পুরোটা পড়ার সময় নেই ? ব্লগটি একবার শুনে নাও !
(এক হ্যারি পটারের বদৌলতে বিশ্বজুড়ে পরম সমাদৃত লেখিকা জে কে রাওলিং। শূন্য থেকে শুরু করে সাফল্যের শিখরে পৌঁছানোর অনবদ্য একটি গল্প রয়েছে তাঁর জীবনে। ২০০৮ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এক আত্মস্মৃতিচারণায় সেই গল্পটি তুলে ধরেন তিনি বিশ্ববাসীর সামনে। সংক্ষেপিত আকারে তাঁর সেই ভাষণটি উপস্থাপিত হয়েছে এখানে।)
স্বাগতম সবাইকে! আমি অত্যন্ত গর্বিত অনুভব করছি তোমাদের উদ্দেশ্যে কথা বলার সুযোগ পেয়ে। তোমাদের সামনে কী বলা উচিত সেটি নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি, তোমাদের জায়গাটিতে বসে আমি নিজে কী শুনতে চাইতাম তা জিজ্ঞেস করেছি নিজেকে। আমার কী মনে হয়েছে জানো? আমার সমাবর্তনের পর একুশটি বছর কেটে গেছে, এতগুলো বছরে জীবন আমাকে কী শিক্ষা দিয়েছে সেগুলো তোমাদের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন।
আজকের এই চমৎকার ঝলমলে দিনটিতে আমি তোমাদের সামনে যে জিনিসটি নিয়ে কথা বলবো তা হচ্ছে- হেরে যাওয়া মানে শেষ হয়ে যাওয়া নয়।
আমি যখন পেছন ফিরে তাকাই, একুশ বছর আগে সমাবর্তনের সেই তরুণী আমি আর এখনকার এই পরিণত আমি-র মাঝে কত পার্থক্য! সেই তরুণ বয়সটি ছিল দারুণ অনিশ্চিত- আমার একান্ত আপন ইচ্ছাঘুড়ি এবং কাছের মানুষদের প্রত্যাশার মাঝের ব্যবধানটি ছিল পাহাড়সম।
জীবনজুড়ে আমার কেবল একটিই স্বপ্ন ছিল, আমি সবসময় কেবল একটি কাজই করতে চেয়েছি- সেটি হচ্ছে উপন্যাস লেখা। যথারীতি আমার বাবা-মা’র এই ব্যাপারে কোন সমর্থন ছিল না! বাবা-মা দুজনেই উঠে এসেছেন অসচ্ছল পরিবার থেকে, কলেজ পর্যন্ত পড়ালেখাও করেননি দুজনের কেউ। আমার এই স্বপ্নটি তাদের কাছে ছিল একদম ছেলেমানুষি একটি ব্যাপার। এটি করে আমি কখনো টাকা-পয়সা আয় করতে পারবো সেটি তারা কোনদিন কল্পনাও করতে পারেননি!
তাই তাঁরা আমাকে বাধ্য করলেন একটি ডিগ্রি অর্জন করতে। আমার ইচ্ছা ছিল ইংরেজি নিয়ে পড়ার, কিন্তু সেটিতে তাঁদের সমর্থন ছিল না। তাই আমি ভর্তি হলাম আধুনিক ভাষা বিভাগে, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়া হতে তাঁদের গাড়ি চোখের আড়াল হতে না হতেই আমি ছুটলাম ক্লাসিকস বিভাগের করিডোরে!
আমার মনে পড়েনা বাবা-মা কে কখনো জানিয়েছি আমার এই কাণ্ডের কথা, খুব সম্ভবত আমার সমাবর্তনেই তাঁরা প্রথম আবিষ্কার করেছেন আমি এতদিন ক্লাসিকস নিয়ে পড়েছি!
আমি খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই একটি কথা- আমি কোনদিন আমার বাবা-মাকে তাঁদের এমন চিন্তা চেতনার জন্য দায়ী করিনি। সত্যি বলতে কি, খাবারের যেমন একটি মেয়াদোত্তীর্ণ দিন থাকে, তোমার জীবনের সিদ্ধান্তগুলোর জন্য বাবা-মাকে দায়ী করারও তেমনি একটি মেয়াদ রয়েছে! তুমি যখন বড় হবে, তোমার জীবন কোনদিকে যাবে কীভাবে যাবে সেই দায়ভারটি কেবল তোমার উপর, পৃথিবীর আর কাউকে এই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার সুযোগ দিতে পারো না তুমি।
আমার বাবা-মা কেন আমাকে ডিগ্রি নেওয়ার জন্য জোর দিয়েছিলেন সেটি আমি অনুভব করতে পারি। তাঁরা চেয়েছিলেন আমাকে যেন কোনদিন অভাবে পড়তে না হয় তাদের মতো। তাদের সারাটি জীবন কেটেছে কঠিন দারিদ্র্যে, এবং ছোটবেলা থেকে আমি দেখে এসেছি দারিদ্র্য কি ক্ষমাহীন, দুঃসহ একটি জিনিস।
দারিদ্র্য তোমার স্বপ্নগুলোকে সংকীর্ণ করে দেয়, তোমার হাত-পা হাজারটা শেকলে বেঁধে ফেলে, বিষণ্ণতা-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় বিষাক্ত করে তোলে তোমার হৃদয়। দারিদ্র্য জিনিসটিকে শিল্প-সাহিত্যে অনেকসময় খুব রোমান্টিকভাবে উপস্থাপন করা হয়, কিন্তু বিশ্বাস করো বাস্তুবে এর মাঝে সুন্দরের লেশমাত্র নেই!
অভাবের অন্ধকূপ থেকে হাতড়ে হাতড়ে আপন উদ্যোগে বেরিয়ে আসতে পারা, জগতের রূপরস একবার প্রাণভরে উপলব্ধি করার সুযোগ পাওয়া- সে কী অসাধারণ গৌরবের, অসম্ভব আনন্দের একটি অভিজ্ঞতা সেটি যে নিজের জীবন দিয়ে অনুভব করেনি তাকে কখনো বলে বোঝানো যাবে না!
কিন্তু তোমাদের বয়সে দারিদ্র্য আমার দুশ্চিন্তা ছিল না, আমার ভয় ছিল একটি জিনিসে- ব্যর্থতা।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার জীবন কোনদিকে যাবে সে ব্যাপারে আমার তেমন পরিষ্কার ধারণা ছিল না। ক্লাসে, লেকচারে, বন্ধুদের আড্ডায় আমাকে খুঁজে পাওয়া ছিল দায়। আমার দিনের বেশিরভাগ সময় কাটতো একদম একলা- কফি শপের এক কোণায় বসে গল্প লেখার চেষ্টায়।
ছাত্রজীবনে তোমরা অনেকেই সাফল্য-ব্যর্থতা যাচাই করো পরীক্ষায় কে কত পেয়েছে তার উপর। আমি নিজে পরীক্ষার সবসময় ভাল ফলাফল করে এসেছি কিন্তু তা নিয়ে আমার মনে কোন পরিতৃপ্তি ছিল না, পরীক্ষার নাম্বার দিয়ে জীবনে আসলেই খুব বেশি কিছু আসে যায় না!
সাফল্য জিনিসটি অনেকটা মরীচিকার মতো। তুমি দারুণ মেধাবী, উচ্চশিক্ষিত বলেই যে জীবনে সাফল্য পাবে সবসময় কিন্তু সেটি সত্যি নয়! ভাগ্য খুব বিচিত্র একটি ব্যাপার, এটি কখন যে তোমাকে আকাশে তুলে দেবে আবার একটানে মাটিতে নামিয়ে আনবে তুমি বুঝতেও পারবে না! আমাদের সবার জীবনেই তাই কমবেশি দুঃখের অভিজ্ঞতা রয়েছে, অনেকগুলো হতাশার অনুভূতি রয়েছে।
তুমি যখন একবার হেরে যাওয়া শুরু করবে তখন হঠাৎ করে আবিষ্কার করবে পৃথিবী কী নিষ্ঠুর একটি জায়গা! সবাই তোমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিবে যে তুমি একজন হেরে যাওয়া মানুষ, চলার পথে অনেকবার সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অপমানের মাধ্যমে সেটি তোমাকে মনে করিয়ে দেওয়া হবে।
ব্যর্থতার দিনগুলোতে অপমান গায়ে মাখানো একটি বিলাসিতা, সেটি আমি বুঝতে পেরেছি যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোনোর সাত বছর পর নিজেকে দেখতে পেলাম ব্যর্থতার সাগরে তলিয়ে যেতে।
আমার বিয়ে টিকেছে খুব অল্প সময়ের জন্য, না ছিল কোন চাকরি, না আয়ের কোন উৎস। পরিবার বলতে একমাত্র সন্তানকে নিয়ে এই বিশাল শহরে একদম একা একটা মানুষ- সেটি যে কী দুঃসহ, অসহায় একটি অনুভূতি তুমি কল্পনাও করতে পারবে না! আমার বাবা-মা সারাজীবন যেই ভয়টি করে এসেছেন- আমি তা কিছুতেই এড়াতে পারিনি, দারিদ্র্যের শেকল আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। এই ব্যাপারটি কী দুঃখের, কী যে হতাশার! আমার চেয়ে ব্যর্থ মানুষ যেন আর দ্বিতীয়টি নেই এই পৃথিবীতে!
প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন তাহলে আমি ব্যর্থতার সুফল নিয়ে কথা বলতে এসেছি?
কারণ ব্যর্থতা তোমাকে শেখাবে জীবনের অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো দূরে সরিয়ে দিতে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের অনেক কিছু মেনে চলতে হয়। তুমি চাইলেই অনেক কিছু করতে পারো না, সমাজের রীতিনীতি, কাছের মানুষদের প্রত্যাশা সবকিছুর ভার কাঁধে নিয়ে চলতে হয় প্রতিটি পদক্ষেপে। কিন্ত যখন তোমার আর হারানোর কিছু থাকে না, তখন একটি চমৎকার ব্যাপার ঘটে- তুমি একদম মুক্ত একটি মানুষ হিসেবে সবকিছু নতুন করে শুরু করতে পারো!
দুঃখগুলোকে শক্তিতে পরিণত করে আবার নতুন করে শুরু করেন জীবন
কে কী ভাবছে তোমাকে নিয়ে তাতে তোমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা থাকে না। বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পেতে তোমার একটা কিছু আঁকড়ে ধরার প্রয়োজন হয়- তুমি তোমার সবটুকু প্রাণ ঢেলে শুধু সেই স্বপ্নটি সত্যি করার পেছনে ছুটে চলো। তোমার একটি জেদ চেপে যায় সবাইকে ভুল প্রমাণ করার যারা বলে এসেছে তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না।
আমি তাই একদিন ঘুম থেকে উঠে অনুভব করলাম হয়তো সমাজের চোখে আমার মতো পরাজিত মানুষ আর দ্বিতীয়টি নেই, কিন্তু তাই বলে তো আমি এখনো মরে যাইনি! আমার কোলজুড়ে ফুটফুটে একটা সন্তান রয়েছে, সম্বল বলতে আছে পুরোন একটি টাইপরাইটার আর বুকের মাঝে এখনো বেঁচে আছে আকাশছোঁয়া কিছু স্বপ্ন!
তোমার পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায় কেবল তখনই তুমি আবিষ্কার করতে পারবে বুকের ভেতর কী অদম্য একটি বারুদ রয়েছে তোমার, কী ভীষণ ক্ষুধার্ত তুমি আরেকবার ঘুরে দাঁড়াতে! পানিতে ডোবা মানুষ যেভাবে খড়কুটো আঁকড়ে ধরে তুমি তখন সাফল্য খুঁজে বেড়াবে সেভাবে- ব্যর্থতার অনলে যে মানুষটি দগ্ধ হয়নি সে এই অনুভূতিটি কোনদিন উপলব্ধি করতে পারবে না!
হেরে যাওয়া মানে তাই শেষ হয়ে যাওয়া নয়। হেরে যাওয়া মানে নতুন করে আরেকবার শুরু করা জীবনটাকে, নতুন করে নিজের অপার সম্ভাবনাগুলোকে আবিষ্কার করা, নতুন করে নিজের স্বপ্নের পিছে ছুটে চলা ধূমকেতুর তীব্রতায়।
ব্যর্থতাকে আমি তাই বুকে টেনে নিয়েছি ভালোবেসে। ব্যর্থতা আমার প্রেরণা নিরন্তর ছুটে চলার পথে, ব্যর্থতা আমার জীবনে আশীর্বাদ।
(জে কে রাওলিং এর গোটা জীবনই সংগ্রাম আর প্রতিকূলতার গল্পে পরিপূর্ণ। তিনি প্রাণের চেয়ে ভালোবাসতেন যেই মানুষটিকে- তাঁর মা, মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে তাকে হারান রাওলিং। সাতাশ বছর বয়সে বিয়ে করেন তিনি, কিন্তু স্বামীর অকথ্য নির্যাতন সইতে না পেরে বিচ্ছেদ ঘটান বিয়ের বছরখানেকের ভেতর। একমাত্র কন্যা সন্তানকে কোলে নিয়ে একদম নিঃস্ব অবস্থায় দিনানিপাত করেন বছরের পর বছর, বিষণ্ণতা তীব্রতায় পৌঁছালে আত্মহত্যার চিন্তা করেন তিরিশ বছর বয়সে।
দুঃখগুলোকে শক্তিতে পরিণত করে আবার নতুন করে শুরু করেন জীবন, একত্রিশ বছর বয়সে প্রকাশ করেন তাঁর প্রথম বই- হ্যারি পটার সিরিজের সূচনা সেই বইটি থেকে! বিশ্বজুড়ে তাঁর লেখা বইগুলো বিক্রি হয়েছে চল্লিশ কোটিরও বেশি। পৃথিবীর সর্বকালের সবচেয়ে সফল এবং জনপ্রিয় লেখকদের তালিকায় জে কে রাওলিং এর নামটি একদম প্রথম সারিতে থাকবে।)
১০ মিনিট স্কুলের লাইভ এডমিশন কোচিং ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে সরাসরি চলে যেতে পারো এই লিঙ্কে: www.10minuteschool.com/admissions/live/
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন