নতুন কারিকুলামে একক ও দলীয় কাজ: কী ভাবছেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক এবং নীতিনির্ধারকগণ?

December 31, 2023 ...

জীবনস্মৃতি-তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, 

শিক্ষার সকলের চেয়ে বড়ো অঙ্গটা—বুঝাইয়া দেওয়া নহে, মনের মধ্যে ঘা দেওয়া।

স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পর, বাংলাদেশ তার অপ্রতিরোধ্য চলার পথকে আরো মসৃণ করতে, আরো বেশি জনসম্পদ তৈরি করতে, একটি সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার লক্ষ্যে নতুন এক শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে। আর আশ্চর্য হলেও সত্য, এই শিক্ষাক্রম যেন রবীন্দ্রনাথের এই উক্তির এক বিস্তারিত রূপ, কারণ এই শিক্ষাক্রম একজন শিক্ষার্থীকে ‘মনের মধ্যে ঘা’ দেবার লক্ষ্যে তৈরি। যার ফলাফল হিসেবে মুখস্থ নির্ভর ও গাইড বই নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে একজন শিক্ষার্থী কোন একটি বিষয়কে মন থেকে শিখবে, তাকে আত্মস্থ করবে, এবং যোগ্যতা ভিত্তিক মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে তার ভেতর যোগ্যতার চারটি অংশ- জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধের বিকাশ ঘটবে। 

 

এই ব্লগে আমি আলোচনা করার চেষ্টা করবো নতুন কারিকুলামে একক ও দলীয় কাজ ভিত্তিক এসাইনমেন্ট এবং পোস্টার প্রেজেন্টেশন নিয়ে। আলোচনার সুবিধার্থে সর্বপ্রথম পুরাতন শিক্ষাক্রম সম্পর্কিত একটি সাধারণ ধারণা উল্ল্যেখ করা হবে, যেন পরবর্তী অংশে আলোচিত নতুন কারিকুলাম ও পুরাতন কারিকুলামে এসাইনমেন্ট তথা বাড়ির কাজের তুলনামূলক আলোচনা সহজেই বোধগম্য হয়। এছাড়া ব্লগের একটি অংশে, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও নীতিনির্ধারকরা কী ভাবছেন সে বিষয়টি উঠে আসবে টেন মিনিট স্কুল  আয়োজিত 10MS EduTalk– এর আলোকে, যেখানে উপস্থিত ছিলেন NCTB এর একজন কর্মকর্তা ও একজন শিক্ষাগবেষক ও বেশ কজন শিক্ষার্থী ও অভিভাবক। আর একদম শেষে যুক্ত করে দেয়া হবে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা ও তাদের উত্তর। 

 নতুন কারিকুলাম - একক ও দলীয় কাজ

[Image Source- Freepik]

 

পুরাতন শিক্ষাক্রম: একটি সাধারণ ধারণা 

পুরাতন শিক্ষাক্রম, অর্থাৎ যে শিক্ষাক্রমটি ২০২৪ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে পুরাতন শিক্ষাক্রম হিসেবে বিবেচিত হবে, সেই শিক্ষাক্রমে একজন শিক্ষার্থীকে প্রতি বিষয়ে মোট ১০০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে হতো। এই নম্বরের পাশাপাশি, প্রতি বিষয়ের মোট নাম্বারের ২০ শতাংশ ধারাবাহিক মূল্যায়নের ভিতর দিয়ে যেতে হতো।  {দেখুন- জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২, পৃষ্ঠা ১৬ ও ১৭} পরবর্তীকালে, এই দুই ধরনের মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবককে ফলাফল জানানো হতো, পাশাপাশি তৈরি হতো পরবর্তী শ্রেণীর রোল।

 

পুরাতন শিক্ষাক্রমে এসাইনমেন্টের লক্ষ্য

এসাইনমেন্টের ধরণ 

পুরাতন শিক্ষাক্রমের  মূল্যায়নের একটি অংশ ‘ধারাবাহিক মূল্যায়ন’ হিসেবে পরিচিত। প্রতিটি বিষয়ের মোট নম্বরের শতকরা ২০ শতাংশ নাম্বার ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হতো। এই ২০ শতাংশ নম্বরের মধ্যে ৫ নম্বর নির্ধারিত থাকতো বাড়ীর কাজ ও অনুসন্ধানমূলক কাজের উপর। বাড়ির কাজ ও অনুসন্ধানমূলক কাজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১২ যে মন্তব্য করে, তার সারাংশ হলো- শিক্ষাক্রম ভিত্তিক কিছু কাজ শিক্ষকের নির্দেশনা অনুসারে একজন শিক্ষার্থী বাড়িতে সমাধান করবে। কাজগুলো সে করবে এককভাবে, এবং কাজগুলো এমন হবে যেন তা ২০-২৫ মিনিটে সমাধান করা যায়। আর অনুসন্ধান্মূলক কাজ প্রদান করা হবে একজন শিক্ষার্থীর সমাধান দক্ষতা ও চিন্তন দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য। শিক্ষক একটি বিষয়, সে বিষয়ের পর্যবেক্ষণ টুলস, সিডিউল, প্রশ্নমালা তৈরি করে দেবেন, শিক্ষার্থীরা সেই কাজ সমাধানের লক্ষ্যে প্রাইমারি বা সেকেন্ডারি উৎস হয়ে তথ্য সংগ্রহ করবে। {দেখুন- জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২}

 

মূল্যায়ন পদ্ধতি

প্রদত্ত কাজ সমাধানের পর শিক্ষার্থী তা শিক্ষককে বুঝিয়ে দেবে। শিক্ষক মূল্যায়ন করবেন ৫ নম্বরের ভিত্তিতে। তবে শিক্ষক যে কোন নম্বরের কাজ দিতে পারেন, কিন্তু মূল্যায়নের সময় তা ৫ নাম্বারের ভিত্তিতে রূপান্তর করতে হবে। রূপান্তরের পর নম্বর ভগ্নাংশ হলে সেটি ভগ্নাংশ আকারেই সংরক্ষণ করতে হবে। শিক্ষক শিক্ষার্থীর এই প্রাপ্ত নাম্বার মূল্যায়নের শিটে রেকর্ড রাখবেন। 

 

শিখনফল

বাড়ির কাজ ও অনুসন্ধানমূলক কাজের এই অংশের মূল উদ্দেশ্য একজন শিক্ষার্থীকে মুখস্থ বিদ্যার শৃঙ্খল থেকে বের করে আনা। এছাড়া তাদের চিন্তন দক্ষতাকে শাণিত করা,  সৃজনশীলতাকে উসকে দেয়া, দায়িত্ববোধ সম্পন্ন করাও এই অংশের আরেকটি উদ্দেশ্য। 

 

শিখনফল

[Image Source- Freepik]

 

নতুন কারিকুলামে এসাইনমেন্টের লক্ষ্য

এসাইনমেন্টের ধরণ

শ্রেণিকক্ষে ও শ্রেণিকক্ষের বাইরে একজন শিক্ষার্থীর বিভিন্ন অর্জনকে স্বীকৃতি দেয়ার লক্ষ্যে নতুন কারিকুলামে শিখনকালীন মূল্যায়ন একটি বড় জায়গা দখল করে থাকবে। শ্রেণিকক্ষের বাইরের অর্জন-ই মূলত আগের শিক্ষাক্রমের বাড়ির কাজ ও এসাইনমেন্ট পদ্ধতির আরেকটি রূপ, তবে পার্থক্য নিশ্চই থাকবে। শিখনকালীন মূল্যায়নের আওতায় দেখা হবে একজন শিক্ষার্থী কতটুকু শিখছে, তার আগ্রহ কতটুকু, ক্লাসে তার ব্যবহার কেমন, দলগত কাজে তার পার্ফর্মেন্স কেমন- এই বিষয়গুলো। এই মূল্যায়ন হবে সম্পূর্ণ অনানুষ্ঠানিক ও ব্যক্তি নিরপেক্ষ। 

নতুন এই শিক্ষাক্রম অনুসারে, প্রদত্ত এসাইনমেন্টে একজন শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দেয়া হবে। এই অভিজ্ঞতাকে তুলে আনতে চারটি ধাপ মেনে চলা হবে। প্রথম ধাপে শিক্ষার্থীরা কোন একটি সুনির্দৃষ্ট বিষয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতাকে উপস্থিত বক্তৃতার মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করবে, এবং এর মধ্য দিয়ে নিজের দলের জন্য একটি সমস্যা চিহ্নিত করবে। দ্বিতীয় ধাপে শিক্ষার্থীরা সেই সমস্যার সমাধানকল্পে দলীয়ভাবে জরিপ পরিচালনা করবে। জরিপ পরিচালনার সময় তারা প্রাইমারি বা সেকেন্ডারি উৎস হতে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করবে এবং সেগুলো যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করবে। তৃতীয় ধাপে এসে শিক্ষার্থীরা প্রাপ্ত তথ্য থেকে নতুন একটি সিদ্ধান্তে উপনিত হবে। সরাসরি শিক্ষকের সহায়তায় তারা উক্ত বিষয় সম্পর্কে প্রাপ্ত নতুন ধারণার সাথে পূর্বের ধারণার একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করবে এবং প্রতিবেদন তৈরি করবে। পরবর্তীকালে, চতুর্থ ধাপে শিক্ষার্থীরা দলগতভাবে তাদের নতুন চিন্তাকে সেমিনারের মাধ্যমে উপস্থাপন করবে। 

 

নতুন কারিকুলাম - শিখনফল

 

মূল্যায়ন পদ্ধতি

শিখনকালীন মূল্যায়নের মান শ্রেণীভিত্তিক ভাবে আলাদা রাখা হয়েছে। যেমন- প্রাক প্রাথমিক ও ১ম হতে ৩য় শ্রেণী পুরোপুরিভাবে শিখনকালীন মূল্যায়নের উপর নির্ভর করবে। ৪র্থ ও ৫ম, এবং ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ৬০%, ৯ম ও ১০ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ৫০ এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ৩০% শিখনকালীন মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। পরবর্তীকালে, শিখনকালীন মূল্যায়নের সাথে সামষ্টিক মূল্যায়নের সামঞ্জস্য করে শিক্ষার্থীকে পরবর্তী শ্রেণিতে প্রমোশন দেয়া হবে। তবে পূর্বে যেখানে একজন শিক্ষার্থীকে তার পারদর্শীতার উপর ‘নাম্বার’ দেয়া হতো, সে বিষয়টি এখন আর থাকছে না। এর পরিবর্তে এখানে একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করবেন ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ ও বৃত্তের মাধ্যমে। ফলে আগে নম্বর প্রাপ্তি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে অসুস্থ প্রতিযোগীতা কাজ করতো, তা এবার হ্রাস পাবে। {দেখুন- জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১}

 

মূল্যায়ন পদ্ধতি

[Image Source- জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১]

 

শিখনফল

নতুন এই পদ্ধতির শিখনফল ব্যাপক ও বিস্তৃত। শিখনকালীন মূল্যায়নের সময়ে তাকে বাড়িতে যে কাজ দেয়া হবে, সে কাজ সে একা সমাধান করবে এমনটাই কাম্য। স্কুলে শিক্ষকের নির্দেশনা অনুসারে বাড়িতে বসে নিজে সেই কাজের সমাধানের মধ্য দিয়ে তার মধ্যে সততার গুণ বিকশিত হবে। একক কাজ ছাড়াও দলীয় কাজ সমাধানের মধ্য দিয়ে তার মধ্যে তৈরি হবে দায়িত্বশীলতা ও গণতান্ত্রিকতা। এছাড়া দলের প্রতিটি মানুষের মতামতকে সম্মান দেয়ার মধ্য দিয়ে সে পরমতসহিষ্ণুতা শিখবে, শিখবে অসাম্প্রদায়িকতা। এছাড়া এই দলগত কাজ তাকে সংহতি ও সম্প্রীতির শিক্ষাও দেবে- এমনটাই জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১-এ বর্ণিত আছে। {দেখুন- জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১} পৃষ্ঠা- ২১ 

 

শিক্ষার্থী মূল্যায়ন ছক

[Image- শিক্ষার্থী মূল্যায়ন ছক]

 

শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও নীতিনির্ধারকদের মতামত

 

চীন দেশে একটি প্রবাদ আছে, ‘মাছ খেতে নয়, ধরতে শেখাও’। নতুন কারিকুলামের শিক্ষানীতি একজন শিক্ষার্থীকে মাছ খেতে দেবে না, বরং কি করে মাছটা ধরতে হয়, সে বিষয়্টি সম্পর্কে ওয়াকিবয়াহাল করবে। আর এই বিষয়টিই উঠে এসেছে টেন মিনিট স্কুল  আয়োজিত 10MS EduTalk-এ। নতুন কারিকুলাম নিয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবকরা কী ভাবছেন, তাদের মতামত কী- এই সকল কিছু জানতে টেন মিনিট স্কুল অতি সম্প্রতি আয়োজন করেছিলো 10MS EduTalk নামের একটি মতবিনিময় সভার, যেখানে শিক্ষার্থী অভিভাবকের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে, পাশাপাশি নতুন কারিকুলাম নিয়ে সাধারণ ধারণা দিতে উপস্থিত ছিলেন নতুন কারিকুলামের সাথে যুক্ত NCTB এর একজন কর্মকর্তা ও একজন শিক্ষাগবেষক । তাদের একজন অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য, এবং এম তারিক আহসান, অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং দুজন এক্সপার্টের সরাসরি আলাপে নতুন এই শিক্ষাক্রমের অনেকগুলো বিষয় উঠে এসেছে। 

 

তারিক মনজুর স্যার আলোচনার শুরুতেই বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাসের জায়গাটিকে তুলে আনেন সকলের সামনে। ৬৯ এর শিক্ষানীতির মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্যের যে বিভাজন তৈরি হয়েছিলো, এবং বর্তমান সময়ের সাথে এই শিক্ষাক্রমের যে বিপরীত অবস্থান, সেটি তার কথায় উঠে এসেছে। তার মতে, নতুন যে কারিকুলাম তৈরি হচ্ছে, সেখানে একজন শিক্ষার্থী তার নিজের অবস্থান অনুযায়ী, প্রেক্ষিত অনুযায়ী, সামর্থ্য অনুযায়ী নিজেকে মেলে ধরবার সুযোগ পাবে। 

 


নতুন কারিকুলাম নিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের যত প্রশ্ন

 


 

অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান স্যারের মতে, নতুন কারিকুলাম হবে অনেক বেশি যোগ্যতাভিত্তিক। এই যোগ্যতা তৈরি হবে চারটি বিষয়ের সমন্বয়ে। এগুলো হলো- জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি। বিষয়টিকে তিনি গাড়ি চালানোর উদাহরণ দিয়ে বেশ সহজে বুঝিয়ে দিয়েছেন। ধরা যাক, কোন একজন শিক্ষার্থীকে গাড়ি কি করে চালাতে হয় সে সম্পর্কে বইয়ের দুটো পৃষ্ঠা মুখস্থ করতে দেয়া হলো। শিক্ষার্থী সেটা মুখস্থ করে খাতায় লিখে দিলে তাকে নাম্বার দিয়ে দেয়া হয়। এতে করে ড্রাইভিং সিটে বসিয়ে দিলে সে গাড়ি চালাতে পারবে কি না, সে বিষয়টি মুখ্য ছিলো না। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে তাকে সেই গাড়িটা চালানোর মতো দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কেবল তাই নয়, গাড়ি চালানোর সময়ে সিট বেল্ট বাধা কিংবা যত্রতত্র পার্কিং না করার মতো মূল্যবোধও সে অর্জন করবে। 

 

অভিভাবকদের অনেকেই এই সময়ে নানান প্রশ্ন তোলেন। এমন একটি প্রশ্ন হলো- শিক্ষার্থীদের বইতে তত্ত্বের ভাগ অনেক কম। কিন্তু মূল্যায়নের সময়ে সে প্রশ্ন করা হচ্ছে, সেখানে এই তত্ত্ব সাহায্য করছে সিকিভাগ। এর উত্তরে মশিউজ্জামান স্যার বলেন, নতুন কারিকুলাম তৈরিই করা হচ্ছে, যেন শিক্ষার্থীরা একটা সমস্যাকে চিহ্নিত করতে পারে এবং তার সমাধান নিজেরা বের করতে পারে। সেক্ষেত্রে অভিভাবক তাকে উত্তরটা বলে দেবেন না, হয় শিক্ষার্থী নিজে তা খুঁজে বের করবে, অথবা উত্তরটা কোথায় বা কার কাছে পাওয়া যেতে পারে সে সম্পর্কে খোজ করবে। এবং এভাবেই তার মধ্যে কোন সমস্যাকে সমাধানের যৌক্তিক ও কার্যকর সমাধান বের করার দক্ষতা তৈরি হবে। মশিউজ্জামান স্যার ৯৬ সালের শিক্ষাক্রমের উদাহরণ টেনে বলেন, সে সময়ে জনসংখ্যা সমস্যা প্রকট ছিলো বিধায় শিক্ষার্থীদের এই সমস্যা নিরসনের কিছু পদ্ধতি বাতলে দেয়া হতো, সেগুলোই শিক্ষার্থীরা শিখতো, পরীক্ষা দিতো। কিন্তু বর্তমানে আর সেই সমস্যা নেই, বর্তমানে সমস্যা অন্যরকম। ফলে তখনকার শিক্ষার্থীদের সেই জ্ঞান এখন এসে আর খুব একটা কাজে লাগছে না। কিন্তু সে সময়ে যদি প্রবলেম সলভিং শেখানো যেন, তাহলে এখন হতো আমরা ভিন্ন চিত্র দেখতে পেতাম। তাই বর্তমানের শিক্ষার্থীদের সমস্যা মোকাবেলা করার পদ্ধতি শেখানো হবে, কোন নিদৃষ্ট সমস্যাকে ধরে এগোনো এই শিক্ষাক্রমের উদ্দেশ্য নয়। তারিক মনজুর স্যার এর সাথে আরো যুক্ত করেন যে, নতুন এই পরিবর্তনের মুহুর্তে শিক্ষার্থীরা গিনিপিগ হচ্ছে না, বরং এই ট্রানজিশনের মধ্য দিয়ে যাওয়ার দরুণ তাদের মধ্যে নতুন কোন বিষয়ে অভিযোজন করবার প্রক্রিয়াটি ইন্সটল হচ্ছে। 

 

নতুনরূপে অনলাইন ব্যাচ ২০২৪ (৬ষ্ঠ-১০ম শ্রেণি)

কোর্সটিতে যা যা পাচ্ছেন:

  • ৬টি বিষয়ের উপর ইন্টারেক্টিভ লাইভ ক্লাস
  • ডাউট সলভ ও প্রতিটি ক্লাসের লেকচার শীট
  • ডেইলি প্র্যাক্টিস ও উইকলি প্র্যাক্টিস
  • ডেমো অ্যাসাইনমেন্ট ক্লাস ও প্র্যাক্টিস
  • "

     

    আরেকজন অভিভাবকের মতে, এসাইনমেন্ট ভিত্তিক পড়াশোনার  ফলে তাদেরকে নানা রকমের উপকরণ সন্তানকে কিনে দিতে হচ্ছে, যা শহরে অনেক বেশি ব্যায়বহুল, আর গ্রামে একেবারেই অপ্রতুল। এর উত্তরে মশিউজ্জামান স্যার বলেন, এই সকল এসাইনমেন্ট করার জন্য একজন শিক্ষার্থীকে যে সমস্ত উপকরণ যোগাড় করার কথা বলা হচ্ছে, তা একেবারেই সহজলভ্য এবং সস্তা। কারণ উপকরণে বলা হচ্ছে পুরানো খবরের কাগজ ব্যবহার করতে, ফেলে দেয় রঙিন কোন বাক্স কিংবা গাছের শুকনো পাতা ব্যবহার করতে। শিক্ষার্থীকে দামী আইকা না কিনে বরং কি করে ঘরেই আঠা তৈরি করা যায় সে সম্পর্কে শিখতে ও শেখাতে  বলা হচ্ছে। মশিউজ্জামান স্যারের মতে, এসকল দামী উপাদান কেনার কথা তথাকথিত শহরের “দামী ও ভালো” স্কুলগুলোই বলছে, এমন কোন নির্দেশনা পাঠ্যপুস্তক বোর্ড দেয় নি। একজন অভিভাবক এর সাথে সম্পূরক হিসেবে একটি মন্তব্য যুক্ত করেন- অনেক স্কুলে শিক্ষার্থীদেরকে বাসা থেকে নানা খাবার রান্না করে নিয়ে যেতে বলা হচ্ছে। মশিউজ্জামান স্যার এখানেও অভিভাবকদের পক্ষ নিয়ে কথা বলেন, তার মতে এমন কিছু ঘটনা আসলেই ঘটেছে যা কোনভাবেই শিক্ষাক্রমের সাথে যুক্ত না, বরং কতিপয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই অতি উৎসাহের প্রেক্ষিতে এমন কাজ করছে। তিনি ও তারিক মনজুর স্যার এইসকল ব্যপারে অভিভাবকদেরও সচেতন হতে অনুরোধ জানান। পাশাপাশি শিক্ষকদেরকে এই বিষয়গুলোও ভালোভাবে অনুধাবন করানো লক্ষ্যে, তাদেরও নানা রকমের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হচ্ছে বলে তারা মতামত প্রদান করেন। 

     

    শেষ কথা

    পুরো ব্লগে আমরা আলোচনা করার চেষ্টা করেছি নতুন কারিকুলাম নিয়ে, বিশেষ করে নতুন শিক্ষাক্রমে এসাইনমেন্ট ও বাড়ির কাজ নিয়ে। আমরা পুরাতন শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনা করেছি, নতুন শিক্ষাক্রমের সাথে তার একটি তুলনার মধ্য দিয়ে আমরা দেখেছি- যেখানে প্রাক্তন শিক্ষাক্রমে একজন শিক্ষার্থীর যোগ্যতার একটি অংশ- কেবল জ্ঞানের বিকাশ ঘটতো, নতুন কারিকুলামে এসে সেই শিক্ষার্থীর মধ্যে আরো তিনটি অতিরিক্ত গুণ, যথা দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এছাড়া এম তারিক আহসান স্যার এবং অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান স্যারের আলোচনার প্রেক্ষিতে নতুন এই শিক্ষাক্রমের দিকগুলো আরো স্পষ্ট করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। শুরুটা হয়েছিলো রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে, শেষটাও রবীন্দ্রনাথের হতে ধরেই হোক। ‘শিক্ষা’ নামের প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, 

    সুশিক্ষার লক্ষণ এই যে, তাহা মানুষকে অভিভূত করে না, তাহা মানুষকে মুক্তিদান করে।

    সুশিক্ষার এই নতুন পথ ধরে বাংলাদেশ আরো এগিয়ে যাবে, এমনটাই প্রত্যাশা। 

     

    কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা 

    এই অংশে আমরা নতুন শিক্ষাক্রম ২০২৪ সম্পর্কিত কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসার উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবো-

    • নতুন শিক্ষাক্রমের মূল উদ্দেশ্য কী? 

    নতুন শিক্ষাক্রমের মূল উদ্দেশ্য হলো, একজন শিক্ষার্থীকে নতুন বিশ্বব্যবস্থার প্রেক্ষিতে যোগ্য করে তোলা। আর এই যোগ্যতা তৈরি হবে চারটি মূল ভিত্তির উপর- জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ। অর্থাৎ, একজন শিক্ষার্থীকে আরো বেশি যোগ্য, আরো বেশি কর্মক্ষম এবং সর্বপরি পরিপূর্ণ বিশ্বনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে তার মধ্যে জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ- এই চারটি গুণের বিকাশ ঘটানোই নতুন শিক্ষাক্রমের মূল উদ্দেশ্য। 

    • নতুন শিক্ষাক্রম মূলত কী কী পরিবর্তন আসবে? 

    নতুন শিক্ষাক্রমের উল্ল্যেখযোগ্য কিছু পরিবর্তন হলো- 

    • প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোন প্রথাগত পরীক্ষা থাকবে না। 
    • শিক্ষার্থীকে ‘শিখনকালীন মূল্যায়ন’ ও ‘সামষ্টিক মূল্যায়ন’-এর মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে। 
    • পঞ্চম শ্রেণী, অষ্টম শ্রেণীতে কোন পাবলিক পরীক্ষা থাকবে না। একজন শিক্ষার্থী দশম শ্রেণীর পরে পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নেবে, অর্থাৎ এসএসসি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবে। দশম শ্রেণীর পাঠ্যসূচির উপর ভিত্তি করে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। 
    • নবম শ্রেণীতে কোন প্রকার বিভাজন থাকবে না। অর্থাৎ, বিজ্ঞান-ব্যবসা-মানবিক শাখায় ভাগ থাকবে না। একজন শিক্ষার্থী একাদশ শ্রেণীতে ওঠার পর বিজ্ঞান-ব্যবসা-মানবিক শাখা বেছে নিতে পারবে। 
    • সৃজনশীল পদ্ধতি বাদ যাচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রমে। 
    • নতুন শিক্ষাক্রমের শিক্ষা উপকরণ কেমন হবে? 

    নতুন শিক্ষাক্রমের শিক্ষা উপকরণ হিসেবে প্রথমেই বলতে হয় পাঠ্য বইয়ের কথা। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণীতে কোন প্রকার পাঠ্য বই থাকবে না। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণীতে কোন পরীক্ষা না থাকলেও তিনটি করে বই থাকবে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীতে ৮টি (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান,  সামাজিক বিজ্ঞান, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি)  এবং ষষ্ঠ হতে দশম শ্রেণীতে ১০টি (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, জীবন ও জীবিকা, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা (প্রত্যকে ধর্ম অনুযায়ী) এবং শিল্প ও সংস্কৃতি) করে পাঠ্যপুস্তক থাকবে। তবে শিক্ষা উপকরণ হিসেবে কেবল বই নয়, এখানে শিক্ষা উপকরণ হিসেবে আরো যুক্ত হবে ভিডিও, পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন, ইউটিউব, গুগল, ভ্রমণ, লাইব্রেরি, শিক্ষক, পিতামাতা, বড় ভাই বোন সহ বিভিন্ন জায়গা, পরিস্থিতি ও বিভিন্ন ব্যক্তি। 

    • নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করা হবে কী উপায়ে? 

    চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীতে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৪০ শতাংশ। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীতে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৪০ শতাংশ। নবম দশম শ্রেণীতে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৫০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৫০ শতাংশ। 

    • নতুন শিক্ষাক্রমের সাথে বাস্তব জীবনের সম্পৃক্ততা কতটুকু? 

    নতুন শিক্ষাক্রমে একজন শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন হবে তার অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে। ফলে একজন শিক্ষার্থী কেবল বই মুখস্থ করে পাশ করে যাবে না, বরং সে তার চারপাশের জগৎ থেকে শিখবে, নিজের শিক্ষাকে সেই জগতে চলার পথে কাজে লাগাবে। গৎ বাঁধা জিনিস মুখস্থ করে নিজের সম্ভাবনাকে নষ্ট না করে বরং বাস্তবমুখী ও কার্যকরী শিক্ষা লাভের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী নিজের উন্নতি করবে ও সমাজ, দেশ, রাষ্ট্রের সম্পদে পরিণত হবে। 

     


    নতুন কারিকুলাম নিয়ে বিস্তারিত জানতে দেখে নিন আমাদের এই ব্লগ গুলো:

    নতুন কারিকুলামে ৬ষ্ঠ-৯ম শ্রেণির পড়ালেখা নতুন উদ্যমে শুরু করতে টেন মিনিট স্কুল নতুনরূপে নিয়ে এসেছে ‘অনলাইন ব্যাচ ২০২৪’:

    তথ্যসূত্র: 

    ১০ মিনিট স্কুলের ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে সরাসরি চলে যেতে পারেন এই লিংকে: www.10minuteschool.com

    আপনার কমেন্ট লিখুন