আমার সাত বছর বয়সের ছোট্ট একজন বন্ধু আছে।
ভীষণ সুন্দর গান গাইতে পারে সে ! আপনাকে আরও জানিয়ে রাখি, এইটুকু বয়সেই বর্গ সংখ্যার ধারণাটাও সে বেশ ভালোভাবেই বুঝে ফেলেছে।
কিন্তু বিধিবাম! নাম ধরে ডাকলে আমার বন্ধু সাড়া দেয় না! আদর করলে সে নির্বিকার থাকে, কোনো পাত্তাই দেয় না!
সমবয়সী খুব কমই বন্ধু আছে তার। সারাক্ষণ আপন মনে সে কী যেন চিন্তা করে , আর তার অসম্ভব রকমের প্রিয় খেলনা প্লেনের চাকা ঘুড়িয়ে সে যেই আনন্দ পায় সেটি দেখার মতো ! দুই বছর বয়স থেকেই আমার বন্ধুর এমন সব অস্বাভাবিক আচরণ প্রকাশ পেতে থাকে।
আমার এই অদ্ভুতুড়ে বন্ধুর দলে আরও অনেক মানুষ আছে যাদের মস্তিষ্ক স্নায়ুগত কিছু সমস্যার কারণে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারেনা। আর এই জটিলতার কারণে নিজের মনের ভাবটাও তারা ঠিক ভাবে প্রকাশ করতে পারেনা। যার ফলে সমাজে চলাফেরা করতে তারা হাজার রকমের বাধার সম্মুখীন হয়।
আমাদের সমাজের এই বিশেষ শ্রেণীর নাম অটিস্টিক। আর এই রোগটির নাম অটিজম।
“কিন্তু অটিজম কোন ধরনের রোগ?”
আসলে অটিজম কোনো রোগ নয়।
অটিজমের আদ্যোপান্ত জানতে পারলে আপনার প্রশ্নের এমন উত্তর খুবই স্বাভাবিক বলে মনে হবে।
অটিজম কীঃ
অটিজম কী সেটি জানার আগে স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার।
স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার হোল এক ধরনের মানসিক জটিলতা যেখানে অনেক ধরনের মানসিক সমস্যা একসাথে যুক্ত থাকতে পারে। আর অটিজম এক ধরনের স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার। এই সমস্যাটির পুরোনাম
অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (Autism Spectrum Disorder)।
অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার হোল এক ধরনের নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার যেখানে অনেক ধরনের মানসিক সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতা একসাথে ঘটতে পারে। এই ধরনের নিউরোলজিকাল বা স্নায়ুবিক সমস্যার কারণে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় যার সাথে মানসিক বিকাশগত জটিলতাও প্রকাশ পায়। এই সমস্যার কারণে জন্মের পরের ১৮ মাস থেকে ৩ বছর বয়সের মধ্যেই শিশুর আচরণগত এবং মানসিক সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয় যার ফলে কথা বলা বা ঠিক মতো শব্দ উচ্চারণ করা, নতুন জিনিস বুঝতে পারা বা শেখা কিংবা সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলা শিশুর জন্য বেশ বড়সড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়!
১৯০৮ সালে “অটিজম’ শব্দটি সর্ব প্রথম ব্যবহার করেন সাইকিয়াট্রিস্ট ইউজেন ব্লিউলার।আর অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার ASD) ধারণার জন্ম দেন অস্ট্রিয়ান মেডিকেল থিয়োরিস্ট হ্যানস অ্যাসপারগার এবং আমেরিকান শিশু মনোবিজ্ঞানী লিও ক্যানার। লিও ক্যানার ১৯৪৩ সালে ১১ জন শিশুকে নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁর গবেষনায় দেখা যায়, ওই সকল শিশুদের স্মৃতি, সামাজিক সম্পর্ক তৈরি ,ডাক দিলে সাড়া না দেয়া, সহনশীলতা, বুদ্ধিমত্তা, দক্ষতা,একই কথার পুনরাবৃত্তি ইত্যাদি সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে।
সাধারণত ছেলে শিশুরাই এই ধরনের সমস্যায় বেশি ভোগে। প্রতি ২৫০ জন শিশুর মধ্যে একজন শিশু অটিস্টিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সবচেয়ে অবাক বিষয় হোল, এতো প্রতিবন্ধকতার সত্ত্বেও অটিস্টিকরা নিম্ন বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন হয় না।
এরা গড় বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন হয়ে থাকে এবং কিছু ক্ষেত্রে এরা উচ্চ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন হয়। আর তখনি একজন অটিস্টিক তার পছন্দের বিষয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে যায়!
অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারগুলো কীঃ
আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এ্যাসোসিয়েশন থেকে প্রকাশিত Diagnostic Statistical Manual for Mental Disorders বইটি মানসিক সব ধরনের জটিলতা সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা দিয়ে থাকে। এই বইটির ৫ম সংস্করণে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের অন্তর্ভুক্ত ডিসঅর্ডারগুলো কি কি সেই বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
ডিসঅর্ডারগুলো হচ্ছেঃ
অটিস্টিক ডিসঅর্ডারঃ (Autistic disorder)
এই ডিসঅর্ডারটি সবরকমের মানসিক জটিলতার সমন্বয়। এর অপর নাম “হাই ফাংশনিং অটিজম”।
স্নায়ুগত সমস্যার কারণে ভাষাগত জটিলতা, সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনীহা, কিংবা অদ্ভুত সব অভ্যাস আর জিনিসের প্রতি আকর্ষণ- সবই এই ডিসঅর্ডারের অন্তর্ভুক্ত।
GIF: Gifycat
অ্যাসপারগার ডিসঅর্ডার (Asperger Disorder)
GIF: Odyssey
এক্ষেত্রে ভাষাগত এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো জটিলতা থাকে না। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা আর অস্বাভাবিক আচরণ এই ডিসঅর্ডারের অন্তর্ভুক্ত। এরা সাধারণত মাঝারি কিংবা উচ্চ বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন হয়ে থাকে। নিজের পছন্দের বিষয়ে, কোনো ধাঁধা কিংবা সমস্যার সমাধানে এরা বেশ দক্ষ হয়ে থাকে!
পারভেসিভ ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার (Pervasive Developmental Disorder):
এই ক্ষেত্রে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে কিংবা ভাষা আদান প্রদানে জটিলতা দেখা যায়। এছাড়া আর অন্য কোনো সমস্যা দেখা যায় না। এদেরকে PDD-NOS বলা হয়ে থাকে। NOS বলতে এখানে Not otherwise Specified বোঝানো হয়েছে। এদের ক্ষেত্রে মানসিক জটিলতার মাত্রা খানিকটা কম।
GIF: Spectrum, Autism Research Institute
অটিজম কেন হয়?
অটিজমের অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হতে পারে জন্মের সময় নার্ভাস সিস্টেমে আঘাত লাগা। অটিজমের জেনেটিক কারণ হিসেবে ক্রোমোজোমের অস্বাভাবিক অবস্থা “7q11.23”কে দায়ী করা হয়। যেসব শিশু একটির বেশি 7q11.23 বহন করে, তাদের ক্ষেত্রে ক্রোমোজোম 7 এর অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। জেনেটিক কোডিংএর এই অবস্থার কারণে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের সম্মুখীন হতে হয়।
বংশগত কারণে অটিস্টিক হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। পরিবেশগত কারণেও কোনো শিশু অটিজম সমস্যায় ভুগতে পারে। এছাড়াও গর্ভকালীন অবস্থায় মায়ের বিশেষ কিছু ঔষধ সেবন, যেমনঃ থ্যালিডোমাইড (thalidomide) এবং ভালপ্রোয়িক (valproic) এসিড সেবনের কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অটিস্টিক বাচ্চার জন্ম হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অটিজমের ও অটিস্টিকঃ লক্ষণগুলো কী?
অটিজমের অনেকগুলো লক্ষণ রয়েছে যেগুলা জন্মের পরের ৩ বছরের মধ্যে ধরা পড়লে বুঝতে হবে যে শিশুটি অটিস্টিক।
অটিস্টিক শিশুর লক্ষণঃ
- নাম ধরে ডাকলে আমার বন্ধুটির মতো সাড়া না দেয়া। স্বাভাবিক শিশু জন্মের এক বছরের মধ্যেই নিজের নাম শুনলে বুঝতে পারে এবং নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয়।
- একা থাকতে চাওয়া কিংবা কার সাথে না মিশতে চাওয়া।
- একই শব্দ বা কথা বারবার উচ্চারণ করা।
- সমবয়সী বন্ধুদের সাথে কম মিশতে চাওয়া।
- হঠাৎ মনের ভাব পরিবর্তন হওয়া। ইংরেজিতে এর নাম বাইপোলার ডিসঅর্ডার।
- মনোযোগের অভাব। একে (attention deficit hyperactivity disorder ADHD) বলে।
- কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে অনীহা।
- কোনো প্রশ্নের অপ্রাসঙ্গিক উত্তর দেয়া।
- অস্বাভাবিক বিষয়ে আগ্রহ থাকা।
- অস্বাভাবিক শব্দ করা।
- দেরি করে কথা বলতে শেখা।
- ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা।
- নিজের চাহিদা প্রকাশ করতে না পারা।
- নতুন রুটিন কিংবা কোনো পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে না পারা।
GIF:make a gif
অটিজম চিকিৎসাঃ
আমাদের সমাজের প্রচলিত ভুল ধারণা হচ্ছে অটিজম কখনো ভালো হয় না এবং এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী চিকিৎসা আর সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব এই সমস্যাটিকে খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। অটিস্টিক শিশুর প্রথম চিকিৎসা হোল তার সমস্যাটি খুঁজে বের করা।
অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের জটিলতাগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ কিছু জনপ্রিয় থেরাপি রয়েছে। যেমনঃ
অকুপেশনাল থেরাপিঃ (occupational Therapy)
দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্মের ক্ষেত্রে যাতে কোনো অসুবিধায় পড়তে না হয় সেই জন্যই এই থেরাপি। এই থেরাপিতে শিশুদের খাবার সময় ঠিক মতো চামচ ধরা কিংবা জামার বোতাম আটকানো থেকে শুরু করে স্কুলের কাজ, খেলাধুলাসহ যাবতীয় বিষয় সমন্ধে শেখানো হয়। উদ্দেশ্য হচ্ছে শিশুরা নিজেরাই যেন নিজের ন্যূনতম প্রয়োজনটুকু মেটাতে পারে।
ছবিঃ speech and occupational therapy of north texas, hotfrog,the independent bd
স্পীচ থেরাপিঃ (speech therapy)
ছবিঃ Verywell Health
এই থেরাপি শিশুদের সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করে। এই ক্ষেত্রে শিশুদের সাংকেতিক ভাষা বা ছবির মাধ্যমে কথা বলা শেখানো হয়। চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা অর্থাৎ আই কন্টাক্ট এর ব্যাপারটিও এই থেরাপির মাধ্যমে শেখানো হয়ে থাকে।
অ্যাপ্লাইড বিহেভিয়ার এনালাইসিসঃ (Applied Behavior Analysis (ABA)
এই থেরাপিতে অটিস্টিক শিশুদের বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে এবং কাজটি কয়েকটি ধাপে শেষ করার জন্য শিশুদেরকে উদ্বুদ্ধ করা হয়। ঠিকমতো কাজটি শেষ করতে পারলে শিশুকে পুরস্কারও দেয়া হয়। এই পদ্ধতিতে অটিস্টিক শিশুদের মানসিক অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে নাকি সেই বিষয়েও লক্ষ রাখা হয়।
এই থেরাপির কয়েকটি পদ্ধতি আছে। যেমনঃ
ডিসক্রিট ট্রায়াল ট্রেনিং (DiscreteTrialTraining): এই পদ্ধতিতে অটিস্টিক শিশুদের জন্য বড় কাজগুলোকে ছোট কয়েকটি ধাপে ভাগ করে দেয়া হয়।
আর্লি ইন্টেনসিভ বিহেভিওরাল ইন্টারভেনশন (Early Intensive Behavioral Intervention): ৫ বছরের কম বয়সী অটিস্টিক শিশুদের মানসিক উন্নতির জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
পিভোটাল রেসপন্স ট্রেনিং (Pivotal Response Training): এই পদ্ধতিতে শিশুদেরকে নতুন জিনিস শিখতে আগ্রহী করে গড়ে তোলা হয়। নিজের নিয়ন্ত্রণ অটিস্টিক শিশু যাতে নিজেই করতে পারে সেই বিষয়ে এখানে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিতে থেরাপির ফলে অটিস্টিক শিশু সামাজিকভাবে তার যোগাযোগের উপায়গুলোকে আরো উন্নত করতে পারে। যেমনঃ সমবয়সীদের সাথে মিশতে পারা, ডাক দিলে সাড়া দেয়া ইত্যাদি।
ভার্বাল বিহেভিওর ইন্টারভেনশন (Verbal Behavior Interviention): অটিস্টিক শিশুদের ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা দূর করতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
ছবিঃ Northern Michigan University
ট্রিটমেন্ট অ্যান্ড এডুকেশন অফ অটিস্টিক অ্যান্ড রিলেটেড কমিউনিকেশন হ্যান্ডিক্যাপড চিলড্রেন মেথড (TEACCH): এই অটিজম সম্পর্কিত প্রোগ্রামটি ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলিনার উদ্যোগে গঠিত। অটিস্টিক শিশুদের নিজস্ব কিছু চিন্তা ভাবনা, প্রতিভা বা গুণ থাকে। এই পদ্ধতিতে সেই প্রতিভা বা গুণকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে নতুন কাজ শেখা যায় সেই ব্যাপারে শিশুদেরকে উৎসাহী করে তোলা হয়।
এছাড়া পারস্পরিক সহযোগিতা এবং অটিস্টিক শিশুদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন মনোভাব অটিজম সংক্রান্ত জটিলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে।
অটিজম ও বাংলাদেশঃ
ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিসঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা) এর উদ্যোগে দেশব্যাপী অটিজম এর ব্যাপারে জরীপ চালানো হয়। জরীপে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে ১৬ থেকে ৩০ মাস বয়সী শিশুদের মাঝে অটিজম বিস্তারের হার প্রতি ১০ হাজারে ১৭ জন। সংখ্যাটিই আপাত দৃষ্টিতে কম মনে হলেও বাংলাদেশে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু দেশে যেই হারে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা বাড়ছে, সেই অনুপাতে অটিস্টিক শিশুদের স্কুলের সংখ্যা বাড়ছে না। অটিস্টিক শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ স্কুল না থাকায় তারা শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে পড়ছে।
অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষাক্ষেত্রে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগের পাশপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে বেসরকারিভাবেও বিভিন্ন এনজিও বা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিশেষায়িত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এসকল বেসরকারি উদ্যোগকে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা, সহায়তা প্রদান এবং উদ্বুদ্ধ করার জন্য সরকার ‘প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা-২০০৯’ প্রণয়ন করেছে। অটিস্টিক শিশুদের জন্য এইসব বিশেষায়িত বিদ্যালয়সমূহের মধ্যে রয়েছে সুইড বাংলাদেশ (Society for the Welfare of the Intellectually Disabled, Bangladesh) পরিচালিত ৪৮টি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন পরিচালিত ৭টি ইনক্লুসিভ বিদ্যালয় এবং প্রয়াস পরিচালিত অটিস্টিক শিশুদের বিদ্যালয়।
এছাড়াও আরো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান প্রতিনয়ত অটিস্টিক শিশুদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। যেমনঃ
- স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন- তরি ফাউন্ডেশন।
- বাংলাদেশ ডাউন সিন্ড্রোম এসোসিয়েশন।
- অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন।
- সূচনা ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।
এসকল উদ্যোগের পাশাপাশি বাংলাদেশে অটিস্টিক শিশুদের দৈনন্দিন জীবনে সাহায্য করার জন্য রয়েছে “অটিজম বার্তা” নামক একটি অ্যাপ। অ্যাপটি দ্বারা পরীক্ষার মাধ্যমে কোনো শিশুর অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা প্রকাশ পেলে তার খবর নিকটস্থ অটিজম সেন্টারে সয়ংক্রিয়ভাবে পাঠানো করা হয়। এর পাশাপাশি শিশুর অভিভাবককে পরবর্তী করনীয় সম্পর্কে জানানো হয়। অ্যাপটির মাধ্যমে শিশুর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা ও পরবর্তীতে সময়মত বাবা-মাকে মোবাইলে জানানো হয়। পাশাপাশি অটিজম বিষয়ক সামাজিক সচেতনতা এবং এই বিষয়ে সবাইকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা “অটিজম বার্তা” অ্যাপটির অন্যতম লক্ষ্য।
ঢাকার কোথায় অটিজম স্কুল আছে?
রাজধানী ঢাকার বেশ কিছু জায়গায় অটিস্টিক শিশুদের জন্য বিশেষায়িত স্কুল রয়েছে।
রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে রয়েছে এ্যাডভান্সড স্কুল ফর স্পেশাল চিলড্রেন
যেখানে অটিস্টিক শিশুদের অত্যন্ত যত্ন সহকারে দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সব কাজই শেখানো হয়। এছাড়া ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় রয়েছে অটিস্টিক শিশুদের বিশেষায়িত স্কুল “প্রয়াস”। এ স্কুলে জাতীয় পাঠ্যক্রমের কর্মসূচি অনুযায়ী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পাশাপাশি অটিস্টিক শিশুদের জন্য রয়েছে ব্রিটিশ পাঠ্যসূচি অনুযায়ী ইনক্লুসিভ ইংরেজি মাধ্যম। এছাড়া কারিগরি ও ভকেশনাল শিক্ষাও চালু রয়েছে এখানে । স্কুলটির লক্ষ্য হচ্ছে অটিস্টিক শিশুদের সর্বোচ্চ বিকাশ নিশ্চিত করা। আরো রয়েছে খিলগাঁও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক স্কুল যেটি ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় অবস্থিত। স্কুলটি সুইড বাংলাদেশের অধীনে পরিচালিত হয়ে থাকে। ঢাকার গুলশানে রয়েছে রেইনবো অটিজম কেয়ার ফাউনডেশন।
প্রয়াস স্কুলের অটিস্টিক শিশুদের যাবতীয় সব কার্যক্রম দেখতে ঘুরে আসতে পারেন এই লিঙ্কটিতে
লিঙ্কঃ https://youtu.be/uHr-mBPfLdA
ঢাকার বারিধারায় অটিস্টিক শিশুদের সার্বিক বিকাশের জন্য রয়েছে ইউনিক গিফট ফাউনডেশন।
তাঁদের কার্যক্রমগুলো দেখতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন এই ওয়েবসাইটটিতেঃ
লিঙ্কঃ http://uniquegiftbd.com/index
অটিস্টিক শিশুদেরকে দৈনন্দিন কাজগুলো ইউনিক গিফট ফাউনডেশন কিভাবে শেখায় তা দেখতে চাইলে এই লিঙ্কটিতে যেতে হবেঃ
লিঙ্কঃ https://youtu.be/nw8A9gVrRTg
ছবিঃ youtube.com
অটিস্টিক মানেই কি সমাজের বোঝা?
শুরুতে কিছু উদাহরণ দিয়ে আপনার ধারণা পাল্টানোর চেষ্টা করি।
ছবিঃ WBAA
ছবির ব্যক্তিটির নাম মোজার্ট। ১৭৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করা দুনিয়াজুড়ে সমাদৃত এই মিউজিক প্রডিজি ছিলেন অটিস্টিক। ইম্পালস কন্ট্রোল ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ছিলেন মোজার্ট আর তাই নিজের উপর মোটেই নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারতেন না। কিন্তু নিজের অসামান্য প্রতিভার জায়গাটিতে ছাড়িয়ে গেছেন প্রায় সবাইকেই!
ছবিঃ earthsky.org
ছবিঃ history.com
চোখ কি কপালে উঠলো?
বামপাশের মানুষটি সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন আর ডানপাশের মানুষটি অসামান্য প্রতিভাধর স্যার আইজ্যাক নিউটন। অক্সফোর্ড আর ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির প্রোফেসর ইউয়ান জেমস এবং সিমন বেরন কোহেন এই দুই মহান বিজ্ঞানীর স্বভাব এবং বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করেন এবং শেষে যেই সিদ্ধান্তে তারা পৌঁছান সেটি হোল- আলবার্ট আইনস্টাইন এবং আইজ্যাক নিউটন উভয়ই পারভেসিভ ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডারের অ্যাসপারগার সিনড্রোমে আক্রান্ত ছিলেন।
আমার কথা বিশ্বাস না হলে এই দুই বাঘা প্রোফেসরের যুক্তিগুলো দেখতে পারেন এই লিঙ্কটিতেঃ
লিঙ্কঃ https://www.verywellhealth.com/einstein-newton-and-asperger-syndrome-2860279
তালিকায় আরো রয়েছেন অস্কারজয়ী অভিনেতা স্যার অ্যানথনি হপকিন্স, এলিস ইন ওন্ডারল্যান্ড এর লেখক লুইস ক্যারল, কালজয়ী কেমিস্ট হেনরি ক্যাভেন্ডিস, বিবর্তনবাদের প্রবক্তা চার্লস ডারউইন, গ্র্যান্ডমাস্টার এবং বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়ন ববি ফিশার, কিংবা নিকোলাস টেসলার মতো অবিনশ্বর বিজ্ঞানী।
তালিকা কিন্তু শেষ না। এই তালিকায় অন্তত আরো কয়েকশ কালজয়ী মানুষের নাম রয়েছে যারা নিজেদের সব প্রতিবন্ধকতাকে ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছেন বিশ্বসেরা।
কিংবা আমার সাত বছর বয়সের ছোট্ট বন্ধুটির কথাই ভাবুন না! সাত বছর বয়সে আপনি এতো সুন্দর গান গাইতে পারতেন ? বর্গ সংখ্যার ধারনাটা এই বয়সে আপনার ছিল কি ?
আমাদের এই অদ্ভুত বন্ধুদের প্রতি একটুখানি সহযোগিতার হাতই কিন্তু পারে তাদেরকে অনিন্দ্য অসাধারণ করে গড়ে তুলতে।
আর তাই আমার বন্ধুর মতো এইসব অটিস্টিক শিশুদের একটি বিশ্বজয়ী নাম আছে !
এরা প্রত্যেকেই আমদের “স্পেশাল চাইল্ড” !
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন