প্রথমেই দু’টো ঘটনা বলে এই ব্লগ শুরু করা যাক।
ঘটনা ১:
আমার বান্ধবী প্রমিতি। নরসিংদী থেকে ঢাকায় থাকতে এসেছে, পড়াশুনা করার জন্য। কিন্তু ঢাকায় তার নিকটাত্মীয় বলে কেউ নেই। তাই থাকার জন্য সে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলো, যেখানে আগে থেকেই দুই জন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া আপু রয়েছেন। শুরুতে সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় প্রমিতির মানিয়ে নিতে খুব অসুবিধা হলেও, ওই দুইজন আপুর আদরযত্নে সে এখন তার ভাষায় ‘হেব্বি’ আছে!
ঘটনা ২:
আমার আরেক বান্ধবী শুচি। চুপচাপ স্বভাবের শুচি দরকার না পড়লে কারো সাথেই কথা বলে না। আর তার এই চুপচাপ স্বভাবের ফায়দা নেয় তার রুমমেট সুদীপা। ‘শুচিকে জ্বালানোর ১০১টি উপায়’ জানা যাবে সুদীপার কাছ থেকে(!) রাতে যখন শুচি ঘুমানোর জন্য তৈরি হয়, সুদীপা তখন লাইটের সুইচ অন করে আর স্পিকারে গানের ভলিউম বাড়িয়ে পড়তে বসে। ঘর গোছানো তো দূরের কথা, খাওয়ার পর নিজের প্লেটটা ধুয়ে রাখে না সে! সুদীপাকে নিয়ে এখন বেশ বিরক্ত শুচি। সে আমাকে বলে, “ এমন রুমমেট যেন আমার শত্রুও না পায়!”
একই বিষয় নিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটি অভিমত। কারো সাথে রুম শেয়ার করা আপনার জন্য বেশ প্যারাদায়ক হয়ে উঠবে, যদি সেটা আপনার প্রথম বার হয়ে থাকে। সেই রুম শেয়ার করা হতে পারে নিজের ভাই বা বোনের সাথে, কাজিনের সাথে, বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে কিংবা একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত কোনো ব্যক্তির সাথে। যদিও দুই বা একাধিক মানুষের মধ্যে মতের অমিল থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, তবুও পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ থাকলে এবং একসাথে সব সমস্যার সমাধান করে, বিরোধ- বিবাদ মিটমাট করে নিতে পারলে, একটু হলেও শান্তিতে থাকা সম্ভব।
কারো সাথে একই রুমে বা ফ্ল্যাটে একসাথে থাকতে হলে বেশ কিছু বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। লেখাটা আসলে একই রুম বা ফ্ল্যাটে দুই জন থাকলে কীভাবে থাকা উচিত, সেই অনুযায়ী লেখা। তবে চাইলেই এই বিষয়গুলোর সাথে একাধিক মানুষ মিলে একই ফ্ল্যাট বা রুমে থাকার আদবকেতাগুলো মিলিয়ে নেওয়া যাবে। চলুন তাহলে সেগুলো জেনে আসা যাক-
রুম ভাগাভাগি হোক সঠিকভাবে:
‘জোর যার মুল্লুক তার’- এই নীতি থেকে বেরিয়ে এসে সমান ভাবে রুম ভাগ করে নেওয়া উচিত। যদি আপনারা একটি রুমে একসাথে দুই জন থাকেন এবং সেখানে যদি দুইটি বিছানা পাতার মতন জায়গা থাকে, তাহলে রুম অর্ধেক করে ভাগ করে নেওয়া উচিত। এতে করে দুইজনের দিকেই সমান সমান জায়গা থাকবে। চোখের আন্দাজে জায়গা ভাগ করে নিতে পারেন। কিংবা মাঝখানে একটা পর্দা পার্টিসন হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।
আর যদি একটা বিছানা দুইজনের জন্য হয়, তাহলে খাট রাখার পর বাদবাকি জায়গা অর্ধেক করে নেওয়া উচিত। কেননা একটি রুমে খাট ছাড়াও দুইজনের আলাদা আলাদা আলনা, চেয়ার, টেবিল ও বুকশেলফ থাকতে পারে।
দু’জনে মিলে করি রুম সজ্জা:
দুইটি ভিন্ন মানুষের মধ্যে মতের অমিল থাকাটাই স্বাভাবিক। আপনার রুমমেটের সব বিষয় নিশ্চয়ই আপনার পছন্দ হবে না। হুট করে চলে আসা কোনো ব্যক্তির রুচি কেমন হবে, সেটাও আপনি জানেন না। তাই এইসব ‘না’ এর উত্তর ‘হ্যাঁ’ করতে চাইলে একসাথে শপিংয়ে বেড়িয়ে পড়ুন। দুই জন মিলে রুমের প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি, যেমন হাঁড়ি- পাতিল, মগ, বালতি, কার্পেট, পাপোস, লাইট, ফ্যান ইত্যাদি কিনে ফেলুন। সবচেয়ে ভালো হয় জিনিস কেনার সময় একটা আপনি ঠিক করবেন, আরেকটা তিনি ঠিক করবেন। যেমন: প্রথমবার আপনি বললেন যে এই বাদামি কার্পেটটা ঘরের জন্য কিনবেন। তাহলে এরপরে তিনি যদি লাল বালতি কিনতে চান, তাকে সেই সুযোগটাও দিতে হবে। ফলে দুইজনের মধ্যে টুকটাক কথাবার্তাও হবে, একে অপরকে জানাও হবে।
নিয়মকানুন ঠিক করে নেওয়া:
কারো সাথে কোনো পোষা প্রাণি থাকবে কী-না, কখন টিভি, লাইট, স্পিকার অফ করা হবে, কোনদিন কে আগে উঠে ঘর পরিষ্কার করবে, কে কবে কবে বাজার করে আনবে, কখন ঘরে গেস্ট আনা যাবে, একজন আরেকজনের জিনিস ধার করতে পারবে নাকি- এইসব আগেভাগে ঠিক করে রাখা ভালো। তাহলে খুব কম সমস্যার মুখে পড়তে হবে।
সেইজন্য দুইজন মিলে একটি এগ্রিমেন্ট সই করতে পারেন। যাতে কেউ কোনো রুল ভাঙলে বা অমান্য করলে সেটা তাকে দেখিয়ে ঝামেলা মেটানো যায়।
ঘর ও এর চারপাশ পরিষ্কার রাখা:
যত দ্রুত সম্ভব নিজের জায়গাটুকু পরিষ্কার করা উচিত, যাতে তা আপনার রুমমেটের বিরক্তির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। তোয়ালে ব্যবহারের পর সেটা হ্যাঙ্গারে বা আলনায় ঝুলিয়ে রাখুন। মোজা বা অপরিষ্কার কাপড় যেখানে- সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে না রেখে একটা বাস্কেটে রেখে দিন। দিনে অন্তত দুইবার ঘর ঝাড়ু দেওয়ার অভ্যাস করুন। একদিন আপনি করলে আরেকদিন আপনার রুমমেট সেটা করবে।
একই বিছানায় দুইজন ঘুমালে একদিন আপনি বিছানা করুন, আরেকদিন আপনার রুমমেটকে তা করতে বলুন। সব কাজ ভাগাভাগি করে নিলে কাজ অনেক এগিয়ে রাখা যায়। যেমন: সপ্তাহের বা মাসের কোনো নির্দিষ্ট দিনে আপনি বাজার করবেন, কাপড় আয়রন করবেন। আর আপনার রুমমেট ওয়াশরুম পরিষ্কার করবেন ও ঝুল ঝাড়বেন।
উচ্চস্বরে কোনো কিছু করা থেকে বিরত থাকুন:
আমাদের অনেকেরই একটা বাজে স্বভাব হলো আমরা উচ্চস্বরে কথা বলি, উচ্চস্বরে হাসি ও উচ্চস্বরে গান শুনি। যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনার এই অভ্যাস আরেকজনের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত বিষয়টা ঠিক আছে। তাই খেয়াল রাখবেন আপনার কুড়মুড় করে নাস্তা করা, ফুল ভলিউমে তামিল মুভি দেখা, জোরে জোরে ফোনে কথা বলা যেন আপনার রুমমেটকে অস্বস্তিকর অবস্থায় না ফেলে।
ফোনে কারো সাথে জরুরি কথা বলতে হলে অন্য রুমে বা বাইরে যেয়ে কথা বলুন। আপনার রুমমেট ঘুমিয়ে পড়লে বা পরীক্ষার জন্য পড়াশুনা করলে কানে হেডফোন বা ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনুন। কিন্তু তাকে বিরক্ত করা থেকে বিরত থাকুন! রাত ১১:৩০ থেকে সকাল ৮:০০টা পর্যন্ত ‘সাইলেন্ট টাইম’ পালন করতে পারেন।
ধার নেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করুন:
আপনার জিনিস শুধু আপনার জিনিস, আর কারো জিনিস যেমন না, তেমনি আপনার রুমমেটের জিনিসও শুধু আপনার রুমমেটেরই, আপনার না! তাই তার কোনোকিছু আপনার দরকার হলে তাকে আগে জিজ্ঞেস করে নিন। তিনি যদি আশেপাশে না থাকেন তবে তাকে টেক্সট দিয়ে বা কল করে জিজ্ঞেস করুন, কিন্তু তবুও না জিজ্ঞেস করে কিছু নেবেন না। তার উত্তর যদি না হয়, তাহলে লুকিয়ে লুকিয়ে সেটা ব্যবহার করার দরকার নেই। এতে করে শুধু শুধু অবিশ্বাস তৈরি হবে।
যদি আপনি আপনাদের সম্পর্কের উন্নতি চান, তবে নিজে থেকেই তাকে কিছু ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে রাখুন। যেমন: যদি তার কখনো প্রিন্টারের দরকার হয়, তাহলে তিনি আপনার প্রিন্টারটা ব্যবহার করতে পারবেন। কিংবা আপনার জ্যাকেট ব্যবহার করার জন্য তার কোনো অনুমতি নেওয়ার দরকার নেই ইত্যাদি।
রুমমেটের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার চেষ্টা করুন:
কখনো- সখনো আপনার রুমমেটের কিছু আচরণ আপনার ভালো নাই লাগতে পারে। তাই বলে তাকে কিছু বুঝিয়ে বলার আগেই তাকে বকাঝকা করা বা তার উপর চিল্লানো আপনার উচিত হবে না। কেননা ‘রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন’। অযথা উচ্চস্বরে কথা বললে এটা শুধু দুইজনের মধ্যে বিরক্তিরভাব সৃষ্টি করবে ও ঝামেলা বাড়াবে।
তাই প্রথমে দীর্ঘ শ্বাস নিন এবং ছাড়ুন এবং তাকে বলুন সে যাতে এরকম আচরণ আর না করেন। হয়তো তিনি যে উচ্চস্বরে টিভি দেখছেন, এটা আপনার পড়ালেখায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। তাহলে তাকে বুঝিয়ে বলুন যে টিভির সাউন্ডের কারণে আপনার পড়তে অসুবিধা হচ্ছে। টিভির ভলিউম কমালে ভালো হতো।
সমস্যার কথা খুলে বলুন:
মানুষের জীবন সমস্যামুক্ত নয়। সবসময় কোনো না কোনো ঝামেলা আমাদের সাথে লেগেই থাকে। কিন্তু আপনার এই হতাশা, কষ্ট আপনার রুমমেটকে প্রথমেই জানতে দেবেন না, যদি না তিনি আপনার খুব কাছের কেউ হন। কোনোকিছু ঘটে যাওয়ার ২৪-৪৮ ঘণ্টা পর তাকে জানান। কেননা তখন আপনার মাইন্ড ফ্রেশ থাকবে এবং আপনি তাকে খুলে আপনার সমস্যার কথা বলতে পারবেন।
নিজের জন্য আলাদা সময় রাখুন:
সবসময় একসাথে থাকছেন মানে এই না যে ‘সবসময়ই’ একসাথে থাকা প্রয়োজন। কিছু সময় একা কাটালে নিজেরই ভালো লাগবে, নিজের মতন করে কিছু চিন্তাও করা যাবে। সবারই একান্তে সময় কাটানো দরকার, তবে একা থাকার আগে তাকে সেটা আগেভাগেই জানিয়ে রাখুন। না হলে তিনি আপনাকে চুপচাপ থাকতে দেখে ভাবতে পারেন যে আপনি তার উপর রাগ করে মুখ ফুলিয়ে বসে আছেন!
সমস্যা সমাধানে তৃতীয় ব্যক্তিকে ডাকুন:
আপনাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হলে তা মিটমাটের জন্য এমন কাউকে ডাকুন, যিনি আপনাদের দুইজনকেই ভালোমতো চেনেন।
জরুরি তথ্য জেনে রাখুন:
আপনি যার সাথে থাকছেন, তিনি কোথায় পড়াশুনা করেন বা চাকরি করেন, আগে কোথায় থাকতেন- সবকিছু জেনে রাখুন। সেই সাথে তার অভিভাবকের ফোন নাম্বার, কাছের কোনো বন্ধুর নাম্বারটাও সংগ্রহে রাখুন। কারণ কখন কোথায় কোন পরিস্থিতিতে এগুলো কাজে লেগে যায়, তা বলা যায় না। হঠাৎ করে আপনার রুমমেট অসুস্থ হয়ে গেলে তো তার কাছের মানুষদেরই আগে জানাতে হবে।
ঘরে অতিথি আনার আগে রুমমেটকে জানিয়ে রাখুন:
হয়তো আজকে আপনার সাথে আপনার কোনো কলিগ বা ফ্রেন্ড আপনার ফ্ল্যাটে যাচ্ছেন। কোনো অতিথি নেওয়ার আগে আপনার রুমমেটকে সে সম্পর্কে অবগত করুন। তাহলে তিনি রুম পরিষ্কার করার পাশাপাশি অতিথির জন্য হাল্কা নাস্তার ব্যবস্থাও করে রাখতে পারবেন। আপনার রুমমেটও কোনো বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হবেন না।
এই তো জানা হয়ে গেলো জরুরি জিনিস সম্পর্কে। এছাড়াও একে অপরের বদ অভ্যাসগুলোও খেয়াল করার চেষ্টা করবেন। কেননা তার কোনো বদ অভ্যাস আপনাকে বিরক্ত করতে পারে। একসাথে থাকতে গেলে হালকা ঝগড়া হতেই পারে। তবে ঝগড়ার পরিমাণটা যাতে হালকাই হয়, গাঢ় হওয়ার আগেই ঝগড়া মিটিয়ে ভাব করে ফেলুন।
আপনার সারারাত লাইটের সুইচ অন করে রাখা যেন আপনার রুমমেটের অসুবিধার কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। বাড়ি ভাড়ার ব্যাপারটা মাসের শুরুতেই মিটিয়ে ফেলুন। এবং মাসের শুরুতে বাজেট তৈরি করে সেই বাজেটটা ফলো করুন দুজনেই। রুম গুছানোর সময় দুইজন দুইজনকে সাহায্য করুন। আরেকটা কথা মাথায় রাখবেন, ‘Treat your roommate how you want to be treated.’
তবে রুমমেটের সাথে থাকা মানে এই না যে সবসময় তা এডভেঞ্চারাস ও মজাদার হতে হবে। চাইলে দুইজন পাশাপাশি বসে চুপচাপ একসাথে ১০ মিনিট স্কুলের ব্লগগুলোও পড়ে ফেলতে পারেন!!!!
সূত্র: https://m.wikihow.com/Share-a-Room
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন