ক্যারিয়ার কী?
ক্যারিয়ার বলতে মূলত পেশাজীবনকে (Professional Life) বুঝায়। বিস্তৃত অর্থে জীবিকা বা নিজের চাহিদা পূরণের জন্য একজন মানুষ যেসব শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ, দক্ষতা, সামর্থ্য ইত্যাদি অর্জন করে থাকেন তাকে ক্যারিয়ার বলা যাতে পারে। যেমন: একজন ডাক্তার, শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিত্রশিল্পী, লেখক হিসেবে কাজ করাটা তাদের স্ব স্ব ক্যারিয়ারকে নির্দেশ করে।
তবে ক্যারিয়ারকে আরেকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। সমগ্র কর্মজীবনে পেশা সংক্রান্ত যেসব ক্রমোন্নতি ঘটে বা উন্নতির লক্ষ্যে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় ক্যারিয়ার হল তার সমন্বিত রূপ। এর মধ্যে থাকতে পারে জীবনের দীর্ঘ সময় ধরে করা ছোট-বড় বিভিন্ন চাকরি, পদবী, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি।
মূলত পেশা ও পেশা সংক্রান্ত অগ্রগতির সামগ্রিক ধাপই হলো ক্যারিয়ার।
ক্যারিয়ার আর চাকরি কি এক?
চাকরি এবং ক্যারিয়ার দুটোরই লক্ষ্য পর্যাপ্ত অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে আমাদের নিজেদের চাহিদা পূরণ করা হলেও দুটো এক জিনিস নয়। ক্যারিয়ার প্ল্যানিং এর আগে এটা জানা জরুরি যে আপনি আসলে কী চান, শুধুমাত্র একটি চাকরি নাকি সামগ্রিকভাবে একটি সফল ক্যারিয়ার।
চাকরি ও ক্যারিয়ারের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো, চাকরি তাই যা আপনি শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্য করেন আর ক্যারিয়ার হল একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রয়াস, যা পূরণের লক্ষ্যে আপনি প্রতিদিন কাজ করেন। বলা যায়, চাকরি একটি ভূমিকা মাত্র, যেখানে ক্যারিয়ার হল ভূমিকা, অভিজ্ঞতা, শিক্ষা; সর্বোপরি লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে পথগুলো একজন গ্রহণ করেন তার সমন্বয়।
ক্যারিয়ার জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। আপনার এক ক্যারিয়ার জীবনে আপনি অসংখ্য চাকরির সাথে যুক্ত হতে পারেন।
ক্যারিয়ার প্ল্যানিং কেন জরুরি?
ক্যারিয়ার প্ল্যানিং বা ক্যারিয়ার পরিকল্পনা হল মানুষের প্রফেশনাল জীবনের রোড ম্যাপ বা মানচিত্র। কর্মক্ষেত্রে থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি সফল ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে সাহায্য করে ক্যারিয়ার প্ল্যানিং।
ক্যারিয়ার প্ল্যানিং ব্যক্তি জীবন এবং কাজের পরিবর্তনগুলো পরিচালনা করার একটি ব্যবহারিক উপায়। একজন ব্যক্তির নিজস্ব পরিচয় তৈরি করা থেকে শুরু করে সফল হিসেবে গড়ে তোলে একটি সফল ক্যারিয়ার এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে প্রয়োজন একটি সুন্দর ক্যারিয়ার প্ল্যানিং।
কীভাবে করবেন ক্যারিয়ার প্ল্যানিং?
ক্যারিয়ার নিয়ে তো অনেক কিছুই জানা হল। এবার সামনে এগোনোর পালা। এত এত অপশন থেকে কীভাবে নিজের জন্য সঠিক ক্যারিয়ার নির্বাচন করা যায়? আর কীভাবে পরিকল্পনা করলে ক্যারিয়ার নামক সোনার হরিণকে পোষ মানিয়ে নিজের হাতে নিয়ে আসাটা সহজ হয়ে যায়?
ক্যারিয়ার প্ল্যানিং করার উপায়গুলো নিয়েই আজকের আলোচনা।
১। জানতে হবে নিজেকে
ক্যারিয়ার প্ল্যানিং এর প্রথম ধাপটাই হলো নিজেকে জানা। আপনার প্রয়োজন, চাহিদা, দক্ষতা, সামর্থ্য, আকাঙ্ক্ষা, প্রতিভা, আগ্রহ ইত্যাদি সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখাটা জরুরি-
-
নিজেকে মূল্যায়ন:
আপনি কত বেতন বা স্যালারি আশা করছেন তার সঠিক ধারণা থাকা প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেক দক্ষতা এবং পরিশ্রম করা সত্ত্বেও আশানুরূপ স্যালারিটা অনেকে পান না। এতে চাকরি জীবনে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী নিজেকে মূল্যায়ন করতে পারাটা জরুরি। সেই সাথে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন থাকাটাও জরুরি। আপনি একাকী কাজ করতে চান নাকি দলগত কাজে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, সমাজ এবং দেশের প্রতি আপনার কাজের প্রভাব কতটা বা আপনি কীভাবে প্রভাব রাখতে চান, এ সম্পর্কেও ধারণা রাখতে হবে।
-
আগ্রহ মূল্যায়ন:
কাজের ব্যাপারে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি, পছন্দ-অপছন্দের জায়গাটা জানতে হবে। কেননা সেই অনুযায়ী যদি আপনি ক্যারিয়ার নির্বাচন না করেন তাহলে কর্মক্ষেত্রে প্রেষণা আসে না। আপনি অনুসন্ধানী, বাস্তবসম্মত, সামাজিক, শৈল্পিক, উদ্যোগী নাকি প্রচলিত ধারার ক্যারিয়ার চান সেই সিদ্ধান্ত অবশ্যই আপনার আগ্রহের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে নেয়া উচিত।
-
যোগ্যতা মূল্যায়ন:
নতুন ক্যারিয়ার শুরু করতে কতটুকু সময়, অর্থ, শ্রম বা প্রচেষ্টা ব্যয় করতে চান সে সম্পর্কে সুষ্ঠু ধারণা রাখতে হবে। কর্মক্ষেত্রে আপনার গুণাবলি, সামর্থ্য এবং দুর্বলতার জায়গা, ক্ষমতা এ সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা রাখতে হবে। সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, শিক্ষা বা দক্ষতা দরকার হলে তা অর্জন করে নিতে হবে।
২। ক্যারিয়ার রিসার্চ এবং বিশ্লেষণ
নিজের যোগ্যতা, গুণাবলি এবং দক্ষতার জায়গা চিহ্নিত করার পর কোন ধরনের ক্যারিয়ার নিয়ে আপনি এগোতে চান সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আপনার চাহিদা অনুযায়ী আপনার পছন্দের সম্ভাব্য ক্যারিয়ার অপশনগুলো নিয়ে একটি তালিকা বা লিস্ট তৈরি করে নিতে পারেন। অবশ্যই কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ, দায়িত্ব, নিজের দক্ষতা বৃদ্ধি, অগ্রগতির বিষয়গুলো মাথায় রেখেই লিস্টটি করতে হবে।
এরপর লিস্টে থাকা ক্যারিয়ার অপশনগুলো সম্পর্কে জেনে নিতে হবে। প্রতিটি পেশার সাধারণ বিবরণ, বেতন, সাধারণ সুবিধা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা এবং সমস্ত চাহিদা পূরণের পরে নিয়োগের সম্ভাবনা কতটুকু এ সবই বিবেচনায় রাখতে হবে।
এক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। আপনার সেই ক্যারিয়ার সম্পর্কিত যত প্রশ্ন আছে তা জিগ্যেস করুন। এতে ভালো নেটওয়ার্কিং ও সৃষ্টি হয়। তাছাড়া ক্যারিয়ারকেন্দ্রিক প্ল্যাটফর্মগুলোর সাহায্যও চাইলে নেয়া যেতে পারে। কোম্পানিগুলোর রিভিউ দেখেও অনেক বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়।
ভলান্টিয়ারিং, ইন্টার্নশিপ, পার্ট টাইম জব সরাসরি আপনার ক্যারিয়ার বিশ্লেষণে সহায়তা করবে। তাই এই সুযোগগুলো হাতছাড়া করা যাবে না। আপনার পছন্দের ক্যারিয়ার সংক্রান্ত কোর্স করেও ক্যারিয়ার শিক্ষাটা নিয়ে নিতে পারেন।
৩। ক্যারিয়ার নির্বাচন
ক্যারিয়ার নিয়ে রিসার্চ ও বিশ্লেষণ দুটোই শেষ। এবার চূড়ান্তভাবে ক্যারিয়ার নির্বাচনের পালা। চাইলে ক্যারিয়ার অপশনগুলো অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সাজিয়ে নিতে পারেন। আপনার দক্ষতা বৃদ্ধি এবং অগ্রগতির সাথে সাথে অবশ্যই ক্যারিয়ার অপশনগুলো আপডেট করার চেষ্টা করবেন। একই ধরনের বিকল্প ক্যারিয়ারগুলো সম্পর্কে ভাবতে ভুলবেন না।
ক্যারিয়ার নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেসব বিষয়ে লক্ষ্য রাখা উচিত তা জানতে পড়ে ফেলতে পারেন আমাদের এই ব্লগটি।
৪। চূড়ান্ত পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ
ক্যারিয়ার নির্বাচন করা হয়ে গেলে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি-
-
স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নির্ধারণ:
ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকলেও দেখা যায় বেশিরভাগই সেই লক্ষ্য বা গোলগুলো সম্পর্কে উদাসীন থাকে। অথচ চূড়ান্তভাবে আপনার পছন্দের ক্যারিয়ারকে হাসিল করতে সেই সম্পর্কিত যেসব স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য (Short and Long-Term Goals) থাকে তা অর্জন করা প্রয়োজন। এই লক্ষ্যের মধ্যে থাকতে পারে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা, স্কিল ডেভেলপমেন্ট বা দক্ষতা অর্জন ইত্যাদি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আপনি যদি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চান অবশ্যই প্রথমে আপনার নির্দিষ্ট কিছু সফটওয়ার সম্পর্কিত শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ দরকার হবে।
লক্ষ্য নির্ধারণের পর কোনো লক্ষ্য অর্জন করার জন্য কতটুকু সময় দেয়া দরকার তা আগে থেকেই পরিকল্পনা করে নেয়া উচিত। দরকার হলে ডেডলাইন সেট করে নিতে হবে।
-
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা:
লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে কী কী বাঁধা আসতে পারে সে সম্পর্কে সুষ্ঠু ধারণা নেয়ার চেষ্টা করতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ, কারো কারো অর্থনৈতিক অসুবিধা থাকতে পারে, ব্যর্থ হওয়ার অভিজ্ঞতা থাকতে পারে। তাছাড়া ব্যক্তিগত, পারিবারিক ইত্যাদি নানা ধরনের সমস্যা বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে।
এই বাধা বা চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। অভিজ্ঞ কারো সাথে কথা বলা, দক্ষতা অর্জন, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি কিংবা প্রয়োজনে কাউন্সেলিং গ্রহণ করা যেতে পারে।
-
অগ্রগতি বিশ্লেষণ:
ছোট বা বড়, লক্ষ্য যেমনই হোক না কেন, সেই লক্ষ্য পূরণে আপনার অগ্রগতি কেমন তা চিহ্নিত করুন। সময় মতো কাজগুলো শেষ করা এবং একেকটি কাজের জন্য নিজেকে উপহার দেয়া যেতে পারে। এতে যেমন কাজ করার আগ্রহ এবং গতি বৃদ্ধি পায় তেমনই আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যায় বহুগুণে।
৫। চাকরি অনুসন্ধান
ক্যারিয়ার প্ল্যানিং অনুযায়ী এবার চাকরি খোঁজার পালা। আপনার দায়িত্ব বা ভূমিকা, নির্দিষ্ট কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে আগ্রহীরা শনাক্ত করা এবং তা আপনার ক্যারিয়ারের জন্য উপযুক্ত কিনা তা অবশ্যই খেয়াল করতে হবে। আবেদনের জন্য আরও কোনো স্কিল অর্জন করা দরকার কিনা সে বিষয়েও লক্ষ্য রাখতে হবে। একটি সুন্দর ও আপডেটেড সিভি এক্ষেত্রে আপনাকে অন্যান্যদের থেকে আরও এগিয়ে রাখতে পারে।
ক্যারিয়ার নিয়ে বেশিরভাগ মানুষেরই অসন্তোষের শেষ নেই। ক্যারিয়ার প্ল্যানিং-এর এই ধাপগুলো অনুসরণ করে এগিয়ে চলুন সফল ক্যারিয়ারের লক্ষ্যে। সেই সাথে এই প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে হয়ে উঠুন অনন্য।
আপনার কমেন্ট লিখুন