উইল স্মিথ সবার খুব পছন্দের একজন অভিনেতা। তাঁর ‘The Pursuit of Happyness’ চলচ্চিত্রটি কতো মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তাঁর নিজের জীবনেও ছেলেবেলার একটি গল্প রয়েছে যেটি তার নিজের জীবনের মোড় বদলে দিয়েছিল।
উইল স্মিথের বাবা ছিলেন একজন ইলেকট্রিশিয়ান। বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে, শপিং মলে রেফ্রিজারেটর থেকে শুরু করে নানা যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক করার কাজ করতেন তিনি। উইল স্মিথ আর তার ছোটভাইও ছুটিছাটার সময়ে কাজ করতেন বাবার সাথে। এভাবে ছোটবেলা থেকেই নানারকম কাজে দক্ষ হয়ে উঠেন তিনি। অনেক রকম মানুষের সাথে মেশার সুযোগ হয়- সমাজের উঁচুতলার, মধ্যবিত্ত, পথের ভিখারী সবার থেকেই কিছু না কিছু শেখার রয়েছে। এগুলো পরবর্তীতে অভিনয় জীবনে অনেক কাজে এসেছে তাঁর।
এক গ্রীষ্মে স্মিথের বাবা ঠিক করলেন একটা বেকারি শপ দেবেন। সবাই মিলে কেক-পেস্ট্রি এরকম মজার মজার সব জিনিস নিয়ে ফাটাফাটি একটা খাবারের দোকান হবে! এখন দোকানের সামনে বিশাল একটা দেয়াল। বহু বছর ধরে এভাবেই আছে। ছোটখাটো কিছু নয়- একদম তিরিশ ফিট লম্বা আর প্রায় ষোল ফিট উঁচু এক দেয়াল! বাবার মাথায় কী খেয়াল চাপলো, তিনি ঠিক করলেন এই পুরো দেয়ালটি ভেঙ্গে আবার নতুন করে দেয়াল বানাবেন! সিদ্ধান্ত তো নিলেন, কিন্তু এত্তো বড় দেয়াল ভাঙবেটা কে? মিস্ত্রি ডেকে দেয়াল ভেঙ্গে আবার নতুন করে বানানোয় অনেক খরচ! একটু ভেবে পেয়ে গেলেন খুব সহজ সমাধান- দুই ছেলেকে নামিয়ে দিলেন কাজে!
এই পুরো তিরিশ ফিট দেয়াল ভাঙ্গা, তারপর ছয় ফিট গভীর মাটি খুঁড়ে ভিত্তি বানানো, নিজের হাতে কংক্রিট মেশানো, ঢালাই করা আরো কতো কিছু… –প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর এটাই ছিল উইল স্মিথ আর তাঁর ভাইয়ের কাজ! দুই বেচারা যে প্রতিবাদ করবেন সেই উপায়ও নেই, বাবা ধরে দেবেন প্যাঁদানি! বাস্তব জীবন অনেক কঠিন, তারই প্রস্তুতি হিসেবে ছোটবেলাতেই কঠোর পরিশ্রমে দুই ছেলেকে অভ্যস্ত করে তোলাই ছিল বাবার লক্ষ্য। সুতরাং বিরসমুখে কাজ করে যেতে লাগলেন দুই ভাই, একদিন-দুইদিন না, প্রতিদিন!
উইল স্মিথ সবসময় সেই দেয়ালের সামনে ইট-সুরকি ভাঙতে আর গর্ত খুঁড়তে খুঁড়তে ভাবতেন, এখানে জীবনেও কোনদিন নতুন কোন দেয়াল তৈরি হবে না! এই বিশাল জায়গাজুড়ে গর্তই থেকে যাবে চিরদিন! তখন বাবা পাশে এসে দাঁড়ালেন, বললেন- ‘তুমি যদি বিশাল একটা দেয়াল বানানোর কথা চিন্তা করো তাহলে সেই ভয়েই আর কাজ আগাবে না! তুমি মাথা ঘামাবে এই মুহূর্তে যেই ইটটা বসাচ্ছো এটা কতোটা নিখুঁতভাবে বসানো যায় তার কথা! পরে কী হবে, দেয়াল কতোটুকু তৈরি হবে সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন মানেই হয় না!’
উইল স্মিথের খুব মনে ধরলো কথাটি। আসলেই তো, এতো বড় দেয়াল বানানোর কাজ দেখে ভড়কে যাওয়ার কী আছে?! এমন তো না যে পুরো দেয়ালটি একসাথে বানিয়ে ফেলা সম্ভব! একটা একটা করে ইট বসিয়েই বানাতে হবে- আর এ তো খুব সহজ কাজ! সুতরাং ভয় পাওয়ার তো কিছু নেই!
এবং হলোও তাই! টানা দেড় বছর, প্রায় পাঁচশো দিন কাজ করার পর দেখা গেল স্কুলপড়ুয়া ছোট্ট দুই ভাই সত্যি সত্যি নতুন একটা দেয়াল বানিয়ে ফেলেছে! পাক্কা তিরিশ ফিট লম্বা আর ষোল ফিট উঁচু! উইল স্মিথ আর তার ভাই নিজেরাই অবাক হয়ে সেই দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে দেখছেন আর ভাবছেন এত্তো বড় দেয়াল কীভাবে বানিয়ে ফেললেন তারা! কখন যে বাবা চুপিচুপি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন কেউ টেরও পায়নি, তিনি দুজনের কাঁধে হাত রেখে মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘দেখেছো! তোমরা আজ প্রমাণ করে দেখালে যে তোমাদের জন্য কোন কাজই অসম্ভব নয়!’
কাজটি যদিও ছিল দারুণ পরিশ্রমের, কিন্তু এর মাঝে লুকিয়ে ছিল চমৎকার একটি শিক্ষা। এই শিক্ষাটি উইল স্মিথ সবসময় কাজে লাগিয়ে এসেছেন নিজের জীবনে, আর সবার থেকে নিজেকে আলাদা করে তুলেছেন অনন্য কৌশলে।
যেমন আমি যখন পড়তে বসি, তখন বইটা হাতে নিয়েই শুরুতে কী করি? যেই চ্যাপ্টারটা পড়া শুরু করতে যাচ্ছি সেটার পাতা উল্টিয়ে দেখি মোট কয় পৃষ্ঠা আছে এই চ্যাপ্টারে! মনের অজান্তেই একটা ভয় কাজ করে- ‘এত্তো বড় চ্যাপ্টার! এত্তো কিছু কীভাবে পড়বো?!’ খুব সহজ সমাধান- এখন পড়তে হবে না! পাঁচ মিনিট পরে পড়া শুরু করলেই হয়! রাখো বই, হাতে নাও স্মার্টফোন! তারপর কীভাবে যে সময় পেরিয়ে যায় হিসেবই থাকে না! এই সমস্যা একদিন-দুইদিন নয়, প্রতিদিনের!
উইল স্মিথ খুব সহজ করে বলেন, ‘তোমাকে পুরো চ্যাপ্টার পড়তে বলেছেন কে? আর এমনও তো নয় যে তুমি চাইলেই পুরো চ্যাপ্টার একসাথে পড়ে ফেলতে পারবে! এক পৃষ্ঠা এক পৃষ্ঠা করেই পড়তে হবে! সুতরাং ভয় পাওয়ার তো কিছু নেই! চ্যাপ্টারটা কতো বড় সেটা জানারই দরকার নেই, খামাখা মাথার উপর একটা ভার চেপে বসবে। তুমি শুধু এখন যেই পৃষ্ঠাটা পড়ছো সেটা মনোযোগ দিয়ে পড়ো। পরে কী হবে সেটা পরে দেখা যাবে।
খুব সহজ একটা সমাধান, তাইনা?! মজার ব্যাপার হচ্ছে খুব সহজ এই কৌশলটি দারুণ কাজেরও বটে! আমার হয়তো একদমই পড়তে ইচ্ছা করছে না। উইল স্মিথ বলেন, ‘থাক, কেবল একটা পৃষ্ঠাই পড়ো!’ এক পৃষ্ঠা পড়তে তো মোটেই তেমন কষ্ট নেই! আচ্ছা, পড়েই নাহয় ফেললাম এক পৃষ্ঠা! তারপর আবার মনে হয়, বেশি না, কেবল আর এক পৃষ্ঠা পড়ো! এভাবে এক পৃষ্ঠা এক পৃষ্ঠা করে অনেকখানি পড়া হয়ে যায়!
এবং শুধু পড়ালেখাই নয়, যেকোন কাজেই দারুণভাবে সাহায্য করে এই মানসিকতা! যেমন সকালে ভোরবেলা ব্যায়াম করার কথা ভাবলেই গায়ে জ্বর চলে আসে! এতো মাইল দৌড়াও! এতোগুলো পুশ আপ দাও! এই করো, সেই করো! তখন মনকে বুঝাই, ‘না না! কেবল পাঁচটা মিনিট দৌড়াবো! আর কিছু না!’ একবার বিছানা থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে দৌড় শুরু করলে আলসেমিটাও চলে যায়, শরীর-মন ঝরঝরে হয়ে উঠে, তখন একশোটা পুশ আপ দেওয়াকে আর কঠিন কোন কাজ বলে মনে হয় না!
মনের উপর খাটানো ছোট্ট এই কৌশলটি উইল স্মিথকে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে এগিয়ে দিয়েছে অনেক দূর! চলচ্চিত্রজগতে অনেক কঠিন সব চ্যালেঞ্জ আসে, মনের উপর ভয়াবহ চাপ যায়! অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা যখন মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে, উইল স্মিথ তখনও হাসিমুখে কাজ চালিয়ে যান! কারণ তার মাথার উপর তো কোন চাপই নেই! চাপ আসবে কোথা থেকে? তিনি তো পুরো কাজটিকেই ছোট্ট ছোট্ট সহজ অংশে ভাগ করে নিয়েছেন!
তুমিও এই কৌশলটি কাজে লাগাও! এখন থেকে আর কোনদিন পরীক্ষার সিলেবাস দেখে ঘাবড়ে যেয়ো না। একটা পৃষ্ঠা দিয়ে শুরু করো, যতক্ষণ ভালো লাগে পড়ে যাও। বিন্দু বিন্দু জল থেকেই সিন্ধু, তেমনি এক পৃষ্ঠা এক পৃষ্ঠা পড়েই পুরো সিলেবাস কভার করে ফেলবে! একটা বিশাল দেয়াল বানানো কঠিন, কিন্তু ছোট্ট একটা ইট বসানো খুব সহজ কাজ! তেমনি পরীক্ষার সিলেবাসকেও কঠিন বাঁধার দেয়াল হিসেবে না দেখে একেকটি পৃষ্ঠাকে একেকটি ইট হিসেবে দেখো।
উইল স্মিথ যেমন কাজের সময় একটি ইট কতোটা নিখুঁতভাবে বসানো যায় সে চিন্তায় মগ্ন থাকতেন, তুমিও তেমনি যখন যে পৃষ্ঠা পড়ছো সেটার উপর পুরো মনোযোগ নিবদ্ধ রাখো, দেখতে দেখতে কখন যে কভার করে ফেলবে সিলেবাস ভাবতেই পারবে না! জীবনটাই যে এমন- এক-একটি দিন যেন এক-একটি ইট, তুমি প্রতিদিন কতোটুকু কাজে লাগাচ্ছো তার উপর নির্ভর করছে জীবন নামের দেয়ালের গাঁথুনি কতোখানি শক্ত হবে, কতোটা সফল হবে তুমি!
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন