ছোটবেলায় আমি যখন অনেক অনেক বই নিয়ে স্কুলে যেতাম তখন আমার মনে হত, “ইশ! এই ভারী ব্যাগটার বদলে যদি বই না নিয়ে স্কুলে যাওয়া যেত, কতই না ভালো হত। কিংবা এমন কিছু ব্যবস্থা থাকত যাতে এতগুলো করে বই না নেয়া লাগে।”
কিছু বছর আগেও এখানে সেখানে ঘুরতে যাওয়ার সময় পছন্দের দুই-তিনটে উপন্যাস এর বই নেয়ার পর যখন ব্যাগ ভারি হয়ে যেত, তখনও মনে হত কোনভাবে সবগুলো বই নেয়া গেলে কত মজাই না হত। আমাদের মাঝে যারা বইপ্রেমী আছেন, তাদের জীবনে হয়ত কখনও না কখনও এমন হয়েছে যে, লম্বা ছুটিতে কোথাও গেলে অনেকগুলো বই নিতে চেয়েও নিতে পারেননি।
অনেকে আবার এর সমাধান হিসেবে বলে স্মার্টফোনে ই-বুক পড়ার কথা। কিন্তু দুধ এর স্বাদ কি ঘোলে মেটে? হাত এ নিয়ে বই পড়ার আনন্দ কি আর স্মার্টফোন এ ই-বুক পড়ে পাওয়া যায়? তার উপর একের পর এক কল, মেসেজ, মেইল কিংবা ফেসবুক এর নোটিফিকেশন তো আছেই। আর এই সমস্যার কথা মাথায় রেখেই আনা হয় ই-বুক রিডার। এরকমই একটি ই-বুক রিডার হচ্ছে কিন্ডল যা বিখ্যাত অ্যামাজন কোম্পানি নিয়ে এসেছে। বই পড়ার দারুণ এই বন্ধু কিন্ডল নিয়ে জানতে হলে পড়তে হবে এই লেখাটি-
অ্যামাজন কিন্ডল:
অ্যামাজন কিন্ডল হচ্ছে অ্যামাজন এর একটি ই-বুক রিডার। শুরুর দিকে কিন্ডল যখন বাজারে আনা হয় তখন এটি দিয়ে শুধু বই পড়া গেলেও এখন এটির সাহায্যে বই, ম্যাগাজিন, পত্রিকা পড়া এবং অনেক কিছু কেনা এবং ডাউনলোড করা যায়।
বইয়ের পাতার ঘ্রাণ আর একের পর এক পাতা উল্টিয়ে পড়া – বইপ্রেমীদের সবচেয়ে প্রিয় এই দুইটি জিনিস কিন্ডল এ পাওয়া সম্ভব না হলেও বেশ কিছু কারণে কিন্ডল হয়ে উঠতে পারে আপনার বই পড়ার দারুণ এক বন্ধু। চলুন জেনে নেয়া যাক সেগুলো-
স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা:
কিন্ডল এর হার্ডওয়্যারটি বেশ চমৎকার এবং শক্তপোক্ত। এই বিষয়টি বাদ দিলেও কিন্ডল এর সবচেয়ে চমৎকার দিকটি হচ্ছে – এটি ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা যায়। এই ই-বুক রিডারটিতে ব্যবহার করা হয় চমৎকার একটি ই-ইংক স্ক্রিন। এতে করে কোনো বই পড়তে গেলে মনে হয় যেন কাগজে প্রিন্ট করা বই পড়া হচ্ছে। আবার স্মার্টফোন, ল্যাপটপ বা কম্পিউটার এর স্ক্রিন এর মতও নয় এটি। শীতের দিনে আমরা যেমন বারান্দায় বা ছাদে বসে কিংবা গ্রামের বাড়িতে উঠোনে বসে রোদ পোহাতে পোহাতে পছন্দের বই পড়তে পারি, তেমনটি পড়া যাবে কিন্ডল দিয়েও। এর চেয়ে চমৎকার আর কী আছে?
ব্যাটারি:
অনেকের মনে চিন্তা আসতে পারে যে, বই তো যখন খুশি তখন পড়া যায়। কিন্তু কিন্ডল এ ব্যাটারি থাকলে সেটাকেও যদি স্মার্টফোন এর মত বারবার চার্জ দিতে হয়, তাহলে তো সমস্যা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো কিন্ডল এর সুবিধা হচ্ছে এটিতে একবার চার্জ দিলে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে ৫-৬ সপ্তাহ ব্যবহার করে বই পড়া যায়। স্বাচ্ছন্দ্যে বই পড়তে পারার সাথে সাথে যদি এমন দীর্ঘমেয়াদী ব্যাটারির সুবিধা পাওয়া যায় কিন্ডল এ – তাহলে তো কথাই নেই।
কোর্সটি করে যা শিখবেন:
ঘরে বসে Spoken English
জায়গা বাঁচানো যায়:
অ্যামাজন কিন্ডল এর সাথে একটি কিন্ডল স্টোর যুক্ত করে দেয়া যেখান থেকে চাইলেই যেকোন বই কিনে পড়া যায়। এটির জন্য নতুন করে কোনো বই কিনতে দোকানে দোকানে ঘোরার প্রয়োজন নেই। পেন্সিল এর মত চিকন কিন্ডল এ একইসাথে হাজার হাজার বই জমা করে রাখা যায়, যেটি প্রিন্টেড বইগুলোর বেলায় সম্ভব নয়। প্রিন্টেড বই কিনে বাসায় রাখতে হয়ত ভালো লাগতে পারে কিন্তু আমরা চাইলেও হাজার হাজার বই আমাদের বাসার অল্প কোনো জায়গায় এনে রাখতে পারব না। সেদিক থেকে কিন্ডল এর সুবিধা অনেক বেশি। এছাড়া আমরা চাইলেই আমাদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের দরকারি বইগুলোকে নির্দিষ্ট ফরম্যাটে পরিবর্তন করে কিন্ডল এ করে নিয়ে যেতে পারব। আগের দিন এর মত এখন আর ভারী ভারী ব্যাগ নিয়ে ঘোরাফেরা করার কোনোই দরকার নেই।
চোখের উপর চাপ কমে:
অনেক সময় দেখা যায় প্রিন্টেড বইগুলি সাথে করে নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে না পেরে আমাদেরকে স্মার্টফোন বা ট্যাবলেটগুলো থেকে বই পড়তে হচ্ছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে চোখ এ অনেক চাপ পড়ে এবং অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়না। কিন্তু অ্যামাজন কিন্ডল এর স্ক্রিন এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে করে চোখ এর উপর কোনো ধরণের চাপ না পড়ে। প্রিন্টেড বইগুলো যেমনভাবে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়তে পারি, ঠিক তেমনই কিন্ডল দিয়েও আমরা যতক্ষণ খুশি বই পড়তে পারি। এর স্ক্রিন স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট এর মত নয় বলে চোখে লাগে না পড়তে গিয়ে।
উত্তম ভ্রমণসঙ্গী:
কিন্ডল বেশ ছোট এবং হালকা বলে মোটামুটি সবখানেই এটি সাথে করে নিয়ে যাওয়া যায়। মনে করুন আপনি সুন্দরবন বেড়াতে গেছেন। সেখানে ঘুরতে গিয়ে আপনার জাফর ইকবাল স্যার এর লেখা ‘দস্যি ক’জন’ এর ইবু আর তার বন্ধুদের সুন্দরবন ভ্রমণে গিয়ে দুর্ধর্ষ ডাকাত বাহিনীর সাথে ঘটে যাওয়া কাহিনী পড়ার আগ্রহ হলো। কিন্তু আপনি ৫টি উপন্যাস এর বই নিয়ে গেছেন শুধু ওই একটিই ছাড়া। স্বাভাবিকভাবেই আপনার মন খারাপ লাগতে পারে। কিন্তু এখন আর সে সমস্যা নেই। কেননা কিন্ডল এ খুব সহজেই হাজার হাজার ই-বুক নির্দিষ্ট ফরম্যাটে পরিবর্তন করে আপনি নিয়ে নিতে পারবেন। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার সময় বই ব্যাগ এ করে নিতে গিয়ে বইয়ের কোণায় ভাঁজ হয়ে গেলে আমার মত অনেকেরই খারাপ লাগে। কিন্তু কিন্ডল এ এটি হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। সর্বোপরি যেকোন জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার সময় এই কিন্ডলই হতে পারে আপনার শ্রেষ্ঠ ভ্রমণসঙ্গী।
অন্ধকারে পড়া যায়:
আমরা আমাদের প্রিন্টেড বইয়ের কপি হাতে নিয়ে যখন খুশি পড়তে পারলেও অন্ধকারে পড়তে পারিনা। আমাদেরকে অন্য কোনো আলোর উৎসের সাহায্য নিতে হয়। এই সমস্যার সমাধান করেছে কিন্ডল। মনে করুন আপনি বাইরে থেকে রাতে বাড়ি ফিরছেন অথবা বাসায় বসে বই পড়তে গিয়ে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে। এই মুহূর্তগুলোতে আমরা আমাদের বই পড়তে না পারলেও কিন্ডল পেপারহোয়াইট এ ব্যাকলিট স্ক্রিন থাকায় খুব সহজেই অন্ধকারেও বই পড়তে পারব আমরা। এমনকি নিজের সুবিধামত কিন্ডল স্ক্রিন এর ব্রাইটনেসও ঠিক করে নেয়া যায়।
সস্তায় বই পাওয়া যায়:
আমরা পছন্দের কোনো বই কিনতে গেলে দেখা যায় বইয়ের দোকান থেকে কিনতে তার অনেক বেশি দাম পড়ে যায়। সেক্ষেত্রে আমরা কিন্ডল স্টোর থেকে বই কিনলে এর চাইতে অনেক কম দামে বই কিনতে পারি। এমনকি অ্যামাজন প্রাইম মেম্বারশিপ নিলে বইগুলো ফ্রিতে ডাউনলোড করে রাখা যায়। আবার আমাদের দেশের অনেক বইয়েরই ই-বুক আমরা অনলাইনে সুলভ মূল্যে পেতে পারি। সেক্ষেত্রে আমাদেরকে প্রিন্টেড বই কেনার মত খরচ করতে হয় না।
ভোকাবুলারি সমৃদ্ধ করা যায়:
অনেক সময় দেখা যায় ইংলিশ বইগুলো পড়তে বসলে অনেক শব্দের অর্থই আমরা বুঝতে পারছি না। গল্পের ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে সেই শব্দগুলো আর ডিকশনারি থেকে খুঁজে দেখা হয় না। কিংবা অনেক সময় শব্দের অর্থ দেখতে দেখতে এত বিরক্তি চলে আসে যে বইটি ঠিকভাবে আর পড়াই হয় না। এই সমস্যাটির একটি সুন্দর সমাধান এনেছে কিন্ডল। কিন্ডল এ যুক্ত করে দেয়া হয়েছে ‘New Oxford American Dictionary’। কোন শব্দের অর্থ বুঝতে না পারলে সেটায় ক্লিক করে সাথে সাথেই অর্থ দেখা যায়। আবার আপনি যে শব্দটি দেখবেন সেটি আলাদা করে একটি ভোকাবুলারি লিস্টে চলে যাবে। বই পড়া শেষে আপনি দেখতে পারবেন কতগুলো নতুন শব্দের অর্থ আপনি অনায়াসেই শিখে ফেলেছেন।
ফ্রি ই-বুক পাওয়া যায়:
এর আগে আমরা জানলাম যে অ্যামাজন প্রাইম মেম্বারশিপ নিলে অনেক বই ফ্রিতে ডাউনলোড করা যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে অ্যামাজন প্রাইম মেম্বারশিপ এর জন্য খরচ করতে হচ্ছে। কিন্তু এছাড়া অনেক অনেক ফ্রি বইয়ের বিশাল সংগ্রহ রয়েছে। যেগুলো অ্যামাজন কিন্ডল থেকে সহজেই ডাউনলোড করে পড়া যায়।
বই শেয়ার করা যায়:
ছোটবেলায় আমি একবার আমার বন্ধুকে চারটে উপন্যাসের বই ধার দিয়েছিলাম। কিন্তু যখন ও বইগুলো আমার কাছে ফেরত দেয় তখন বইয়ের নাজেহাল অবস্থা দেখে আমার এত কষ্ট লেগেছিল যে বলার মত না। এই পরিস্থিতিতে খুব সম্ভবত অনেক বইপ্রেমীদেরই পড়তে হয়েছে। একবার বই ধার নেয়ার পর সেটিকে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়না। আবার অনেক সময় অনেক কারণে বই ধার দিয়ে ফেরতই পাওয়া যায়না। প্রিয় বন্ধুদের বই ধার দিলেও সমস্যা, না দিলেও সমস্যা। এমন পরিস্থিতি উতরানোর চমৎকার মাধ্যম এখন কিন্ডল। কিন্ডল এ আপনি কোনো একটি বই চাইলেই আপনার পরিবারের কাউকে বা কোনো বন্ধুকে ধার দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনি যতদিনের জন্য বইটি তাদেরকে ধার দিবেন ততদিন আপনার বইটিতে ঢোকার অনুমতি থাকবে না। নির্দিষ্ট সময় শেষ হলে আপনা-আপনিই বইয়ে ঢোকার অনুমতি পেয়ে যাবেন। মানে সহজ কথায় নির্দিষ্ট সময় শেষ হলেই ধার দেয়া বইটি ফেরত পেয়ে যাচ্ছেন আপনি।
আবার কিন্ডল এর নতুন অ্যাপ বের হয়েছে যেটি আপনি চাইলেই আপনার পিসি বা স্মার্টফোনে ইন্সটল করে নিয়ে কিন্ডল এর সব বইগুলো পড়তে পারবেন। কিন্তু এক্ষেত্রে কিন্ডল ই-বুক রিডারটির যে সুবিধাগুলো রয়েছে সেগুলো আপনি পাবেন না। আপনার স্মার্টফোন বা পিসিতে যেভাবে বই পড়তে হয় সেভাবেই পড়তে হবে।
এত কিছুর পরও হয়ত মনে একটা খুঁতখুঁত থেকেই যায় যে, আসল বইয়ের আনন্দ কি এই ই-বুক কিংবা ই-বুক রিডার দিয়ে পাওয়া যায়? সেখানে না পাব নতুন বইয়ের কাগজের ঘ্রাণ, না পাব মোটা মোটা বই হাতে নিয়ে পড়ার আনন্দ। কিন্তু কিছু জিনিস কাটিয়ে উঠে যদি কয়েকটা দিন কষ্ট করে পড়তে পারেন, তাহলে হয়ত দেখবেন মোটা বইগুলো কষ্ট করে নিয়ে ঘুরে পড়ার চেয়ে কিন্ডল এ স্বাচ্ছন্দ্যে পড়তে পারছেন।
বই পড়ার সাথে সাথে যদি আপনি ঘোরাঘুরিও পছন্দ করেন তাহলে আপনার জন্য কিন্ডল হবে চমৎকার এক সঙ্গী। পাহাড়ে, বনে, সমুদ্রের ধারে – যেকোন জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার সময় শুধু এক কিন্ডলে করেই একটা লাইব্রেরি সমান বই নিয়ে যেতে পারবেন সাথে করে। বই পড়ার জন্য কিন্ডল এর মত চমৎকার বন্ধুর তুলনা হয় না। হাতের মুঠোয় লাইব্রেরি নিয়ে কি আর ভারী ভারী বই নিয়ে পড়তে ইচ্ছে করবে? আর যদি করেও তবে সময়ে সময়ে কিন্ডল থেকে বিরতি নিয়ে পড়ার জন্য তাকে তুলে রাখা মোটা মোটা বইগুলো তো আছেই।
ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে Shutterstock থেকে।
তথ্যসূত্র:
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন