পৃথিবী: মহাশূন্যের এক নীল গ্রহের নাম

January 10, 2024 ...

“And forget not that the earth delights to feel your bare feet and the winds long to play with your hair.” —Khalil Gibran

আমরা, মানব জাতি, এই পৃথিবীর বাসিন্দা। প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে এখন অব্দি, মানুষ নানা ভাবে চেষ্টা করেছে তাদের এই বাসস্থান সম্পর্কে জানতে, এই বাসস্থানের অজানা সব রহস্যকে উন্মোচন করতে। সকল বিষয় এই আধুনিক যুগে এসেও, প্রকাশ না পেলেও, যা সামনে আছে তাও কম কৌতুহল উদ্দীপক নয়। সমুদ্রের তলদেশ থেকে মহাশূন্যের অনন্তলোক অব্দি মানুষ প্রতিনিয়ত জানতে চেয়েছে, জানতে চেয়েছে কোমল আর নরম মাটি, যার উপর ফসল ফলে, জন্মে বৃক্ষ, তার নিচে কী রয়েছে। মানুষের এই কৌতুহল তাকে অন্য প্রানী হতে করেছে আলাদা, দিয়েছে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকা শ্রেষ্ঠ জীবের সম্মান। 

এই লেখায় আমরা আলোচনা করবো পৃথিবীর পরিচিতি, সৃষ্টির ইতিহাস, গঠন- আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক, মহাদেশগুলোর নাম ও দেশের নাম- ইত্যাদি সম্পর্কে। এছাড়া পৃথিবীর বাসযোগ্যতা কিভাবে দিন দিন কমে যাচ্ছে, সে বিষয়টিও লেখার একটি অংশ জুড়ে থাকবে। এছাড়া পৃথিবী সম্পর্কে অজানা ১০টি তথ্যের পাশাপাশি কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তরও যুক্ত করে দেয়া হবে। 

 

পৃথিবীর পরিচিতি 

আমাদের আবাসভূমি পৃথিবী, সূর্যের ৩য় গ্রহ হিসেবে পরিচিত, যেখানে (এখন অব্দি) একমাত্র জীবনের অস্তিত্ব বিদ্যমান। সূর্য থেকে যাত্রা শুরু করে বুধ, শুক্র গ্রহ পেরিয়ে পৃথিবীর কাছে আসতে হলে পাড়ি দিতে হবে প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার। অবস্থানে ৩য় হলেও আয়তনের দিক থেকে পৃথিবী কিছুটা পিছিয়ে আছে। প্রায় ৪০০০ মাইল ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট এই গ্রহ। আর দশটা গ্রহ থেকে পৃথিবী আলাদা হওয়ার একটি বিশেষ কারণ হলো এর মধ্যে থাকা জলের উপস্থিতি। ভূভাগের পরিমান যেখানে মাত্র ৩০ শতাংশ, জলের ভাগ সেখানে ৭০ শতাংশ। তবে তারপরেও পৃথিবী পরিচিত পাথুরে ও স্থলজ গ্রহ বা Terrestrial Planet হিসেবে। জলভাগ, সমভূমি, উপত্যকা, পাহাড়-পর্বত, গিরিখাত, উদ্ভিদ, নানা প্রজাতির প্রাণী- এই সকল কিছু মিলেমিশে তৈরি আমাদের এই পৃথিবী। 

পৃথিবী

 

নাম ও বুৎপত্তি

সাধারণত গ্রিক দেবতাদের নামে গ্রহের নামকরণ হয়, পৃথিবীর ক্ষেত্রে ঘটেছে তার ব্যাতিক্রম। কবে প্রথম আর্থ শব্দটি ব্যবহার হয়েছে জানা যায় না। তবে এই শব্দের উৎপত্তি আঠারো শতকের এংলো স্যাক্সন শব্দ এরদো (erdo) থেকে ধারণা করা হয়, যার শাব্দিক অর্থ ভূমি বা মাটি। এই শব্দের উৎপত্তি হয়েছে প্রটো ইন্দো ইউরোপীয়ান শব্দ erþō থেকে। বাংলা নামকরণের ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত ‘পৃথিবী’ শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে। সুতরাং ‘পৃথিবী’ সংস্কৃত শব্দ যার অপর নাম “পৃথ্বী”। পৃথ্বী ছিল পৌরাণিক “পৃথু”-এর রাজত্ব।

 

পৃথিবী কত বড়? 

সর্বপ্রথম পৃথিবীর পরিধি মেপেছিলেন এক লাইব্রেরিয়ান, নাম তার ইরাটোস্থেনিস। অষ্টম শ্রেণির  গণিত বইতে মৌলিক সংখ্যা নির্ণয়ের যে ইরাটোস্থেনিসের ছাকনির কথা বলা হয়, সেটা তারই আবিষ্কার। গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের সেনাপতি টলেমি তাকে আলেকজান্দ্রিয়ার সুবিশাল লাইব্রেরির দায়িত্ব দেন। প্রায় বিষুব রেখার উপর অবস্থিত মিশরের সিয়েন শহর ও আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির প্রাঙ্গনে কাঠি পুঁতে সূর্যের ছায়ার কোণের পার্থক্য মেপে এই ভদ্রলোক পৃথিবীর পরিধি মেপে ফেলেছিলেন! তার দেয়া পরিধি ছিলো ৪০,০০০ কিলোমিটার, আর বর্তমানকালের আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে মাপার পর দেখা গেলো, পৃথিবীর পরিধি প্রায় ৪০,০২০ কিলোমিটার। কোনো প্রকার আধুনিক যন্ত্র ছাড়া ইরাটোস্থেনিসের এত নিখুঁত হিসেব সত্যিই বিষ্ময়কর। নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের তথ্য মতে, পৃথিবীর বিষুব রেখার ব্যাসার্ধ ৩,৯৬৩ মাইল। অন্যদিকে, পৃথিবী উত্তর দক্ষিণে কিছুটা চাপা হওয়ার কারণে, মেরু অঞ্চলের ব্যাসার্ধ কিছুটা কম, প্রায় ৩,৯৫০ মাইল। এই তথ্যগুলো ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা নিরক্ষীয় ও মেরু অঞ্চলের পরিধি নির্ধারণ করেছেন, যা যথাক্রমে ৪০,০৭৫ কিলোমিটার এবং ৪০,০০৮ কিলোমিটার। 

পৃথিবী
Source: Greek Asia

 

পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস

বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবী সৃষ্টির যে ইতিহাস বর্ণনা করা হয়, তা বেশ মজার ও চিত্তাকর্ষক। ধারণা করা হয় প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর পূর্বে, গ্যাস এবং ধূলার মেঘ- যাকে নেবুলা বলা হয়- থেকে আমাদের এই সৌরজগত সৃষ্টি হয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় এই গ্যাস এবং ধূলা গ্র্যাভিটির কারণে জোট বাঁধতে শুরু করে। ফলে নানা রকমের ভারী মৌল এক স্থানে জড়ো হয়ে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে এবং একসময় একটি আদ্যনক্ষত্রের জন্ম হয়, যাকে আমরা এখন সূর্য নামে চিনি। নতুন জন্ম নেয়া সূর্যের চারপাশে একসময় বাকি গ্যাস কুণ্ডলী কেন্দ্রমুখী বলের দরুণ ঘুরতে শুরু করে এবং প্রায় একই উপায়ে বাকি গ্রহ ও উপগ্রহগুলো তৈরি হতে শুরু করে।

তবে এই পুরো ঘটনাটি নিয়ে বৈজ্ঞানিক মহলে এখনো তর্কবিতর্ক চলমান। জার্মান বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪ – ১৮০৪) মনে করেন, আদিম নীহারিকা থেকেই সৌরজগত, সূর্য, গ্রহ-উপগ্রহ, ধূমকেতু, উল্কাপিন্ড, গ্রহাণুপুঞ্জ সবকিছুর জন্ম। ফরাসি বৈজ্ঞানিক লাপলাস (১৭৪৯ – ১৮২৭) তার এই মতকে সমর্থন করেন। অন্যদিকে ১৯০৪ সালের দিকে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বিজ্ঞানী মূলটন ও চেম্বারলিন উপরের এই মতগুলোকে পাশ কাটিয়ে ভিন্ন মতামত প্রদান করেন। তাদের মতে, প্রচন্ড বেগে চলমান নক্ষত্র ও সূর্যের মধ্যে সংঘর্ষ হয়, এবং সেখান থেকে ছোট ছোট টুকরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে একটি টুকরো পরবর্তীকালে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ঠান্ডা হতে হতে জীবন বিকাশের উপযুক্ত হয়ে ওঠে, এবং সেখানে জীবনের স্ফুরণ ঘটে। এভাবেই আমাদের পৃথিবীর জন্ম। (সভ্যতার ইতিহাস প্রাচীন ও মধ্যযুগ)

 

মহাসাগরের সৃষ্টি 

মহাকাশ থেকে আমাদের পৃথিবীকে নীল দেখায়- এর মূল কারণ পৃথিবীকে বেষ্টন করে রাখা সাগর ও মহাসাগর। পুরো পৃথিবীর ৭০ ভাগ জল, এ তথ্য পূর্বেই দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো মহাসাগরের সৃষ্টি হলো কিভাবে? 

এই প্রশ্নের উত্তরে আমাদের আবারো ফিরে যেতে হবে ৪.৫ বিলিয়ন বছর পূর্বে, যখন পৃথিবী একটি উত্তপ্ত গোলক ছাড়া আর কিছু নয়। সে সময়ে এই বিরাট গোলকের উত্তাপ এত বেশি ছিলো যে সেখানে জলের কোন অস্তিত্ব ছিলোই না। পরে, ধীরে ধীরে যখন তপ্ত এই গোলক ঠান্ডা হতে শুরু করে, তখন মাঝে মাঝেই অভ্যন্তরে থাকা গলিত ম্যাগমা অগ্নুৎপাত আকারে ভূপৃষ্ঠে উঠে আসতে শুরু করে। নানা রকমের গ্যাসও এর সাথে বেরিয়ে আসতে শুরু করে, যাদের মধ্যে জলীয় বাষ্পও ছিলো। এই সকল জলীয়বাষ্প মেঘরূপে জমা হতে থাকে এবং একসময় বৃষ্টি রূপে পৃথিবীতে পতিত হয়। ইতোমধ্যে ভূভাগ মোটামুটি ঠান্ডা হয়ে নানা স্থানে নানা বেসিনের সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। সেখানেই এই বৃষ্টির জল জমতে শুরু করে এবং একসময় জলাধারের সৃষ্টি হয়, যা কালের ব্যবধানে সাগর ও মহাসাগরে পরিণত হয়। মনে রাখতে হবে, এই প্রক্রিয়া একদিনে হয়নি। 

 

জীবনের আবির্ভাব ও বিবর্তন 

পৃথিবী ঠান্ডা হওয়ার এক পর্যায়ে প্রাণের মূল উপাদান প্রোটিন ও নিউক্লিয়িক এসিড তৈরি হতে শুরু করে। এই উপাদান থেকেই পরবর্তীকালে এককোষী জীবের জন্ম হয়, পৃথিবীতে শুরু হয় প্রাণের স্পন্দন। এই ঘটনা ঘটে মোটামুটি ৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে। এরপর থেকে বিবর্তনের নানা ধাপ পেরিয়ে বর্তমানের এই বিচিত্র প্রাণি ও উদ্ভিদ জগতের সৃষ্টি হয়েছে। পুরো বিষয়টিকে যদি একটি সময়রেখায় দেখানো যায় তাহলে বিষয়টা অনেকটা এমন হবেঃ 

যুগের নাম ও সময়কাল  উপবিভাগ  প্রাণের অস্তিত্ব 
আর্কিওজোয়িক (৮২৫ থেকে ১৫৫০ মিলিয়ন বছর পূর্বে) প্রোটোজোয়া নামক এককোষী জীবের আবির্ভাব 
প্রটেরোজয়িক (৫০০ থেকে ৮২৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে)  সমুদ্রের শৈবাল এবং রেডিওলারিয়া নামের আণুবীক্ষণিক জীবাণুর আবির্ভাব 
পেলিওজোয়িক (১৮৫ থেকে ৫০০ মিলিয়ন বছর পূর্বে) –  এই সময়ে পানিতে শামুক, কাকড়া, জোঁকের জন্ম হয়। সামুদ্রিক নানা উদ্ভিদ ডালপালা মেলতে শুরু করে। এই যুগের মাঝামাঝিতে জলের তলে মাছের জন্ম হয়। শেষ দিকে জলে স্থলে বিচরণ করার মতো প্রাণির আবির্ভাব ঘটে, পাশাপাশি ভূমিতেও নানা উদ্ভিদের জন্ম হতে শুরু করে। 
মেসোজোয়িক (৬০ থেকে ২৫০ মিলিয়ন বছর পূর্বে) এই যুগে সরীসৃপদের বিকাশ ঘটে। এমনই এক সরীসৃপ হলো ডায়নোসর। এই যুগের শেষ দিকে নানা স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবির্ভাব ঘটতে শুরু করে। এদের মগজ ছিলো তুলনামূলকভাবে আকারে বড়, গায়ে ছিলো পশমের আবরণ।
সেনোজোয়িক যুগ (৬০ মিলিয়ন বছর পূর্বে) টার্শিয়ারি  প্রাইমেট নামে পরিচিত বনমানুষের আদি বংশধরদের আবির্ভাব 
কোয়াটারনারি  এই যুগে হোমো সেপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষের উদ্ভব হয় 
প্লেইস্টোসিন (২.৫৮ মিলিয়ন থেকে ১১৭০০ বছর পূর্বে) এই যুগে সমগ্র উত্তর গোলার্ধ বরফে ঢেকে যায়। ফলে পশু ও মানুষের পক্ষে একেক অঞ্চলে বিচরণ সহজ হয়ে ওঠে। আইস এইজ সিনেমাটা দেখা হয়েছে কী? না দেখে থাকলে দেখে নিতে পারেন, বিষয়টা আরো ভালোভাবে পরিষ্কার হয়ে যাবে। 
হলসিন (৯৭০০ বছর পূর্বে) বরফ যুগের শেষ হয়ে হলসিন যুগের শুরু হয়। বর্তমানে আমরা এই যুগে বাস করছি । 

 

পৃথিবী-image-of-virus

Source- Chicago News

কিভাবে সৃষ্টি হয় চাঁদের 

পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদ কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিলো তা নিয়েও আছে নানা তত্ত্ব ও বিতর্ক। এর মধ্যে প্রথমটি হলো Capture Theory, এই তত্ত্বমতে চাঁদ আর দশটা গ্রহাণুর মতোই যা সৌরজগতের কোনো এক প্রান্তে সৃষ্টি হয়েছিলো ঠিকই, কিন্তু পরবর্তী সময়ে কোনো এক কারণে পৃথিবীর কাছাকাছি আসার পর মধ্যাকর্ষণ শক্তির দরুণ এর চারদিকে ঘুরতে শুরু করে। অন্য আরেকটি হাইপোথিসিস হলো The accretion hypothesis; এই হাইপোথিসিস দাবী করে অন্য কোথাও বা আলাদা ভাবে নয়, চাঁদ সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবী সৃষ্টির সময়েই, একই সাথে। The fission theory বলছে অন্য কথা। এই তত্ত্বানুসারে, পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি এক সময় আজকের গতি অপেক্ষা বহুগুণ বেশি ছিলো, এত বেশি গতির কারণে পৃথিবী থেকে কিছু উপাদান ভেঙে আলাদা হয়ে যায় এবং তা পৃথিবীর আকর্ষণ ছাড়তে না পেরে এর চারদিকে ঘুরতে শুরু করে। তবে এত সব তত্ত্বের মধ্যে The giant-impact theory সবচেয়ে বেশি গৃহীত ও চর্চিত। এই তত্ত্ব বলে, জীবন সৃষ্টির পূর্বে কোন এক সময় পৃথিবী ও অন্য কোনো ছুটে আসা গ্রহের মধ্যে সংঘর্ষ হয়, যার আকৃতি মোটামুটি মঙ্গল গ্রহের মতোই। ফলস্বরূপ, সংঘর্ষের পর ভাঙা টুকরোগুলো পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে শুরু করে এবং চাঁদের সৃষ্টি হয়।

 

চাঁদ কেন দূরে সরে যাচ্ছে? 

যুগ যুগ ধরে লেখক-কবিদের পরম আগ্রহের চাঁদ ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। বর্তমানে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব প্রায় ৩,৮৪,৪০০ কিলোমিটার। ১৯৬৯ সালের এপোলো মিশনে এস্ট্রোনটগণ চাঁদের পৃষ্ঠে কিছু রিফ্লেক্টর বা প্রতিফলক বসিয়ে আসেন। পৃথিবী থেকে চাঁদের দিকে লেজার রশ্মি নিক্ষেপ করলে তা আবার এই প্রতিফলকে আঘাত করে ফিরে আসে। এই প্রতিফলনের সময় বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা শতভাগ নিশ্চিত হয়েছেন, আমাদের ‘চাঁদ মামা’ আমাদের থেকে প্রতি বছর ১.৫ ইঞ্চি হারে দূরে সরে যাচ্ছে (এই একই হারে আমাদের নখও বৃদ্ধি পায়!)। এর কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর জোয়ার ভাটাকে দাবী করছেন। চাঁদের আকর্ষণ বলের কারণে পৃথিবীর সাগর মহাসাগরের জল ফুলে ওঠে, জোয়ারের সৃষ্টি হয়। পৃথিবী সেই ফুলে ওঠা জল নিয়েই নিজের আহ্নিক গতি সম্পন্ন করতে চায়। পৃথিবী একবার নিজের অক্ষে পাক খেতে ২৪ ঘন্টা সময় নিলেও, চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে সময় নেয় প্রায় ২৭ দিন। এই অসম সময়কালের কারণে চাঁদকে প্রতিমুহুর্তে নতুন নতুন অংশের জলকে নিজের দিকে টেনে ধরে রাখতে হয়। এতে করে পৃথিবীর ঘূর্ণন হার কিছুটা কমে যায় এবং চাঁদও নিজ অক্ষ থেকে কিছুটা দূরে সরে যায়। 

 

পৃথিবীর গাঠনিক বৈশিষ্ট্য 

বাহ্যিক গঠন 

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৈচিত্রের জায়গা এর ভিন্ন ভিন্ন ভূমিরূপ। সকল স্থানে এই ভূমিরূপ সমান নয়। কোথাও আছে সুউচ্চ পর্বত, কোথাও বা সমভূমি, আবার কোথাও আছে বিস্তৃত সমতলভূমি। এই বৈচিত্র্যময় ভূমিরূপকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। এগুলো হলো, 

  • পর্বত
  • মালভূমি 
  • সমভূমি

পর্বত

পর্বত হলো এমন এক বিশেষ ধরণের ভূমিরূপ যা সমুদ্রতল থেকে ১০০০ মিটারের বেশি উঁচু,  আংশিক খাড়া ঢাল সমৃদ্ধ, চূড়া বিশিষ্ট। পর্বত বিচ্ছিন্নভাবে যেমন অবস্থান করতে পারে, তেমনি ক্লাস্টার আকারে আলাদা আলাদা চুড়া নিয়ে একটি বিস্তৃত এলাকা জুড়েও অবস্থান করতে পারে। পর্বতকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো, 

পর্বত  বৈশিষ্ট্য 
ভঙ্গিল পর্বত 
  • এই ধরনের পর্বতে শৃঙ্গের সংখ্যা বেশি 
  • শিলাসমূহ স্তরে স্তরে সজ্জিত থাকে
  • জীবাশ্ম পাওয়া যায় 
  • নরম পাললিক শিলা সমৃদ্ধ 
  • দীর্ঘ ও উচ্চতম পর্বতগুলো এই শ্রেণিভুক্ত 
  • উদাহরণ- আল্পস, ককেশাস, কার্পেথিয়ান 
আগ্নেয় পর্বত 
  • অপরনাম সঞ্চয়জাত পর্বত 
  • মোচাকৃতির হয় 
  • উচ্চতা ও ঢাল মাঝারি 
  • এই জাতীয় পর্বত আগ্নেয় শিলা দ্বারা গঠিত 
  • উদাহরণ- ইতালির ভিসুভিয়াস, আফ্রিকার কিলিমানজারো 
চ্যুতি-স্তুূপ পর্বত 
  • এরা স্বল্প জায়গা জুড়ে অবস্থান করে 
  • ঢাল খুব খাড়া হয় 
  • চূড়া চ্যাপ্টা আকৃতির 
  • উদাহরণ- ভারতের বিন্ধ্যা, সাতপুরা, নীলগিরি, আন্নামালাই 
ল্যাকোলিথ পর্বত 
  • গম্বুজাকৃতির পর্বত 
  • শৃঙ্গ থাকে না 
  • অল্প অঞ্চলব্যাপী অবস্থান করে 
  • ঢাল খাড়া হয় 
  • উচ্চতা কম হয় 
  • উদাহরণ- আমেরিকার হেনরি পর্বত, ব্ল্যাক হিলস 

মালভূমি 

সমতলভূমি দ্বারা বেষ্টিত উঁচু সমতল ভূমিকে মালভূমি বলা হয়। পর্বত থেকে এর পার্থক্য এখানেই যে, পর্বতের ন্যায় এর কোন চূড়া থাকে না। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এদের উচ্চতা কয়েকশ থেকে কয়েক হাজার মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর ঢাল অত্যন্ত খাড়া, মোটামুটি ভূমির সাথে নব্বই ডিগ্রি কোণে থাকে। মালভূমিকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়।  

মালভূমি বৈশিষ্ট্য 
পর্বতমধ্য মালভূমি 
  • এর চতুর্দিক পর্বত দ্বারা বেষ্টিত থাকে 
  • বাকি প্রকারভেদ থেকে এরা আকারে বড়, উঁচু হয় 
  • উদাহরণ- বলিভিয়া মালভূমি, মেক্সিকো মালভূমি 
পাদদেশীয় মালভূমি 
  • পর্বতের সর্বনিন্ম বিন্দু থেকে এদের সূচনা 
  • সাধারণত পর্বত হতে বৃষ্টির জলে ভেসে আসা ক্ষয়প্রাপ্ত নানা পদার্থ জমা হয়ে এই মালভূমি গঠিত হয় 
  • উদাহরণ- কলোরাডো মালভূমি, দক্ষিণ আমেরিকার পাটাগোনিয়া 
মহাদেশীয় মালভূমি 
  • এর এক পাশে থাকে সাগর বা নিন্মভূমি 
  • পর্বতের কোন সংযোগ থাকে না 
  • উদাহরণ- স্পেন, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি মহাদেশীয় মালভূমি 

 

সমভূমি 

সমুদ্র থেকে সামান্য উঁচু, স্বল্প ঢাল বিশিষ্ট, প্রশস্ত ও সুবিস্তৃত সমতল ভূমিই সমভূমি নামে পরিচিত। এরা নানা আকৃতি ও প্রকৃতির হতে পারে। কয়েক হেক্টর থেকে কয়েক হাজার বর্গমাইলের সমভূমিও এই ভূভাগে বিদ্যমান। সমভূমি দুই প্রকার, যথা- 

সমভূমি  বৈশিষ্ট্য 
ক্ষয়জাত সমভূমি 
  • এর উপরে মাটির আবরণ খুব বেশি পুরু নয় 
  • কৃষিকাজের জন্য খুব বেশি উপযোগী নয় 
  • নদীপ্রবাহ, বায়ুপ্রবাহ, হিমবাহের কারণে কোন উচ্চভূমির ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় 
  • উদাহরণ- ইউরোপের ফিনল্যান্ড ও সাইবেরিয়া সমভূমি 
সঞ্চয়জাত সমভূমি 
  • উচ্চভূমি ক্ষয় হয়ে ক্ষয়িত বালুকণা, মাটি ইত্যাদি সঞ্চিত হয়ে এর সৃষ্টি 
  • এই ভূমির উর্বরতা শক্তি বেশি 

 

অভ্যন্তরীণ কাঠামো 

পৃথিবীর বাহ্যিক কাঠামো সম্পর্কিত আলোচনার পর এবার আমাদের আলোচ্য পৃথিবীর আভ্যন্তরীন কাঠামো নিয়ে। পৃথিবীর যে অংশে আমরা বাস করি, স্পষ্টতই সেটি হলো ভূত্বক। ভূত্বকের ঠিক পরের অংশটাই হলো গুরুমন্ডল, আর একদম কেন্দ্রে আছে কেন্দ্রমন্ডল। এবার এই তিনটি স্তর সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। 

আভ্যন্তরীন কাঠামো  বৈশিষ্ট্য 
ভূত্বক 
  • এই অংশের আরেক নাম অশ্বমন্ডল। অশ্ব শব্দের অর্থ শিলা। 
  • এর গড় পুরুত্ব ২০ কিলোমিটার। মহাদেশীয় অংশে এর পুরুত্ব বেশি হলেও সমদ্র তলদেশে এর পুরুত্ব গড়ে মাত্র ৫ কিলোমিটার। 
  • এই শিলামন্ডল ম্যাগনেসিয়াম, সিলিকন, কোয়ার্টজ, এলুমিনিয়াম দ্বারা তৈরি 
  • এই অংশ দুটি ভাগে বিভক্ত, একটি ‘সিয়াল’ অন্যটি ‘সিমা’
গুরুমন্ডল
  • অশ্বমন্ডলের পরের স্তর 
  • এর বিস্তৃতি ২,৮৮৫ কিলোমিটার (অশ্বমন্ডল বাদে)
  • উপরের অংশকে উর্ধগুরুমন্ডল বলা হয়, যার বিস্তৃতি ৭০০ কিলোমিটার। বাকি অংশকে নিন্মগুরুমন্ডল বলা হয়। 
  • এই অংশের মূল উপাদান ব্যসাল্ট শিলা 
  • এই অংশের গড় চাপ ৮৮৫ কিলোবার 
  • গুরুমন্ডল ও অশ্বমন্ডলের মধ্যকার সীমারেখায় একটি পাতলা স্তর বিদ্যমান যাকে মোহোবিযুক্তিরেখা বলা হয়
কেন্দ্রমন্ডল 
  • এই স্তরের পুরুত্ব ৩৪৮৬ কিলোমিটার, যা কেন্দ্র অব্দি বিস্তৃত 
  • এই অংশের প্রধান উপাদান নিকেল ও লোহা। তবে পারদ ও সিসাও রয়েছে এই অংশে 
  • গুরুমন্ডল ও কেন্দ্রমন্ডলের মধ্যবর্তী স্থান গুটেনবার্গ রেখা নামে পরিচিত
  • এই অংশ দুইটি ভাগে বিভক্ত। একটি বহিঃকেন্দ্র, অন্যটি অন্তঃকেন্দ্র 

 

ভূত্বকের কথা বলতে গিয়ে আমরা বলেছি যে, এটি শিলা দ্বারা গঠিত। এখন প্রশ্ন হতে পারে শিলা কী? শিলা হলো এক বা একাধিক খনিজ উপাদানের মিশ্রণ। তাহলে প্রশ্ন হলো, খনিজ কী? খনিজ হলো এক প্রকারের প্রাকৃতিক অজৈব পদার্থ যা দুই বা ততোধিক মৌলিক পদার্থ দ্বারা তৈরি হয়। তবে একক মৌলিক পদার্থের খনিজ-ও আছে, যেমন সোনা, রূপা, পারদ ইত্যাদি। শিলাকে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়, এগুলো হলো- 

  • আগ্নেয় শিলা
  • পাললিক শিলা
  • রূপান্তরিত শিলা

 

শিলা  বৈশিষ্ট্য উপবিভাগ উদাহরণ 
আগ্নেয় শিলা 
  • পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম পর্যায়ে সৃষ্টি 
  • উত্তপ্ত গ্যাসপিন্ড হতে ঠান্ডা  হতে হতে জমাট বেশে এই ধরণের শিলা তৈরি 
  • এই শিলাকে কোন স্তরে ভাগ করা যায় না, এতে কোন প্রকার জীবাশ্মও পাওয়া যায় না 
বহিঃজ আগ্নেয় শিলা  ব্যাসাল্ট, রায়োলাইট 
অন্তঃজ আগ্নেয় শিলা  গ্রানাইট, ল্যাকোলিথ 
পাললিক শিলা 
  • পলি সঞ্চিত হয়ে এই ধরণের শিলা গঠিত হয় 
  • স্তরীভূত, হালকা। এরা সহজেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। 
  • এতে জীবাশ্ম পাওয়া যায় 
বেলেপাথর, কয়লা, শেল, চুনাপাথর 
রূপান্তরিত শিলা 
  • আগ্নেয় ও পাললিক শিলা প্রচন্ড চাপের কারণে রূপান্তরিত শিলায় পরিণত হয় 
  • স্ফটিকযুক্ত ও কঠিন 
  • জীবাশ্ম পাওয়া যায় না 
–  স্লেট, নিস, গ্রাফাইট 

 

রাসায়নিক গঠন 

ভূত্বকের ৯৮.৪% তৈরি হয়েছে অক্সিজেন, সিলিকন, এলুমিনিয়াম, লোহা, ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম দ্বারা। বাকি ১.৬% অংশটুকুতে আরো নানা রকমের রাসায়নিক পদার্থ বিদ্যমান। নিচে একটি তালিকার সাহায্যে পৃথিবীর ভূত্বকের রাসায়নিক উপাদান ও তাদের পরিমান উল্ল্যেখ করা হলো। তবে মনে রাখতে হবে এই পরিমানগুলো স্থির নয়। বিভিন্ন স্থানে, মাটির ধরণ অনুসারে এই উপাদানগুলোর পরিমান ভিন্ন হতে পারে। 

উপাদানের নাম  সংকেত পরিমান 
অক্সিজেন  O ৪৬.৬০% 
সিলিকন  Si ২৭.৭২% 
এলুমিনিয়াম  Al ৮.১৩ 
লোহা  Fe ৫.০০% 
ক্যালসিয়াম  Ca  ৩.৬৩% 
সোডিয়াম  Na ২.৮৩% 
পটাসিয়াম  K ২.৫৯% 
ম্যাগনেসিয়াম  Mg ২.০৯% 
টাইটেনিয়াম Ti ০.৪৪% 
হাইড্রোজেন  H ০.১৪% 
ফসফরাস  P ০.১২% 
ম্যাঙ্গানিজ  Mn ০.১০% 
ফ্লোরিন  F ০.০৮% 
বেরিয়াম  Ba  ৩৪০ পিপিএম 
কার্বন  C ০.০৩% 
স্ট্রনসিয়াম  Sr  ৩৭০ পিপিএম 
সালফার  ০.০৫% 
জিরকোনিয়াম  Zr  ১৯০ পিপিএম 
টাংস্টেন  ১৬০পিপিএম 
ভ্যানাডিয়াম  ০.০১% 
ক্লোরিন  Cl ০.০৫% 
রুবিডিয়াম  Rb  ০.০৩% 
ক্রোমিয়াম  Cr  ০.০১% 
তামা  Cu  ০.০১% 
নাইট্রোজেন  ০.০০৫% 
নিকেল  Ni  খুবই সামান্য 
জিংক Zn খুবই সামান্য 

 

দেশ ও মহাদেশ  

সমগ্র স্থলভাগ মোট ৭টি মহাদেশে বিভক্ত। ৭টি মহাদেশে সব মিলিয়ে মোট ১৯৫টি দেশ রয়েছে। নিচে সবগুলো মহাদেশের নাম ও দেশের তালিকা দেয়া হলো, 

মহাদেশ  দেশের সংখ্যা দেশের নাম 
এশিয়া  ৪৮ চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, জাপান, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, তুরস্ক, ইরান, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, সৌদি আরব, উজবেকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইয়েমেন, নেপাল, উত্তর কোরিয়া, শ্রীলংকা, কাজাখস্তান, সিরিয়া, কম্বোডিয়া, জর্ডান, আজারবাইজান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তাজিকিস্তান, ইজরায়েল, লাওস, লেবানন, কিরগিজস্তান, তুর্কমেনিস্তান, সিঙ্গাপুর, ওমান, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র (পরাধীন), কুয়েত, জর্জিয়া, মঙ্গোলিয়া, আর্মেনিয়া, কাতার, বাহরাইন, তিমুর-লেস্তে, সাইপ্রাস, ভুটান, মালদ্বীপ, ব্রুনাই 
আফ্রিকা  ৫৪ নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, মিশর, ডিআর কঙ্গো, তানজানিয়া, দক্ষিন আফ্রিকা, কেনিয়া, উগান্ডা, আলজেরিয়া, সুদান, মরক্কো, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, ঘানা, মাদাগাস্কার, ক্যামেরুন, আইভরি কোস্ট, নাইজার, বুর্কিনা ফাসো, মালি, মালাউই, জাম্বিয়া, সেনেগাল, চাদ, সোমালিয়া, জিম্বাবুয়ে, গিনি, রুয়ান্ডা, বেনিন, বুরুন্ডি, তিউনিসিয়া, দক্ষিণ সুদান, যাও, সিয়েরা লিওন, লিবিয়া, কঙ্গো, লাইবেরিয়া, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, মৌরিতানিয়া, ইরিত্রিয়া, নামিবিয়া, গাম্বিয়া, বতসোয়ানা, গ্যাবন, লেসোথো, গিনি-বিসাউ, নিরক্ষীয় গিনি, মরিশাস, এস্বাতিনী, জিবুতি, কমোরোস, কাবো ভার্দে, সাও টোমে এবং প্রিন্সিপে, সেশেলস
ইউরোপ ৪৪ রাশিয়া, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, ইউক্রেন, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, চেক প্রজাতন্ত্র, গ্রীস, পর্তুগাল, সুইডেন, হাঙ্গেরি, বেলারুশ, অস্ট্রিয়া, সার্বিয়া, সুইজারল্যান্ড, বুলগেরিয়া, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, মলদোভা, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, আলবেনিয়া, লিথুয়ানিয়া, উত্তর মেসিডোনিয়া, স্লোভেনিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, মন্টিনিগ্রো, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, আইসল্যান্ড, এন্ডোরা, মোনাকো, লিচেনস্টাইন, সান মারিনো, 

হলি সী

উত্তর আমেরিকা  ২৩ অ্যান্টিগুয়া ও বার্বুডা, বাহামাস, বার্বাডোজ, বেলিজ, কানাডা, কোস্টারিকা, কিউবা, ডমিনিকা, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র, এল সালভাদর, গ্রেনাডা, গুয়াতেমালা, হাইতি, হন্ডুরাস, জ্যামাইকা, মেক্সিকো, নিকারাগুয়া, পানামা, সেন্ট কিটস ও নেভিস, সেন্ট লুসিয়া, সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রেনাডাইন দ্বীপপুঞ্জ, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, যুক্তরাষ্ট্র
দক্ষিণ আমেরিকা  ১২ আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, ব্রাজিল, চিলি, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, গায়ানা, প্যারাগুয়ে, পেরু, সুরিনাম, উরুগুয়ে, ভেনেজুয়েলা
ওশেনিয়া  ১৪ অস্ট্রেলিয়া, পাপুয়া নিউ গিনি, নিউজিল্যান্ড, ফিজি, সলোমান দ্বীপপুঞ্জ, মাইক্রোনেশিয়া, ভানুয়াতু, সামোয়া, কিরিবাতি, টোঙ্গা, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, পালাউ, টুভালু, নাউরু
এন্টার্কটিকা – 

 

গুরুত্বপূর্ণ রেখাসমূহ 

১) বিষুবরেখা- উত্তর দক্ষিণ মেরু ছেদকারী মেরু রেখার মধ্যবিন্দুকে কেন্দ্র করে পূর্বপশ্চিম বরাবর যে মহাবৃত্ত কল্পনা করা হয়, তাকে বিষুব রেখা বা নিরক্ষ রেখা বলে। 

২) অক্ষরেখা- মহাবৃত্তকে সমান্তরালে রেখে উত্তর-দক্ষিণে অঙ্কিত বাকি রেখাগুলো অক্ষরেখা নামে পরিচিত। 

৩) দ্রাঘিমারেখা- নিরক্ষরেখাকে ডিগ্রি, মিনিট ও সেকেন্ডে ভাগ করে প্রত্যেক ভাগবিন্দুর ওপর দিয়ে উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু অব্দি যে সকল রেখা কল্পনা করা হয়েছে, সেগুলোই দ্রাঘিমা রেখা হিসেবে পরিচিত। 

৪) কর্কটক্রান্তি রেখা- সাড়ে তেইশ ডিগ্রি উত্তর অক্ষরেখাকে কর্কটক্রান্তি রেখা বলা হয়।  

৫) মরকক্রান্তি রেখা- সাড়ে তেইশ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষরেখাকে মকরক্রান্তি রেখা বলা হয়। 

 

নতুনরূপে অনলাইন ব্যাচ ২০২৪ (৬ষ্ঠ-১০ম শ্রেণি)

কোর্সটিতে যা যা পাচ্ছেন:

  • ৬টি বিষয়ের উপর ইন্টারেক্টিভ লাইভ ক্লাস
  • ডাউট সলভ ও প্রতিটি ক্লাসের লেকচার শীট
  • ডেইলি প্র্যাক্টিস ও উইকলি প্র্যাক্টিস
  • ডেমো অ্যাসাইনমেন্ট ক্লাস ও প্র্যাক্টিস
  • "

     

    বাসযোগ্যতা 

    আমাদের পৃথিবী তার বাসযোগ্যতা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে, আর এর পেছনে যেমনিভাবে মানবসৃষ্ট কারণগুলো দায়ী, তেমনিভাবে দায়ী প্রকৃতি নিজেও। কেন ধীরে ধীরে তার বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলছে তার কয়েকটি কারণ নিচে তুলে ধরা হলো- 

    ১) জলবায়ু পরিবর্তন- মানবজাতি কর্তৃক নিঃসৃত গ্রীনহাউজ গ্যাসের প্রভাবে ওজন স্তরের যে তীব্র  ক্ষতি সাধন ইতোমধ্যে হয়ে গিয়েছে, তা বোঝা যায় সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনকে লক্ষ্য করার মধ্য দিয়ে। এর ফলে বিশ্বউষ্ণায়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে, খরার হার বাড়ছে, প্রাকৃতিক নানা দূর্যোগের বৃদ্ধি ঘটছে, দাবদাহের ফলে বিশ্বের নানা স্থান ধীরে ধীরে জনশূন্য হচ্ছে। 

    ২) সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি- জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি মারাত্মক ফলাফল হলো সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, যা এই উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। ফলাফল হিসেবে দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশংকা দিনকে দিন বাড়ছে। কেবল দ্বীপ নয়, বিভিন্ন রাষ্ট্রের উপকূলে বসবাসরত মানুষরাও তাদের বাসস্থান হারাতে পারেন, এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

    ৩) সুপেয় পানির অভাব- প্রতিনিয়ত আমাদের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আরো নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে বিশ্বের নানা অঞ্চলে ধীরে ধীরে সুপেয় পানির মারাত্মক অভাব দেখা দিচ্ছে। এতে বাধ্য হয়েই দূষিত পানি পান করতে হচ্ছে, যা একসময় এই পৃথিবী জনশূন্য করে দেয়ার জন্য যথেষ্ঠ। 

    ৪) মরুকরণ- বিশ্বের তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি প্রাপ্তি, পাশাপাশি অনিয়ন্ত্রিত ভাবে নগরায়নের জন্য বৃক্ষকর্তনের কারণে পৃথিবীর মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। এর ফলে আবাদি জমির পরিমান হ্রাস পাচ্ছে, ধীরে ধীরে দেখা দিচ্ছে খাদ্য সংকট। 

    ৫) পারমানবিক দূর্ঘটনা- রাশিয়ার চেরনোবিলের ১৯৮৬ সালের দূর্ঘটনার কথা আমরা সবাই জানি। এই দূর্ঘটনার ফলে রাশিয়ার ঐ নিদৃষ্ট অংশ এখনো মানব বসতির যোগ্যতা পুনঃলাভ করতে পারেনি। পারমানবিক পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোর এমন দুর্ঘটনা মানব জাতির অস্তিত্বের জন্য মারাত্মকভাবে হুমকিস্বরূপ। 

     

    woman protesting because global warming

    Source: Freepik

    ৬) যুদ্ধ- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা কর্তৃক জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা হামলা হয়। এতে করে সেখানে যে কেবল মানুষের মৃত্যু ঘটেছে তা নয়, ঘটেছে প্রকৃতিরও মৃত্যু। সেখানে জন্ম নেয়া বৃক্ষের পাতায়, ফলে এখনো তেজস্ক্রিয়তার উপস্থিতি পাওয়া যায়, জন্ম নেয়া শিশুদের মধ্যে বিকলাঙ্গ হওয়ার হারও কম নয়। বলা হচ্ছে এমন দূর্যোগ আরো কয়েক প্রজন্ম তাদের বয়ে বেড়াতে হবে। বর্তমান সময়ে ইউক্রেন-রাশিয়া সংকট, কিংবা ইজরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের মতো আরো কিছু যুদ্ধ যদি শুরু হয়, তবে মানব জাতি কতদিন টিকে থাকবে তা বলা মুশকিল। যুদ্ধের ফলাফল কেবল মানুষের উপর নয়, প্রকৃতির ওপর-ও সমানভাবে পড়ে। 

    ৭) বাস্তুসংস্থান ধংস- পরিবেশের এত এত বিপর্যয়ের ফলে প্রকৃতিতে থাকা স্বাভাবিক বাস্তুসংস্থান নষ্ট হচ্ছে। এতে করে হারিয়ে যাচ্ছে উদ্ভিদ, নানা প্রজাতির উপকারি প্রাণী। ফলে পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাচ্ছে প্রতিনিয়ত। 

    ৮) মহামারি- অতি সাম্প্রতিক কালে আমরা করোনা মহামারি পার করেছি, পৃথিবী যে এখনো পুরোপুরি সুস্থ তাও বলা যায় না। এই লেখাটা যখন আমি লিখছি তখন বাংলাদেশে চলছে ডেঙ্গু। প্রতিনিয়ত পত্রিকায় ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধির খবর ছাপা হচ্ছে, প্রতিদিনই পত্রিকায় আসছে স্বজন হারানো মানুষের আর্তনাদের ছবি। পৃথিবীর বাসযোগ্যতার এমন সব মহামারির তীব্রতার কারণে দিন দিন আরো কমে যাচ্ছে। 

     

    বিশ্ব ধরিত্রী দিবস 

    পৃথিবীর এমন ক্রান্তিলগ্নকে জনমানুষের সামনে আরো ব্যপকভাবে হাজির করতে, তাদেরকে সচেতন করতে, পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে আরো স্বোচ্চার করতে, প্রতিবছর সারাবিশ্বে ২২শে এপ্রিল ‘বিশ্ব ধরিত্রী দিবস’ পালন করা হয়। ১৯৭০ সালে সর্বপ্রথম পরিবেশ দূষণ, মরুকরণ, প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ত হ্রাসের প্রতি লক্ষ্য রেখে এই দিবসের সূচনা করা হয়। আধুনিক পরিবেশ আন্দোলনের সূচনাও এরই মাধ্যমে ঘটে। বর্তমান বিশ্বে ‘বিশ্ব ধরিত্রী দিবস’ পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি, এবং এ সম্পর্কিত শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। 

     

    কিছু অজানা ইন্টারেস্টিং তথ্য

    ১) পৃথিবী সম্পূর্ণ গোল নয়, উত্তর-দক্ষিণে কিছুটা চাপা। পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারণে এরূপ হয়। 

    ২) প্রায় সকল ভাষায় পৃথিবী শব্দটি মাটি শব্দের সমার্থক শব্দ।

    ৩) পৃথিবী থেকে যেমনিভাবে চাঁদের উদয়-অস্ত দেখা যায়, চাঁদ থেকেও পৃথিবীর উদয়-অস্ত দেখা যায়। 

    ৪) সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে গিয়ে পৃথিবী প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয় 

    ৫) পৃথিবীতে একটা সময় প্রায় ৭০০ প্রজাতির ডায়নোসর বাস করতো

    ৬) চিলির আটাকামা মরুভূমি তে কখনোই বৃষ্টিপাত হয় নি। এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে শুকনো জায়গা।

    ৭) পৃথিবীই একমাত্র গ্রহ যেখানে পানি মোট তিনটি (কঠিন, তরল, বায়বীয়) অবস্থাতেই থাকতে পারে।

    ৮) সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে প্রায় ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড লাগে

    ৯) প্রতি ১০০ বছরে প্রায় ১৭ মিলি সেকেন্ড করে সময় বাড়ছে। এর মানে আরো ১৪০ মিলিয়ন বছর পর পৃথিবী তে ২৫ ঘন্টায় এক দিন হবে।

     

    পৃথিবী

    Source- Freepik 

     

    কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর

     

    • ১) পৃথিবীর বয়স কত?

    উত্তর- ৪.৫৪৩ বিলিয়ন বছর 

    • ২) পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব কত? 

    উত্তর- ১৪৭.৭৯ মিলিয়ন কিলোমিটার 

    • ৩) পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব কত কিলোমিটার? 

    উত্তর- ৩,৮৪,৪০০ কিলোমিটার 

    • ৪) সূর্য পৃথিবী থেকে কত গুন বড়? 

    উত্তর- সূর্যের ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের ১০৯ গুণ 

    • ৫) পৃথিবীর উপগ্রহ কয়টি? 

    উত্তর- একটি, আর তা হলো চাঁদ 

    • ৬) পৃথিবী কোন গ্যালাক্সিতে অবস্থিত? 

    উত্তর- মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি 

    • ৭) পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে কেন? 

    উত্তর- মধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে 

    • ৮) পৃথিবী কিভাবে ঘুরে? 

    উত্তর- নিজ অক্ষের উপর, উপবৃত্তাকার পথে 

    • ৯) পৃথিবীতে মোট কয়টি দেশ আছে? 

    উত্তর- ১৯৫ টি 

    • ১০) পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা কত? 

    উত্তর- প্রায় ৮.১ বিলিয়ন 

    • ১১) পৃথিবীর মহাসাগর কয়টি? 

    উত্তর- ৫টি 

    • ১২) পৃথিবীর উষ্ণতম স্থান কোনটি? 

    উত্তর- ডেথ ভ্যালি

    • ১৩) পৃথিবীর প্রথম প্রাণ কী? 

    উত্তর- মাইক্রোস্কোপিক অর্গানিজম 

    • ১৪) পৃথিবী থেকে মঙ্গলের দূরত্ব কত? 

    উত্তর- ৩৭৮.৫ মিলিয়ন কিলোমিটার 

    • ১৫) বিশ্ব ধরিত্রী দিবস কবে? 

    উত্তর- ২২শে এপ্রিল

    • ১৬) পৃথিবীর মানচিত্র বা ম্যাপ কে অঙ্কন করেন? 

    উত্তর- গ্রিক দার্শনিক এনাক্সিমেন্ডার প্রথম অঙ্কন করার চেষ্টা করেন.

    শেষ কথা

    এই লেখায় আলোচনা করা হয়েছে পৃথিবী সম্পর্কে। পৃথিবী কী, পৃথিবীর সৃষ্টির ইতিহাস কী, পৃথিবীর গঠন- আভ্যন্তরীন ও বাহ্যিক ইত্যাদি বিষয় এখানে আলোচনায় এসেছে। এছাড়া আলোচিত হয়েছে কী করে পৃথিবী ধীরে ধীরে তার বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। আমাদের এই নীল গ্রহ খুব শীঘ্রই মরুভূমিতে পরিণত হবে, যদি এখনি আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করি। এই পৃথিবীকে নতুন শিশুর জন্য বাসযোগ্য করে রেখে যাওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। 

     


    তথ্যসূত্র

    নতুন কারিকুলামে ৬ষ্ঠ-৯ম শ্রেণির পড়ালেখা নতুন উদ্যমে শুরু করতে টেন মিনিট স্কুল নতুনরূপে নিয়ে এসেছে ‘অনলাইন ব্যাচ ২০২৪’:

    ১০ মিনিট স্কুলের ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে সরাসরি চলে যেতে পারেন এই লিঙ্কে: www.10minuteschool.com

    আপনার কমেন্ট লিখুন