রুশ বিপ্লব নিয়ে এ লেখার প্রথম পর্বে আমরা দেখেছিলাম নিকোলাসের বেড়ে ওঠা, ইতিহাসের নিকোলাস দা ব্লাডি। আমরা দেখেছিলাম লেনিনের জন্ম। দেখেছিলাম প্রতিবাদের কৃষ্ণচূড়ার ধীরগতিতে পরিস্ফুটন। এই পর্বে সেই ফুল পরিণতি পাবে। আজ আমরা ইতিহাসে ঘুরে আসব আরও একটু দূর। মূল ঘটনার আরেকটু কাছে। আলেক্সান্ডার তখন অসুস্থ। রাশিয়ার সিংহাসনে নিকোলাসের বসার সময় ঘনিয়ে আসছে। এখান থেকেই শুরু হবে, এই পর্ব।
(৭)
রাজ্যের সবার চোখ নিকোলাসের দিকে থাকলেও নিকোলাসের চোখ তখন রাজ্যের দিকে নয়। রাজকুমারীর দিকে। কাহিনীতে এবার আসছে নতুন চরিত্র। রাজকুমারী এলিক্স।
নিকোলাস তখন বিয়ে করতে চাইছেন ইংল্যান্ডের রাজকুমারী এলিক্সকে। এলিক্স তাকে সাফ মানা করে দিলেন। কেননা তিনি রাশিয়ান অর্থোডক্স ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে চাননি। কিন্তু শেষমেশ তিনি রাজী হন নিকোলাসকে বিয়ে করতে। নিকোলাসকে পছন্দ করলেও এলিক্স পছন্দ করতেন না রাশিয়াকে।
আলেক্সান্ডার তা জানতেন। জানতেন, হবু রানীর টান নেই রাজ্যের প্রতি। তবুও ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সম্পর্কটাকে মেনে নেন আলেকজান্ডার তৃতীয়। সে বছর হেমন্তে রাজা একদম বিছানায় পড়ে যান। তখনই তিনি নিকোলাসকে বলেন এলিক্স কে রাশিয়ায় নিয়ে আসতে এবং সিংহাসনে বসতে।
এলিক্স রাশিয়ায় এসে ধর্মান্তরিত হয়ে নাম নিলেন আলেক্সান্দ্রা। রাজা তৃতীয় আলেক্সান্ডারের মৃত্যুর পরদিনই সিংহাসনে বসলেন নিকোলাস জার দ্বিতীয়। তিনি আর রাজকুমার নন, রাজা দ্বিতীয় নিকোলাস জার।
নিকোলাস এসবের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি তার স্ত্রীর ভাই গ্র্যান্ড ডিউক আলেক্সাণ্ডারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার আর রাশিয়ার কী হবে?’
এতক্ষণ আপনারা প্রাসাদের ভেতরে ছিলেন বৈকি কিন্তু এটাও তো জানেন যে বাতাস থেমে থাকে না এবং প্রাসাদের বাইরে বাতাস বইছে। সে বাতাসে মুক্তির স্বপ্ন ভেসে বেড়ায়। যে স্বপ্ন দেখার জানালা তৈরি করেছিলেন কার্ল মার্কস।
নিকোলাস যখন সিংহাসনে তখন লেনিন বেআইনিভাবে ছাপাচ্ছেন তার রাজনৈতিক গঠনমূলক সমালোচনার বই, ‘Friends of the People’. ইতিহাসের চোখে তখনও ধরা পড়েননি রাসপুটিন।
(৮)
গোড়ায় গলদ বলে একটা কথা আছে। সেই গোড়ায় গলদের একটা উদাহরণ আমরা দেখতে পাব নিকোলাসের অভিষেক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। নিকোলাসের অভিষেকই হয়েছিলো জনগণের অসন্তোষের মধ্য দিয়ে।
আনুষ্ঠানিকভাবে সিংহাসনে নিকোলাস বসেন ১৮৯৬ সালে। খোদেনকা মাঠে আয়োজন করা হয় এক বিশাল উৎসবের। যেখানে দেয়া হচ্ছিলো বিনামূল্যে খাবার ও পানীয়। প্রায় দশ হাজার মানুষ উপস্থিত হয় সেই মাঠে। হঠাৎ করেই গুঞ্জন দেখা দেয় মানুষের মাঝে। অনেকেই বলা শুরু করে খাবার পর্যাপ্ত নেই। তাই নিজের ভাগ পেতে হুড়োহুড়ি করা শুরু করে সবাই। সেদিন পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মারা যান ১৩৮৯ জন।
১৩৮৯টি লাশের ওপর দিয়ে রাজ্য অভিষেক হয় রাজা দ্বিতীয় নিকোলাস জারের।
ফরাসিদের রুশদের সাথে কোনো শত্রুতা ছিল কিনা জানা নেই। তারা সে রাতেই একটা পার্টির আয়োজন করেন এবং দাওয়াত দেন নিকোলাস জারকে। ফরাসিদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে নিকোলাস জার যোগ দেন পার্টিতে। রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে চাপা অসন্তোষ।
‘নিকোলাস জার প্রজাদের কথা ভাবেন না। নিকোলাস জার ১৩৮৯টি লাশের জন্য দুঃখিত নন। ‘এরকম কথাই ভেসে বেড়াতে থাকে রাশিয়া জুড়ে।
(৯)
এবার ইতিহাসের চোখে ধরা পড়েছে রহস্যময় রাসপুটিন। ধার্মিক সম্প্রদায়ে তখন এই নামটি বেশ শোনা যাচ্ছে। গ্রেগরি রাসপুটিন। কিছু মানুষের জন্য রাসপুটিন দেবতার আসন নিয়ে নিয়েছে।
সেই বিচক্ষণ চরিত্র, জারের অর্থমন্ত্রী সেরগেই ছিলেন রাসপুটিনের অনুসারী। ১৯০৫ এর নভেম্বরে তিনি নিকোলাসের সাথে দেখা করিয়ে দেন রাসপুটিনের। ওদিন সেরগেই বিরাট একটা কাজ করে ফেলেছিলেন। সেরগেই যদি জানতেন এই পরিচয়ের ফল কী হবে, তাহলে কখনোই রাসপুটিনকে নিকোলাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন না।
রাসপুটিন জাদু জানতেন কিনা জানা নেই। নিকোলাস প্রথম দেখাতেই ওনাকে পছন্দ করে ফেলেন। ওদিন নিকোলাস তার ডায়েরীতে লেখেন – ‘ঐশ্বরিক এক মানুষের সাথে আজ পরিচিত হলাম। নাম তার গ্রেগরি রাসপুটিন।’
রাশিয়ার ইতিহাসে ১৯০৫ আরও একটি তাৎপর্য বহন করে। ১৯০৫ সাল এক রক্তাক্ত বছর। এবার আলোচনা হোক ১৯০৫ নিয়ে, এবার আলোচনা হোক ব্লাডি সানডে নিয়ে।
(১০)
ভূমিদাসত্বের শিকল থেকে রাশিয়ানরা মুক্তি পায় ১৯ শতকে। রুশরা তাই ছিল মনেপ্রাণে কৃষক। হুট করে তারা ঢুকে গেল লোহার জঞ্জালে। দৈনিক ১৫ ঘণ্টার মত কারখানায় কাজ করা রুশদের জন্যে সহজ ছিল না। মজুরি যা দিত তা দিয়ে ভদকা হলেও রুটিতে টান পড়তো কখনও কখনও।
তার উপর মেশিনগুলোর মন মর্জি বোঝা দায়, প্রতি সপ্তাহে দুর্ঘটনায় কেউ না কেউ মরছে বা আহত হচ্ছে।
১৮৮৬তে আমেরিকান শ্রমিকরা যা করলো তা রুশ শ্রমিকরা করলো ১৯০৫ এ এসে। তফাৎ এই যে ১৮৮৬ এর জন্যে আমরা মে ডে পালন করি কিন্তু ১৯০৫ এর ২২ জানুয়ারির কথা ক’জন জানি তা বলা দায়।
২২ জানুয়ারি, ১৯০৫, প্রায় তিন হাজারের বেশি শ্রমিক জড়ো হয়েছে সেইন্ট পিটাসবার্গে, উইন্টার ক্যাসেলের সামনে। রাজা নিকোলাস জারের আবাসস্থলের সামনে দাবী নিয়ে দাড়িয়ে লোহার শ্রমিক।
আরো পড়ুন: জানা অজানার রুশ বিপ্লব: পর্ব ১
রাশিয়ার বাতাসে তখন কনকনে ঠাণ্ডা, এরকম ঠাণ্ডায় আরো প্রায় ৫৪ বছর পর কুপোকাত হবে হিটলারের জার্মান সৈন্যরা। সেইন্ট পিটাসবার্গে অবস্থানরত বিদ্রোহীরা তা জানে না, কিন্তু আমরা জানি। কেননা এই মুহূর্তে আমরা বিধাতার মত সব দেখতে পাচ্ছি।
কিন্তু এখন আমরা যা দেখব তা একজন বিধাতার জন্যে দেখা কষ্টকর। একজন বিধাতা নিশ্চয়ই চাইবে না তার সৃষ্টির মাঝে লড়াই হোক। একদল আরেকদলকে রক্তাক্ত করুক। কিন্তু বিধাতা হতে গেলে অপ্রিয় জিনিসগুলোও নিতে হয়। আমরা এখন তাই করব।
সেদিন প্রাসাদে ছিলেন না রাজা দ্বিতীয় নিকোলাস জার। অথচ তার কাছে দাবী নিয়ে এসেছে হাজারো মানুষ। সকাল দশটার দিকে রাজার সৈন্যরা গুলি চালালো প্রতিবাদী সৈন্যদের উপর। সৈন্যদের গুলি চালানোর অনুমতি কেউ দিয়েছিলো কিনা জানা নেই। অথবা হাতে কাটা রাইফেল থাকলে মানুষ মারতে সনদপত্রের দরকার পড়ে না হয়ত।
নারভা গেটের সামনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলো গ্যাপন নামের এক উঠতি নেতা। সেখানেই গুলি চললো প্রথমে। প্রায় চল্লিশটা লাশ পড়লো প্রাসাদের সামনে। গ্যাপনের দলের চল্লিশজন মারা গেলেও সে ছিল অক্ষত। চল্লিশটা লাশের বোঝা কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে।
সেদিন আর কয়টা লাশ পড়েছিলো তা সঠিকভাবে কেউ জানে না। রেকর্ডে বলা হয়েছে ১০০ জনের মত মারা গেছে। যদিও সবাই বলাবলি করছিলো ১০০০ জনের মত মারা গেছে।
ওদিন রাতে নিকোলাস জার আবার ডায়েরি নিয়ে বসলেন। লিখলেন, ‘আজকের ঘটনাটা ছিল খুবই হতাশাজনক এবং বেদনাদায়ক ‘।
কিন্তু নিকোলাস কি তখন জানতেন, আজকের এই বেদনাদায়ক দিনের পর তার নাম হয়ে গেল, ‘ নিকোলাস দা ব্লাডি’। যারা তার এই নাম দিয়েছিলো, তারা কি জানতেন নিকোলাস ভারী মনে ডায়েরিতে সেই দিনের বিবরণ লিখেছেন?
তারা জানতেন না বলেই বিপ্লবটা তাদের জন্য সহজ ছিল। কিন্তু যেহেতু আমরা জানি তাই আমরা পুরোপুরিভাবে নিকোলাসকে ঘেন্না করতে পারি না।
আপনিই বলুন, নিকোলাস ঠিক কোন জায়গায় ভুল ছিলেন? তার জন্ম থেকেই নির্ধারিত হয়ে ছিলো তিনি রাজা হবেন। রুশ রাজতন্ত্রের পতাকা বইতে হবে কাঁধে। তৃতীয় আলেক্সান্ডার তাকে রাজার মত করে গড়েও তোলেননি এবং ঠিক সেই সময়েই রাশিয়াতে উত্থান হতে থাকে সমাজতন্ত্রের। তখনই লেনিনের জন্ম হয়। কার্ল মার্কসের তৈরি জানালা দিয়ে সবাই জীবন দেখতে থাকে। নিকোলাসকে আমরা উদাসীন বলতে পারি, বলতে পারি এমন একজন রাজা যিনি প্রজা সম্পর্কে ভাবতেন না। কিন্তু আমরা কি তাকে অত্যাচারী বলতে পারি?
যখন আপনি বিধাতার জায়গা থেকে দেখবেন তখন আপনার এরকম মনে হওয়াই স্বাভাবিক, যেন কোন লেখক গল্প লিখছেন। কেউ একজন আড়ালে বসে ঠিক করে দিচ্ছে রাশিয়ার ভাগ্য। পরোক্ষ বিধাতার কথা না ভেবে এখন প্রত্যক্ষ বিপ্লবীর দিকে চোখ নেই।
কোর্সটি করে যা শিখবেন:
English for Govt. Jobs
আমি বলেছিলাম এ গল্পে কোনো নায়ক নেই। যদিও অনেকের কাছে লেনিন নায়কের মূর্তিরূপ হয়ে দাড়াবে। নিকোলাসের অভিষেকের সময় থেকে ব্লাডি সানডে পর্যন্ত সময়টায় আমরা লেনিনকে দেখতে পাইনি। আমরা লেনিনের কাছে ফেরত যাব। তার আগে, যারা লেনিনকে নায়কের জায়গায় বসিয়ে ফেলেছে তাদের আরেকটি অপশন তৈরি করে দেই। এখন কাহিনীতে আসছে নতুন আরেক চরিত্র। ম্যাক্সিমভিচ গোর্কি। নতুন নায়ক আসা মানে আগের নায়কের সাথে ক্লেশ। ক্লেশটা ঠিক কতদুর পর্যন্ত গড়াবে?
আমাদের কোর্সগুলোতে ভর্তি হতে ক্লিক করুন:
- Communication Masterclass by Tahsan Khan
- Facebook Marketing Course by Ayman Sadik and Sadman Sadik
- ঘরে বসে Freelancing by Joyeta Banerjee
- ঘরে বসে Spoken English Course by Munzereen Shahid
- Microsoft Office 3 in 1 Bundle
- Microsoft Word Course by Sadman Sadik
- Microsoft Excel Premium Course
- Microsoft PowerPoint Course by Sadman Sadik
১০ মিনিট স্কুলের ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে ভিজিট করুন: www.10minuteschool.com
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন