সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কুর মতে, আমরা জীবনের তিন ভাগের এক ভাগ ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেই, যা পুরোপুরি অপচয়।প্রফেসর শঙ্কু বিস্ময়কর জ্ঞানের অধিকারী হলেও এই একটি ব্যাপারে তিনি ভুল ছিলেন। ঘুম মোটেও সময়ের অপচয় নয়। তবে হ্যাঁ, দিনের অধিকাংশ সময় যদি কেউ ঘুমিয়ে কাটায় তাহলে তাতে অবশ্যই উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হবে। কিন্তু প্রত্যেকেরই তার বয়স অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময় ঘুমের প্রয়োজন আছে।
অনেকেরই ধারণা দিনে আট ঘণ্টা ঘুমই যথেষ্ট। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বয়স অনুযায়ী পর্যাপ্ত ঘুমের পরিমাণও ভিন্ন। আসুন জেনে নেয়া যাক কোন বয়সে ঠিক কতটুকু ঘুমানো প্রয়োজন-
০-৩ মাস : ১৪-১৭ ঘন্টা
৪-১১ মাস : ১২-১৫ ঘন্টা
১-২ বছর : ১১-১৪ ঘন্টা
৩-৫ বছর : ১০-১৩ ঘন্টা
৬-১৩ বছর : ৯-১১ ঘন্টা
১৪-১৭ বছর : ৮-১০ ঘন্টা
১৮-৬৪ বছর : ৭-৯ ঘন্টা
৬৫+ বছর : ৭-৮ ঘন্টা
কম ঘুম কি শুধুই আমাদের মেজাজকে খিটখিটে করে? নাকি এর প্রভাব পরে অন্য সব ক্ষেত্রেও? আসুন জেনে নেই অপর্যাপ্ত ঘুম আমাদের কী কী ক্ষতি করতে পারে-
চিন্তাশক্তির হ্রাস
অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছেন? কখন ভাবনার খেই হারিয়ে ফেলছেন বুঝতে পারছেন না? তাহলে হতে পারে, আপনি প্রয়োজনের চেয়ে কম ঘুমাচ্ছেন। প্রয়োজনের চেয়ে কম ঘুম আমাদের কর্মক্ষমতা, সামাজিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলার পাশাপাশি বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সূত্রপাত ঘটায়। ঘুমের স্বল্পতা আমাদের সারাদিনের ক্লান্তিভাব, অনিয়ন্ত্রিত আবেগ নিয়ন্ত্রণে ও অহেতুক উদ্বেগের জন্য দায়ী।
মনোযোগের অভাব ও ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি
তীক্ষ্ণ মেধা-সম্পন্ন হতে চান? তাহলে সঠিক পরিমাণে ঘুমান। কম ঘুম আমাদের স্মৃতিশক্তিতে দুইভাবে প্রভাব ফেলে। প্রথমত, যেকোনো বিষয়ে আমাদের মনোযোগের ক্ষমতা কমিয়ে শিখন পদ্ধতিকে ধীর করে দিয়ে। দ্বিতীয়ত, ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্ক ব্যস্ত থাকে স্মৃতি একীভূতকরণে। তাই কম ঘুমের ফলাফল হয় বিচ্ছিন্ন কিছু স্মৃতি যা ফলশ্রুতিতে আমাদেরকে করে তোলে ভুলোমনের অধিকারী।
চেহারায় বয়স্ক ভাব ও ত্বকের সাবলীল সৌন্দর্য নষ্ট
ধারাবাহিকভাবে ঘুমের অভাব হলে ত্বকের উজ্জ্বলতা কমে যায়, চেহারায় ফুটে ওঠে বয়সের ছাপ। কারণ ঘুমের সময় শরীর তার মৃত কোষগুলোকে সরিয়ে নতুন কোষের সংস্থাপন করে, তাদের পুষ্টির জোগান দেয়। সঠিক পরিমাণ ঘুম শরীরের ৬০% ক্ষতিকর পদার্থ অপসারণে সাহায্য করে। এছাড়াও কম ঘুম শরীরে গ্রোথ হরমোনের নিঃসরণও কমিয়ে দেয় ও শরীর ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পড়ে।
ওজন বাড়িয়ে দেয়
বেশি ঘুমোলে ওজন বাড়ে, তা সবার জানা। তাই অনেকেরই ধারণা যে কম ঘুমালে নিশ্চয়ই ওজন কমে? কিন্তু সঠিক উত্তর ঠিক এর উল্টো। ঘুমের অভাব আমাদের ক্ষুধার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় ও আকর্ষণ বাড়ায় হাই ফ্যাট খাবারের প্রতি। গবেষণা মতে, যারা দিনে ছয় ঘণ্টা বা তার কম ঘুমায় তাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনা যারা দিনে সাত থেকে নয় ঘণ্টা ঘুমায় তাদের থেকে ৩০% বেশি।
ডিপ্রেশনের কারণ
অপর্যাপ্ত ঘুম বা ঘুমের কোন সমস্যা ডিপ্রেশনের একটি আহ্বায়ক হিসেবে কাজ করে। গবেষণায় উঠে এসেছে যে বেশিরভাগ হতাশাগ্রস্ত মানুষ ছয় ঘণ্টার কম ঘুমায়। না ঘুমানো বা কম ঘুমানো ডিপ্রেশনকে যেমন পাকাপোক্ত করে, ঠিক তেমনি ডিপ্রেশনও ‘ইনসমনিয়ার’ একটি অন্যতম কারণ। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় ইনসমনিয়ার চিকিৎসা করলে ডিপ্রেশন ভালো হয়ে যায় এবং বিপরীতেও একই।
প্রজনন ক্ষমতা কমে যায়
একটানা ঘুমের অভাব দেহে হরমোনের ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটায়, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। অনিয়মিত ঘুম পুরুষ দেহে টেস্টোস্টেরন ক্ষরণ কমায়, যা প্রজনন ক্ষমতায় প্রভাব ফেলে। আর নারীদেহে ঘুমের অপ্রতুলতা শরীরের জৈবিক ছন্দ ব্যাহত করে, হরমোন ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটায়। এছাড়াও মেজাজের তিরিক্ষিভাব সম্পর্কে চিড় ধরায় ও পরস্পরের মধ্যে সান্নিধ্য কমে আসে।
হৃদরোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়
স্বল্প ঘুমের অর্থ হচ্ছে শরীর তার পর্যাপ্ত বিশ্রাম পাচ্ছে না। বিশ্রামহীন শরীরকে দীর্ঘক্ষণ কর্মক্ষম রাখতে বিশেষ কিছু রাসায়নিকের নিঃসরণ হয় যার ফলে সাময়িকভাবে হৃদকম্পন ও ব্লাড প্রেসার কমে যায়, কিন্তু ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকলে হৃদকম্পন ও ব্লাড প্রেসার বৃদ্ধির পাশাপাশি হৃদরোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এছাড়া শরীরে ইনসুলিন প্রতিরোধ বেড়ে যায় যা কিনা ডায়াবেটিস ও হার্টের বিভিন্ন রোগের কারণ।
ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়
অপর্যাপ্ত ঘুম ও ক্যান্সারের মধ্যে সূত্র খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, বিশেষ করে স্তন ক্যান্সার, প্রস্টেট ক্যান্সার ও কলোরেক্টাল ক্যান্সারের সাথে। মূলত ঘুম স্বল্পতা যেকোন ক্যান্সারের সম্ভাবনাই বাড়িয়ে দেয়। পর্যাপ্ত ঘুম শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ও আরোগ্যলাভে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া ঘুমের সময় শরীরে মেলাটোনিন হরমোন নিঃসরণ হয় যা কোষক্ষয়ের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
দুর্ঘটনার আশংকা বাড়ায়
বেশিরভাগ সড়ক দুর্ঘটনার একটি অতি পরিচিত কারণ চালকদের তন্দ্রাভাব। তন্দ্রাভাব আমাদের কর্মক্ষমতা ঠিক ততটাই কমিয়ে দেয় যতটা কমায় অ্যালকোহল। এর কারণে চালকরা যেমন তাদের স্টিয়ারিং এর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না, ঠিক তেমনি একজন তন্দ্রাচ্ছন্ন পথচারীও বিপদের মুহূর্তে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয় যা হয়ে ওঠে জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, পৃথিবীর ২৫% মানুষ কোনো না কোনো ঘুমের ব্যাধিতে আক্রান্ত। কারো ক্ষেত্রে তা বড় কোন সমস্যার সৃষ্টি করলেও অনেকের ক্ষেত্রে করে না বলে আমরা বিষয়টি সম্পূর্ণ অবহেলা করে যাই। কিংবা হয়ত আমাদের বড় রোগটির নেপথ্যেও যে অপর্যাপ্ত ঘুমই দায়ী তা আমরা বুঝতে পারি না। কম ঘুমিয়ে বেশি পরিশ্রম করে আমরা আর্থিক যে সুবিধাটি পেতে চাই কিংবা ইন্টারনেট, টিভি, ভিডিও গেমে আমরা যে সময়টা নষ্ট করি তাতে হয়ত ক্ষণিকের জন্য মানসিক প্রশান্তি লাভ হয়। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে আমরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতির পথ সুগম করছি। তাই এখন পর্যাপ্ত ঘুম ও সুন্দর ভবিষ্যৎ নাকি অধিক পরিশ্রম ও পরবর্তী ভোগান্তি, আপনি কোনটি বেছে নেবেন তা আপনার হাতে।
এই লেখাটি নেয়া হয়েছে Spikestory ব্লগ থেকে।
এরকম আরো লেখা পড়তে ঘুরে এসো Spikestory-র ফেসবুক পেজ থেকে।
আপনার কমেন্ট লিখুন