নীল পাড়ের সাদা সুতি শাড়ি, রুক্ষ চামড়া ও মায়াবী এক চেহারা- শুধু এতটুকু বললে যে মানুষটির ছবি চট করে মাথায় চলে আসে, তার নাম মাদার তেরেসা। মহীয়সী এই নারী পৃথিবীতে মানবতার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি ছিলেন একজন ক্যাথলিক ধর্মপ্রচারক, যিনি সারাজীবন নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন মানবতার দোরগোড়ায়।
নানা সময় ছুটেছেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে, কোলে তুলে নিয়েছেন পীড়ন-নিপীড়নে থাকা হাজারো শিশুদের, সেবা করেছেন অনেক অবহেলিতদের। পৃথিবীতে তাঁর অবদান কখনোই বলে শেষ করা সম্ভব নয়। মাদার তেরেসা জগতজুড়ে অনেক খ্যাতি পেয়েছেন নিজের কষ্টসাধ্য চেষ্টার কারণে, তবে পথটা এতটাও মসৃণ ছিল না যতটা না শুনতে মনে হচ্ছে। অসহায়দের নিয়ে চলাফেরার সাথে সাথে তাঁর নিজের মধ্যেও অনেক উপলব্ধি এসেছিলো যা মাদার তেরেসার নানা উক্তির মাধ্যমেই প্রকাশ পেয়েছে। এসব উক্তি যতটা শ্রুতিমধুর, ঠিক ততটাই অনুপ্রেরণামূলক।
মাদার তেরেসার ১০টি অনুপ্রেরণামূলক উক্তি:
১. পিতৃবিয়োগের পর সময়টা অনেক কঠিন ছিল মাদার তেরেসার জন্য। তাঁর মা তাঁকে রোমান ক্যাথলিক আদর্শে অনেক কষ্টে বড় করেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই তিনি ধর্মীয় জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন এবং যোগদান করেন সিস্টার্স অব লরেটো নামক এক মিশনারি সংস্থায়। ১৯৪৬ সালে ধর্মীয় কাজে ভারতের দার্জিলিং যাত্রাপথে তাঁর মধ্যে এক গভীর উপলব্ধি আসে যাকে পরবর্তীতে তিনি “কল উইদিন দ্যা কল (Call within the call)” হিসেবে আখ্যা দেন। এসময়ই তাঁর মধ্যে দরিদ্রের মাঝে বেঁচে থাকার যে আকাঙ্ক্ষা, সেটির পরিস্ফুটন ঘটে। তাঁর মতে সর্বদা দুস্থ অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আমাদের প্রতি আদেশ এবং এই আদেশ অমান্য করা মূলত ধর্মবিশ্বাসের অবমাননা করা। তিনি বলেন,
“বাইরের জগতে এখনি বেড়িয়ে পড়ো এবং ভালোবাসো প্রত্যেকটি মানুষকে। তোমার উপস্থিতি যেন হাজারো মানব হৃদয়ে নতুন আলোর সঞ্চার জাগায়।“
২. আমি একটি ব্যাক্তিগত গল্প বলবো এখন। সময়টা ছিল ২০১৩ কিংবা ২০১৪ এর একটা সময়। আমি ক্লাস নাইনে পড়তাম তখন, বনশ্রীর আইডিয়াল স্কুল অ্যাণ্ড কলেজে। সে সময়ে আমার স্কুলের কিছু ক্লাসমেট নিজ উদ্যোগে একটা সামাজিক সংঘ খুলেছিলো, নাম আলোড়ন, যার মূল কাজই হচ্ছে বনশ্রীর রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো হাজারো পথশিশু, ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধীসহ আরো অনেক মানুষকে কোনো না কোনোভাবে সাহায্য করা।
সাহায্যের তহবিলের জন্য ওরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় রোড ক্যাম্পিং করে টাকা উঠাতো। আমার অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল আলোড়নে যোগ দেয়ার। একবার আমার খুব কাছের এক বন্ধুকে আলোড়নের এসব উদ্যোগের কথা বলতেই সে আমাকে বলেছিলো “শুন, এভাবে মাত্র একজন-দুইজন মানুষকে সাহায্য করে কী লাভ বল? দেশে যে হাজারো মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে, তার কী হবে? একজন মানুষকে সামান্য একটা জামা কিনে না দিয়ে বরং বৃহত্তর উদ্যোগে কিছু করা উচিত।” আমাদের সমাজে এরকম অনেক ঘটনাই দেখতে পাওয়া যায়। এইরকম ঘটনাগুলোকে ইঙ্গিত করে মাদার তেরেসা বলেছিলেন,
“যদি তুমি একশো মানুষকে সাহায্য করতে সক্ষম না হও, তাহলে অন্তত একজনকে সাহায্য করো।“
৩. ১৯৪৮ সালে মাদার তেরেসা গরীব ও সাহায্যের আশায় থাকা মানুষদের নিয়ে নিজের মিশনারি কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি নিজ উদ্যোগে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন কলকাতার মতিঝিল এলাকায়। এত বড় একটা উদ্যোগ নেয়ার পূর্বে তিনি কারোর জন্য অপেক্ষা করেননি। তাঁর মনে হয়েছে যে উদ্যোগ কারোর না কারোর তো ঠিকই নিতে হবে। কারোর আদেশ-উপদেশের বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে নিজ প্রচেষ্টাতেই সকল কাজ শুরু করার জন্য মাদার তেরেসার জীবনী ছিল অন্যতম দৃষ্টান্ত।
“কারোর নেতৃত্বের অপেক্ষা না করে নিজ থেকেই সকল উদ্যোগ নেয়া উচিত।“
আরো পড়ুন: অস্কার ওয়াইল্ডের যে ৭টি উক্তি আপনার জীবনবোধ বদলে দিতে পারে
৪. শুরুর দিকে বিদ্যালয় পরিচালনা করার কাজটা তাঁর একার পক্ষে অনেক কঠিন ছিলো। ধর্মপালন থেকে শুরু করে মানবসেবা, সত্যিই একটা সময় তাঁর মাথার ওপর পাহাড়সম দায়িত্বের বোঝা চলে আসে। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। ধীরে ধীরে তাঁর এই মহৎ উদ্যোগে হাজারো মানুষ যুক্ত হতে শুরু করে। দ্রুতই এই খবর ভারতীয় সরকারের নজরে আসে। ভারতীয় সরকারের তখনকার প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং জহরলাল নেহেরুও মাদার তেরেসার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। মাদার তেরেসা মনে করতেন,
“আমি একা এই পৃথিবীকে বদলে দিতে পারবোনা। তবে আমি স্বচ্ছ জলে একটি ছোট পাথরের টুকরো নিক্ষেপ করে বড় বড় জলতরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারবো।“
৫. মাদার তেরেসার জীবনী থেকে জানা যায় যে, তিনি জন্ম থেকেই ছিলেন প্রচণ্ড প্রভুভক্ত। তিনি দিনের বড় একটা সময় প্রার্থনায় মগ্ন থাকতেন, বাকি সময় মানবসেবায়। তিনি মানবসেবাকে ধর্মপালনের একটি মহৎ অংশ হিসেবেই সর্বদা গণ্য করতেন। তাঁর দর্শন ছিল,
কোর্সটি করে যা শিখবেন:
Communication Masterclass by Tahsan Khan
“সৃষ্টিকর্তা তোমাদের সফল হওয়ার আদেশ দেননি, শুধুমাত্র সর্বদা অবিরাম চেষ্টা ধরে রাখার আহ্বান করেছেন।“
তিনি তাঁর কাজকে সবসময় শ্রদ্ধা করতেন এবং একই সাথে ভরসা রাখতেন সৃষ্টিকর্তার উপর। তিনি জানতেন, কঠিন সাধনা করলে ঈশ্বর অবশ্যই একদিন মুখ তুলে তাকাবেন।
৬.
মাদার তেরেসা যে সারাজীবন নিজের অবদানের জন্য মানুষের প্রশংসা পেয়েছেন, তা কিন্তু নয়। জীবনের নানা পর্যায়ে তিনি মানুষের সমালোচনার শিকার হয়েছেন। সমালোচিত হয়েছেন ধর্মযাজকের নির্দিষ্ট পোশাক ত্যাগ করে সাদা শাড়ি তুলে নেয়ার সময়, সমালোচিত হয়েছেন গর্ভপাত নিয়ে সমালোচনা করায়। এমনকি অনেকে তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়েও সমালোচনা করতে দেরি করেনি। কিন্তু এসব কথার তীর মাদার তেরেসাকে নিজের কর্মজীবন ও মানবসেবা থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। এমনকি তিনি এসব মানুষকে কখনো এসব কথার জের ধরে বিচার করেননি। তাঁর জীবনী থেকে পাওয়া একটি অনুপ্রেরণামূলক উক্তি হলো,
“মানুষকে বিচার করে সময় নষ্ট করলে কখনোই তাদেরকে ভালবাসার সময় পাওয়া যাবে না।”
এমনকি যেসব মানুষ মাদার তেরেসার কাজের সমালোচনা করতো, মাদার তেরেসা ঠিক সেসব মানুষকেই পরবর্তীতে মানবতার ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য অনুরোধ করতেন।
৭. আমি একটা জিনিস খেয়াল করে দেখলাম। সেটা হলো, এই ব্লগটি লেখার সময় আমি কিছুক্ষণ গুগলের এদিক-সেদিক ঘুরাফেরা করলাম, কিছু তথ্য সংগ্রহ করলাম, কিছু ছবি বের করলাম। হঠাৎ করে চোখে ধরা পড়লো যে, মাদার তেরেসার বেশিরভাগ ছবিতেই তাঁর হাস্যজ্জল একটা চেহারা ভেসে উঠছে। মাদার তেরেসা খুব গম্ভীর হয়ে বসে আছেন, এমন ছবি খুব কম আছে বলেই ধরে নিচ্ছি। আসলে মাদার তেরেসা নিজেও খুব হাসিখুশি একজন মানুষ ছিলেন। তিনি মানবসেবার কাজের মধ্যেই তাঁর সবটুকু সুখ খুঁজে পেতেন। তিনি জানতেন, একজন অসহায় হতদরিদ্রের কাছে সামান্য হাসির মূল্য কতটুকু। তাঁর একটি মহৎ উক্তি হলো,
“প্রত্যেকের প্রতি ভালবাসার শুরুটা হোক হাসির মাধ্যমে। “
৮. ১৯৯৬ সালে পৃথিবীর শতাধিক দেশে সর্বমোট ৫০০টিরও বেশি মিশনারি পরিচালনা করেছিলেন মাদার তেরেসা। মাত্র ১২ জন সদস্য নিয়ে যে চ্যারিটির যাত্রা শুরু হয়েছিলো, সময়ের ব্যবধানে সেই সংখ্যাটি কয়েক হাজারে পৌঁছায়। তারা সবাই পৃথিবীর নানা প্রান্তে মানবসেবা অব্যাহত রেখেছিলেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন। গরীবদের মাঝেও যারা গরীব, তাদের জন্য কাজ করতো এই চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান। যেই শুরুটা হয়েছিল ক্ষুদ্র আকারে, আজ তা পৃথিবীব্যাপ্ত আকার ধারণ করেছে।
“আমরা সকলেই শুরুতেই বিশাল কোনো মহৎ কাজ করতে পারবো না। কিন্তু ভালবাসা দিয়ে ছোট ছোট অনেক ভাল কাজ করা সম্ভব।“
একসময়ের সেই ক্ষুদ্র মানবসেবা প্রতিষ্ঠান আজ মাদার তেরেসা অর্গানাইজেশন এ রূপ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে অবস্থিত রয়েছে বিখ্যাত মাদার তেরেসা সেন্টার।
৯. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ– ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫, এই পাঁচ বছরব্যাপী চলমান এই যুদ্ধ পুরো পৃথিবীর মানচিত্রকে যেন ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলে। জার্মান হিটলার বাহিনীর হাত ধরে শুরু হওয়া এই যুদ্ধে লক্ষাধিক মানুষ অচিরেই প্রাণ হারায়, আহতদের সংখ্যাটা অজানা থাকাই শ্রেয়। চারদিক তছনছ করে দেয়া এই যুদ্ধকালীন সময়ে পৃথিবীবাসী যেন ভুলে গিয়েছিল শান্তির প্রকৃত শব্দার্থ। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন নেতারা কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন পৃথিবীতে পুনরায় শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে।
এসময় এই পুরো ব্যাপারটা স্বয়ং মাদার তেরেসাকেও উদ্বিগ্ন করে তুলেছিলো। পৃথিবীতে এত ধ্বংসযজ্ঞ, মানুষের আর্তনাদ তাঁর মনকে ব্যথিত করে তোলে। তিনি মানুষের কাছে গিয়ে শুনেছেন যুদ্ধের সেই ভয়াবহতা। তিনি মনে করতেন, অস্ত্র দিয়ে কখনোই শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। শান্তি ফিরিয়ে আনতে সবচেয়ে বেশি দরকার যেটি, সেটি হচ্ছে মানবতা।
“অস্ত্র দিয়ে কখনোই শান্তিকে ঘরে আনা সম্ভব নয়, সম্ভব ভালবাসা ও সহানুভূতির হাত ধরে।“
১০.
“সবচেয়ে ভয়াবহ দারিদ্রতা হচ্ছে একাকীত্ব এবং প্রিয়জনের সহানুভূতি না পাওয়ার অনুভূতি।“
বর্তমান সময় কিশোর-কিশোরিদের মধ্যে আলোচিত একটি বিষয় হলো ডিপ্রেশন। ভয়াবহ এই ব্যাধির অন্যতম কারণ হচ্ছে একাকীত্ব। একজন মানুষের জীবনে একাকীত্ব যে কতটা বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, তা কল্পনাতীত। মাদার তেরেসার জীবনেও এমন অনেক সময় এসেছে, যখন তিনি একাকীত্বে ভুগেছেন। অল্প বয়সেই পরিবার ছেড়ে এসে মিশনারিতে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্তের কারণে তিনি বাকি জীবন পরিবারকে কাছে পাননি।
এমনকি ১৯২৮ সালে ১৮ বছর বয়সে গৃহত্যাগের পর তিনি তাঁর মায়ের চেহারা আর কখনো দেখতে পাননি। তিনি কখনো কখনো অনেক ভেঙ্গে পড়তেন একাকীত্বের জন্য। ঘরে ফেরার জন্য তাঁর মন সবসময় আনচান করতো, কিন্তু দায়িত্বের টানে কখনোই তা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি।
মাদার তেরেসার জীবনী আমাদেরকে অনেক কিছু শিখিয়েছে, অনেক অনুপ্রেরণারও জোগান দেয় তাঁর অসাধারণ জীবন। কিভাবে মানুষকে সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে আত্মতুষ্টি পাওয়া যায়, তারই নিদর্শন নীল পাড়ের শাড়ি পরিহিত হাস্যোজ্জ্বল ঐ মহীয়সী নারী। তাই বোধহয় মাদার তেরেসার প্রতিটি বাণীই যেন জয়গান গায় মানবতার, জয় হয় মানুষের।
তথ্য কৃতজ্ঞতা:
https://www.brainyquote.com/authors/mother_teresa
আমাদের কোর্সগুলোতে ভর্তি হতে ক্লিক করুন:
- Communication Masterclass by Tahsan Khan
- Facebook Marketing Course by Ayman Sadik and Sadman Sadik
- ঘরে বসে Spoken English Course by Munzereen Shahid
- Microsoft Office 3 in 1 Bundle
- English Grammar Crash Course by Sakib Bin Rashid
- ঘরে বসে Freelancing by Joyeta Banerjee
১০ মিনিট স্কুলের ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে সরাসরি চলে যেতে পারেন এই লিঙ্কে: www.10minuteschool.com
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন