পুরোটা পড়ার সময় নেই? ব্লগটি একবারে শুনে নাও!
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ বা বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণ নিয়ে সকল জল্পনা কল্পনার অবসান হবে শীঘ্রই। আর কিছুক্ষণ বাদেই পৃথিবীবাসী আবারও ‘বাংলাদেশ’ নামক ছোট্ট ভূ-খন্ডকে নিয়ে গুগলে রিসার্চ করতে বসবে। কী আছে এই দেশে? মানুষগুলো কেমন এই দেশের? এত ছোট আর গরীব দেশ স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছে? কী সাহস রে বাবা! এতদূর কীভাবে আসলো এই দেশ? আচ্ছা দেখি তো দেশটার জন্ম কীভাবে হলো, ইতিহাস কী!
অত:পর বাংলাদেশকে ঘাঁটতে গিয়ে পৃথিবীবাসী আবিষ্কার করবে চোখের কোণে অপ্রত্যাশিত নোনা জল। জল কীসের? এ জল ‘৭১ এর আর্তনাদের জল! বিভীষিকাময় রাতে প্রাণে বাঁচার আকুতির জল, যা চোখ দিয়ে বেয়ে বেয়ে পড়ছিল। কিন্তু অত্যাচারীর হিংস্র বুলেটে সেই জলের সাথে তাজা লাল রক্ত মিশে মাটিতে বাংলাদেশের মানচিত্র এঁকে দিয়েছিল।
এ জল সেই নির্যাতিতার চোখের জল, এটা সেই সম্ভ্রম রক্ষার জন্য আকুতি! যা মা-বোনের চোখ বেয়ে ঝরছিল কিন্তু ক্ষুধার্ত দানবের বিষাক্ত লালার কাছে যেই জল ছিল মূল্যহীন, শক্তিহীন, আশ্রয়হীন। নোনা সেই জল পশুদের জিহ্বায় মিষ্টি স্বাদের সঞ্চার করেছিল। সেই আর্তনাদের জলই পৃথিবীবাসীর চোখে আবেগের জলের প্রবাহ ঘটাবে। তবুও পঁচা-গলা লাশগুলোকে শকুনের ঠুকরে ঠুকরে খাওয়ার দৃশ্য কিন্তু স্বস্তি দিবে না তখন।
তখন তারা ভাববে, এটা তো সেই দেশ! যেই দেশের মানুষ বাংলায় কথা বলার জন্য লাঠি বৈঠার সাথে নিজের বুকের পাঁজর বেঁধে লড়াইয়ে নেমেছিল। এই দেশ আজ কত সুজলা সুফলা! শিক্ষা, চিকিৎসা, অর্থনীতি সবদিকেই এই দেশ এগিয়ে চলছে। আরে বাহ! এই দেশ তো প্রযুক্তির দিক দিয়েও পিছিয়ে নেই! এই লাল-সবুজের দেশ আর কিছুক্ষণ বাদেই মহাশূন্যে পাড়ি জমাবে।
বঙ্গবন্ধু তো সেই ব্যক্তি যিনি দু’চোখ ভরে স্বপ্ন দেখেছেন এই দেশকে নিয়ে, দু’হাত ভরে কাজ করেছেন যেন দেশের মাটিতে আবারও ধান জন্মায়। যেই ধানের ক্ষেতে আর কৃষকের লাশ পড়ে থাকবে না । সেই মহৎ ব্যক্তির নামে এই স্যাটেলাইট ।
পৃথিবীবাসী কিছুক্ষণ চুপ থাকবে। ভাববে, এটা তো সেই দেশ যেই দেশের শহীদদের রক্তে আজ এই অর্জন। বাঘগুলো লড়েছে বেশ! এখনো লড়ছে। এই স্যাটেলাইট কিন্তু সাধারণ কোনো স্যাটেলাইট নয়, এটি ছোট্ট দেশের ছোট্ট মানুষের চোখে আকাশচুম্বী স্বপ্ন। বাস্তবায়ন হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই । কম কীসের?
১৯৭৫ সালের ১৪ই জুন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পার্বত্য চট্টগ্রামের বেতবুনিয়ায় প্রথম উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র স্থাপন করেন, তখন আমাদের অংশগ্রহণ ছিল শুধু ব্যবহারকারী হিসেবে। আর সেখান থেকেই পরবর্তীকালে নিজস্ব স্যাটেলাইট অর্জনের ভিত রচিত হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশের পথচলা শুরু সেখান থেকেই। তারই ফলাফল আমাদের আজকের দিনটি। আজই সেই বহুল প্রতীক্ষিত বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের এর উৎক্ষেপণ।
চলুন ধাপে ধাপে আমরা বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের বিস্তারিত তথ্য জানার পাশাপাশি বিশ্বের প্রথম স্যাটেলাইট, স্যাটেলাইটের কার্যাবলি এবং সেই সাথে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের ভবিষ্যৎ উপকারিতা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি।
বিশ্বের প্রথম স্যাটেলাইটের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা
সময়টা ১৯৫৭ সাল, ৪ অক্টোবর, রাত ১০:২৯ । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের শক্তির ক্ষমতা সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই অবগত সবাই। সেই সাথে প্রযুক্তির দৌড়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল রাশিয়া। ইতিহাসের সর্বপ্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘স্পুটনিক-১’ পৃথিবীর অভিকর্ষের মায়া কাটিয়ে চলে গেল তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে। স্পুটনিক রুশ শব্দ, যার অর্থই হলো ‘উপগ্রহ’।
অনেকটা ভলিবল আকৃতির সেই কৃত্রিম উপগ্রহটির ভর ছিল ৮৩৬ কেজি মাত্র। তবে স্থায়ীত্ব বেশিদিন ছিল না, মাত্র তিন মাস। সর্বমোট ৭০ মিলিয়ন কিলোমিটার আবর্তনের পর পৃথিবীর বুকে ছিটকে পড়ে।
আর সেই থেকেই মানুষ মহাশুন্যে পাড়ি জমানোর এতদিনের স্বপ্নকে বাস্তবে দেখা শুরু করে। একের পর এক সব দেশ স্যাটেলাইট পাঠাতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় ৫৬টি দেশ এই পর্যন্ত নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিক হয়েছে। তবে আমাদের দেশ আজ ৫৭ তম নিজস্ব স্যাটেলাইটের অংশীদার হতে যাচ্ছে। আজও কি আমরা বলবো যে আমরা পিছিয়ে আছি?
আরো পড়ুন: মঙ্গল আমাদের জন্য কতটুকু মঙ্গলজনক?
বঙ্গবন্ধু-১ এর বৈশিষ্ট্য, উৎক্ষেপণ এবং কিছু তথ্য
বঙ্গবন্ধু-১ হলো আমাদের দেশের প্রথম একটি ভূ-স্থির যোগাযোগ উপগ্রহ বা সহজ কথায় কৃত্রিম উপগ্রহ যা যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডাতে অবস্থিত ক্যাপ ক্যানাভেরাল-এর ‘কেনেডি স্পেস সেন্টার,লঞ্চ প্যাড ৩৯এ’ থেকে উৎক্ষেপিত হবে আজ ১০ই মে, স্থানীয় সময় বিকাল ৪টা ১২ মিনিট থেকে ৬টা ১২ মিনিটে। অর্থাৎ বাংলাদেশ সময় ১১ই মে রাত ২টা ১২ মিনিটে আমরা সরাসরি সম্প্রচার দেখতে পাব বলে আশা করা যাচ্ছে। তবে গোলযোগের কারণে সময় পরিবর্তিত হতে পারে।
বাংলাদেশ ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন কর্তৃক বঙ্গবন্ধু-১ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। এর প্রধান কন্ট্রাক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে স্পারসো (SPARRSO)। বাংলাদেশ সরকার ২০১৫ সালের ১১ই নভেম্বর ‘’থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস’’ নামক এক ফরাসি কোম্পানির সাথে যাবতীয় যন্ত্রপাতির ডিজাইন বা নকশার জন্য চুক্তি করে।
বিটিআরসিকে শুধু ডিজাইন এবং যন্ত্র নির্মানের জন্য গুনতে হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে সর্বমোট খরচ হিসেবে ধরা হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা যার অর্ধেক সরকারি তহবিলের মাধ্যমে এবং বাকি অর্ধেক বিদেশি সংস্থার কাছে থেকে প্রাপ্ত।
এই কৃত্রিম উপগ্রহটির সর্বমোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার ব্যান্ড থাকবে। হয়তো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে ট্রান্সপন্ডার ব্যান্ড কী। একদম সহজ! ধরুন একটি প্রেরক অ্যান্টেনা এবং আরেকটি প্রাপক অ্যান্টেনা। এই দু’য়ের মধ্যে একটি যোগাযোগ চ্যানেল গঠন, যা ইন্টার-কানেক্টেড ইউনিট সিরিজে যুক্ত থাকে।
৪০ টি ট্রান্সপন্ডার ব্যান্ডের মধ্যে ১৪টি ‘সি’ ব্যান্ড এবং ২৬টি ‘কেইউ’ ব্যান্ড। সর্বমোট ৪০টি ব্যান্ডের মধ্যে ২০টি ব্যান্ড নিজেদের জন্য এবং বাকি ২০টি ব্যান্ড বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির জন্য রাখা হবে। এটি ৪০০০বি২ স্পেসবাস প্লাটফর্মের।
১৬০০ ওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন(যার উৎস ২টি সৌর ব্যাটারি) স্যাটেলাইটটির ভর ১৩০০ কেজি হলেও বাহক রকেটসহ উৎক্ষেপণ ভর হবে প্রায় ৩৬০০ কেজি ।
স্পেস এক্স এবং বঙ্গবন্ধু-১
এবার আসি স্পেস এক্স এর কথায়। এলন মাস্ক, যাকে আমরা কমবেশি সবাই চিনি। বর্তমানে প্রযুক্তির বরপুত্র বলা হয় কাকে? উত্তরটি চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যায় বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা উদ্ভাবক এবং বিখ্যাত স্পেস এক্স এর কর্ণধার এলন মাস্কের নাম। যিনি ‘হাইপারলুপ’ নামক একটি নকশার পরিকল্পনা করেছেন যেখানে একটি বিশেষ টিউবের মধ্য দিয়ে দ্রুতগতির ট্রেন সিস্টেম পরিচালিত হবে। এলন মাস্কের আরো একটি বড় পরিচয় হচ্ছে তিনি ‘টেসলা মটরস’ এরও প্রধান নির্বাহী।
কোর্সটিতে যা যা পাচ্ছেন:
বিসিএস প্রিলি লাইভ কোর্স
বলতে গেলে দ্রুতগতির যোগাযোগ ব্যবস্থার বর্তমান রক্ত মাংসের একক হচ্ছেন ‘এলন মাস্ক’। নাসার সাথে একযোগ হয়ে মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনায় মত্ত এই স্বপ্নবাজ মানুষেরই রকেট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্পেস এক্স। আর এই স্পেস এক্স হলো আমাদের দেশের প্রথম যোগাযোগ উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু-১’ এর লঞ্চ অপারেটর। অর্থাৎ উৎক্ষেপণ থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট কক্ষপথে পৌঁছে দেয়ার গুরু দায়িত্ব নিয়েছে কোম্পানিটি!
আর তাই আমাদের বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটটি স্পেস এক্স-এর তৈরি ‘ফ্যালকন-৯’ নামক রকেটের স্পেস শাটলের কার্গো বে এর মাধ্যমে মহাকাশে পাঠানো হবে। ফ্যালকন হচ্ছে একটি রকেট পরিবার যেখানে ৩ ধরণের ফ্যালকন রকেটের সমাহার দেখা যায়।
‘ফ্যালকন-১, ফ্যালকন-৯ এবং ফ্যালকন হেভি’। তবে আমাদের বঙ্গবন্ধু-১, ৬ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ফ্যালকন -৯ রকেটের অত্যাধুনিক ১.২ ভার্সনের (ফুল থ্রাস্ট) নাকের ডগায় অবস্থান নেবে।
উৎক্ষেপণের মাত্র ৮ মিনিটের মাথায় রকেটের নিচের অংশ পৃথিবীতে ফেরত আসবে এবং উপরের স্যাটেলাইট চেম্বার নিয়ে যাবে তার গন্তব্যস্থলে। সেখানে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (ISS)-এ পৌঁছার পর প্রয়োজনীয় ধাপ পার করে একে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ছেড়ে দেয়া হবে। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে ফ্যালকন-৯ রকেট বেশ সফল। তবে মহাকাশে সর্বপ্রথম গাড়ি টেসলা রোডস্টার পাঠানো হয় কিন্তু ফ্যালকন-হেভি নামক রকেটের সাহায্যে।
এ যেন স্বপ্নবাজ লোকের হাতে গড়া রকেট দিয়ে ১৮ কোটি মানুষের স্বপ্নের উৎক্ষেপণ!
স্যাটেলাইটের কাজ এবং ধরণ:
আমরা জানি একটি স্যাটেলাইট পৃথিবীর চারদিকে ডিম্বাকার পথে পরিভ্রমণরত থাকে। তবে একে উৎক্ষেপণের পর একটি নির্দিষ্ট দ্রুতি প্রদান করা হয় যাতে কক্ষপথে ঘুরতে থাকে এবং কেন্দ্রমুখী বলের মাধ্যমে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে।
আমরা পদার্থবিজ্ঞানে পড়েছি যে কোনো বস্তুকে ১১.২ কি.মি/সেকেন্ড বেগে উপরে নিক্ষেপ করলে তা আর পৃথিবীতে ফেরত আসে না। অর্থাৎ চাঁদের মত পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। কিন্তু একটি স্যাটেলাইটকে ২৫০ কি.মি. উপরে তুলে এবং পৃথিবী পৃষ্ঠের সমান্তরালে এমন ভাবে উৎক্ষেপ করতে হবে যেন তা প্রতি সেকেন্ডে ৮ কি.মি পথ অতিক্রান্ত করে। যা রকেটের সাহায্য ছাড়া একদমই অসম্ভব।
সাধারণত পৃথিবী থেকে রেডিও অ্যাকটিভ বা বেতার তরঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে স্যাটেলাইটে তথ্য প্রেরণ করা হয়। সেক্ষেত্রে স্যাটেলাইট তখন প্রাপক যন্ত্র হিসেবে কাজ করে এবং রিসিভ করা উপাত্তকে বিবর্ধিত করে পুনরায় পৃথিবীতে প্রেরণ করে। স্যাটেলাইট থেকে আসা সিগন্যাল কিছুটা কম শক্তিসম্পন্ন যার জন্য প্রথমে ডিশ অ্যান্টেনা ব্যবহার করে প্রাপ্ত সিগন্যালকে কেন্দ্রীভূত করা হয় এবং রিসিভার দিয়ে গ্রহণ করে পরবর্তী কাজগুলো সম্পন্ন হয়। আমরা নিরবিচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা পেয়ে থাকি।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট হচ্ছে জিওস্ট্যাশনারি কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট যা শুধুমাত্র যোগাযোগ ক্ষেত্রে অর্থাৎ তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ, টেলিভিশন সম্প্রচার ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। তবে আপাতত আবহাওয়া সম্পর্কিত কোনো উপাত্ত সংগ্রহে ভূমিকা রাখতে পারছে না বঙ্গবন্ধু-১।
এছাড়াও আরও বিভিন্ন ধরনের স্যাটেলাইট আছে। মিলিটারি, ওয়েদার, ন্যাভিগেশন, আর্থ অবজারভেশন সহ আরও বিভিন্ন স্যাটেলাইট কাজের ধরন অনুযায়ী মহাকাশে স্থাপন করা হয়। এক এক স্যাটেলাইটের কাজের ধরণ বিবেচনায় এক এক উচ্চতায় স্থাপন করা হয়। তবে বিভিন্ন স্যাটেলাইটের কাজে ভিন্নতা থাকলেও প্রতিটি স্যাটেলাইটেরই শক্তির উৎস হচ্ছে সূর্য। এদের গায়ে সৌরকোষ লাগানো থাকে যার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় শক্তি গ্রহণ করে তথ্য প্রেরণে ভূমিকা রাখে।
কমিউনিকেশন এবং ভূ-স্থির স্যাটেলাইট কী?
এক কথায় যোগাযোগ সম্পন্নের জন্য যে স্যাটেলাইট। একটু বুঝিয়ে বলি। আপনি যদি কোনো স্যাটেলাইটকে পৃথিবীপৃষ্ঠ হতে প্রায় ৩৫ হাজার ৭৮৬ কি.মি. উচ্চতায় স্থাপন করেন তবে তার পৃথিবীর চারদিকে সমবেগে একবার আবর্তন করতে সময় লাগবে ২৪ ঘন্টা (২৩ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট ৪ সেকেন্ড)। আবার পৃথিবীও নিজ কক্ষপথে চারদিকে একবার ঘূর্ণন সম্পন্ন করতে সময় নেয় ২৪ ঘন্টা। তার মানে পৃথিবীর সাপেক্ষে আপনি ভূ-উপগ্রহকে দেখলে মনে হবে স্থির হয়ে আছে। আর যেহেতু ভূপৃষ্ঠের সাপেক্ষে কক্ষপথ স্থির সেহেতু এই কক্ষপথের নাম হচ্ছে জিওস্ট্যাশনারি অরবিট বা ভূ-স্থির কক্ষপথ।
তবে একটু সমস্যা আছে । আমাদের পৃথিবীর আকৃতিগত বক্রতার কারণে এই ধরণের শুধু একটি স্যাটেলাইট যোগাযোগ রক্ষার্থে পুরো পৃথিবীকে সেবাদান করতে পারে না ।
সেক্ষেত্রে তিনটি স্যাটেলাইটকে পরষ্পর ১২০ ডিগ্রি কোণে জিও স্ট্যাশনারী অরবিটে স্থাপনের মাধ্যমে সহজেই পুরো পৃথিবীর কভারেজ প্রদান সম্ভব। কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আমাদের টেলিভিশন সম্প্রচার, টেলিযোগাযোগ, রেডিও বার্তা প্রদান, দ্রুতগতির নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা ইত্যাদি নিশ্চিত হবে।
আর আমাদের বঙ্গবন্ধু-১ হচ্ছে ঠিক এরকম ভূ-স্থির কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট।
বঙ্গবন্ধু-১ এর কক্ষপথ
২০১১ সালে বাংলাদেশের পাঠানো ভবিষ্যত স্যাটেলাইটের জন্য আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (আইটিইউ) ১০২ ডিগ্রি পূর্ব স্লট নির্ধারন করেছিল। সেক্ষেত্রে রাশিয়ান সর্ববৃহৎ স্যাটেলাইট কোম্পানি ‘ইন্টারস্পুটনিক’ এর কাছ থেকে অরবিটাল স্লটের জন্য চুক্তিও করা হয়। আমাদের দেশ সবসময়ই চেয়েছিল স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে যেন ১০২ ডিগ্রি পূর্ব স্লটকেই দেয়া হয়।
কিন্তু দু:খের বিষয় সেই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, রাশিয়া সহ প্রায় ২০টি দেশ বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য আপত্তি প্রকাশ করে। তবে তার মূল কারণ ছিল ১০২ ডিগ্রি স্লট নিয়ে। কারণ ১০২ ডিগ্রির আশেপাশে অন্যান্য স্যাটেলাইটের অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের স্যাটেলাইট এবং সেই সাথে অন্যান্য স্যাটেলাইটেও ফ্রিকোয়েন্সি পেতে সমস্যা হতে পারে।
তখন আমাদের দেশ পুনরায় ভিন্ন একটি উপায় বের করে এবার ৬৯ ডিগ্রিতে আবেদনের চিন্তা করে। কিন্তু তা বাতিল করতে হয় সিঙ্গাপুর, চীন এবং মালয়েশিয়ার সম্ভাব্য আপত্তির কারণে। তাই স্পুটনিকের কাছ থেকে ১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ স্লট কিনে নেয়া হয়, যার জন্য খরচ পড়েছে প্রায় ২১৯ কোটি টাকা (২.৮০ কোটি মার্কিন ডলার)। কিন্তু আমাদের দেশের অবস্থান ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে বিধায় স্যাটেলাইটের অবস্থান হবে ইন্দোনেশিয়া বরাবর।
তবে আমাদের এই স্যাটেলাইটের প্রাথমিক মেয়াদ ধরা হয়েছে ১৫ বছর। এর মানে হলো ‘স্পুটনিক’ আমাদেরকে তাদের ১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমারেখাকে ১৫ বছরের জন্য ভাড়া দিয়েছে। তবে আরও দু’বার ১৫ বছর করে আরও ৩০ বছর পর্যন্ত কক্ষপথ কেনা যাবে। সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সরকার আরও দুটি স্লটের জন্য আবেদন করবে। স্লট দুটি হলো ৬৯ ডিগ্রি পূর্ব এবং ১৩৫ ডিগ্রি পূর্ব। অদূর ভবিষ্যতে আরও ২টি স্যাটেলাইট স্থাপনের মাধ্যমে পুরো পৃথিবীর কভারেজ নেয়া সম্ভব হবে।
তাই আপাতত ১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ কক্ষপথেই স্থাপিত হবে আমাদের লাল সবুজের গর্বের বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট।
বঙ্গবন্ধু-১ নিয়ন্ত্রণের গ্রাউন্ড স্টেশন:
একটি স্যাটেলাইটকে কক্ষপথে ছেড়ে দিলেই যদি কাজ শেষ মনে করেন, তবে ভুল ভাবছেন। একে কন্ট্রোল করতে হয়। ২৪ ঘণ্টা রক্ষণাবেক্ষণ না করলে যেকোনো সময় কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়তে পারে। আর সেই লক্ষ্যে আমাদের দেশ থেকেই বঙ্গবন্ধু-১-কে নিয়ন্ত্রণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ করবে দেশের সেরা ১৮ জন স্যাটেলাইট প্রকৌশলী। গ্রাউন্ড স্টেশন দু’টি হলো ঢাকার অদূরে গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বিসিএসসিএল এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি জেলার ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র।
ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া ৩ বছরের জন্য একে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিলেও মূল কাজ সম্পাদিত হবে জয়দেবপুরের গ্রাউন্ড স্টেশন থেকেই।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জয়দেবপুরের গ্রাউন্ড স্টেশন থেকেই উদ্বোধন করবেন দেশের প্রথম স্যাটেলাইটের অভিযাত্রা এবং সংকেত পেয়েই ফ্লোরিডার আকাশ ছিন্ন করে উর্ধ্বগামী হবে বঙ্গবন্ধু-১।
বাংলাদেশের ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধু-১ :
Satellite communications connect television screens in Japan with television cameras in England, and the distance of half a world loses its meaning.
– Robert Kennedy
প্রযুক্তিগত উন্নয়নে মানুষের কল্যাণের পরিধি কখনোই ছোট হয় না। যে দেশ প্রযুক্তিতে যত বেগবান, সেই দেশ ততো বেশি সমৃদ্ধশালী। রাশিয়ার ইতিহাসে চোখ রাখলেই প্রমাণ পাওয়া যাবে। আমাদের দেশে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। অর্থাৎ যোগাযোগের ব্যবস্থাও উন্নত হচ্ছে। তার মানে স্যাটেলাইটের ব্যবহারও বাড়ছে। কিন্তু আমরা সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশের স্যাটেলাইট সেবা ভাড়া নিয়ে ব্যবহার করে আসছি, যার জন্য সরকারকে প্রতি বছর গুণতে হয় ১২৫ কোটি টাকা। তাহলে একবার ভাবুন দেশের নিজস্ব স্যাটেলাইটের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু!
একটি হিসেবে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের সেবায় শুধু বৈদেশিক মুদ্রাই সাশ্রয় হবে না, উপরন্তু এর কিছু অব্যবহৃত অংশ মায়ানমার, নেপাল, ভূটানের মতো দেশে ভাড়া দিয়ে প্রতি বছর ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব। যার ফলে বঙ্গবন্ধু-১ প্রকল্পের সর্বমোট খরচ তুলতে ৫-৭ বছরের বেশি লাগবে না। এখন আর আমাদেরকে অন্য দেশের স্যাটেলাইটের উপর নির্ভর করে চলতে হবে না। টেলিভিশন সম্প্রচারের খরচও অনেকটা কমে যাবে।
এছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্র যেমন টেলিমেডিসিন, ই-লার্নিং, ই-গবেষণা, ভিডিও কনফারেন্স, প্রতিরক্ষা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা উন্নত হবে। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় তথ্য আদান-প্রদানে গোপনীয়তা অত্যন্ত জরুরি যেখানে বিশ্বের অন্যান্য দেশ ‘স্যাটেলাইট ফোন’ ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের জন্য এই প্রথম বারের মত নিজস্ব স্যাটেলাইট ব্যবহার করার মাধ্যমে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ রক্ষা এবং গোপনীয়তা বজায় রাখা সম্ভব হবে।
কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটের অন্যতম সেবা হচ্ছে দূর্যোগের সময়েও দ্রুতগতির ইন্টারনেট প্রদান যা বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় কম খরচ সহ প্রযুক্তিখাতে এক নতুন ভিত্তি রচনা করবে। প্রাকৃতিক দূর্যোগে দেশের অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্থ হলেও এই স্যাটেলাইট প্রয়োজনীয় ‘ই-সেবা’ প্রদান করে জরুরি মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
প্রযুক্তির এই প্রতিযোগিতায় বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট আমাদের দেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিচ্ছে, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই.
প্রস্তুত ফ্যালকন-৯ ব্লক ৫। পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য ৪ই মে, ৭ই মে থেকে দু’বার তারিখ পেছালেও অপেক্ষার প্রহর শেষের পথে। বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) থেকে সরাসরি সম্প্রচার হবে, এছাড়াও স্পেসএক্স-এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল থেকেও উপভোগ করা যাবে এই ঐতিহাসিক গৌরবজ্জ্বল মুহূর্ত। https://www.rocketlaunch.live/ এই ওয়েবসাইট থেকেও সরাসরি সম্প্রচার হবে বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণ। আপনি সহজেই http://spacexstats.xyz ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আর কত সময় অপেক্ষা করতে হবে তা জানতে পারবেন।
কখনও ভেবে দেখেছেন আর কিছুক্ষণ বাদেই ফ্লোরিডার আকাশে 3, 2, 1 বলে বাংলাদেশের সাফল্যের জয়গান গীত হচ্ছে? আর সেই সাথে প্রচন্ড বেগে উৎক্ষেপিত হচ্ছে আমাদের স্বপ্নের ভেলা? ভাবলেই গর্ব হচ্ছে আজ আমাদের সবার। ৫৭টি দেশের তালিকায় আজ লাল সবুজের দেশ নাম লেখাবে। হাজার হাজার স্যাটেলাইটের ভিড়ে আজ আমাদেরও স্যাটেলাইট উড়বে।
আজ আমরা মাথা তুলে বুকে হাত রেখে ‘আমরাও পারি’ বলা এক জাতি। পেরেছি ৫২, ৬৯ আর ৭১ এ। পারছি ২০১৮ তে। পারবো ভবিষ্যতেও । প্রস্তুত কেনেডি স্পেস সেন্টার, অ্যাপোলো/স্যাটার্ন কমপ্লেক্সে দর্শনার্থীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ মেনে উপভোগের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। খুব গর্ব হয় না? যখন এত বিশাল ক্ষমতাধর দেশের মানুষগুলো আজ বাংলাদেশকে মাথা উঁচু করে দেখবে? প্রস্তুত আজ আমরা সবাই। প্রস্তুত শহীদদের রক্তের মর্যাদা দিতে।
শহীদদের আত্মারা আজ চিৎকার করে বলবে ‘’রক্ত বৃথা যায়নি! রক্ত বৃথা যায়নি’’।
জয় বাংলা!
এই লেখাটির অডিওবুকটি পড়েছে মনিরা আক্তার লাবনী।
আমাদের কোর্সগুলোতে ভর্তি হতে ক্লিক করুন:
- Communication Masterclass by Tahsan Khan
- Facebook Marketing Course by Ayman Sadik and Sadman Sadik
- ঘরে বসে Freelancing by Joyeta Banerjee
- ঘরে বসে Spoken English Course by Munzereen Shahid
- Microsoft Office 3 in 1 Bundle
- Microsoft Word Course by Sadman Sadik
- Microsoft Excel Premium Course
- Microsoft PowerPoint Course by Sadman Sadik
১০ মিনিট স্কুলের ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে ভিজিট করুন: www.10minuteschool.com
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন