“মাগো, ওরা বলে,
সবার কথা কেড়ে নেবে
তোমার কোলে শুয়ে
গল্প শুনতে দেবে না।
বলো, মা, তাই কি হয়?
তাইতো আমার দেরী হচ্ছে।
তোমার জন্য কথার ঝুড়ি নিয়ে
তবেই না বাড়ি ফিরবো।
লক্ষ্মী মা রাগ করো না,
মাত্রতো আর কটা দিন।”
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর “মাগো, ওরা বলে” কবিতার সেই ছেলেটি কি কথার ঝুড়ি নিয়ে তার মায়ের কাছে ফিরতে পেরেছিলো? না! ছেলেটি আর তার মা-এর কাছে ফিরতে পারেনি। চিঠিটাও পায়নি মা, কারণ পোস্ট করবার আগেই হানাদারের বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া বুকের তাজা রক্ত সে চিঠিকে করে দিয়েছিলো লাল, যেই লাল রঙ হার মানায় কৃষ্ণচূড়ার রঙকেও।
আজকের এই ব্লগে আলোচনা করবো ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন-এর ইতিহাস এবং ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট আর সে সম্পর্কিত বাংলার ইতিহাসের নানা বাঁক। সেই সাথে আরও থাকবে ভাষা আন্দোলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসামান্য ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা।
ভাষা আন্দোলন কি?
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালীর স্বাধিকার আদায় সংগ্রামের অন্যতম নিদর্শন। বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করবার দাবীতে, ১৯৫২ সালে বাঙালীরা তৎকালীন পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে, বুকের রক্ত দিয়ে বাংলাকে মাতৃভাষার মর্যাদা এনে দেয়। ইতিহাসে এই আন্দোলন ভাষা আন্দোলন নামে পরিচিত। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের মধ্য দিয়ে বাঙালীর স্বাধীনতা অর্জনের যে আকাঙ্ক্ষার বীজ বপন করা হয়েছিলো, ৫২ এর ভাষা আন্দোলন যেন সেই বীজের থেকে বেরিয়ে আসা ছোট্ট চারাটি, যা পরবর্তী সময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ নামে এক মহিরুহতে পরিণত হয়।
১৯৪৭: ভাষা আন্দোলনের সূচনা
দ্বিজাতি তত্ত্ব: দুটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন-এর প্রেক্ষাপট জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৪৭-এর সময়টায়। ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থাকে ভেঙে উপনিবেশিক শক্তি ইংল্যান্ড ভারত ভূমি থেকে বিদায় নেয়। জিন্নাহ প্রদত্ত দ্বিজাতি তত্ত্ব (যেখানে ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির পরিবর্তে ধর্মকে প্রাধান্য দেয়া হয়)-কে সামনে রেখে, ১৪ ও ১৫ আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান) ও ভারত নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য
পশ্চিম পাকিস্তান তারপর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করতে শুরু করে। বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ দখল, সকল প্রকার উন্নয়ন থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করা- এমন সব ঘটনা ধীরে ধীরে এই ভূখন্ডের মানুষকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। এই শোষন আরো বেশি প্রকট হয়ে ওঠে যখন পশ্চিম পাকিস্তান বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু ভাষাকে প্রাধান্য দিতে শুরু করে। এর প্রধান কারণ ছিলো পাকিস্তানের বড় বড় সকল রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীরা ছিলেন উর্দুভাষী। আবার মুসলীম লীগের ‘মোহাজের’-গণের প্রভাবেও ধীরে ধীরে উর্দু প্রধান ভাষা হয়ে উঠতে শুরু করে। বাংলা ভূখন্ডের জনগণ তখনো উর্দুকে মেনে নিতে পারেনি, কারণ উর্দুর চর্চা এই ভূখন্ডে তেমন ছিলোই না বলতে গেলে।
মাতৃভাষায় প্রথম আঘাত: উর্দুকে সরকারি ভাষা ঘোষণা
ভাষার প্রতি প্রথম সরাসরি আঘাত আসে যখন উর্দুকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়, যার ফলে ৫২ এর ভাষা আন্দোলন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। এছাড়া এই সময়ে গণমাধ্যমে উর্দুর প্রচুর ব্যবহার, ডাকটিকিট থেকে বাংলা অক্ষর সরিয়ে দেয়া, পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষায় কেবল উর্দু ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ- এই সকল কিছু শিক্ষিত বাঙালীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। এই সময় তমদ্দুন মজলিস বাংলাকে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পাওয়ার পক্ষে জোর দাবী জানায়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব তোলে। এর প্রতিবাদে দেশে বিক্ষোভের সূচনা হলে সরকার ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সকল সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১৯৪৮: গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের রাষ্ট্রভাষার দাবি
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা দাবি
পার্লামেন্টের এসেম্বলিতে প্রথমবারের মতো বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করবার প্রস্তাব তোলেন কুমিল্লার সন্তান ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো নেতারা এই প্রস্তাবের পক্ষে থাকলেও প্রতিদ্বন্দী হিসেবে পুরো পাকিস্তান সরকার প্রস্তুত ছিলোই, তাই খাজা নাজিমুদ্দিন, লিয়াকত আলী খান প্রমুখের প্রত্যক্ষ বিরোধিতায় এই বিল বারবার খারিজ হতে থাকে। এর প্রতিবাদে ২ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গড়ে ওঠে যার আহ্ববায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন শামসুল আলম। ১১ মার্চ হরতাল ঘোষণা করা হয়। নির্ধারিত দিনে হরতাল চলাকালে শেখ মুজিব, শামসুল আলম সহ প্রায় ৬৯ জন গ্রেফতার হন। এতে আন্দোলন আরো বেড়ে গেলে ১৫ মার্চ বন্দিদেরকে মুক্তি দেয়া হয়।
আরো পড়ুন: এশিয়া মহাদেশ: জেনে নিন বিস্তারিত
রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাষণ
এরপর ১৯শে মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন, ২১শে মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বক্তৃতার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, “Let me make it very clear to you that the state language of Pakistan is going to be Urdu and no other language. Anyone who tries to mislead you is really the enemy of Pakistan. Without one state language, no nation can remain tied up solidly together and function. Look at the history of other countries. Therefore, so far as the state language is concerned, Pakistan’s shall be Urdu.” খাজা নাজিমুদ্দিন তার এই বক্তব্যপকে পুরোপুরি সমর্থন দেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে জিন্নাহ একই বক্তব্য পেশ করলে প্রতিবাদে ফেটে পরে ছাত্রসমাজ।
১৯৪৯: আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা
আরবি হরফে যেন বাংলা লেখা
বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করবার কোনো ইচ্ছা যে তৎকালীন সরকারের ছিলো না, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দিতে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী ফজলুর রহমান এক উদ্ভট বুদ্ধি বের করলেন। তিনি প্রস্তাব করলেন, আরবি হরফে যেন বাংলা লেখার প্রচলন করা হয়। এই প্রস্তাবের পক্ষে তিনি কিছু যুক্তি দেন, যেমন, বাংলা অক্ষরে ইসলামী ভাবাদর্শ নেই, তাই আরবি হরফে বাংলা লেখা হলে তা প্রকৃত মুসলিমের ভাষা হয়ে উঠবে। আবার, পশতুসহ পাকিস্তানে প্রচলিত আর সব ভাষাও আরবি হরফে লেখা, তাহলে বাংলা আরবি হরফে লিখতে সমস্যা কী? তাই পাকিস্তান সরকার মাওলানা আকরাম খাঁ-কে চেয়ারম্যান করে একটি কমিটি করলেন এই ব্যপারে কাজ করতে। কিন্তু ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সহ আরো অনেক বুদ্ধিজীবিরা এই প্রস্তাবকে খারিজ করে দেন।
সুন্দর ও দ্রুত বাংলা হাতের লেখা
এই কোর্সটি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করবে?
পাকিস্তানের প্রথম বিরোধীদল
এই সময়ে, ২৩ জুন ১৯৪৯ সালে, তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম বিরোধীদল হিসেবে মাওলানা আবদুল হামীদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে একটি নতুন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে, যার নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগ’। যদিও পরবর্তীকালে সকল ধর্মের মানুষের কথা চিন্তা করে এর নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। প্রথমে এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন শামসুল হক। পরে, ১৯৫২ সালে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এবং পরের বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৬ সাল অব্দি, অর্থাৎ ১৩ বছর জাতির পিতা এই পদে দায়িত্বরত ছিলেন।
১৯৫০: বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব
১৯৫০ সালে পুনরায় পার্লামেন্টে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করবার প্রস্তাব করা হয়। বরাবরের মতো এবারও পূর্ব বাংলা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। আওয়ামী মুসলিম লীগ, পূর্ব বাংলার অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা তীব্রভাবে এই প্রস্তাবের বিপক্ষে আওয়াজ তোলেন। ১৪ নভেম্বর ঢাকায় Grand National Convention-এর আয়োজন করা হয়। এই কনভেনশনে, উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করবার দাবী জানান হয়।
১৯৫১: ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত
১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ গঠিত হয়। বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতিকে চর্চার জায়গাটি নিয়ে তারা ছিলেন সচেতন। এই বছরই আবারো পার্লামেন্টে আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাবনা রাখা হয়। কিন্তু পূর্বগঠিত কমিটি এই প্রস্তাবকে উদ্ভট বলে বাতিল করে একটি রিপোর্ট জমা দেয়। কিন্ত সেই রিপোর্ট জনগনের সামনে আনা হলো না। হাবিবুল্লাহ বাহার, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত- আরো অনেকে এই প্রস্তাবকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থাকে চিরতরে ধংসের উদ্দ্যোগ বলে অভিহিত করেন। পরে পূর্ব পাকিস্তানের পার্লামেন্ট সদস্যদের বিরোধিতায় পাকিস্তান সরকার এই প্রস্তাব বাতিল করতে বাধ্য হয়।
১৯৫২: ভাষা আন্দোলনের পুনর্জাগরণ
২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টনের এক সমাবেশে আবারো উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করবার কথা বলেন। সমাবেশস্থল থেকেই ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান উঠে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকে সারাদেশে ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়।
আরো পড়ুন: ঢাবি খ ইউনিট প্রস্তুতি: কিভাবে জিতবে ভর্তি যুদ্ধ?
২১ শে ফেব্রুয়ারি
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় ৩১শে জানুয়ারি। গোলাম মাহবুবকে আহ্ববায়ক করে গঠিত এই সংগঠন থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি সারা পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এই ধর্মঘটকে বানচাল করতে ১৪৪ ধারা জারি করে। সর্বদলীয় রাষ্টভাষা সংগ্রাম পরিষদে আবদুল হাশিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই দিন বেলা তিনটায় ছাত্ররা মিছিল নিয়ে বর্তমান জগন্নাথ হলের দিকে যাত্রা করে। পুলিশ গুলি ছোঁড়ে, রাস্তায় গড়ায় বরকত, রফিক আর জব্বারের রক্তরঞ্জিত দেহ। গুরুতর অবস্থায় সালামকে হাসপাতালে নেয়া হলে সেও মৃত্যুবরণ করে। রক্তাত্ব রাজপথ যেন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বরণের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
২২ শে ফেব্রুয়ারি
পরের দিন সকাল হতে হতে, রাজপথের রক্ত শুকিয়ে গিয়েছে। রাজপথে তখন আবারো উত্তেজিত জনতা জড়ো হতে শুরু করে। কার্জন হল এলাকায় শহীদদের জানাজা নামাজ আদায় করে পুনরায় মিছিল শুরু করে তারা। পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী আবারো সেই মিছিলে গুলি চালায়। এবার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন শফিউর। জনতার ঢল প্রবল আক্রোশে দি মর্নিং নিউজ পত্রিকার অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয়। অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে সরকার খুব দ্রুত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করবার বিল উথাপন করে এবং তা সর্ব সম্মতিক্রমে পাশ হয়। বাংলা ভাষা তার ভূমিজ সন্তানদের আত্মত্যাগে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন-এর মধ্য দিয়ে, নিজের সম্মান অর্জন করে।
১৯৫৩-১৯৫৬: ভাষা আন্দোলনের পুনর্জাগরণ
১৯৫৪: যুক্তফ্রন্ট গঠন
মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে থাকা বাকি সকল রাজনৈতিক দল নিয়ে ১৯৫৪ সালের ৪ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। মুসলিম লীগ সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে থাকে যেন যুক্তফ্রন্ট মানুষের মাঝে জনপ্রিয়তা না পায়, ক্ষমতায় না আসতে পারে। তাই যুক্ত ফ্রন্টের একাধিক নেতাকে তখন আটক করা হয়। কিন্তু সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে বিপুল ভোটে যুক্তফ্রন্ট গণপরিষদ নির্বাচনে জয়লাভ করে। মুসলিম লীগ নাম মাত্র আসন নিয়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, ভাষাকে রক্ষার্থে ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর গঠন করে বাংলা একাডেমি, যার প্রাঙ্গনে ভাষা শহীদদের স্বরণে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে বইমেলা।
১৯৫৬: রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি
এই বছর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। ২৬শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের পার্লামেন্টে উর্দু এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সংবিধানে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই সংবিধান কার্যকর হয় ৩ মার্চ থেকে। অবশেষে বাংলা ভাষা আসীন হয় তার বহুল আকাঙ্ক্ষিত মর্যাদার আসনে। কিন্তু আজ ৬৭ বছর পর যখন আমরা আমাদের চারপাশে বাংলা ও ইংরেজির মিশ্রণে কথা বলতে শুনি, তখন কি এই প্রশ্ন মনে আসাটাই স্বাভাবিক নয়- ভাষা আন্দোলন কি আসলেই তার পূর্ণ মর্যাদাটুকু পেলো?
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু
উর্দুকে যখন রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব হয়
গণপরিষদে উর্দুকে যখন রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করা হলো, তার প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ বাংলা ভাষার দাবী নিয়ে পূর্ববাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। মিছিলের সময় পুলিশ লাঠিচার্জ করে, গ্রেফতার করে শামসুল হক, বঙ্গবন্ধু সহ আরো প্রায় ৭০-৭৫ জন ছাত্রকে। কিন্তু শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, খয়রাত হোসেনের মতো বড় নেতাদের প্রবল দাবীতে খাজা নাজিমুদ্দিন আট দফা চুক্তিতে সাক্ষর করেন, যেখানে গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মুক্তি দেয়ার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ফলে ১৫ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ও বাকি বন্দিরা মুক্তি লাভ করেন। ১৬ই মার্চ তার নেতৃত্বে আমতলায় একটি ছাত্রসমাবেশ হয়। এই সমাবেশের মূল লক্ষ্য ছিলো ভাষার আন্দোলন যেন ঝিমিয়ে না পড়ে সে বিষয়টি নিয়ে সকলকে সচেতন করা।
উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পর
একই বছর (১৯৪৮) ১৯শে মার্চ জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে আসেন, রেসকোর্স ময়দানে ২১শে মার্চ উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করবার ঘোষণা দেবার পর, ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে একই ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু সহ আরো অনেক ছাত্ররা সেখানে উপস্থিত ছিলেন, সকলে সমস্বরে ‘না, না’ বলে প্রতিবাদ জানান। বঙ্গবন্ধু সেই দিনের স্মৃতিচারণ করেন তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইতে, “জিন্নাহ প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করেছিলেন, তারপর পুনরায় বক্তৃতা করেন। আমার মনে হয়, এই প্রথম তার মুখের উপরে তার কথার প্রতিবাদ করল বাংলার ছাত্ররা। এরপর জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন, আর কোনোদিন বলেননি, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।”
৫২ এর ভাষা আন্দোলনচলাকালীন কারাবন্দি
১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু আবারো কারাবন্দি হন। ১লা ফেব্রুয়ারি তিনি ও মহিউদ্দিন আহমেদ সরকারের কাছে মুক্তি চেয়ে আবেদন করেন। ১৫ ফেব্রুয়ারিতেও তাদের মুক্তি না দিলে তিনি ও মহিউদ্দিন আহমেদ ১৬ই ফেব্রুয়ারি অনশনে বসেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি রাতে তিনি জেলে বসে পুলিশের গুলির খবর জানতে পারেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লেখেন, “মুসলিম লীগ সরকার কত বড় অপরিণামদর্শিতার কাজ করল। মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয়নি।…আমি ভাবলাম, দেখব কিনা জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে, তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে উপায় নাই।” একজন দূরদর্শী নেতার এমনটাই বৈশিষ্ট্য, তিনি জানেন কোন কাজের ফলাফল কী হতে পারে।
শেষ কথা
আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে
কেমন নিবিড় হয়ে। কখনো মিছিলে কখনো-বা
একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়- ফুল নয়, ওরা
শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।
একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রং…।
শামসুর রাহমানের এই কবিতাটি ধারণ করে আছে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটানো ভাষা আন্দোলনের সেই করুণ অথচ গর্বের ইতিহাসকে। চর্যাপদ থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন হয়ে যে বাংলা ভাষা তার অমিয় সুধা নিয়ে নদীর মতো বয়ে চলেছে নিরবধি, সে যেন অগ্নিস্নানে সূচি হলো ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন-এর মধ্য দিয়ে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো যখন এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়, তখন বাংলার মতো সারা পৃথিবীর সকল মায়ের মুখের বুলিই সম্মানের আসনে আসীন হয়। আত্মত্যাগী আর অমর সেই সকল ভাষা শহীদদের প্রতি রইলো নিরন্তর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
তথ্যসূত্র:
- বাংলা ভাষা আন্দোলন | উইকিপিডিয়া
- ১৯৫২- ভাষা আন্দোলন | উইকিপিডিয়া
- ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ | শামসুর রাহমান
- মাগো, ওরা বলে |আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
- অসমাপ্ত আত্মজীবনী |শেখ মুজিবুর রহমান
- বাংলা ভাষা আন্দোলনের কালপঞ্জি | উইকিপিডিয়া
- ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু | মো. মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া
- পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি| বদরউদ্দীন উমর
- একুশে ফেব্রুয়ারি: রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যেভাবে সূচনা হয়েছিলো আন্দোলনের | শাহনাজ পারভীন
আমাদের কোর্সগুলোতে ভর্তি হতে ক্লিক করুন:
১০ মিনিট স্কুলের ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে সরাসরি চলে যেতে পারো এই লিঙ্কে: www.10minuteschool.com
আমাদের কোর্সগুলোর তালিকা:
- Communication Masterclass by Tahsan Khan
- Facebook Marketing Course by Ayman Sadik and Sadman Sadik
- ঘরে বসে Freelancing by Joyeta Banerjee
- ঘরে বসে Spoken English Course by Munzereen Shahid
- Study Smart Course by Seeam Shahid Noor
আপনার কমেন্ট লিখুন