১.
একদিন আমার সাথে আমাদের আরেক রাইটার জিহাদের কথা হচ্ছিল। তোমরা যারা নিয়মিত আমাদের ব্লগ পড়ো তাদের তো চেনার কথা জিহাদকে। জোতির্বিদ্যার মতো সেরা জিনিস নিয়ে ব্লগ লেখে। ওর সাথে মূলত চ্যাট হচ্ছিল। কী নিয়ে লেখা যায় সেটা নিয়ে কথা বলছিলাম আমরা। তখন ও হাসতে হাসতে বলল, “কেকা, তুমি কেকাকে নিয়ে লেখো! তোমার নামের সাথে রান্না জিনিসটা তো ভালোই যায়।“ এবং কতগুলো হাসির ইমোজি দেওয়া শুরু করলো।
যাই হোক, জিহাদ ঠাট্টার ছলে বললেও ওর এই কথাটা থেকেই আমার মাথায় একটা জোস আইডিয়া আসলো। ভাবলাম, কেমন হয় আসলেই খাবার নিয়ে লিখি? কারণ, আইডিয়াটা আমার আসলেই ভালো লেগেছে। আর মনে হয় আমিই প্রথম খাবার নিয়ে টেন মিনিট ব্লগে লিখব! তাই দেরি না করে ভাবতে বসে গেলাম, কী নিয়ে লেখা যায়। ভেবে ভেবে বের করলাম বিভিন্ন দেশের জাতীয় খাবার নিয়ে লিখব। আর যারা রাঁধতে অনেক বেশি পছন্দ করো তাদের জন্য রেসিপি লিংক ও দিয়ে দিচ্ছি। চলো শুরু করি টেন মিনিটে প্রথম (সম্ভবত)খাদ্য বিষয়ক ব্লগ!
২.
কথা হচ্ছে এই জাতীয় খাবার ব্যাপারটা কী। কোনো দেশের জাতীয় খাবার হচ্ছে এমন খাবার যা ঐ দেশের মানুষ নিয়মিত খায়, এবং খাবার রান্নার উপকরণগুলো সেই দেশেই উৎপাদিত হয়। ব্যাপারটা হচ্ছে যেই দেশে যে খাবার বহুল প্রচলিত, এবং যুগ যুগ ধরে যে খাবার মানুষজন খেয়ে আসছে এবং এর সাথে সে দেশের ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে।
যেমন ধরো, আমাদের দেশের জাতীয় খাবার হচ্ছে, ভাত-মাছ। আমাদের দিনে দুইবেলা ভাত খেতে হয়। আবার নদীমাতৃক দেশ বলে এদেশে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। তাই ভাত মাছ এটি আমাদের প্রধান খাদ্য বা স্টেপল ফুড। সেজন্যই আমরা মাছে ভাতে বাঙ্গালি। জাতীয় খাবারও একধরনের স্টেপল ফুড। তবে জাতীয় খাবার হচ্ছে দুইধরনের। অফিশিয়াল এবং আনঅফিশিয়াল। অফিশিয়াল বলতে বোঝায় সরকার নিজেই স্বীকৃতি দিয়েছে। যেমন আমাদেরটা। আর আনঅফিশিয়াল হচ্ছে সবাই জানে এটাই ওদের জাতীয় খাবার তবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই।
যাক গে, এবার তাহলে অন্যান্য দেশের জাতীয় খাবারের কথা বলি।
হ্যামবার্গার (Hamburger), আমেরিকা :
আমেরিকায় সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার হচ্ছে হ্যামবার্গার। বিপুল সংখ্যক আমেরিকানকে লাঞ্চের সময় এই হ্যামবার্গার হাতে দেখতে পাবে। ১৯০০ সাল থেকে আমেরিকার কানেক্টিকাটে সবচেয়ে পুরোনো হ্যামবার্গারের রেস্টুরেন্টটি আছে। সেটা হল “লুইস লাঞ্চ।” বনের ভিতরে বিশাল বড় এক মাংসের কিমার কাটলেট, বেকন, চিজ, পেঁয়াজ, লেটুস, আচার, সস এসব দিয়ে বানানো হয় হ্যামবার্গার। তবে অঞ্চলভেদে টপিংসগুলো ভিন্নরকম হতে পারে।
বর্তমানে আমাদের দেশেও বার্গার অনেক অনেক বেশি জনপ্রিয়। আমি নিজেও একজন বার্গার লাভার। ঢাকার চিলক্স, ম্যাডশেফ, টেকআউট, মি. মানিক আরো অনেক অনেক জায়গায় পাওয়া যায়।
রেসিপির লিংক : https://www.youtube.com/watch?v=iM_KMYulI_s
রোস্ট বিফ উইথ ইয়র্কশ্যার পুডিং (Roast Beef and Yorkshire Pudding), ইংল্যান্ড :
ইংল্যান্ডের মানুষরা তাদের রবিবারে লাঞ্চ বা ডিনার রোস্ট ছাড়া ভাবতে পারেন না। আটা, ময়দা, ডিম, দুধ দিয়ে বানানো এক ধরনের পুডিং হচ্ছে ইয়র্কশ্যার পুডিং। এটা সাধারণত, মেইন কোর্স খাওয়ার আগেই খাওয়া হতো। কারণ, অনেকেই আছেন যারা বিফ বা অন্য মাংস কেনার মতো অতো স্বচ্ছল না। তাই যাতে এটি খেয়েই পেট অনেকটুকু ভরে যেতে পারে সেজন্যই এই ব্যবস্থা! তবে বর্তমানে, রোস্ট বিফের সাথে এক প্লেটেই পরিবেশন করা হয়।
সাথে থাকে হালকা ভাজা কিছু সবজি, যেমন গাজর, শাকজাতীয় কিছু, রোস্টেড পটেটো ইত্যাদি। এছাড়া এর সাথে গ্রেভি হিসেবে এক ধরনের সস দেওয়া হয়।
১৭৯৮ সাল থেকে চালু হওয়া বিট্রিশ রেস্টুরেন্ট “লন্ডন রুলস” এ ট্র্যাডিশনাল এমন সব খাবারের জন্য বিখ্যাত। ব্রিটেনে ২০০৭ সাল থেকে ইয়র্কশ্যার পুডিং ডে উদযাপন করা হয় ফেব্রুয়ারির প্রথম রবিবারে।
রেসিপির লিংক : https://www.youtube.com/watch?v=xZ6PhPBMNgM
পুটিন (Poutine), কানাডা :
আমি নিশ্চিত এই খাবারটি সবারই খুব পছন্দের খাবার হবে! আমার তো নিঃসন্দেহে অন্যতম প্রিয় খাবার। এখনো মনে আছে, প্রথম খেয়েছি, চট্টগ্রামের এক ক্যাফেতে।
ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস তো সবারই পছন্দের তাই না? এই পুটিন হলো, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইসের উপর কিছু মাংসের কিমা সহ রান্না করা গ্রেভি দেওয়া এক ধরনের খাবার! শুধু তাই না, গ্রেভির সাথে আরো থাকে অনেক চিজ! আমি নিজেই বলছি এটা খুবই লোভনীয় একটি খাবার। এটির উৎপত্তি হয়েছে কানাডার কুইবেকে। বার্ষিক পুটিন উদযাপন করা হয় কানাডার মন্ট্রিলে।
তবে যারা এটা খেতে চাও তাদের এখন আর কষ্ট করে কানাডা যেতে হবে না। যেকোনো ফাস্টফুড রেস্টুরেন্টেই এটি পাওয়া যায়।
রেসিপি লিংক : https://www.youtube.com/watch?v=l7Q0TSnCiFU
কাবসা (Kabsa), সৌদি আরব :
আশা করি রেস্টুরেন্ট এবং ফুডগ্রুপ গুলোর সুবাদের এই নামটা তোমাদের কাছে পরিচিত। আরবের দেশগুলোতে এমনেও শাহী খাবার দাবারের জন্য বিখ্যাত। আমাদের দেশের মোগলাই খাবারের মতনই। আমাদের মত বিরিয়ানি প্রিয় মানুষের জন্য এটা অবশ্য চেখে দেখার মতো খাবার। মাংস, ভাত, নানান রকমের মশলার যেন সম্মিলন ঘটে এই রান্নাতে। কালো গোল মরিচ, জয়ফল, জয়িত্রী, তেজপাতা, দারচিনি, এলাচ এসব মশলা তো আছেই, পাশাপাশি বিভিন্ন বাদাম যেমন, কাজু বাদাম, কাঠবাদাম, চিনাবাদাম, কিশমিশ সব কিছু মিলিয়ে এটি একদম অনন্য সাধারণ এক খাবার। আবার মাংসের মধ্যেও হরেক রকমের মাংস আছে। মুরগী, গরু, খাসি, উটের মাংস, ভেড়ার মাংস।
এখন খাবার দাবারে কোনো ব্যারিয়ার নেই। তাই সব ধরনের খাবার সবজায়গাতেই কম বেশি পাওয়া যায়। তাই যারা কাবসা খেতে চাও তারা ধানমন্ডির বা পুরান ঢাকার যেকোনো জায়গাতেই পেয়ে যাবে!
রেসিপি লিংক : https://www.youtube.com/watch?v=hxTXHSt5j5A
ক্রেপ (Crepe), ফ্রান্স :
ক্রেপ কিরকম জানো? আমাদের পাটিসাপ্টা পিঠা আছে না অনেকটা ওইরকম। তবে তফাত হচ্ছে, পাটিসাপ্টার মতো ভিতরে ক্ষীর জাতীয় কিছু দেয়না, বরং এর ভিতরে থাকে কলা, নিউটেলা বা স্ট্রবেরি এই ধরনের ফল। আবার অনেক সময় ভিতরে পুর হিসেবে কিছু থাকেনা বরং ক্রেপসের উপর দিয়েই চকলেট সিরাপ বা ম্যাপেল সিরাপ দেওয়া হয়। সাথে কিছু ক্রিম উপরে সাজিয়ে দিলে তো আরো জোস! তবে লম্বাটে হয় না পাটিসাপ্টার মত, এটি হয় ত্রিভুজাকৃতির এবং তুলনামূলক বাদামী বর্ণের।
দুধ, ডিম, ময়দা দিয়ে তৈরি এই ফ্রেঞ্চ খাবারটিও তুমি আমাদের দেশের কফিশপগুলোতে পাবে।
রেসিপি লিংক : https://www.youtube.com/watch?v=RLHjdhP7waU
প্যাড থাই (Pad Thai), থাইল্যান্ড :
এটি হচ্ছে রাইস নুডুলস দিয়ে তৈরি একটি খাবার। ডিম, টফু দিয়ে এটি রান্না করা হয়। এছাড়া তেঁতুলের রস, পাম সুগার, ফিশ সস, লেবুর রস, শুকনো চিংড়ি মাছ, মরিচ ইত্যাদি দিয়ে বানানো হয়। মাঝে মাঝে এতে, কাঁকড়া, স্কুইড, চিকেন এসবও থাকে। আর এভাবেই তৈরি হয় অথেন্টিক থাই কারিটি।
ঢাকায় অনেক থাই রেস্টুরেন্ট আছে। এসবে এটি পাওয়া যায়।
রেসিপি লিংক : https://www.youtube.com/watch?v=m88rF0rwHo8
মিট পাই (Meat Pie), অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড :
নামেই পরিচয়! মিট পাই হচ্ছে এমন এক ধরনের পাই যার ভিতরে পুর হিসেবে থাকে মাংসের কিমা। মাংসের কিমার সাথে অনেক সময় চিজ, পেঁয়াজ, মাশরুম এসবও থাকে।
মিট পাই অস্ট্রেলিয়াতে ফুটবল এবং রাগবি দেখার সময় সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। সবার হাতে হাতেই নাকি মিট পাই থাকে খেলা দেখার সময়! ২০০৩ সালে নিউজিল্যান্ডে এটিকে জাতীয় খাবার হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।
রেসিপি লিংক : https://www.youtube.com/watch?v=0TKzJZQc6fI
বিফ নুডলস সুপ (Beef Noodle Soup), তাইওয়ান :
শুধু তাইওয়ান না, বর্তমানে এই সুপটি বাংলাদেশে অনেক বেশি পাওয়া যায়। ইউ কি সেন্টার বা ইয়াম চা ডিস্ট্রিক্ট এর মতো থাই, চাইনিজ, ক্যান্টনিজ রেস্টুরেন্টে গেলেই এটি পাওয়া যায়।
এটি হচ্ছে নুডুলস ক্লিয়ার সুপ, সাথে করে বিফ এবং টফু দেওয়া হয়। তাইওয়ানে এটি অনেক বড় বাটিতে পরিবেশন করা হয়। এবং এটাকেই মূল ডিশ বিবেচনা করা হয়। এর সাথে আর কোনো সাইড ডিশ থাকে না। প্রতিবছর, তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেতে অনুষ্ঠিত হয় বিফ নুডলস সুপ ফেস্টিভ্যাল যেখানে শত শত শেফরা আসেন এবং তাদের মধ্যে প্রতিযগিতা হয়। ফলে নানা রকমের বিফ নুডলস পাওয়া যায় সেখানে। আর যেই শেফের রান্না সবচেয়ে ভালো হয় তার ডিশটি “বেস্ট বিফ নুডল ইন তাইওয়ান” খেতাব পায়।
রেসিপি লিংক : https://www.youtube.com/watch?v=uLGkYRx7V7k
ববটি (Bobotie), সাউথ আফ্রিকা :
শেষ করব এই উদ্ভট নামের জাতীয় খাবার দিয়ে। এটি আসলে এক ধরনের বেকড আইটেম। এটার মধ্যে থাকে মাংসের কিমা এবং ডিম। মাংসের কিমা অনেক মশলা দিয়ে ঝাল করে রান্না করা হয়। তারপর ধাপে ধাপে বাটিতে মাংসের পর দুধ, ডিম দিয়ে বেক করা হয়।
রেসিপি লিংক : https://www.youtube.com/watch?v=WW-PDbGJTBY
আমাদের দেশে এখনো এই খাবার পাওয়া যায় বলে আমার তেমন ধারণা নেই। আমার কাছে মনে হয় পৃথিবীতে খাবারের ধরনের অভাব নেই। ভিন্ন ভিন্ন দেশ, তাদের ভিন্ন ভিন্ন টেস্ট। ভিন্ন দেশের মানুষের ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের তৈরি হয় একটার চেয়ে একটা মুখোরোচক খাবার। আমি হয়তো অনেকগুলো দেশের জাতীয় খাবারের কথাই লিখতে পারি নি! কারণ লিখতে গেলে আমি পুরো একটি বই লিখে ফেলতে পারব! এত এত দেশ! তাদের এত এত মজার মজার খাবার! সেটা তোমাদের উপরই ছেড়ে দিলাম না হয়। তোমরা যারা আমার মতো ভোজনরসিক মানুষ আমি নিশ্চিত তারা এই ব্লগটা পরে অন্যান্য দেশের জাতীয় খাবার নিয়েও উৎসাহ জাগবে। তো দেরি না করে গুগল করে জেনেই নাও না আরো কি কি মজার মজার খাবার আছে। আর যারা রাঁধুনি বা নতুন নতুন শেফ হওয়ার প্রচেষ্টাতে আছো তারা রেসিপির ভিডিও দেখে টুকটাক বানিয়ে ফেলো!
তথ্যসূত্র
১। https://tastessence.com/list-of-national-dishes-around-world
২। https://www.reachtoteachrecruiting.com/national-dish-by-country
৩। https://www.nationalgeographic.com/travel/top-10/national-food-dishes/
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: [email protected]