মিয়ানমার – দেশটির নাম রোহিঙ্গা ইস্যুতে ব্যপক আলোচিত ও সমালোচিত বর্তমানে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ হলেও মিয়ানমার সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুবই কম। ২০১৭ সালে যখন লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমার থেকে জীবন বাজি রেখে আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশের কক্সবাজার উপকূলে পাড়ি জমায় তখন আমাদের সবার মনোযোগে আসে এই মিয়ানমার। মিয়ানমার আমাদের এত নিকটবর্তী দেশ হওয়া স্বত্বেও এ দেশের ভৌগলিক, রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে বিস্তর জানাশোনা নেই আমাদের। আর এজন্যই রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে কূটনৈতিক আলোচনায় বেগ পেতে হচ্ছে আমাদের।
মিয়ানমারের অর্থনীতি আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই দৃষ্টি দিতে হবে আপার বার্মা ও লোয়ার বার্মার দিকে। ‘আপার বার্মা’ ও ‘লোয়ার বার্মা’ এই শব্দগুলো মূলত বৃটিশদের থেকে প্রচলিত। মায়ানমারের দক্ষিণাঞ্চল মূলত লোয়ার বার্মা হিসেবে চিহ্নিত। বৃটিশরা দুই দফা যুদ্ধ করে এই অঞ্চলগুলোই প্রথম দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। ইরাবতী নদী সন্নিহিত নিচুভূমির এলাকা হওয়ায় এর নামকরণ লোয়ার বার্মা। এয়াওয়াদি, বাগো, রেঙ্গুন, রাখাইন, মন স্টেট ও তানিনতারি এলাকা এই লোয়ার বার্মার অন্তর্ভূক্ত। জাতিগত ভাবে লোয়ার বার্মার অধিবাসীরা হল মন, কারেন, রোহিঙ্গা ও রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ। সমুদ্র উপকূলীয় এসব অঞ্চল প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ভাবে রেঙ্গুন কেন্দ্রিক।
আরো পড়ুন: কফি আনান: জাতিসংঘকে যিনি দিয়েছেন নতুন রূপ
বর্তমান মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় অঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলই ‘আপার বার্মা’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। আপার বার্মা হল মান্দালে, সাগাইন রিজন, কাচিন ও শ্যান স্টেট কেন্দ্রিক। আপার বার্মার কাচিন ও শান স্টেইট এর কিছু অঞ্চল ‘ফ্রন্টিয়ার এলাকা’ নামে অভিহিত হয়। এই আপার বার্মা অঞ্চলের মূল অধিবাসী হল দেশটির প্রধান জাতিসত্তা বামার সম্প্রদায়ের মানুষ। আপার ও লোয়ার বার্মায় বিস্তর পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বার্মিজ ভাষার উচ্চারণেও আপার ও লোয়ার বার্মায় পার্থক্য দেখা যায়।
রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে দীর্ঘ দিন থেকে মিয়ানমারের আপার বার্মার বামার জাতিসত্তার আধিপত্য রয়েছে। যদিও অর্থনীতিতে বড় অবদান রেখে আসছে লোয়ার বার্মা। মিয়ানমারের মূল অর্থকরী ফসল ধানের ব্যপক ফলন হয় এই লোয়ার বার্মায়। আর এর উপরই অনেকাংশে নির্ভর করে মিয়ানমারের অর্থনীতি। ব্যপক ধানের ফলন হওয়ায় দেশটির খাদ্য নিরাপত্তায় লোয়ার বার্মার অবদান অসীম। ব্রিটিশ শাসনামলেই লোয়ার বার্মা এশিয়ার প্রধান ধান ভান্ডার হয়ে উঠে। এর পিছনে রয়েছে অবশ্য অন্য এক ইতিহাস। বৃটিশ রা প্রথম ও দ্বিতীয় দফা যুদ্ধে এই লোয়ার বার্মার দখল নেয় প্রথমে। এই লোয়ার বার্মাকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে বৃটিশ শাসকরা তদানীন্তন বাংলা থেকে বিশেষ কৃষিপ্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন দক্ষ লোকবল নিয়ে যায় লোয়ার বার্মায়। বৃটিশ সরকারের সহায়তায় ও এই দক্ষ লোকবলের ফলে মিয়ানমারে ধানের উৎপাদন বেড়ে যায় ব্যপক হারে।
বর্তমানে মিয়ানমারের বাৎসরিক চাল উৎপাদনের মাত্রা প্রায় ১৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন। বিপুল পরিমাণে উৎপাদিত চালের প্রায় ৬০ শতাংশ নিজ দেশের খাদ্য চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন হয়। বাকি ৪০ শতাংশ উৎপাদিত চাল মিয়ানমার বিশ্বের অন্যান্য দেশে রপ্তানি করে থাকে। বছরে প্রায় ৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল রপ্তানি করে দেশটি। বাংলাদেশ, চীন ও শ্রীলংকা বিপুল পরিমাণে চাল সংগ্রহ করে মিয়ানমার থেকে।
সরকারি চাকরি প্রস্তুতি বেসিক কোর্স
কোর্সটি করে যা শিখবেন:
মিয়ানমারের অর্থনীতি ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মোড় নিয়েছে বারবার। মিয়ানমারের স্বাধীনতার পর মিয়ানমারের অর্থনীতির স্বাভাবিক বিকাশ ব্যহত হয় তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক নীতি গ্রহণের কারণে। এর ফলে নে উইনের শাসনামলে মিয়ানমারের শিল্প ও ব্যাংক জাতীয়করণের শিকার হয়। ১৯৮৮ সালের পর থেকে দেশটির অর্থনীতি আবার স্বাভাবিক গতিধারায় ফিরতে শুরু করে। কিন্তু বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় সামরিক শাসন। ১৯৬২ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ধারায় চলে সামরিক শাসন। দশকের পর দশক ধরে চলা সামরিক শাসনের কারনে দেশটির প্রশাসন ও অর্থনীতিতে দুর্নীতি এক বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ২০১১ সালে সামরিক শাসনের বিলুপ্তির পর থেকে মিয়ানমার আবার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিমন্ডলে যুক্ত হয়ে পড়ে পুরোদমে।
মিয়ানমারের অর্থনিতির অন্যতম খাত হল খনিজ খাত। মিয়ানমারের অর্থনীতিতে জ্বালানী তেল খাতের বিশাল অবদান রয়েছে। মিয়ানমারের জ্বালানী তেল সম্পদের উপর নির্ভর করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার পুরনো তেল কোম্পানি ‘বার্মা অয়েল’। ১৮৫৩ সাল থেকে মিয়ানমার বহির্বিশ্বে অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করে আসছে। এর মাঝে নে উইনের শাসনামলে সমাজতান্ত্রিক নীতি গ্রহণের ফলে অন্যান্য খাতের ন্যায় জ্বালানী খাতও জাতীয়করণ হয়। ১৯৯১ সাল থেকে আবার বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানি তেল ও গ্যাস উত্তোলনের জন্য মিয়ানমারে আসতে শুরু করে।
বর্তমান এশিয়ার অন্যতম প্রধান গ্যাস উত্তোলনকারী দেশ হল মিয়ানমার। চীন ও থাইল্যান্ড তারা গ্যাস রপ্তানি করে। গ্যাসের জন্য চীন ও থাইল্যান্ড পুরোপুরি মিয়ানমারের উপর নির্ভরশীল। মিয়ানমারে ইতিমধ্যে ১০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুদের সন্ধান পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞদের ধারনা এই পরিমাণ আরো বাড়বে। ইতিমধ্যে সমুদ্র এলাকায় প্রায় অর্ধশত স্থানে তেল ও গ্যাসের অনুসন্ধান চলছে।
মিয়ানয়ারের অর্থনীতি অনেকাংশেই কৃষি ও খনিজ শিল্পের উপর নির্ভরশীল হলেও দেশটি বর্তমানে কৃষি ও খনিজের বাইরে পর্যটন ও পোশাক শিল্পের বিকাশ ঘটাতে চাইছে। ইয়াঙ্গুন ভিত্তিক পোশাক খাতের ইতিমধ্যে দুই বিলিয়ন ডলারের বাজার তৈরি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন হলো মিয়ানমারের পোশাক খাতের প্রধান বাজার। এর পরেই রয়েছে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। ২০২০ সাল নাগাদ এ খাতে ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের আশা করছে সরকার। পোশাক খাতের পাশাপাশি পর্যটন খাতেও বিকাশ ঘটাচ্ছে মিয়ানমার। পর্যটন খাত থেকে ১০ মিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে দেশটি। বর্তমানে ৪ মিলিয়ন দর্শক ও পর্যটকের আগমন ঘটে মিয়ানমারে। পর্যটক আগমনের এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ মিলিয়ন। ২০১৫ সালের নির্বাচনের পর থেকেই দেশটিতে উন্নত মানের হোটেল নির্মাণে ধুম পরে যায়।
এর ফলে কর্মসংস্থান ও সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেই সাথে শ্রমিকদের মজুরিও বেড়েছে। ২০১৮ সালে সরকার ১০ জনের বেশি কর্মী রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম দৈনিক মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে ৪ দশমিক ৬৮ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার মান প্রায় ৪০০ টাকা। বিভিন্ন জরিপে দেখা যায় মিয়ানমারে শ্রমিকদের মজুরি সন্তোষজনক হারে বেড়েছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত এক জরিপে দেখা যায়, দেশটিতে ২০০৯-২০১০ সালে মিয়ানমারে দারিদ্র্যের হার ৪২ ভাগ ছিল। কিন্তু পরবর্তী পাঁচ বছরে তা ৩২ শতাংশে নেমে আসে। মিয়ানমারের সাধারণ মানুষদের জীবনে এ অগ্রগতি দেখা গেলেও উল্টো চিত্রের দেখা মিলে আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গাদের জীবনে।
মিয়ানমারের তেল ও গ্যাসের সম্ভাব্য উত্তোলন ও বাজার সম্ভাবনা ইউরোপ আমেরিকার বড় বড় কোম্পানির নিকট মিয়ানমার বিনিয়োগের এক আকর্ষণীয় এক ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও পর্যটন খাত বিকাশেও বিদেশি বিনিয়োগের দেখা মিলে। ২০১২-১৩ সালে দেশটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১৪২ কোটি ডলার। ২০১৬-১৭ সালে তা এসে দাঁড়ায় প্রায় ৬৬৫ কোটি ডলারে। যেখানে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে বিনিয়োগ ছিল মাত্র ২৪৫ কোটি ডলার। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সশস্ত্র আন্দোলন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন মাত্রা ছাড়িয়ে গেলেও বিদেশিরা ব্যবসায়িক লাভের আশায় মিয়ানমারে ব্যপক আকারে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। এক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে এগিয়ে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম।
এছাড়াও চীন মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক বিনিয়োগকারী। দেশটির প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব ও চীনের সাথে। আরাকান রাজ্যে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে চীন ছিল মুখ্য বিনিয়োগকারী। এই বন্দরে চীনকে ৭০ ভাগ মালিকানা দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। এছাড়াও আরাকান থেকে চীনের ইউনান পর্যন্ত ২৩৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করছে চীন। মিয়ানমারের এরকম বিভিন্ন বৃহৎ প্রজেক্টে যুক্ত আছে চীন। স্থলবেষ্টিত চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ইউনান থেকে বঙ্গোপসাগর মুখী সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার জন্যও মিয়ানমার কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। চীন ও মিয়ানমারের সাথে ব্যবসায়িক বিনিয়োগে লাভবান হচ্ছে। ভারত মহাসাগরে সরাসরি যোগাযোগের ক্ষেত্রে চীনের জন্য পাকিস্তানের পরই মিয়ানমার গুরুত্ব পাচ্ছে। এছাড়াও চীন গ্যাসের জন্য পুরোপুরি মিয়ানমারের উপর নির্ভরশীল। আর এ কারনেই চীনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন থাকায় আঞ্চলিক রাজনীতিতে মিয়ানমার বেশ সুবিধা পেয়ে আসছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও চীন মিয়ানমার কেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণে মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে বাংলাদেশ ব্যতীত মিয়ানমারের নিকট প্রতিবেশী কোন দেশই গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না। বরং মানবাধিকার পরিস্থিতেকে উপেক্ষা করেই অনেক দেশ মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করে যাচ্ছে। আর এসবের উপরই নির্ভর করছে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে অসহায় ও বঞ্চিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যত।
আমাদের কোর্সগুলোতে ভর্তি হতে ক্লিক করুন:
- Communication Masterclass by Tahsan Khan
- Facebook Marketing Course by Ayman Sadik and Sadman Sadik
- ঘরে বসে Freelancing by Joyeta Banerjee
- ঘরে বসে Spoken English Course by Munzereen Shahid
- Microsoft Office 3 in 1 Bundle
- Microsoft Word Course by Sadman Sadik
- Microsoft Excel Premium Course
- Microsoft PowerPoint Course by Sadman Sadik
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
১০ মিনিট স্কুলের ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে সরাসরি চলে যেতে পারেন এই লিঙ্কে: www.10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন