কোরিয়ান ড্রামা দেখে কোরিয়ান ভাষা শিখে প্রায়ই আশেপাশের সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয় শুচি। কিন্তু কোরিয়ান পড়তে গেলেই তার বারোটা বেজে যায়!
একবার হলো কী, শুচির প্রিয় গায়ক লাইভে এসে ভক্তদের সাথে কথা বলছে। এখন গায়ক ইংরেজি পড়তে পারে না, আর শুচি কোরিয়ান ভাষায় কমেন্ট করতে পারে না। অগত্যা কী আর করার, গুগল ট্রান্সলেটরই শেষ ভরসা। কিন্তু ট্রান্সলেট করে দেখা গেল সে যা বলতে চেয়েছে, ট্রান্সলেটর তার উল্টো অর্থ বের করেছে! ভাষা নাহয় শুনে শুনে শেখা যায়, বর্ণ চিনবো কী করে?
বিদেশে পড়তে গেলে কিংবা চাকরির ক্ষেত্রে মাতৃভাষা ও ইংরেজির পাশাপাশি আরো একটি ভাষায় দখল থাকা খুব জরুরি৷ বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা ভাষার মধ্যে শীর্ষে আছে ইংরেজি, তারপরেই আছে মান্দারিন, হিন্দি, স্প্যানিশ, ফরাসি ও আরবি।
নতুন কোনো ভাষা শেখার সময় বোঝার সুবিধার্থে রোমান হরফে লিখলেও পরবর্তীতে সেই ভাষায় কিছু লিখতে বা পড়তে গেলে বেশ বিপাকে পড়তে হয়। অনেক সময় দেখা যায় পড়তে না পারার কারণে অনেক সাইনবোর্ডের মানে বোঝা যায় না, কোনো নোটিশ ট্রান্সলেট না করে দিলে সেটাও বুঝতে অসুবিধা হয়। তাই কথা বলতে পারার পাশাপাশি পড়তে পারাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ৷
বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ নন-ল্যাটিন ভাষায় কথা বলে ও লেখে যেমন: চাইনিজ, জাপানিজ, কোরিয়ান, আরবি, তুর্কি ইত্যাদি। নন-ল্যাটিন বর্ণ বা ভাষা শেখা একটু মুশকিল। কারণ তাদের বর্ণমালা সম্পূর্ণ ভিন্ন৷ তাই বলে অসম্ভব না। আপনি যদি নিজের ফোকাস ঠিক রেখে একবার শুরু করতে পারেন, তাহলে খুব দ্রুতই তা রপ্ত করতে পারবেন
অল্প করে শিখুন:
আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন যে বাচ্চারা কেন যেকোনো নতুন ভাষা প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় বেশি আগে আয়ত্তে আনতে পারে? এর মূল কারণ হলো বাচ্চাদের মস্তিষ্কের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স বড়দের তুলনায় অনেক পরিপক্ক হয় এবং একসাথে অনেক তথ্য ধারণ করতে পারে।
আমাদের অন্যতম একটা বদঅভ্যাস হলো আমরা যেকোনো কিছুই খুব তাড়াতাড়ি শিখতে চাই। তাড়াতাড়ি শিখতে যেয়ে আমরা আগের শেখা জিনিসগুলো ভুলে যাই, এতে লাভের বদলে লোকসানের পরিমাণটাই বেশি৷
ধরা যাক আপনি কোরিয়ান বা হাঙ্গুল শিখবেন। হাঙ্গুলে মোট বর্ণ আছে ২৪টি। এরমধ্যে ১০টা স্বরবর্ণ ও ১৪টা ব্যঞ্জনবর্ণ। একদিনেই পুরো চার্ট মুখস্থ না করে প্রতিদিন ৬টা করে বর্ণ পড়া ও লেখা শিখুন। যতদিন না আপনি একটা ভাগে পুরোপুরি দখল আনতে পারছেন, ততদিন নতুন বর্ণ শিখবেন না। আর আয়ত্তে চলে আসলেও বারবার অনুশীলন করতে থাকবেন।
নেমোনিক ব্যবহার করুন:
এই পদ্ধতিতে একটা নির্দিষ্ট বর্ণকে কেন্দ্র করে এমন একধরনের গল্প বা ঘটনা বানানো হয়, যাতে সেই গল্প থেকে বর্ণের উচ্চারণ মনে পড়ে।
জাপানিজ বর্ণ あ (আ) দেখলে মনে হবে একটা মাছের মধ্যে ছুরি বা বর্শা গেঁথে দেওয়া। ক্ষুধার্ত আপনি এই মাছ ধরতে পেরে তৃপ্তি নিয়ে বললেন, “আহ! কী দারুণ এক মাছ ধরলাম!” বাস্তবে আপনার বর্শায় মাছ গাঁথুক বা না গাঁথুক, এই গল্পের মাধ্যমে সবসময়ই মনে থাকবে যে あ এর উচ্চারণ ”আ”।
নেমোনিকের মাধ্যমে বর্ণ শিখতে একটু সময় লাগলেও এর ফলাফল আজীবন থাকবে। ধীরে ধীরে এই গল্পগুলো ছাড়াই আপনি পড়া শিখে যাবেন।
কোর্সটি করে যা শিখবেন:
ঘরে বসে Spoken English
ফ্ল্যাশকার্ড তৈরি:
নতুন কিছু শেখার জন্য ফ্ল্যাশকার্ড খুবই দারুণ এক কৌশল। ছোট ছোট অনুশীলনগুলো আপনার ভাষা দক্ষতা দ্রুত ও অনেকাংশে বাড়িয়ে তুলবে।
ফ্ল্যাশকার্ড হাতে নিয়ে জ্যামে বসে, লাইনে দাঁড়িয়ে, ঘুমানোর আগে ৫ মিনিট বসে- যেকোনো অবস্থায় পড়তে পারবেন।
একেক রঙের ফ্ল্যাশকার্ডে একেক গ্রুপের বর্ণ লিখে রাখুন। সেটা হতে পারে বর্ণানুক্রমে বা স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ আলাদা করে৷ বর্ণের পাশাপাশি উচ্চারণও লিখে রাখুন, আর কার্ডের পেছনের অংশে সেই বর্ণ দিয়ে গঠিত শব্দ লিখুন। ফ্ল্যাশকার্ড বেশি হিজিবিজি করার দরকার নেই, প্রতি কার্ডে ৪টা করে বর্ণই যথেষ্ট।
শব্দভাণ্ডার বাড়ানোর জন্য হাতে করা ফ্ল্যাশকার্ড বা ডিজিটাল ফ্ল্যাশকার্ড- দুটোই দারুণ ভূমিকা পালন করে। হাতে বানাতে হলে যেকোনো শক্ত কাগজ আর ডিজিটালি চাইলে মাইক্রোসফট ওয়ার্ড বা এক্সেল ব্যবহার করে ফ্ল্যাশকার্ড বানাতে পারেন। এছাড়াও Brainscape অ্যাপের মাধ্যমে ফ্ল্যাশ কার্ডের রিপিটেশন টাইমিংটা সেট করে দেওয়া যায়- অর্থাৎ কতক্ষণ পর পর আপনাকে রিভিশন দিতে হবে, সেটা নির্দিষ্ট করে দিতে পারবেন।
রোমান হরফকে না বলুন:
জানি রোমান হরফে কোনো ভাষা খুব দ্রুত বলতে শেখা যায়, কিন্তু বর্ণ শিখতে ঠিক ততটাই কষ্ট করতে হয়৷ শুরুতে খাপ খাইয়ে না নিতে পারাটা খুব স্বাভাবিক, কিন্তু ছোট এবং ধীর-স্থির পদক্ষেপ ও নিয়মিত অনুশীলন করলে এই বাধা আর পাহাড়সম মনে হবে না।
আমরা রোমান হরফ ব্যবহার করতে চাই কারণ এটা ব্যবহার করলে শব্দটা ইংরেজির মতনই শোনায়৷ যেমন: Annyeonghaseyo বা 안녕하세요। ‘Annyeonghaseyo’ শব্দটা উচ্চারণ করা সহজ যেহেতু এটা রোমান হরফে লেখা। কিন্তু এটা লেখা হয়েছে আপনার বোঝার সুবিধার্থে, সব জায়গায় এভাবে লেখা থাকে না৷
আলফাবেট সং:
ইংরেজিতে এবিসিডি গানটা আপনার এখনো মনে আছে নিশ্চয়ই? বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, বিভিন্ন ভাষার আলফাবেট সং কিন্তু বেশ কাজের। কারণ কোনোকিছুতে যখন সঙ্গীতের আবহযুক্ত করা হয়, তখন সেই জিনিসটা গানের তালে তালে আমাদের বেশি মনে থাকে। বর্ণমালার এই গানগুলোর কারাওকেও আছে। তাই গানের পাশাপাশি পড়ালেখাও চলবে! ইউটিউবেই এমন অসংখ্য গানের ভিডিও পাবেন।
শব্দ করে পড়ুন:
মনে মনে পড়ার চেয়ে জোরে উচ্চারণ করে পড়লে মনে থাকে বেশি। ৭৫ জন শিক্ষার্থীর উপর চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে ১৬০টি শব্দ জোরে পড়ার পর ৭৭ শতাংশ ছাত্ররাই সেই শব্দগুলো মনে রাখতে পেরেছে।
বর্ণ তো শেখা হয়ে গেল। এবার সেই বিদ্যা কাজের লাগানো দরকার, নাহলে ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা ১০০ শতাংশ! তাই বর্ণমালা চেনা হয়ে গেলে তা দিয়ে শব্দ ও বাক্যগঠন করুন। এই ক্ষেত্রে যা যা করতে পারেন:
ফ্রি হ্যান্ড রাইটিং:
ফ্রি হ্যান্ড রাইটিং ভাষা শিক্ষায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেই ভাষা শিখছেন, প্রতিদিন ৫-৩০ মিনিট সে ভাষার যেকোনো বিষয়ের উপর কিছু লিখুন। বুঝে বুঝে প্রচুর অনুশীলন করুন। প্রথম দিকে সহজ টপিক নিয়ে লিখবেন। আস্তে আস্তে কঠিনের দিকে যাবেন। দরকার হলে সামনে বাংলা বা ইংরেজি ভাষার কোনো বইয়ের পাতা খুলে সেই পাতাটা আপনার শেখা ভাষায় অনুবাদ করুন। আর অনুবাদ শতভাগ মিলতে হবে, এমন কোনো কথা নেই।
নিজের পছন্দমতো একটা শব্দ নিন। এবার সেই শব্দের প্রতিটা বর্ণ দিয়ে একেকটা শব্দ তৈরি করুন। এভাবে করতেই থাকুন৷ এতে করে আপনার ভোকাবুলারিও ঝালাই করে নেওয়া যাবে।
টাইপিং:
বিদেশি ভাষা লেখা শেখার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে টাইপিং৷ যেকোনো কিবোর্ডেই পৃথিবীর সব ভাষা লেখার প্রোগ্রাম সেট করা আছে।
বর্ণ শেখা হলো, লেখাও হলো৷ এবার আসে পড়ার পালা।
যে ধরনের বই পড়বেন:
ছোট এবং সাধারণ বই। শিশুতোষ বই দিয়ে পড়া শুরু করুন। যদি পুরো বই পড়তে অসুবিধা হয়, তাহলে ছোটগল্প বা কোনো ব্লগ পড়তে পারেন। শুরুতেই বড় বই ধরলে অনেক শব্দ ও বাক্যের অর্থ না বুঝতে পেরে হাল ছেড়ে দিতে পারেন। আবার বই পড়াটাকে তখন বাড়ির কাজ বলেও মনে হতে পারে। উপন্যাস না পড়ে কমিকও পড়তে পারেন।
ডিকশনারিকে না বলুন:
কোনো বই পড়ার সময় শুরুতেই ডিকশনারি খুঁজবেন না। আগে এক পাতা পড়ে দেখুন নিজ থেকে কতটুকু বুঝতে পারছেন। একটা অধ্যায় পড়া শেষে সেই অংশের সারমর্ম লিখুন। পরেরবার ওই অধ্যায় পড়া শেষে ডিকশনারি মিলিয়ে দেখুন আপনার বের করা মূলভাবের সাথে বইয়ের আসল কাহিনীর কতটুকু মিল আছে। অজানা শব্দগুলোর নিচে দাগ দিন এবং বইয়ের মধ্যে কিংবা চারপাশে স্টিকি নোট দিয়ের সে শব্দগুলোর অর্থ লিখে রাখুন। এই সুবিধা আপনি যেকোনো ইবুক রিডারেও পপ-আপ ডিকশনারি হিসেবে পাবেন।
তাই বলে সব অজানা শব্দ অনুবাদ করবেন না। আগে শব্দের অর্থ অনুমান করার চেষ্টা করুন। এই কাজ যদি আপনি সবসময় করতে থাকেন, তাহলে একটা সময় আপনি বাক্য দেখেই শব্দের অর্থ বুঝতে পারবেন। তাছাড়া বারবার খোঁজাখুঁজির কাজ আপনার সময়ও নষ্ট করবে।
অডিও বুক:
কোনো বিদেশি ভাষার বইয়ের অডিও ভার্সন শোনার মাধ্যমে আপনাত ওই ভাষা শোনার দক্ষতা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। পাশাপাশি ওই ভাষার উচ্চারণশৈলী এবং শব্দভান্ডারের ওপরেও একটা দখল চলে আসে। নিজের সামনে যেই বইয়ের হার্ডকপি বা সফটকপি খুলে বসেছেন, তার বিদেশি ভাষার অডিও বুক নামিয়ে পড়া অনুশীলন করুন৷
বাইলিঙ্গুয়াল ই-বুক:
এই বইগুলোর সুবিধা হচ্ছে এক প্যারা বিদেশি ভাষায় লেখা, আবার ওই অংশটুকুই আরেক প্যারায় নেটিভ ভাষায় লেখা। ইবুক রিডার বা ফোনে এই সুবিধাটা কাজে লাগাতে পারেন।
সাবটাইটেল:
আগে তো সাবটাইটেল নিজের ভাষায় বা ইংরেজি ভাষায় সেট করতেন, এবার যেই ভাষা শিখছেন সেই ভাষায় সেট করে দেখুন না। বিদেশি ভাষা পড়ার সেরা একটা উপায় এইটা৷
তথ্যসূত্র:
https://www.we-heart.com/2020/12/28/how-to-read-books-in-a-foreign-language/
https://blog.pimsleur.com/2020/02/20/tips-for-learning-a-new-alphabet/
আপনার কমেন্ট লিখুন