স্কুল কলেজ জীবনে লেখাপড়ার পাশাপাশি আরেকটা টার্মও আমরা কমবেশি সবাই শুনে থাকি, আর তা হলো, কো কারিকুলার বা এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজ বা সহজ বাংলায় বলতে গেলে সহশিক্ষা কার্যক্রম। আলিফ পড়ে গেছে বিরাট এক সমস্যায়। ও সবে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, হাতে মোটামুটি কিছু সময়ও আছে কাজে লাগানোর মতো। দুয়েকজন সিনিয়রের সাথে আলোচনা করে আলিফ জানতে পারলো এই সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলো সম্পর্কে। ছাত্রজীবনে লেখাপড়ার পাশাপাশি টুকটাক সহশিক্ষা কার্যক্রমে জড়িত থাকার সুবিধাগুলোও জানতে পারলো সে- দলগত ও টেকনিক্যাল কাজের মাধ্যমে অনেক কিছু শেখা যায়, পাওয়া যায় কিছু মূল্যবান লাইফ লেসন।
সবকিছু জেনে শুনে মধুর সমস্যায় পড়ে গেলো আলিফ; কোনটা ছেড়ে কোন কাজের সাথে যুক্ত হবো? চলো বন্ধুরা, আজকের ব্লগে আমরা দেখে নিই স্কুল কলেজ জীবনে আমরা কোন ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত থেকে নিজেকে আরো উন্নত করে গড়ে তুলতে পারি-
বিতর্ক:
কথায় বলে, “যুক্তিতেই মুক্তি!” হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছো, স্কুল কলেজ জীবনের অন্যতম সেরা একটা অভিজ্ঞতা পেতে পারো যদি বিতর্ক বা ডিবেটিং এর সাথে যুক্ত থাকতে পারো। বিতর্ক তোমাকে শেখাবে কীভাবে যুক্তিবাদী ও স্বচ্ছ মানসিকতা নিয়ে সবকিছু চিন্তা ভাবনা করতে হয়, কীভাবে পাবলিক স্পিকিং বা সুন্দর করে কথা বলার দক্ষতা অর্জন করা যায়, কীভাবে তর্কের শিল্পটা আত্মস্থ করা যায়। পাশাপাশি ডিবেটারদের কিন্তু সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ধারণা রাখতে হয়, যেটা তোমাকে সাধারণ ও সমসাময়িক জ্ঞানের ভাণ্ডার হিসেবে গড়ে তুলতে অবদান রাখতে পারে!
আবৃত্তি:
একটা সুন্দর কবিতা আবৃত্তি শুনেছ কখনো? কিংবা করেছো আবৃত্তি? উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে তো ইতোমধ্যেই বুঝে গেছো আবৃত্তির মজাটা। তবুও বলে রাখি, লেখাপড়ার পাশাপাশি আবৃত্তিতে সময় দিলে কিন্তু তোমার লাভ ছাড়া কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ? আবৃত্তি চর্চায় সময় দিলে তা তোমার কণ্ঠচর্চাকে পরিশীলিত করবে, তোমাকে করে তুলবে আরো সাহিত্যমনা। এমনও হতে পারে, তোমার কবিতা শোনার জন্য বন্ধুরা মুখিয়ে থাকবে!
নাচ/গান:
এমন কেউ কি আছে যে নাচতে বা গাইতে কিংবা অন্তত নাচ-গান উপভোগ করতে ভালোবাসে না? আমার তো মনে হয় না। যাদের যথেষ্ট আগ্রহ আছে তারা কিন্তু লেখাপড়ার পাশাপাশি নাচ-গানেও সময় দিতে পারো। স্কুল কলেজের ক্লাবগুলোয় তোমরা ভালো একটা সঙ্গ তো পাবেই, তাছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও তোমরা নাচ কিংবা গানের কোর্স করতে পারো। আমাদের চারপাশে অনেকেই আছে দেখবে, যারা ভালো গান গায় কিংবা সুন্দর নাচতে পারে।
যারা লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে নাচ-গানে সময় দেয় তারা কোন দিক থেকে লাভবান হয় জানো? ওরা কখনো হতাশ বা ডিপ্রেসড হয় না, জীবনকে উপভোগ করতে শেখে ওরা। এটা আসলে সব ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রমের ক্ষেত্রেই সত্য- যখন তুমি তোমার সময়কে একটা গঠনমূলক সৃজনশীল বিনোদনমূলক কাজে অপচয়(!) করবে, সেটা কিন্তু কখনো বিফলে যাবে না, জীবনে কোনো না সময় কিন্তু তুমিই লাভবান হবে!
থিয়েটার/নাট্যচর্চা:
নাটক, সিনেমা, থিয়েটার এগুলোও হতে পারে তোমার পছন্দের সহশিক্ষা কার্যক্রম। যাদের অভিনয়ের প্রতি ঝোঁক আছে, তারা স্কুল কলেজের ক্লাবগুলোতে লেগে পড়তে পারো রঙ্গমঞ্চের হাতেখড়ি নিতে। হয়তো অন্যান্য সহশিক্ষা কার্যক্রম গুলো থেকে এখানে সময় দিতে হতে পারে বেশি, কিন্তু বিশ্বাস করো, যে টিমওয়ার্ক তুমি শিখবে একটা নাটক মঞ্চস্থ করতে গিয়ে, এই অভিজ্ঞতাটা অতুলনীয়!
খেলাধুলা:
শিক্ষাজীবনে শরীরচর্চা, খেলাধুলা ও সর্বোপরি কায়িক শ্রমের যে গুরুত্ব কতটা তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে শুধু শারীরিক সক্ষমতা অর্জনের দিকটিই নয়, লেখাপড়ার পাশাপাশি নিয়মিত খেলাধুলায় সময় দেওয়ার আরো অনেক সুবিধা আছে। যেমন ধরো, সময়ানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাচর্চা, দায়িত্ববোধ, নেতৃত্বগুণসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ গুণ তুমি অর্জন করতে পারবে।
খেলাধুলার কি অভাব আছে? ক্রিকেট, ফুটবল, হ্যান্ডবল, ভলিবল, বাস্কেটবল, দাবা, হকির মতো আনন্দময় খেলাগুলোয় অংশ নিতে পারো আজ থেকেই। তবে ছোটবেলায় হাজারবার শোনা সেই কথাটা কিন্তু মাথায় রাখতে ভুলবে না- “পড়ার সময় পড়া, খেলার সময় খেলা!” তাহলেই দেখবে, পড়াতেও মন বসবে, খেলাধুলায় যুক্ত থাকার সুবিধাটাও পেয়ে যাবে একেবারে হাতেনাতে।
স্কাউট/রোভার:
সেই ছোটবেলায় পড়া স্কাউটিং-এর নিয়ম আর মটোগুলো মনে আছে? সেই বিখ্যাত আদর্শ “Be Prepared!” কিংবা সেই উদ্যমী লক্ষ্য “Do a good turn daily!” মনে পড়ে স্কাউটদের সেই তিনটি কর্তব্য- “Duty to God and Country, Duty to other people আর Duty to self এর কথা? অথবা মনে পড়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন প্রোগ্রামে স্কাউটদের মনকাড়া প্যারেড? ঠিকই ধরেছো, স্কাউটিং বা তার বড় ভাই (!) রোভার এক্টিভিটিজ হতে পারে তোমাদের সুন্দর একটি চয়েস। নিয়মিত স্কাউটিং এক্টিভিটি, ইভেন্ট অর্গানাইজিং, সমাজসেবামূলক কার্যকলাপ আর ক্যাম্পিং করতে করতে কীভাবে যে সময়টা কেটে যাবে বুঝতেও পারবে না। আর লাইফ লেসন? সেটুকু আর না-ই বা বলি!
ল্যাংগুয়েজ ক্লাব:
স্কুল কলেজ জীবনে সহশিক্ষা কার্যক্রমে জড়িত থাকার ফলে সবচেয়ে বড় যে উপকারটা পাওয়া যায়, তা হলো দলগত কাজের মাধ্যমে নেতৃত্বগুণ শেখা। বিভিন্ন ক্লাবের সাথে যুক্ত থেকে নিজের দক্ষতাকে বাড়িয়ে নিতে পারো আরো কয়েকধাপ। এরকমই কিছু ক্লাবের কথা বলবো এখন; যেমন ধরো কোনো ভাষা বা ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব। এখনকার দিনে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই কিন্তু ইংলিশ ক্লাব, লিটারেচার ক্লাব, ল্যাংগুয়েজ ক্লাব রয়েছে। ইংরেজি চর্চার ভালো সুযোগ তো পাবেই, পাশাপাশি বিভিন্ন উৎসব বা ফেস্টিভাল আয়োজন করতে গিয়ে যে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে, যে অভিজ্ঞতাটা অর্জন করবে সেটা পরে কর্মজীবনেও অনেক কাজে দেবে।
বিজ্ঞান ক্লাব:
ভাষা ও সাহিত্যমনারা যদি ল্যাঙ্গুয়েজ বা লিটারেচার ক্লাবে যোগ দিতে পারে, তাহলে বিজ্ঞানমনস্কদের জন্যেও রয়েছে উপযুক্ত সহশিক্ষা কার্যক্রম; চাইলেই কিন্তু তুমি পড়াশোনার পাশাপাশি একটা নির্দিষ্ট সময় বের করতে পারো তোমার বিজ্ঞান ক্লাবের জন্য। ক্লাবিং-এর ফলে বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রীদের জ্ঞান হয় আরো পরিশীলিত, বিভিন্ন ফেস্টিভাল, এক্টিভিটিজ, সায়েন্স ফেয়ার, প্রজেক্ট শো কেসের মাধ্যমে পাঠ্যবইয়ে পড়া বিজ্ঞানের জটিল জিনিসগুলোর বাস্তবমুখী প্রয়োগ দেখার স্বাদও সহজেই মেটানো যায়। তাই বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য বিজ্ঞান ক্লাব হতে পারে ভালো একটি চয়েস।
বিজনেস ক্লাব:
বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য না হয় বিজ্ঞান ক্লাব আছে, কিন্তু ব্যবসায় শিক্ষা শাখার শিক্ষার্থীরা কী করবে? কোনো দুশ্চিন্তা নেই, ব্যবসায় শিক্ষা শাখার ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে তাদের অবসর সময়টা কাটাতে পারে বন্ধু-বান্ধবের সাথে বিজনেস ক্লাবে সময় দিয়ে। বিজ্ঞানের মত ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগটাও অনেক বেশি বাস্তব প্রয়োগমুখী, তাই বিভিন্ন ক্লাব এক্টিভিটিজ যেমন: বিজনেস কেস সলভ, হ্যাকাথন, প্রেজেন্টেশন প্রভৃতির মাধ্যমে যেমন পাঠ্যবইয়ের বাইরের জগত দেখার কাজটাও হয়ে যাবে, তেমনি ভবিষ্যত কর্পোরেট জীবনের হাতেখড়িও পেয়ে যাবে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থাতেই!
লেখালেখি:
তোমাদের মধ্যে যাদের লেখালেখির প্রতি আগ্রহ আছে, তাদের জন্য বলে রাখছি, অন্যান্য ভালো অভ্যাসসমূহের মতোই লেখালেখির অভ্যাসটা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাজীবনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। লেখাপড়ার পাশাপাশি টুকটাক লেখালেখির কাজটা চালিয়ে যাওয়া কিন্তু মোটেই কঠিন কোনো কাজ নয়। স্কুলে বা কলেজে ক্লাব থাকলে তো তোমরা লেখালেখিতে দক্ষ হয়ে উঠবেই, এছাড়াও প্রতিষ্ঠানের মাসিক, ত্রৈমাসিক বা বার্ষিক ম্যাগাজিন বা পত্রিকাগুলোতেও কিন্তু তোমরা সুন্দর সুন্দর লেখা পাঠিয়ে নিজেদের প্রতিভার পরিচয় দিতে পারো!
কয়েকটি বোনাস(!):
মোটাদাগে এই দশটি সহশিক্ষা কার্যক্রমের কথা বললাম, তবে তার মানে এই নয় যে, এগুলো ছাড়াও আর কোনো অপশন তোমাদের হাতে নেই। অবশ্যই আছে, তোমাদের লেখাপড়ার পাশাপাশি যে কাজগুলো করতে ভালো লাগে, সেগুলোই করতে পারো। যেমন ধরো, ছবি আঁকতে ভালোবাসলে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা বা আর্ট ক্লাবে যোগ দিতে পারো।
তোমাদের মধ্যে যাদের রাজনীতি, কূটনীতি বা ডিপ্লোম্যাসি নিয়ে আগ্রহ আছে তাদের জন্যও রয়েছে একটি চমৎকার সহশিক্ষা কার্যক্রম, যেটাকে বলে ছায়া জাতিসংঘ সম্মেলন বা Model United Nations অনুষ্ঠান, যেগুলো প্রায় সারাবছরই বিভিন্ন ক্লাব বা প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে।
সাধারণ জ্ঞান বা সমসাময়িক বিষয় নিয়ে ভালো দখল থাকলে বা দখল রাখার ইচ্ছা থাকলে করতে পারো কুইজিং! আজকাল অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই আলাদা কুইজ ক্লাব আছে!
রোটার্যাক্ট ক্লাব বা যুব রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতেও যোগদান করতে পারো কেউ কেউ। আসলে শিক্ষাজীবনে লেখাপড়ার পাশাপাশি করার মত সহশিক্ষা কার্যক্রমের অভাব নেই, দরকার শুধু তোমার একটুখানি সদিচ্ছা, আর পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে সময় বের করে পরিশ্রম করার মানসিকতা। তাহলেই দেখবে তোমাকে কেউ আটকাতে পারবে না, তোমার স্বপ্ন পূরণের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না কোনো কিছুই!
কিছু কাটাছেঁড়া:
বন্ধুরা, তাহলে তোমরাও আলিফের মতো জেনে গেলে সেরা দশটি (আসলে আরো বেশি!) কো কারিকুলার এক্টিভিটিজের কথা, যেগুলোতে তোমরা চাইলেই লেখাপড়ার পাশাপাশি সময় দিতে পারো। তবে একটা কথা বলে নেওয়া ভালো, যেজন্য এই শেষের অংশটুকু লেখা- কখনোই যেন সহশিক্ষা কার্যক্রম তোমার মূল মনোযোগে পরিণত না হয়, সাবধান! সবার আগে একাডেমিক লেখাপড়া, সেখানে ভালো ফলাফল করার ব্যাপারে আশাবাদী হতে পারলে তবেই কিন্তু কো-কারিকুলার বা এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজে অংশ নেয়ার কথা চিন্তা করবে।
অনেককেই দেখা যায়, স্কুল কলেজ জীবনের অল্প সময়টুকুতে লেখাপড়া নিয়ে এতো বেশি চিন্তিত ও মশগুল থাকে যে, সময় সুযোগ বের করে কিছু সহশিক্ষা কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়া তাদের জন্য একেবারে অসম্ভব একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায়, কো-কারিকুলার কার্যক্রমে এতো বেশি সময় দিচ্ছে যে, বাসায় গিয়ে ঠিকমতো লেখাপড়া করতে পারছে না অথবা রেজাল্ট খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
তোমাদের কিন্তু এই দু’টো দিককেই এড়িয়ে চলতে হবে, আশা করি বুঝতে পেরেছো। লেখাপড়ার পাশাপাশি সঠিক সময় ও রুটিন মেনে সহশিক্ষা কার্যক্রমে সময় দিতে হবে, কেবলমাত্র তখনই পারবে তুমি সর্বোত্তম লাভটুকু অর্জন করতে। তাহলে বন্ধুরা, আজকে এই পর্যন্তই। কথাগুলো মাথায় রেখো, আর এখনই আলিফের সাথে পরামর্শ করে বেছে নাও তোমার পছন্দের সহশিক্ষা কার্যক্রমটি!
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন