আমাদের আশেপাশে এমন অসংখ্য মানুষ আছে যাদের কেউ ভালো গান গায়, কেউ লেখালিখি করে, কেউ বা অসাধারণ আঁকতে পারে, আবৃত্তি করতে পারে, বক্তৃতা দিতে পারে ইত্যাদি। আবার অনেকেই আছে একইসাথে এমন অনেক বিষয়ে পারদর্শী। আমরা আদর করে মানুষগুলোকে বলি ‘সৃজনশীল’।
ক্রিয়েটিভিটি বা সৃজনশীলতা ব্যাপারটা আসলে কী, প্রতিদিনের জীবনে সৃজনশীলতার প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা আর কীভাবে এর বিকাশ ঘটানো যায় চলুন জেনে নিই এক নজরে।
সৃজনশীলতা কী?
সৃজনশীলতা হলো নিজের দক্ষতা ও প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে কোনো নতুন বা কল্পনাপ্রসূত আইডিয়াকে বাস্তবে রূপান্তর করা। আবৃত্তি, সাহিত্য রচনা, পেইন্টিং ইত্যাদি তো সৃজনশীলতাকে প্রকাশ করেই, পাশাপাশি নতুন বা ভিন্ন আঙ্গিকে কোনো ব্যাপারে ধারণা দেয়াটাও ক্রিয়েটিভিটিরই অংশ।
অনেকে মনে করেন তাদের মধ্যে কোনো সৃজনশীলতা নেই। ধারণাটি একেবারেই ভুল। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই সৃজনশীলতা থাকে। যত্ন, প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের মাধ্যমে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে হয়।
সৃজনশীলতা কেন জরুরি?
সাধারণ জীবনে সৃজনশীলতার প্রভাব অনেক বেশি। সৃজনশীলতা চিন্তা ভাবনার বিকাশ ঘটায়। যেকোনো বিষয়কে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে সাহায্য করে। সৃজনশীলতা এমন একটি অস্ত্র যা দৈনন্দিন কাজকে আনন্দময় করে তোলে, জীবনকে সহজ করে তোলে এবং একঘেঁয়েমি দূর করে।
সৃজনশীলতা ক্রমাগত আপনার মনকে চ্যালেঞ্জ করে, যা আপনার মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। এটি স্বাস্থ্য ও জীবন মানের উন্নতি তো ঘটায়ই, গবেষণা বলছে সৃজনশীলতা মৃত্যুঝুঁকিও কমায়।
লক্ষ্য করলে দেখবেন, সৃজনশীল মানুষের চিন্তাভাবনা গতানুগতিক ধারার বাহিরে। অর্থাৎ সৃজনশীলতা আপনাকে বাক্সের বাহিরে চিন্তা করতে শিখাবে, চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনবে।
শুধুমাত্র দৈনন্দিন জীবনেই নয়, সৃজনশীলতার প্রভাব কর্পোরেট জগৎ বা কর্মক্ষেত্রেও অনেক বেশি। সৃজনশীলতার মাধ্যমে নতুন নতুন আইডিয়া জেনারেট করা, কঠিন সমস্যার সমাধান করা থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে অনন্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। এজন্য চাকরির বাজারেও একজন ক্রিয়েটিভ ব্যক্তি অনেকাংশে এগিয়েই থাকবেন।
সৃজনশীলতা বৃদ্ধির উপায়
-
পর্যবেক্ষণ করুন এবং চিন্তা করুন স্বাধীনভাবে
আমাদের মাঝে নতুন নতুন আইডিয়া কিংবা আমাদের কল্পনার জগৎ গড়ে ওঠে আশেপাশের পরিবেশকে কেন্দ্র করে। এজন্য প্রকৃতি থেকে শুরু করে আশেপাশের সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে থাকুন। পর্যবেক্ষণের আলোকে আপনার নিজের চিন্তাকে গুরুত্ব দিন। গতানুগতিক ভাবনার বাইরে গিয়ে আরও বেশি কৌতূহলী হোন এবং স্বাধীনভাবে ভাবতে শিখুন।
-
নিজেকে আটকাবেন না
স্বাভাবিকভাবেই আপনি একদিনে একটি সাহিত্যকর্ম তৈরি করতে পারবেন না। পারবেন না একদিনের মধ্যেই পার্ফেক্ট কোনো স্কেচ এঁকে ফেলতে। সৃজনশীলতাও অনুশীলনের ব্যাপার।
শুরুটা ভালো না হলেও নতুন সম্ভাবনার জন্য প্রচেষ্টা করে যেতে হবে, নিজেকে আটকানো যাবে না বা ভাবা যাবে না যে, “আমাকে দিয়ে হবেনা!”
কখনো কখনো শুধুমাত্র একটি সুন্দর বাক্য পাওয়ার জন্য অনেকগুলো পৃষ্ঠা নষ্ট করতে হয়!
-
অনুশীলন করতে থাকুন
একবার কাগজ-কলম নিয়ে বসে কেউ সাহিত্যিক হয়ে যায় না, বরং ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই তা সম্ভব। আপনি যে ক্রাফট বা সৃজনশীল কাজ নিয়েই সামনে এগোতে চান না কেন, সেটা প্র্যাক্টিসের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত অবস্থায় নিয়ে আসতে পারবেন।
-
নিজের কাজকে ছোটো চোখে দেখবেন না
নিজের সৃষ্টি করা কোনো কিছু নিয়ে কিছুটা হতাশা কাজ করাটা স্বাভাবিক। যেভাবে চেয়েছিলেন হয়তো সেভাবে হয়নি। তবে এই ভাবনাটা যেন আপনার সৃজনশীল কাজের গতিকে থামিয়ে না দেয় সেদিকে লক্ষ্য রাখাটা জরুরি।
সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করতে ক্রাফটিং
আর্ট ও ক্রাফট আবেগ প্রকাশের একটা মাধ্যম। ক্রাফটিং মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দেয়, উদ্বেগ কমায় ও কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি করে। সর্বোপরি, নিয়মিত ক্রাফট ওয়ার্ক অনুশীলনের মাধ্যমে সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়।
সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করতে এমনই ৫টি সহজ ক্রাফটিং আইডিয়া সম্পর্কে চলুন ঝটপট জেনে নিই:
-
কুইলিং
বর্তমান সময়ে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে পেপার ক্রাফট কুইলিং। রং-বেরঙের কাগজের স্ট্রিপ কেটে, তা দিয়ে গোল কয়েলের মত তৈরি করে বিভিন্ন আকৃতি দেয়াটাই মূলত কুইলিং। কার্ড ডিজাইন থেকে শুরু করে ওয়াল হ্যাঙ্গিং বা জুয়েলারি তৈরিতেও কুইলিং এর জুড়ি মেলা ভার।
কুইলিং কার্ড; Image Source: Pinterest
যা যা লাগবে:
- কাগজের স্ট্রিপ
- কুইলিং টুল (কুইলিং নিডল)
- আঠা বা গ্লু
- কাঁচি
- ট্যুইজার
চলুন শুরু করা যাক!
১. কুইলিং এর জন্য তুলনামূলকভাবে মজবুত কাগজ প্রয়োজন হয় যেন ভাঁজ করা বা শেপিং এর সময় ছিড়ে না যায়। বড় আকৃতির কাগজ কেটে লম্বা স্ট্রিপ বানিয়ে কুইলিং করা যেতে পারে। আবার চাইলে আলাদা করে কুইলিং স্ট্রিপ কিনতে পাওয়া যায়, সেটাও ব্যবহার করতে পারেন।
২. এবার একটি কুইলিং স্ট্রিপ, নিডলে দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কয়েলের মত তৈরি করে নিন। চেষ্টা করবেন কাগজ এবং নিডলের প্রান্ত একই সমান্তরালে রাখতে।
৩. কয়েলের শেষ প্রান্তের স্ট্রিপে গ্লু লাগিয়ে কয়েলটি সম্পূর্ণ করুন এবং নিডল থেকে কয়েলটি সাবধানে খুলে নিন যেন কয়েলের আকার নষ্ট হয়ে না যায়।
৪. এবার কয়েলটিকে আঙ্গুল দিয়ে চেপে আপনার পছন্দমতো আকার দিন বা শেপ তৈরি করুন।
কুইলিং করা জুয়েলারি; Image Source: Pinterest
এবার শেপগুলো নিয়ে বানিয়ে ফেলুন আপনার পছন্দমতো সামগ্রী।
-
কলমদানি
টিস্যু পেপার ব্যবহারের পর ভেতরের পেপার রোলটা কী করেন? নিশ্চয়ই ফেলে দেন। কিন্তু এই পেপার রোলও চাইলে কাজে লাগানো সম্ভব। চলুন টিস্যু পেপার রোল ব্যবহার করে বানিয়ে ফেলা যাক চমৎকার কলমদানি।
যা যা লাগবে:
- টিস্যু পেপার রোল
- রঙিন কাগজ
- এক্রেলিক রং
- কার্ডবোর্ড
- গ্লু
Image Source: Pinterest
পদ্ধতি:
১. টিস্যু পেপার রোলটিকে গ্লু দিয়ে রঙিন কাগজে মুড়ে নিন। এবার তাতে ইচ্ছামতো ডিজাইন করুন রং দিয়ে। চাইলে শুধু এক্রেলিক রং ব্যবহার করেও রঙিন করে তুলতে পারেন পেপার রোলকে।
২. কার্ডবোর্ডটিকে প্রথমে পেপার রোল বসিয়ে রাখার মত মাপে কেটে নিন। চারপাশে কিছুটা বাড়তি অংশ রাখবেন, এতে দেখতে সুন্দর লাগেবে। তারপর কার্ডবোর্ডটিও পছন্দমতো রং করে নিন।
৩. এবার পেপার রোলটিকে কার্ডবোর্ডের ওপর গ্লু দিয়ে লাগিয়ে দিন। ব্যাস, তৈরি হয়ে গেলো পেন হোল্ডার!
একইভাবে প্লাস্টিকের বোতল কেটে, খালি টিনের কৌটা বা কাগজের ছোট বাক্সকেও কলমদানি বা ফুলদানি হিসাবে তৈরি করে নিতে পারেন।
-
ল্যান্টার্ন
Image Source: Jam Paper
যা যা লাগবে:
- বেলুন
- শক্ত মোটা সুতা বা দড়ি
- গ্লু
- ফেয়ারি লাইট বা মরিচবাতি
যেভাবে তৈরি করবেন:
Image Source: nobiggie.net
১. ল্যান্টার্নের আকার যত বড় হবে ঠিক তত বড় মাপের বেলুন ফুলিয়ে নিন। গ্লু এর সাথে ৪ঃ১ অনুপাতে পানি মিশিয়ে নিন। এবার গ্লু এর মিশ্রণে সুতা ডুবিয়ে সুতাকে বেলুনের ওপর সোজাসুজি ও লম্বালম্বি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গোল কাঠামো তৈরি করুন।
২. গ্লু শুকিয়ে কাঠামোটি শক্ত হয়ে গেলে বেলুনটিকে সুঁই দিয়ে ফাটিয়ে বের করে আনুন।
৩. এবার কাঠামোটিতে পছন্দমতো রং করে তাতে মরিচবাতি পেঁচিয়ে দিন।
৪. সুতা বা তার দিয়ে ঝুলিয়ে দিন আপনার ল্যান্টার্নটি।
-
ফটোফ্রেম
Image Source: ecoideaz
যা যা লাগবে:
- নিউজ পেপার
- কাঠি বা নিডল
- গ্লু
- কার্ডবোর্ড
- রং
পদ্ধতি:
১. কার্ডবোর্ড দিয়ে প্রথমে ফ্রেম তৈরি করে নিন। যে ছবিটির জন্য ফ্রেম তৈরি করছেন সেই ছবির সাথে ফ্রেমের মাপের অনুপাত যেনো ঠিক হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখুন।
২. নিউজ পেপারের একটি পৃষ্ঠাকে অর্ধেক করে নিন। পেপারের টুকরোটি নিয়ে কাঠি বা নিডল দিয়ে গোল করে টিউবাকৃতির রোল তৈরি করুন। যতগুলো টিউব ফটোফ্রেমে ব্যবহার করবেন ততগুলো টিউব তৈরি করুন।
৩. এবার টিউব আকৃতির রোলগুলোকে নির্দিষ্ট মাপে কেটে গ্লু দিয়ে ফ্রেমের ওপর একে একে আটকে দিন।
৪. ইচ্ছামতো রং করে নিন
৫. ফ্রেমের পিছে ছবি গ্লু দিয়ে আটকে দিন।
৬. এবার ফ্রেমের মাপে আরেকটি কাগজ বা নিউজ পেপার নিয়ে পেছন দিকটা আটকে দিন।
[Image Source: KiwiCo]
৭. কার্ডবোর্ড দিয়ে একটি স্ট্যান্ড তৈরি করে তা গ্লু দিয়ে আটকে দিন। চাইলে সুতা গোল করে পেঁচিয়ে গ্লু দিয়ে আটকে দেয়ালেও ঝুলিয়ে দিতে পারেন।
-
অরিগ্যামি বুকমার্ক
বইয়ের কিছু অংশ পড়া শেষে তা চিহ্নিত করে রাখতে বুকমার্কের ব্যবহার অনেক আগে থেকে প্রচলিত। কেমন হয় যদি বুকমার্কটি নিজে বানিয়ে নেয়া যায়?
অরিগ্যামির মাধ্যমে খুব সহজেই তৈরি করে নেয়া যায় সুন্দর সুন্দর বুকমার্ক। তো চলুন শুরু করা যাক।
Image Source: Pinterest
যা যা লাগবে:
- কাগজ
- কাঁচি
- রং
পদ্ধতি:
১. এক টুকরো কাগজ নিয়ে তা বর্গাকৃতির করে কেটে নিন।
২. কাগজটিকে এমনভাবে নিজের সামনে রাখুন যেন তা দেখতে ডায়মন্ড আকৃতির মনে হয়। এবার মাঝ বরাবর একটি ভাজ দিন।
Image Source: Pinterest
৩. এবার কাগজটির দুই পাশ থেকে এমনভাবে ভাজ করে নিন যেন ভাজ দুটি ওপরের কর্ণারের সাথে গিয়ে লাগে।
৪. এবার ভাজ খুলে শুধুমাত্র ওপরের কর্ণারের অংশটুকু নিচের অংশের সাথে লাগিয়ে ভাজ দিন। পকেটের মত একটা অংশ তৈরি হবে।
৫. দুই সাইডের বাড়তি কাগজের অংশটুকু মুড়ে দিন পকেটের ভেতর।
৬. পছন্দমতো রং করে বা সাজিয়ে নিন। ব্যাস, হয়ে গেলো বুকমার্ক।
রেফারেন্স
- https://www.indeed.com/career-advice/career-development/importance-of-creativity-in-business
- https://jamesclear.com/creative-thinking
- https://conradfrancis.com/creativity-importance/
- https://bemorewithless.com/create/
- https://www.inc.com/christina-desmarais/25-ways-to-be-more-creative.html
- https://jamesclear.com/creativity
- https://www.craftsy.com/post/paper-quilling-tutorial/
- http://splashofsomething.com/2011/05/13/lantern-diy-let-there-be-light/
- https://www.instructables.com/Balloon-Lantern
- https://www.kiwico.com/diy/art-creativity/fun-functional-projects/rolled-paper-picture-frame
- https://www.wikihow.com/Make-an-Origami-Bookmark
আপনার কমেন্ট লিখুন