একবিংশ শতকে এসে যে কথাগুলো আমরা বারবার শুনছি আর নতুন করে প্রতিনিয়ত যার গুরুত্ব অনুধাবন করছি তার মধ্যে অন্যতম হল তৃতীয় কোনো ভাষা জানা। তৃতীয় ভাষা কী? আমাদের মাতৃভাষা বাংলা এবং বৈশ্বিক সার্বজনীন ভাষা ইংরেজির পাশাপাশি আরেকটি ভাষাকে বলা হচ্ছে তৃতীয় ভাষা। আর এই থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ শেখা শুধু নাম কা ওয়াস্তে শেখাই নয়, বরং রিডিং, রাইটিং, লিসেনিং আর স্পিকিং তথা পড়া, লেখা, শোনা এবং বলা এই সব ধরনের দক্ষতাই যেন অর্জিত হয়।
এখন কথা হচ্ছে কেন শিখবো? কোনো কাজই আমরা উদ্দেশ্য ছাড়া করি না, করতে চাই না। মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি থেকেই আমরা এই লাভ লোকসান তত্ত্বে বিশ্বাসী। আজকে কথা হবে তৃতীয় ভাষা শেখার উপকারিতা নিয়েই এবং আমরা আরও কিছু অবমুল্যায়িত ভাষা নিয়েও আমরা নিবন্ধের শেষদিকে আলোকপাত করবো।
এক বিশাল জনগোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগের অপার সম্ভাবনা
ভাষা শেখার অন্যতম উপকারী দিক হল, একটা বড়সর অডিয়েন্সের সাথে কানেক্টেড হওয়া যায়। শুধু চীনা ভাষার কথা ভাবলেই বোঝা যায়, ১২০ কোটিরও বেশি মানুষ কথা বলে মান্দারিন তথা চীনা ভাষায়। তবে বুঝতেই পারছেন, স্কিল হিসেবে এই ভাষাটি কতটা ইফেকটিভ হবে এত বিশাল লোকজনের সাথে সংযুক্ত হতে পারলে। সবাই কিন্তু নিজের মাতৃভাষায় যোগাযোগে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। অন্য সংস্কৃতির লোকেদের সাথে মিথস্ক্রিয়ার ফলে নিজের মনের চিন্তাধারার পরিধিও বড় হবে, যা বিরুদ্ধমতের সহনশীলতার জন্য খুবই কার্যকর।
তৃতীয় ভাষা শিখে ক্যারিয়ারের দৌড়ে এগিয়ে থাকা
একাধিক ভাষায় দখল আপনাকে কর্মক্ষেত্রে মনোলিঙ্গুয়ালদের থেকে এগিয়ে রাখবে। অধিক জায়গায় কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে এই ২/৩ ভাষা রপ্ত করার স্কিল। অনুমিতভাবেই, বিদেশি ক্লায়েন্ট এবং কোম্পানিগুলো সাধারণত তাদের নিজেদের ভাষায় দক্ষদেরকেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। এতে তাদের নিজেদের ভাষার ন্যাটিভ স্পিকারদের সাথে যোগাযোগের পারঙ্গমতা থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।
তৃতীয় ভাষা শেখা ভ্রমণপিপাসুদের জন্য মোক্ষলাভ
জীবন কি আর শুধুই কর্পোরেট দুনিয়া? ঘুরতে বেড়াতে যাবেন না? সারাজীবন কি শুধু নয়টা-পাঁচটা অফিস ঘড়ির চক্রেই আবদ্ধ থাকবেন? নিশ্চয়ই নয়, হ্যাঁ যেটার কথা ভাবছেন অর্থাৎ ট্র্যাভেলিং-এর জন্যও বড্ড কাজের জিনিস তৃতীয় ভাষা জানা থাকা। উদাহরণস্বরূপ স্প্যানিশ ভাষার কথাই ধরুন না, বিশ্বে প্রায় ২১টি দেশের মানুষ প্রধান ভাষা হিসেবে স্প্যানিশ ব্যবহার করে। সেইসব দেশ আরামসে ঘুরতে যেতে পারবেন, এবং সেখানকার লোকেদের হামেশাই চমকে দেবেন নিজের এস্পানিওল-এর পাণ্ডিত্য জাহির করে!
তৃতীয় ভাষা মস্তিষ্ককে ক্ষুরধার করে তুলতে সহায়ক
আমাদের দেহ একটা যন্ত্রের মতো, তবে পার্থক্যটা হল মস্তিষ্কে। মস্তিষ্কের ব্যাপারে বলা হয়, The more you use it, the better it works; অর্থাৎ বেশি কাজে লাগালে পারফরমেন্স ভালো পাওয়া যায়। একটি নতুন ভাষা শিখতে গেলে সেটার ব্যাকরণ, শব্দভাণ্ডার, বিবিধ কলাকৌশল শিখতে গিয়ে মগজ বাবাজির বেশ খানিকটা ব্যায়াম হয়ে যায়। এর সুফল কিন্তু আপনাকে তিনি অন্যান্য কাজেও দেবেন!
প্রবলেম সলভিং স্কিল এবং ডিসিশন মেকিং স্কিল বৃদ্ধি করে
অনেক বোদ্ধাই নতুন ভাষাকে রপ্ত করার এই দক্ষযজ্ঞকে প্রোগ্রামিং শেখার সাথে তুলনা করে থাকেন, এবং এর যৌক্তিক কারণও আছে বটে। কারণ, উভয় ক্ষেত্রেই অনুশীলনকারীর সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়ে। এবং বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধি করে, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি জরিপ কিন্তু এমনটাই বলে।
সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে ও অ্যানালিটিকাল অ্যাবিলিটিও বর্ধন করে
গবেষকগণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখেছেন, মাল্টিলিঙ্গুয়ালদের সৃজনশীলতা মনোলিঙ্গুয়ালদের থেকে বেশি হয়। তারা শব্দভাণ্ডারে দক্ষতা বৃদ্ধির সুবাদে একই শব্দের বিভিন্ন অর্থ এবং তাদের উৎপত্তি প্রভৃতি ঘাঁটাঘাঁটি করেন। এতে তাদের চিন্তার পরিধি বড় হয়, এবং একই সমস্যাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারেন।
কোন বয়সে শিখবেন তৃতীয় ভাষা?
আমাদের মাঝে একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে, বাচ্চারা নতুন কিছু শেখে খুব দ্রুত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কথাটা সত্যও বটে, তবে সবক্ষেত্রে যে নয় তার হাতেনাতে প্রমাণ এই একাধিক ভাষা শেখার বেলায়। বিবিসির এক প্রতিবেদনও বলছে সে কথাই। গবেষণায় দেখা গেছে, একদম ছোট্ট শিশুরা গড়ে তাদের নিজের ভাষার একটা করে শব্দ শেখে প্রতিদিন। ২০০০+ বিভিন্ন বয়সের শিশু কিশোরের উপর করা জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। ৮ বছর, ১২ বছর, এবং তার থেকে একটু বড় কিশোর (ইয়াং অ্যাডাল্ট) এই তিন ক্যাটাগরিতে শিশুদের ভাগ করে ইজরায়েলের একদল গবেষক দীর্ঘসময় ব্যাপী একটা স্টাডি করেন। তাদের মাতৃভাষা ছিল স্প্যানিশ এবং কাতালান ভাষা, আর এরা দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি শিখছিল। এতে সবথেকে ভালো ফল করে কিশোরদের গ্রুপ।
কোর্সটি করে যা শিখবেন:
ঘরে বসে Spoken English
গবেষকগণ বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন তাদের এই গবেষণা থেকে। এক্কেবারে যারা ছোট, এই শিশুরা ক্লাসরুম কেন্দ্রিক শিক্ষকের লেকচার দেওয়া এবং শিক্ষার্থীরা চুপচাপ বসে শোনা- এই ফরম্যাটকে একদমই অপছন্দ করে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই প্রবণতা কমতে থাকে, এতে করে তারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে কোনো কিছু শিখতে অভ্যস্ত হয় এবং শেখনক্ষমতা বাড়ে। এভাবেই কিছুটা বড়রা একাধিক ভাষা শিক্ষায় এগিয়ে থাকে। তাই পিচ্চিকাল চলে গেছে বলেই হতাশায় ভোগার কোনো কারণই নেই, এক্ষুনি ঝটপট শুরু করে দিন আপনার তৃতীয় ভাষা শিক্ষা!
তৃতীয় ভাষা হিসেবে কোন কোন ভাষা শিখতে পারেন?
কে কোন ভাষা শিখবেন তা একান্তই নির্ভর করে নিজের আগ্রহের উপর। তবে মোটাদাগে শেখার ভাষাগুলোকে দুইভাগে ভাগ করা যায়: ক্যারিয়ারের জন্য শেখা (জব ওরিয়েন্টেড) আর শখের বশে। আমরা দুইভাগ নিয়েই আলোচনা করবো!
ক্যারিয়ার কেন্দ্রিক
ক্যারিয়ার কেন্দ্রিক চিন্তা করলে প্রথমেই আসবে ইংরেজি, কারণ বলা যায় পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ মানুষ এ ভাষায় দক্ষ আর ইংরেজিকে বলা হয় বিজনেস ল্যাঙ্গুয়েজ। তবে আমাদের এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় ইংরেজির বাইরে। এর বাইরে সবার প্রথমে আসবে চীনা তথা মান্দারিন। পৃথিবীর দ্রুত বর্ধনশীল ভাষার মধ্যে মান্দারিন অন্যতম, বিশ্বে ১২০ কোটি লোক চাইনিজ ভাষা বলে। ইন্টারনেটের জগতেও ইংরেজির পরেই মান্দারিন দ্বিতীয় জনপ্রিয়। কিছু বিশ্লেষক ধারণা করছেন ২০৫০ সাল নাগাদ মান্দারিন স্বয়ং ইংরেজিকেও ছাড়িয়ে যাবে। এরপর বলা যায় স্প্যানিশের কথা, পুরো বিশ্বে ৩৭ মিলিয়ন লোক প্রধান ভাষা হিসেবে স্প্যানিশ ব্যবহার করে, এবং দ্বিতীয় তৃতীয় ভাষা সব মিলে মোটমাট ধরলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০ মিলিয়ন বা ৫ কোটি।
আবার আপনি কিন্তু ডয়েচ তথা জার্মান ভাষাও শিখতে পারেন! বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ভাষাগোষ্ঠী রয়েছে ডয়েচের। জার্মানদের প্রযুক্তিতে অগ্রগতি, ইন্ডাস্ট্রি লেভেলে উন্নতি, ইউরোপীয় ইউনিয়নে শক্ত অবস্থান এই সব মিলে দেখা গেছে বিশ্বের ৪% কোম্পানি জার্মান জানা কর্মীদের অগ্রাধিকার দেয়। লাতিন আমেরিকার আরেক শক্তিশালী ভাষা হল পর্তুগিজ। ব্রাজিল এবং আশেপাশের এলাকা থেকে নিয়ে একেবারে আফ্রিকা পর্যন্ত এই ভাষার রাজত্ব আছে। এছাড়া ২৮টি দেশের অফিয়াসিয়াল ভাষা আরবিকেও হিসেবের মধ্যে রাখতে পারেন। ফ্রেঞ্চ, জাপানির কথা তো না বললেই নয় আর রুশ ভাষাও ধর্তব্যের ভেতর রাখতে পারেন।
শখের বশে
এই শখের বশে সেকশনের ভাষাগুলোও কিন্তু ক্যারিয়ার গড়তে সহায়ক হতে পারে। যে কারোরই নিজের পছন্দের কিছু ভাষা শিখতে ইচ্ছে হতেই পারে। স্বাদ-আহ্লাদ বলেও তো কিছু আছে জীবনে! যেমন, অ্যানিমে দেখা লোকজন জাপানি শিখতে চাইবে, আবার কবিতাপ্রেমীরা কিন্তু উর্দু-ফার্সিও শিখতে চাইতেই পারে। উর্দু ভাষায় যেমন আছেন আল্লামা ইকবাল, গালিবের মত নামকরা সব কবি, তেমনই পারসিয়ান তথা ফার্সিতে রয়েছেন হাফিজ, সাদি, রুমির মত বিদগ্ধজন। তাই যে যেটি ইচ্ছা শিখতে পারেন।
এইগুলোকেই আমি বলছি আন্ডাররেটেড ভাষা, কেননা আজকাল ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার করতে করতে না, আমরা দিনকে দিনকে আরও যান্ত্রিক হয়ে চলেছি। কিন্তু মানবদেহে মন বলেও তো একটা বস্তু আছে! তাই কর্পোরেট দুনিয়ায় থাকতে থাকতে আমরা যেন কর্পোরেট পুতুল থেকে দিনে দিনে দাসে পরিণত না হই, নিজের মানসিক দিকটাও যেন অক্ষুন্ন থাকে ঠিকঠাক। তাই এই ভাষাগুলোও চর্চা করা যেতে পারে জোরেশোরেই। তাই প্রিয় পাঠক, আর দেরি কেন! শুরু করে দিন আপনার পছন্দের কোনো ভাষা শিক্ষা!
References:
আপনার কমেন্ট লিখুন