আমার ভর্তিযুদ্ধের শুরুটা হয় একটা বড় ধাক্কার মধ্য দিয়ে। সে এমন এক কাহিনী, ভাবলে এখনো অবাক লাগে!
খুলেই বলি। সবে এইচএসসি দিয়েছি। পরীক্ষার পরে যা হয় আর কি, মনের মধ্যে বেশ ফুরফুরে একটা ব্যাপার হচ্ছে। এর মধ্যেই আব্বু আম্মু ধরে-বেঁধে একটা ভর্তি কোচিংয়ে ভর্তি করে দিলেন। বেশ নামজাদা কোচিং, একগাদা স্টুডেন্ট। সবার মুখ ভার, সবাই এমন সিরিয়াস চোখে তাকিয়ে আছে যেন প্রথম দিনই তাদের ভর্তিপরীক্ষা নেয়া হবে! আমার উলটো এসব দেখে বেশ হাসিই পেলো, মনে হলো- এরা অকারণেই এত সিরিয়াস, এসব ক’দিন পরেই কেটে যাবে!
প্রথম ক্লাস। বোরিং লেকচার হচ্ছিল ভেক্টর নিয়ে। এই চিহ্ন, ওই চিহ্ন দেখতে দেখতে মাথাটা একটু ধরে এসেছিলো। একটু পরেই দেখি, সেই ইন্টারনেট মিমগুলোর মতোই ফাঁকা বোর্ড ভরে উঠেছে একগাদা আঁকিবুঁকিতে! মাথায় হাত আমার, কিছুই তো বুঝলাম না! একটু পর আবার ভাইয়া বলে বসলো, পরের ক্লাসে পরীক্ষা নেয়া হবে। আমি আগাগোড়াই ফাঁকিবাজ মানুষ, মনে করলাম এমনিই হয়ত ভয় দেখাচ্ছেন ভাইয়া।
পরের ক্লাস। ভাইয়া এসেই বললেন পরীক্ষা নেবেন। আমার তো মাথায় বাজ পড়লো, প্রিপারেশনও তো নেইনি সেরকম! যাহোক, পাশে দেখি একজন দুইটা ক্যালকুলেটর বের করলো। আমি দেখে অবাক, একটা ক্যালকুলেটর দিয়েই তো হয়ে যায়, দুইটা কেন দরকার হবে? মুচকি হেসে ভাবলাম, এই ছেলে পাক্কা নার্ড মনে হয়! ওমনি দেখি পাশের জনও দুইটা ক্যালকুলেটর বের করলো! সেটা আবার যে সে ক্যালকুলেটর না, ES 991 লেখা শক্তিশালী একটা ক্যালকুলেটর। আর আমি? একটাই ক্যালকুলেটর, সেটা আবার MS 100, নিজেকে মনে হলো Nokia 1100 ফোন নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে এসেছি আইফোনের সাথে!
পরীক্ষার প্রশ্ন বেশ কঠিন ছিল। অন্তত আমার কাছে আর কি! প্রিপারেশন নেই নাই, আর জীবন তো রূপকথা না, তাই আমি এই পরীক্ষায় একশোতে বিশের বেশি আর তুলতে পারলাম না। শুধু এই পরীক্ষাই না, পরের অনেকগুলো পরীক্ষায় বিশ পার হচ্ছিলোই না! এখানে একটা সমস্যা ছিল, যে পরীক্ষার নম্বরগুলো বাসায় টেক্সট করা হয়। আমি বেঁচে গিয়েছিলাম কারণ বাসার নম্বর দেয়া ছিল আম্মুর, আর আম্মু কখনো টেক্সট চেক করেন না!
কিন্তু ওই যে, চোরের দশ দিন গৃহস্থের একদিন! একদিন ফেঁসে গেলাম আমিও। আব্বু আম্মুর ফোন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন, হুট করে তার চোখে পড়লো একগাদা মেসেজ। তিনি বলে উঠলেন, “আরে! এতগুলা টেক্সটে এইগুলা কীসের নম্বর!”
ডাক পড়লো আমার। তিনি তার সুপুত্রকে ডেকে বললেন, “বাবা, এ কী অবস্থা তোমার নম্বরের?”
আমি এযাত্রায়ও বেঁচে গেলাম এটা বলে, যে পরীক্ষাগুলো সব হয় বিশ নম্বরে! ভাগ্যক্রমে ওই মেসেজগুলোতে মোট নম্বর বলা হতো না, আর এই সুযোগে আরো একটাবার রক্ষা পেয়ে গেলাম!
বিড়ালেরও নয়টা জীবন থাকে, আমার ভাগ্য কি আর সবসময় ভালো হবে? হয়ওনি। সর্বনাশটা হলো অন্য আরেকদিন। আমার এক মহা ট্যালেন্টেড বন্ধু আমার সাথেই নিয়মিত পরীক্ষা দিতে যেতো। তো একদিন আমাদের গাড়ি আসতে দেরি হয়েছে, আমার বন্ধুটি বাসায় এসে বসেছে। অমনি আব্বুর আক্রমণ, পড়ালেখা এবং অন্য সব নিয়ে। কথায় কথায় তিনি বললেন, “বাবা, তোমার পরীক্ষার নম্বর কেমন আসছে?”
বন্ধুটি ইনিয়ে বিনিয়ে বললো, যে তার পরীক্ষা ভালো হচ্ছে না, নম্বর কম আসছে। এই যেমন গত পরীক্ষাতে মাত্র ৫৭ পেয়েছে সে!
আব্বু আমার দিকে-আমি আব্বুর দিকে- এমন এক অবস্থা হয়ে গেল। ভারতীয় বাংলা সিরিয়ালগুলোর মতোই! বাংলায় বজ্রাহত বলে একটা কথা আছে, আমার অবস্থা তখন তেমনই। আব্বু কিছু বললেন না। সন্ধ্যায় কোচিং থেকে ফিরলাম, ফিরে এসে শুরু হলো আমার উপর ঝাড়ির রোলার কোস্টার চালানো।
আব্বু সুন্দর করে বললেন, “বাবা, আমাদের গ্রামে হালচাষ করার লোকের একটু কমতি দেখছি। তুমি না হয় যাও, হালচাষ করো? পড়ালেখায় তো মনে হচ্ছে হবে না তোমার!”
আম্মু সাধারণত এসবে আমার পক্ষ নেয়, এবার দেখি আম্মুও আব্বুর সাথেই দু’কথা শুনিয়ে দিলো! সবমিলিয়ে বিশাল হতাশাজনক ব্যাপার। না, ধরা খেয়েছি সেজন্যে নয়, আসলেই কোথাও চান্স না পেলে তো মহা বিপদ! এই যে একটা ধাক্কা খেলাম, এই ধাক্কাটা পরে গিয়ে আমার অনেক কাজে লেগেছে।
সত্যি বলতে কী, এমন হতাশার পরে অনেকেই হার মানে, হাল ছেড়ে দেয়। আমি দেইনি। সব পরীক্ষায় গড়ে বিশ পেতে পেতেই একটা সময় বুঝতে পেরেছি কীভাবে ভালো করতে হবে, শেষমেষ তো আইবিএর মতো ভালো একটা ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েই গেলাম!
ভর্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে তাই বলছি, পরিশ্রম করলে সাফল্য আসবেই। ভর্তিপরীক্ষার সময়টা সবার জন্যেই খুব কঠিন যায়, তাই বলে হাল ছেড়ে দিও না। আমি যদি একশোতে বিশ পেয়ে ভালো কোথাও সুযোগ পেয়ে যেতে পারি, তুমি কেন নও?
অনেককেই দেখি হতাশ হয়ে যায় তাঁদের এসএসসি বা এইচএসএসির রেজাল্ট ভালো না হলে। মজার ব্যাপার কী জানো? রেজাল্ট খারাপ নিয়েও কিন্তু অনেকে চলে যায় হার্ভার্ডের মতো প্রতিষ্ঠানে! চোখ রগড়ে ওঠার মতো কথা, তাই না? সত্যিটা হলো, একাডেমিক এসব হতাশা ভুলে নিজেকে বিশ্বের জন্যে প্রস্তুত করলে বড় মঞ্চে আরো বড় সাফল্য আসবে তোমার। সে সাফল্যের স্বাদ বড় মধুর!
১০ মিনিট স্কুলের লাইভ এডমিশন কোচিং ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে সরাসরি চলে যেতে পারো এই লিঙ্কে: www.10minuteschool.com/admissions/live/
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন