আঠারো বছর বয়স। এ সময়টা খুব অদ্ভুত। তখন আমরা ঠিক তেমন একটা ছোটও না আবার খুব একটা বড়ও হয়ে উঠতে পারিনি। মনের মধ্যে খেলা করে নানানরকমের আবেগ। আশেপাশের কিছু ঘটনা মনকে ভালো করে দেয়, কিছু ঘটনা বুক চিরে কাঁদায়, কিছু ঘটনা আমাদের ভাবায়, কিছু ঘটনা আবার প্রতিবাদী করে তোলে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার করে তোলে। দুঃসাহসী চিন্তা, স্বপ্ন, কল্পনা উঁকি দেয় এ বয়সে। সাক্ষাৎ হয় নানান ধরনের ভয়ভীতির, দুশ্চিন্তার। তবুও, এ বয়স ভীরু না। কারণ এ বয়সে মন থাকে একদম বিশুদ্ধ। তাই কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায় বললে, “এই বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়।”
আচ্ছা আমাদের দেশের আঠারোর তরুণ তরুণীরা কেমন? উত্তরটা সবারই কমবেশি জানা। এদেশের আঠারোর প্রতিনিধিরা অকুতোভয়। কিছুদিন আগেই আমাদেরকে তাক লাগিয়ে দিয়ে এক বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল এই আঠারোর ছেলেমেয়েরা। আচ্ছা তারা কোথা থেকে পেল সাহস, শক্তি, প্রেরণা? বায়োলজিতে আমরা জেনেটিক্স পড়ি না? সেই বায়োলজি আর আমার এই বাংলা লেখাকে একটু মিলমিশ ঘটাই তাহলেই আমরা উত্তরটা পেয়ে যাব। তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সাহস, তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন তো তাদের জিনগত। শত বছর ধরে বাঙালি তরুণেরা তাদের জিনে বয়ে নিয়ে আসছে সেই অদম্য সাহস। সূচনাটা সেই শত বছর আগে সাদা ধুতি পরা, কোঁকড়া চুলের এক নির্ভীক আঠারো বছর বয়সী সোনার ছেলের হাত ধরে। আল মাহমুদের একুশের কবিতার কিছু লাইন যাকে খুব সুন্দরভাবে বর্ণনা করে।
“চিনতে নাকি সোনার ছেলে
ক্ষুদিরামকে চিনতে?
রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিল যে
মুক্ত বাতাস কিনতে?“
ক্ষুদিরাম বসু
ছোট্ট ক্ষুদিরাম:
ত্রৈলোক্যনাথ বসু ছিলেন নাড়াজোল প্রদেশের তহসিলদার। তিনি ও তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী তাঁদের তিন মেয়ে অপরূপা, সরোজিনী, ননীবালাকে নিয়ে থাকতেন মেদিনীপুরের কেশবপুর থানার অন্তর্গত হাবিবপুর নামক ছোট গ্রামে। তাঁদের দুইটি পুত্র সন্তান হলেও অল্প বয়সেই মারা যায়। কথিত আছে যে, লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী সিদ্ধেশ্বরী কালি মন্দির যা কিনা তাঁদের ঘর থেকে তিন দিন সমান দূরত্বে গিয়ে মানত করেন ছেলের জন্য। শুধু তাই নয় তিনি এমন ছেলে চেয়েছিলেন যার দীর্ঘায়ু হবে।
তিন দিন পর নাকি তিনি স্বপ্নে দেখেন, সৃষ্টিকর্তা তাঁকে একটা পুত্র সন্তান দেবেন তবে সে দীর্ঘায়ু না হলেও, সারাজীবনের জন্য মানুষ মনে রাখবে তাকে। যদিও এই কাহিনীর সত্যতা নিশ্চিত নয়, তবুও তাঁর পুত্র সন্তানকে যে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও সবাই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে সেটা বলাই বাহুল্য। লক্ষ্মীপ্রিয়া এবং ত্রৈলোক্যনাথ বসুর সেই কাঙ্ক্ষিত পুত্র সন্তানটি জন্মেছিলেন বছরের শেষের দিকে। ডিসেম্বর ৩, ১৮৮৯। নাম তাঁর ক্ষুদিরাম।
খুদ থেকে ক্ষুদিরাম :
আমাদের সবারই নাম রাখার পেছনে কোনো না কোনো কারণ বা গল্প থাকেই। ক্ষুদিরামের নাম ক্ষুদিরাম হয়ে উঠার পিছনের গল্প কিছুটা অন্যরকম। আগের দুই পুত্র অল্প বয়সে মারা যাওয়ায় ক্ষুদিরামকে মৃত্যু আশংকা থেকে বাঁচাতে, তাঁর বাবা মা করলেন কী, সমাজের তখনকার একটা প্রথা অনুসরণ করলেন। আমরা এখন এসবকে কুসংস্কারই বলব। যদিও এই প্রথা ছেলের মঙ্গলের জন্য তাঁরা অনেক গুরুত্বের সাথেই পালন করেছিলেন। আচ্ছা, তো তাঁরা যা করেছিলেন তা হল, ক্ষুদিরামের মা ক্ষুদিরামকে তিনমুঠ শস্য বা খুদের বিনিময়ে ক্ষুদিরামের বড় বোনের কাছে বিক্রি করে দিলেন। মূলত এটা দ্বারা লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী ক্ষুদিরাম থেকে সব লৌকিক অধিকার ছিন্ন করলেন তাঁর ছেলের সাথে; এ ধরনের একটা ভান। সত্যি সত্যি না কিন্তু! সেই থেকে তাঁর নাম হল ক্ষুদিরাম। এবং বাবার পদবির সাথে মিল রেখে পদবি হল বসু। হয়ে গেলো তাঁর নাম ক্ষুদিরাম বসু।
পিতৃ-মাতৃহীন ক্ষুদিরাম :
বাবা মায়ের ভালবাসা বেশিদিন পাননি ক্ষুদিরাম। মাত্র ছয় বছর বয়সে মাকে হারান। তারপরের বছর বাবাকে। পিতৃ-মাতৃহীন ক্ষুদিরাম এবং তাঁর অবিবাহিত বোন ননীবালার জায়গা হয় বড় বোন অপরূপা রায়ের বাড়িতে, দাশপুর থানার হাতগাছা গ্রামে। ক্ষুদিরামের কাছে তাঁর বড় বোন ছিল মায়ের মতো। মায়ের মতই আদর যত্ন দিয়েই বড় করেছিলেন তাঁকে। সেখানেই বড় হতে লাগলেনও। প্রথমে গ্রামের পাঠশালাতে ভর্তি হন। ইতোমধ্যে বড় বোনের স্বামী অমৃতলাল রায় চাকরিসূত্রে তমলুকে বদলি হন। তখন অমৃতলাল তাঁর ছেলে ললিত এবং ক্ষুদিরাম দুইজনকেই তমলুকের হ্যামিল্টন ইংলিশ স্কুলে ভর্তি করান।
পড়ালেখাতে আমাদের মতই অল্পসল্প অমনোযোগী ছিলেন ক্ষুদিরাম। অনেক বেশি ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন। কিছুটা অবাধ্য ও বলা চলে। সমাজের নিয়ম-নীতির অত ধার ধারতেন না। ১৯০৩ সালে তাঁর জামাইবাবু আবারো বদলি হয়ে মেদিনীপুর আসলে ক্ষুদিরাম সেখানকান কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে তিনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। তবে তিনি পাঠ্যবইয়ের চেয়ে দেশপ্রেমী বই পড়তেই বেশি পছন্দ করতেন।
বই পড়তেন প্রচুর। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রায় সব বইই নাকি পড়ে ফেলেছিলেন তিনি। বঙ্কিমের “আনন্দমঠ” পড়ে তিনি অনেক উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।
বিপ্লবী ক্ষুদিরাম :
ক্ষুদিরাম আমাদের মত আট দশটা ডানপিটে, বাউন্ডুলে ছেলের মতই বেড়ে উঠছিল, তখনই তাঁর মনে লাগে বিপ্লবের ছোঁয়া। অল্প বয়সেই বিপ্লবী মতাদর্শে নিজেকে আস্তে আস্তে তৈরি করতে থাকেন। বিপ্লবী কর্মকান্ডের সূতিকাগার হয়েছিল সেই মেদিনীপুরেই। ১৯০২ এবং ১৯০৩ সালের দিকে যথাক্রমে শ্রী অরবিন্দ এবং সিসটার নিবেদিতা জনসম্মুখে বিপ্লবী ভাষণ রাখলে ছোট্ট ক্ষুদিরাম বিপ্লবী হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা পান।
আবার ঠিক সেই সময়েই মেদিনীপুরে একটা “অনুশীলন সমিতি” নামে গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন গড়ে ওঠে হেমচন্দ্র দাস কানুনগোর নেতৃত্বে। তাঁর সহকারী ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ক্ষুদিরাম কলেজিয়েট স্কুলে এক বন্ধুর সুবাদে সত্যেন্দ্রনাথের সাথে পরিচয় ঘটে। কিশোর ক্ষুদিরাম সেই সমিতিতে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর বৈপ্লবিক জীবনের সূচনা ঘটান। সাথে সাথে সংগঠনে থাকাকালীন নিজেকে শরীরচর্চার পাশাপাশি রাজনৈতিক শিক্ষা পেতে শুরু করেন। পিস্তল চালনাতেও পারদর্শী হয়ে উঠেন। এবং আস্তে আস্তে তাঁর নেটওয়ার্ক বাড়তে থাকে। পরিচয় ঘটে কলকাতার বারিন্দ্রকুমার ঘোষের সাথে।
কোর্সটিতে যা যা পাচ্ছেন:
বিসিএস প্রিলি লাইভ কোর্স
বৈপ্লবিক কাজে ক্ষুদিরাম :
সাল ১৯০৫। একদিকে বঙ্গভঙ্গ আরেকদিকে স্বদেশী আন্দোলন। উত্তাল বাংলা। ১৫ বছর বয়সী ক্ষুদিরাম বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ইংল্যান্ড থেকে উৎপাদিত কাপড় পোড়ানো এবং ইংল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত লবণ বোঝাই নৌকা ডোবানোর কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি তাঁর বৈপ্লবিক কর্মকান্ডের সূচনা করেন।
কিছু সময়ের মধ্যেই সবার চোখ কাড়েন ক্ষুদিরাম। একের পর এক কর্মকান্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে থাকেন। ১৯০৬ সালে মেদিনীপুরের মারাঠা কেল্লায় এক শিল্প প্রদর্শনী হয়। সেখানে তিনি সত্যেন্দ্রনাথ বসুর আদেশে তৎকালীন রাজদ্রোহমূলক পত্রিকা “সোনার বাংলা” বিলি করেন। আর এই অপরাধে প্রথমবারের মত গ্রেফতার হন এই বিপ্লবী কিশোরটি। পরে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয় তাঁর বয়স কম বলে।
আরও পড়ুন:
সোশ্যাল মিডিয়া এর সদ্ব্যবহার: জেনে নাও কয়েকটি টিপস!
নামাজ পড়ার নিয়ম: কোন নামাজ কত রাকাত ও নামাজের ফরজ কয়টি?
সক্রিয় কর্মী ক্ষুদিরাম:
কিন্তু ক্ষুদিরাম থেমে যাননি। একের পর এক বিদ্রোহ চালিয়ে গিয়েছেন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের বিরুদ্ধে। বিপ্লবী দলের অর্থায়নের জন্য তিনি ১৯০৭ সালে হাটগাছা গ্রামের এক ডাক-হরকরার মেইল ব্যাগ চুরি করেন। একই বছরে নারায়ণগড়ের রেল স্টেশনের কাছে ছোটলাটের গাড়িতে বোমা আক্রমণ করেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের মধ্যপন্থি রাজনীতির বিরুদ্ধেও আর প্রতিবাদের স্বর ছিল অনেক উঁচু। এমনকি তিনি পুলিশ স্টেশনের কাছে বোমা পুঁতেও রাখেন তিনি।
এভাবেই ১৬/১৭ বছর বয়সেই তিনি হয়ে উঠেন সংগঠনের একজন সক্রিয় কর্মী।
কিংসফোর্ড এবং ক্ষুদিরাম:
দিন দিন আন্দোলন প্রবলতর হচ্ছিল। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল ইংরেজদের অত্যাচার। বিপ্লবীদের আন্দোলন চিরদিনের জন্য বানচাল করে দিতে চলছিল নীলনকশা। রাজদ্রোহ মামলায় বিপ্লবীদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার জন্য কুখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড।
অপরদিকে ১৯০৭ সালে বারিন্দ্রকুমার দাস হেমচন্দ্র কানুনগোকে প্যারিস পাঠান বোমা বানানোর কৌশল শিখতে। রাশিয়ান বিপ্লবী নিকোলাস সাফ্রান্সকি ছিলেন তাঁর শিক্ষক। দেশে এসে তিনি বোমা বানানোর কাজ শুরু করলেন। দল সিদ্ধান্ত নিল যে কিংসফোর্ডকে হত্যা করার। কারণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে একটা ঝটকা দেওয়ার জন্য কুখ্যাত কিংসফোর্ডকে হত্যা করাটাই শ্রেয় ভেবেছিলেন তাঁরা। তাকে হত্যা করার প্রথম চেষ্টাটা ছিল একটি বই বোমার মাধ্যমে।
হেমচন্দ্রের তৈরি ঐ বোমাটা ছিল বইয়ের মধ্যে; আর এমনভাবে বানানো ছিল যাতে বইটি খুললেই বিস্ফোরণ ঘটে। একটি খালি ক্যাডবেরি কোকোয়ার টিনের বক্সের মাঝে পিকরিক এসিড এবং তিনটি ডিটেনেটোর দিয়ে বানানো হয়েছিল বোমাটি। পরেশ মল্লিক নামে এক বিপ্লবী তার বাড়িতে বোমাসমেত বইটি পাঠিয়ে দেয়। তবে কিংসফোর্ড তার পুরোনো বই ভেবে বইটি আর খুলে না দেখলে সেইবারে মিশন ব্যর্থ হয়ে যায়। এবং ইংরেজ সরকার কিংসফোর্ডের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাঁকে মুজাফফরপুরে বদল করে দেয়।
কিন্তু বিপ্লবী দল এতে দমে যায়নি। আবার তাঁরা পরিকল্পনা করে হত্যা করার। এবার দায়িত্ব পড়ে ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকীর উপর।
প্রফুল্ল চাকী
ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকী। কেউ চিনত না একে অপরকে। তবে দুইজনের আদর্শ ছিল এক। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে তাঁরা পিছপা হতেন না। তাদের এক বৈপ্লবিক আদর্শ তাঁদের কিংসফোর্ড হত্যা মিশনে এক করে। রেল গাড়িতে ক্ষুদিরামের সাক্ষাত হয় চাঁদপুরের প্রফুল্ল চাকীর সাথে। তাঁদের গন্তব্য ছিল মুজাফফরপুর।
মুজাফফরপুর এবং কিংসফোর্ড হত্যা মিশন :
কিংসফোর্ডের বাংলোর পাশের একটি ধর্মশালায় উঠেন প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম। তাঁরা টানা ৭ দিন ধরে সকাল বিকাল সন্ধ্যা সবসবময় কিংসফোর্ডের গতিবিধি লক্ষ করতে লাগলেন। কিংসফোর্ডের নিত্যদিনের কাজের মধ্যে কেবল অফিসে আর ক্লাবে যাওয়াই ছিল মূল। বাড়ির পাশেই ছিল ইউরোপিয়ান ক্লাব। খেলা শেষ করেই তিনি বাসায় যেতেন।
৩০ শে এপ্রিল, ১৯০৮। কিংসফোর্ড ইউরোপিয়ান ক্লাব থেকে খেলা শেষ করে ফিরছিলেন নিজ গাড়ি করে। সেদিন তার সাথে এডভোকেট কেনেডির স্ত্রী ও তার মেয়ে। কিংসফোর্ড ছিলেন নিজ গাড়িতে। কেনেডির স্ত্রী ও তার মেয়ে ছিলেন অন্য গাড়িতে। তবে দুটো গাড়িতে দেখতে প্রায় একই রকম।
অদূরে দাঁড়িয়ে সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছিলেন প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম। তাঁদের হাতে হেমচন্দ্রের বানানো বোমা।
যখনই ঘোড়ার গাড়ি দুইটি ইস্টার্ন গেটের কাছাকাছি পৌঁছে, রাত ৮ কিংবা সাড়ে ৮টা নাগাদ প্রফুল্ল এবং ক্ষুদিরাম এসে ঘোড়ার গাড়িকে লক্ষ করে বোমা ছুঁড়ে। বিকট শব্দে বোমা বিস্ফোরিত হলেও কিংসফোর্ড তার গাড়িতে অক্ষত অবস্থাতেই রয়ে যান। প্রফুল্ল এবং ক্ষুদিরাম আসলে বোমা ছুঁড়ে মেরেছিলেন মিসেস কেনেডি এবং তার মেয়েকে বহনকারি গাড়িতে। এতে তাঁদের মৃত্যু হয়।
ব্যর্থ মিশন এবং আটক ক্ষুদিরাম :
যখন বোমা ছুঁড়ে মারা হয়েছিল তখন ছিল সন্ধ্যার সময়। এই সময় চারপাশেই এলাকা পুরো সরবই ছিল। তাই বোমা হামলার পর পরই রেলস্টেশন ,রাস্তাঘাট সব জায়গায় কড়া নজরদারি লেগে যায়। এমনকি তাঁদের ধরিয়ে দেওওার জন্য ১০০০ রুপি পুরস্কার ও ঘোষণা করা হয়। আর এই কড়া নজরদারিকেই ফাঁকি দিয়ে প্রফুল্ল চাকী এবং ক্ষুদিরাম দুইজন দুইদিকে পালাতে শুরু করে। প্রফুল্ল চাকী পুলিশের হাতে ধরা পড়লে তিনি গুলি করে আত্মহত্যা করেন।
অন্যদিকে ক্ষুদিরাম ঘটনার পরই হাঁটতে শুরু করেন। পালানোর জন্য। তিনি সারা রাত একটানা হেঁটে হেঁটে প্রায় ২৫মাইল দূরত্ব অতিক্রম করেন। পরের দিন, অর্থাৎ ১মে সকালবেলা ক্লান্ত ক্ষুদিরাম ওয়ানি রেলস্টেশনের কাছে এক চায়ের দোকান থেকে পানি চাইলে পুলিশের নজরে পড়েন। আর তখনই গ্রেফতার হন তিনি। তাঁকে দেখতে সেদিন হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল সেখানে। নির্ভীক এই বিপ্লবীর কণ্ঠে তখনও ধ্বনিত হয়েছিল বন্দে মাতরম কথাটি।
আটকের পর ক্ষুদিরাম
কাঠগড়ায় ক্ষুদিরাম :
ক্ষুদিরামকে বারবার পুরো মিশন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলেও সে নিজের নাম ছাড়া আর কারো নাম বলে নি । এমনকি সব দায়ভার ও নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছিলেন তিনি।
২১ মে, ১৯০৮ এ তার বিচারকার্য শুরু হয়। জাজ হিসেবে ছিলেন মিস্টার কর্নডফ এবং জুরি হিসেবে ছিলেন জানকিপ্রসাদ ও নাথুনি প্রসাদ। ক্ষুদিরামকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরও ক্ষুদিরাম হাসছিলেন বলে জাজ কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। তিনি ভাবলেন, হয়তো বয়স কম বলে ক্ষুদিরাম ফাঁসির ব্যাপারটা বুঝতে পারছেনা। তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ফাঁসিতে ঝুলে মরতে হবে সেটিকে সে বুঝতে পারছে কিনা। উত্তরে মুচকি হেসে বলেন তিনি তা জানেন। ক্ষুদিরামকে তার শেষ ইচ্ছা কি জানতে চাইলে বলেন, তাঁকে কিছুটা সময় দেওয়া হোক, যাতে তিনি জাজকে বোমা বানানো শিখাবেন।
ফাঁসির আদেশ
ফাঁসিরকাষ্ঠে হাস্যোজ্জ্বল ক্ষুদিরাম :
১১ আগস্ট, ১৯০৮। চারদিকে উত্তাল জনতা। মুজাফফরপুর জেলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য মানুষ। আর তখন জেলের ভিতরে হাসতে হাসতে ফাঁসির কাষ্ঠের দিকে এগোতে লাগলেন ক্ষুদিরাম। ভোর ৬টা। ১৮ বছরের তরুণ ইংরেজদের হুংকারকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সাদরে বরণ করে নিলেন মৃত্যুকে।
স্মৃতিতে ক্ষুদিরাম :
ক্ষুদিরামকে নিয়ে অনেক কবি, সাহিত্যক নানান কিছু রচনা করেছেন। কাজী নজ্রুল ইসলাম তাঁকে নিয়ে কবিতা, গান লিখেছেন।
তাঁর স্মরণে, ক্ষুদিরাম বোস সেন্ট্রাল কলেজ ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠি হয় কলকাতাতে। মুজাফফরপুর জেল নাম পালটে হয় ক্ষুদিরাম বোস মেমরিয়াল সেন্ট্রাল জেল। কলকাতার গড়িয়ায় মেট্রোরেল স্টেশনের নাম শহীদ ক্ষুদিরাম বোস স্টেশন করা হয়।
এছাড়া তাঁর স্মরনে রচিত হয় “একবার বিদায় দে মা” গানটি। যেখানে গানে গানে ক্ষুদিরামের জীবনের সংগ্রাম বর্ণিত আছে। স্বয়ং লতা মুঙ্গেশকর এই গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। https://youtu.be/dfgJRCYZz0A
গানের লিংক ঃ https://www.youtube.com/watch?v=dfgJRCYZz0A&list=RDdfgJRCYZz0A&t=4
ক্ষুদিরাম শহীদ হয়েছেন ১১০ বছর আগে। তবুও তাঁর সেই বিপ্লবী চেতনা আমঅরা এখনকার আঠারোদের মধ্যে দেখতে পাই। যুগে যুগে এই আঠারো বছরের তরুণ তরুণীরাই আনতে পেরেছে বিপ্লব। তাই সুকান্তের ভাষায় বললে বলতে হয়, “এদেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।“
এদেশের বুকে ক্ষুদিরাম আসুক নেমে।
তথ্যসূত্র:
৩। http://mythicalindia.com/features-page/khudiram-bose-biography-age-family/
৪। http://www.somewhereinblog.net/blog/cowboyineast/29640588
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আমাদের কোর্সগুলোর তালিকা:
- Communication Masterclass by Tahsan Khan
- Facebook Marketing Course by Ayman Sadik and Sadman Sadik
- ঘরে বসে Freelancing by Joyeta Banerjee
- ঘরে বসে Spoken English Course by Munzereen Shahid
- Study Smart Course by Seeam Shahid Noor
আপনার কমেন্ট লিখুন