবেন আবার আগের জায়গায়ই ফিরে এসেছেন। ট্রেইল ধরে সামনে আগালেই চোখে পড়বে ওয়াচ টাওয়ার। ওয়াচ টাওয়ারে উঠে চাইলেই দেখে নিতে পারবেন বনের চারপাশ।
হাড়বাড়িয়া: করমজল থেকে অল্প কয়েক কিলোমিটার দূরেই হাড়বাড়িয়ার অবস্থান। হাড়বাড়িয়া যাওয়ার সময় চোখে পড়বে নদীর দুপাশের সৌন্দর্য। তারপর সেখানে পৌঁছানোর পর দেখতে পাবেন কুমিরের অভয়ারণ্য। চোখে পড়বে কুমির, এছাড়াও চোখে পড়বে মায়াবী চোখের মায়া হরিণ।
ব্যস্ততম জীবনের ক্লান্তি দূর করতে প্রায় সারাবছরই ভ্রমণ পিপাসুরা ঘুরতে যায় সুন্দরবনে। আপনিও চাইলে সামনের কোনো ছুটিতে ঘুরে আসতে পারেন সুন্দরবন থেকে, কাটিয়ে আসতে পারেন জীবনের সেরা কিছু সময়।
আপনার কমেন্ট লিখুন