আমাদেরকে বলা হয় “নার্সিসিস্টিক জেনারেশন।” প্রযুক্তি আর সোশ্যাল মিডিয়ার জাঁতাকলে পড়ে আমরা নাকি নিজের আসল সত্ত্বাকে চিনতে ভুলে গিয়েছি, খুব স্থুলভাবে নিজেকে নিয়েই পড়ে থাকছি আমরা। কিন্তু তা সত্য হলে তো আমাদের এখন সুখী থাকবার কথা, তাই না? নিজেদের অক্ষমতাকে ভুলে কনফিডেন্টলি দাপিয়ে বেড়াবার কথা সবখানে, তাই না?
অথচ বাস্তবতাটা তার বিপরীত।
বাস্তবে আমরা সবাই অসুখী। কারণ আমাদের কাজকর্ম, আমাদের চিন্তাধারা, এ সবকিছুর পেছনে কোনো স্থুল নার্সিসিজম নেই, নেই কোনো অলীক গৌরব বা আত্মরতি। কারণ আমাদের সবার ড্রাইভিং ফোর্স একটাই- “ইনসিকিউরিটি।” আমাদের আশেপাশের যেকোনো মানুষের ভেতরটা ঘেঁটে দেখতে গেলে, দেখা যাবে সব আবেগকে ছাড়িয়ে, সেখানে এই একটা অনুভূতিই দাঁড়ানো, ইনসিকিউরিটি।
আমাদের ইনসিকিউরিটি আমাদের চেহারা নিয়ে, গায়ের রঙ নিয়ে, উচ্চতা নিয়ে, বুদ্ধিমত্তা নিয়ে; কি নিয়ে নয়! সবসময়ই বলছি নিজেকে, তুমি যথেষ্ট নও। তুমি সুন্দর নও। তুমি বোরিং। তোমার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। কেউ বলছে, তুমি তোমার পরিবারের জন্য যোগ্য নও। কেউ বলছে তুমি তোমার প্রেয়সীর জন্য যোগ্য নও। প্রতি পদে পদে আমরা নিজেদের অক্ষমতা অনুভব করছি, পরে থাকছি সেই ইনসিকিউরিটির দুষ্টচক্রে।
তবে আজকে আমার প্রবন্ধের উদ্দেশ্য ইনসিকিউরিটিগুলোর গপ্পো ফেঁদে তোমাদের সাথে দোস্তি পাতিয়ে হা-হুতাশ করা নয়, এই সমস্যাটির জন্য কার্যকর সমাধান বের করা। সমাধানের জন্য আমাদের আগে এই ইনসিকিউরিটিগুলোর প্রকৃতি বুঝতে হবে। কোনো কিছুর প্রকৃতি বুঝলেই আমরা তার রোধের উপায় বের করতে পারি একদম ব্যাপারটির মূলে আঘাত করে। এ প্রবন্ধে আমার সেই চেষ্টাই থাকবে।
আমি বিভিন্ন মানুষকে তাদের ইনসিকিউরিটিগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে তাদের উত্তরগুলোকে একটু বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করেছি। এটা করে আমি দেখতে পেয়েছি, এই সব ইনসিকিউরিটিগুলোরই সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে বুঝে নিয়েই আমরা এগিয়ে যাব ইনসিকিউরিটি থেকে মুক্তি পাবার দিকে। আগে বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা যাক-
ইনসিকিউরিটিগুলোর সূত্রপাত হয়েছে কোনো অতীত অভিজ্ঞতা থেকে-
তোমার উচ্চতা বা গায়ের রঙ নিয়ে ইনসিকিউরিটির শুরুটা সাধারণত হয় শৈশবেই। যখন তোমার পরিবারের কেউ সেসব নিয়ে কটু মন্তব্য করে। তারপর সেই ইনসিকিউরিটিটাই বাড়তে থাকে যদি পরবর্তী জীবনে গিয়ে তোমাকে সেসব নিয়ে উত্যক্ত করা হয়, ব্যঙ্গ করা হয়। তোমার বুদ্ধিমত্তা বা কার্যক্ষমতার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই। তুমি তখন থেকেই অনুভব করতে শুরু করবে যে তুমি যথেষ্ট নও যখন থেকে তোমার সহপাঠীরা বা কোনো শিক্ষক ব্যাপারটি তোমাকে তাদের কথা বা ব্যবহারের মাধ্যমে তোমাকে দেখিয়ে দেবে। তোমার অতীত অভিজ্ঞতা তোমার ইনসিকিউরিটিগুলো তৈরির পেছনে তোমার অজান্তেই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।
আরো পড়ুন: মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রাখতে যা যা করা প্রয়োজন
ব্যক্তিগত অসন্তুষ্টতার সাথে এগুলোর সম্পর্ক গভীর-
আমরা যেসব ব্যাপার নিয়ে ইনসিকিউরিটিতে ভুগি, এগুলোর কোনোটা নিয়েই আমাদের মাঝে সন্তুষ্টি নেই। আমরা হয়তো ভাবি আমাদের কণ্ঠ যথেষ্ট বলিষ্ঠ নয়, আমাদের কথা বলাটা ঠিকঠাক গোছানো নয়। অর্থাৎ অসন্তুষ্টি আর ইনসিকিরিউটি একদম একই সুতোয় গাঁথা।
“মানুষ কী ভাববে” এই চিন্তাটা সব ইনসিকিউরিটিরই অংশ-
“লোকে কী বলবে” এই চিন্তা আমাদের বাঙালী মনের বলতে গেলে অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর ইনসিকিউর মানুষদের মনটা বলতে গেলে কানায় কানায় পূর্ণ এইসব চিন্তা দ্বারাই। তুমি যতটা নিজের ইমেজ নিয়ে চিন্তিত হবে, ইনসিকিউরিটি ততটা তোমার উপর জেঁকে বসবে।
কোর্সটি করে যা শিখবেন:
Personal Fitness
ইনসিকিউরিটি একটি নেতিবাচকতাপূর্ণ আবেগ-
ইনসিকিউরিটি-জনিত সব চিন্তাই নেতিবাচক চিন্তা। এর কোনো ব্যতিক্রম নেই। যতবার তুমি ইন্সিকিউর চিন্তা করছো, খেয়াল করে দেখব সেই চিন্তায় থাকা সবগুলো বাক্যই শেষ হচ্ছে ‘নেই’ দিয়ে।
সব ইনসিকিউর চিন্তাই আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে অন্যদের সাথে তুলনা করার ফলে-
হ্যাঁ, আমরা সবাই-ই হয়তো রিলেট করতে পারব এ কথাটির সাথে। যখনই আমরা অন্যদের সাথে তুলনা করতে যাই, আমাদের ইনসিকিউরিটিগুলো আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে।
এখন এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে বিবেচনা করে আমরা বের করব আমাদের ইনসিকিউরিটিগুলোকে মোকাবেলা করবার উপায়। আমি ঠিক তাই করেছি এখানে। তবে চলো দেখে নেয়া যাক তোমরা কীভাবে মোকাবেলা করতে পারো তোমাদের ইনসিকিউরিটিগুলোকে।
১। শুরু করো নিজের অতীতকে ক্ষমা করবার মাধ্যমে-
যদি তোমার ইনসিকিউরিটির শুরুটা কোনো আত্মীয়ের ব্যবহারে বা কোনো বন্ধুর করা কটু মন্তব্যে হয়ে থাকে, প্রথমে সেটা নিজের কাছে স্বীকার করে নাও। তারপর একটু সেই অতীতের দিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে তাকাবার চেষ্টা করো। নিজেকে বোঝা, সবাই-ই ঠিক তোমার মতোই ইনসিকিউর, কেউই ত্রুটিমুক্ত নয়। যখন তোমাকে তারা ব্যঙ্গ করেছে, অসম্পূর্ণ বলেছে, তাদেরও ড্রাইভিং ফোর্স ছিল তাদের নিজস্ব ইনসিকিউরিটি। হ্যাঁ, সত্য যে তাদের এই ব্যবহারটি ঠিক ছিল না, কিন্তু আমরা কয়জনই বা সবসময় ঠিক আচরণটা করতে পারি?
তারা একটি ভুল করেছে তোমাকে ছোট করতে চেয়ে, কিন্তু তুমি তাদের এই ভুলকে ক্ষমা করার মাধ্যমেই নিজেকে বড় করে তুলতে পারো, কারণ তাদের প্রতি ক্রোধ রাখাটা তোমাকে কোনোভাবেই সাহায্য করছে না। বরং এই ক্রোধ তোমাকে বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তোমার অক্ষমতায়। তাই এই অতীতকে তোমার জীবন থেকে মুছে ফেলো ধীরে ধীরে, তখন তোমার ইনসিকিউরিটিগুলোও মুছে যেতে শুরু করবে ধীরে ধীরে।
Source: imgur.com
২। নিজের সম্পূর্ণটাকে গ্রহণ করতে শিখো-
লেখার এ পর্যায়ে এসে নিজেকে একটু মূল্যায়ণ করবার চেষ্টা করো। সনাক্ত করার চেষ্টা করো তোমার দেহের এবং সত্ত্বার সেসব অংশকে, যেসব তোমার সত্যিকার অর্থে পছন্দ নয়, যেসব মেনে নিতে তোমার স্ট্রাগল করতে হয়। সেসব অংশের দিকে এবার অসন্তুষ্টির দৃষ্টিতে না তাকিয়ে, একটি ইতিবাচক দৃষ্টিতে তাকাও। বোঝার চেষ্টা করো যে তোমার দৈহিক বা মানসিক কোনো অংশের জন্যই তুমি একা দায়ী নয়, এর পেছনে রয়েছে হাজার জিনোম হাজার ঘটনার জটিল কার্যক্রম।
ভেবে দেখ, এই অঙ্গগুলোর কোনোটিকে খারাপ বা ভালো বলার পেছনে কিন্তু কোনো সত্য ভিত্তি নেই। কালো থেকে সাদা ভালো, খাটো থেকে লম্বা ভালো- এসব কিছুই “সোশ্যাল কন্ডিশনিং।” কখনো সাম্রাজ্যবাদ, কখনো পুঁজিবাদ এই অদ্ভুত ধারণাগুলোর জন্ম দিয়েছে। তাই নিজেকে ভালোবাসার সাথে দেখতে শিখো। তবে নিজেকে সুস্থও রাখতে পারবে, বের হয়ে আসতে পারবে ইনসিকিউরিটি থেকেও। নিজেকে গ্রহণ করতে পারাটাই ইনসিকিউরিটি থেকে বের হয়ে আসার দ্বিতীয় ধাপ।
Source: avalonmalibu.তম
অন্যদের এপ্রুভাল আসলে তোমার নিজের জীবনে কোনো প্রভাব ফেলে না। অন্যরা তোমাকে নিয়ে কি ভাবছে তা তোমার জীবনে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। নিজের চিন্তাধারায়, নিজস্ব নৈতিকতায়, স্বীয় জীবনদর্শনে জীবনকে যাপন করো। যখনই অনুভব করবে যে তুমি অন্যদের এপ্রুভালের পেছনে দৌড়াতে শুরু করেছো, অন্যদের লাইক আর শেয়ার দিয়ে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করছো, তখনই অন্যদের থেকে সেই ক্ষমতাটা নিজের কাছে নিয়ে আসো। এর মানে এই নয় যে তুমি অন্যদেরকে তোমার জীবনে রাখবে না, তুমি অন্যদেরকেও ভালোবাসবে, সংযোগ তৈরি করবে সবার সাথে। কিন্তু তোমার জীবনে মূল্যমানটা তুমি নিজের কাছেই রাখবে, অনুশীলন করবে সেলফ এপ্রুভালের, ফলে জীবনকে নিয়ে আসবে নিজের নিয়ন্ত্রণে।
source : pinterest.com
৪। সবসময় নিজেকে ইতিবাচক রাখো
উপরের ধাপগুলো অনুসরণ করবার সময় তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু হবে নেতিবাচকতা। মাঝে মাঝে নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে, ভাববে- তোমার ইনসিকিউরিটিগুলো হয়তো যৌক্তিক। কিন্তু একটা ব্যাপার মনে রাখবে, তুমি কীভাবে ভাববে, তা কিন্তু একান্তই তোমার চয়েস। যখনই মাথায় নেতিবাচক চিন্তা আসবে, সরিয়ে নিয়ে আসবে ইতিবাচক চিন্তাকে। কি করতে পারবে না তা না ভেবে, ভাববে কি করতে পারবে সেটা। তোমার কি নেই তা না ভেবে, ভাববে কী আছে সেটা। তোমার মস্তিষ্কে ইনসিকিউরিটিগুলো তখন আর জায়গাই খুঁজে পাবে না।
Source: imgur.com
৫। অন্যান্য মানুষের সাথে নিজের তুলনা না করে তাদের জন্য আনন্দিত হও
অন্যরা কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, কতটা আনন্দে আছে, এসবকে নিজের সাথে তুলনা করার ব্যাপারটা কখনোই উপকারে আসে না, বরং তোমার সরাসরি ক্ষতি করে। তাই যখন কারো ভালো অবস্থান দেখবে, তার জন্য খুশি হবে, তার সমাদর করবে এবং তার থেকে শেখার চেষ্টা করবে। প্রত্যেকটি মানুষের জীবনের পথ আলাদা। সে যেমন তার পথে থেকে সুখী থাকতে পারে, তুমিও পারো। হ্যাঁ, আমরা প্রত্যেকেই একে অপরকে অনুপ্রাণিত করতে পারি, শিখতে পারি একে অপরের থেকে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমরা কেউই কারোর প্রতিযোগী নই। তাই সবার জন্য মনে শুভকামনা রাখবে এবং চেষ্টা করে যাবে নিজের জায়গা থেকে।
Source: pinterest.com
এইসব ধাপের অনুশীলন করতে করতে নিজের মধ্যে বিশ্বাস নিয়ে আসো যে তুমি ভালো আছো। জীবনের প্রত্যেকটা মুহূর্ত যাপন করো একটি একটি করে, উদযাপন করো সেই মুহূর্তগুলোকে। সফলতার পেছনে দৌড়াও ঠিক আছে, কিন্তু সেই সফলতার পথটা তৈরি করো তুমি নিজেই। চিনতে শিখো নিজেকে, বুঝতে শিখো তোমার শক্তির জায়গাগুলো। ঠিক সেভাবে বুঝতে শিখো তোমার দুর্বলতাগুলোকে, নিজেকে জানাও যে প্রতিটা মানুষেরই এমনটা দুর্বলতা আছে। তাই ক্ষমা করতে শিখো মানুষকে, সবার সাথে গড়ে তুলো ভালোবাসার, সৌহার্দ্যের সম্পর্ক। আর চিন্তাকে রাখো ইতিবাচক, নেতিবাচক চিন্তার স্থান দিও না নিজের মাঝে। তারপর একসময় তোমার ইনসিকিউরিটিগুলোও দেখবে জীবন থেকে হারিয়ে গেছে, বুঝবেও না কীভাবে একসময় তুমি ইনসিকিউর ছিলে।
Sources:
https://www.psychologytoday.com/us/blog/rediscovering-love/201801/insecurity
https://psychcentral.com/blog/5-things-to-do-when-you-feel-insecure/
https://zenhabits.net/insecurities/
আমাদের কোর্সগুলোতে ভর্তি হতে ক্লিক করুন:
- Communication Masterclass by Tahsan Khan
- Facebook Marketing Course by Ayman Sadik and Sadman Sadik
- ঘরে বসে Freelancing by Joyeta Banerjee
- ঘরে বসে Spoken English Course by Munzereen Shahid
- Microsoft Office 3 in 1 Bundle
- Microsoft Word Course by Sadman Sadik
- Microsoft Excel Premium Course
- Microsoft PowerPoint Course by Sadman Sadik
১০ মিনিট স্কুলের ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে ভিজিট করুন: www.10minuteschool.com
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন