পুরোটা পড়ার সময় নেই ? ব্লগটি একবার শুনে নাও !
আসাদের জন্মটা হয়েছিল ফুটফুটে এক পূর্ণিমা রাতে। লোকে বলে, পূর্ণিমায় জন্মালে নাকি সে শিশুর ভবিষ্যৎ হয় আলোয় ঝলমলে। হ্যা, আসাদ ঝলমলে একটা শুরুই করেছিলো। দিনমজুর বাবার কষ্টের ক’টি টাকায় বেশ ভালো ফল করেই স্কুলের গন্ডি পার করে সে। ওরা থাকে ছোট্ট একটা গ্রামে, এমন সে গ্রাম, যে ওর এস.এস.সি পাসটাই সেখানে অনেক গর্বের একটা ব্যাপার। গ্রামময় তার নাম ছড়িয়ে পড়ে- ট্যালেন্ট আসাদ!
কিন্তু কলেজে ভর্তি হবার সময় তার বাবার আর্থিক দৈন্যের করাল গ্রাস আঘাত হানে ট্যালেন্ট আসাদের স্বপ্নে। সে শহরের কলেজে পড়তে পারেনা। তাকে পড়তে হয় তিন ক্রোশ দূরে উপজেলা ডিগ্রি কলেজে। ছোটবেলা থেকেই আসাদের স্বপ্ন সায়েন্স নিয়ে পড়ার। তাই সে এস.এস.সির পর এইচ.এস.সিতেও বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। গ্রামের স্কুলে সায়েন্স কোনমতে বুঝেছে আসাদ। কিছুটা নিজের চেষ্টায়, কিছুটা বই ঘাঁটা-ঘাঁটি করে এস.এস.সি’র গন্ডি পেরোলেও, কলেজে উঠে থমকে যায় সে।
বিজ্ঞানের বিষয়গুলোকে হঠাৎই কেমন অচেনা লাগে ওর। কলেজ নিয়ে বেশি প্রত্যাশা তার কখনই ছিল না। তবে সে ভেবেছিল কলেজ থেকে হয়তো সামান্য কিছু হলেও শিখতে পারবে। কিন্তু ক’মাস ক্লাস করেই আসাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়। সে বুঝতে পারে, এমন কলেজ থেকে কিছু শেখার আশাটাও তার মতো ছাত্রদের জন্যে দূরাশা।
আসাদ দেখতে পায়, তাদের এই কলেজে আসলে চার ধরণের শিক্ষক আছেন।
ক্যাটাগরি ১:
গ্রামাঞ্চলে এ ধরণের শিক্ষক এখন বিলুপ্তপ্রায় বললেই চলে। তাঁরা হলেন আদর্শ শিক্ষক। সময়মতো ক্লাসে আসেন, সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন যেন তার শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠ শুধু মুখস্ত নয়, আত্মস্থও করতে পারে। তাঁরা পড়ান অতি চমৎকার, এবং এ ধরণের শিক্ষকেরা তাদের শিক্ষার্থীদের কাছে সবচে বেশি জনপ্রিয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আসাদের কলেজে এমন কোন শিক্ষক ছিলো না। ছিলো না আশপাশে কোথাও। সে শুধু গল্পই শুনেছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে তাই এমন শিক্ষক পাবার আশা করাটাই দিবাস্বপ্ন।
ক্যাটাগরি ২:
এই শিক্ষকেরা মোটামুটি ভালোই পড়াতে পারেন। আর সেজন্যে তাঁদের এই গুণটি তাঁরা গ্রামের গন্ডমূর্খ ছাত্রদের পেছনে নষ্ট করেন না। তাঁরা শহরের কোচিং সেন্টারগুলোতে পড়ান, না হলে শহরের সচ্ছল পরিবারের ছাত্রদের বাসায় পড়িয়ে আসেন। তাঁরা থাকেনও শহরে, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মতো করে বললে ভদ্রপল্লীতে তাদের বাস। অন্ধকার এই কলেজে ক্লাস নিতে তাঁদের পদচারণা বিরলই বলতে হয়।
ক্যাটাগরি ৩:
এই শিক্ষকেরা মধ্যম মানের। তাঁরা শহরের কোচিংগুলো থেকে তেমন ডাক পান না। সেজন্যে মোটামুটি নিয়মিত ক্লাস করান। কিন্তু তাঁরা ‘মধ্যম’ মানের শিক্ষক বলে তাদের ক্লাসগুলো হয় সাদামাটা এবং একঘেঁয়ে। তারা তাদের মতো মুখস্ত বুলি আউড়ে যান, কারো কোন প্রশ্ন কানে তোলেন না, চেষ্টা করেন সেগুলো এড়িয়ে যাবার। সেজন্যে তাদের কাছ থেকে খুব একটা উপকার পাওয়া যায় না।
ক্যাটাগরি ৪:
এঁরা নিজেদের অত্যন্ত জ্ঞানী মনে করেন। এতোই জ্ঞানী, যে তুচ্ছ শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাঁদের অপরিসীম জ্ঞান বিতরণ করতে বড্ড বিরক্ত হন তাঁরা। সেজন্যে, ক্লাস নিতে এলেই তাঁরা কঠিন আর উদ্ভট কোন বিষয়ে আলোচনা করতে শুরু করেন। একটা পর্যায়ে নিজেই বুঝতে পারেন না তিনি কি বলছেন! শেষমেষ অজস্র গোজামিল দিয়ে ক্লাস শেষ করেন।
ম্যাথ ক্লাস এঁরা শুরু করেন বইয়ের কঠিনতম অংকগুলোর একটি দিয়ে। বলা বাহুল্য, অধিকাংশ সময়েই তারা এই অংক মেলাতে পারেন না। স্বগতোক্তি করেন, ‘‘জীবনের অংকই মেলাতে পারলাম না, আর এ তো বই’’ – তারপরই বিদায় নেন।
ক্যাটাগরি ৫:
এই মহান ব্যক্তিরা কি করে কলেজের শিক্ষক হয়েছেন তা এক রহস্য বটে। শোনা যায়, তাঁরা নাকি উত্তরাধিকারসূত্রে শিক্ষকতার দায়িত্ব পেয়েছেন! ক্লাসে আসেন। তারপর খানিকক্ষণ চেয়ারে বসে বাকিদের বই খুলে পড়তে বলেন। কিছু বোঝান না, নিজেও কিছু বোঝেন কিনা সে নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়! ফাঁকিবাজ শিক্ষার্থীদের কাছে এঁরা অনেক জনপ্রিয়ও বটে।
আসাদ দেখতে পায়, ভাল একজন শিক্ষকের অভাবে কতশত মেধাবী অকালে ঝরে পড়ছে। পাস করতে পারছে না, আর করলেও এমন রেজাল্ট নিয়ে পাস করছে, তাতে তারা কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ারই সুযোগ পাচ্ছে না। দুই একজন ভালো করছে, কারণ তারা সচ্ছল।
ক্যাটাগরি-২ শিক্ষকদের বাসায় গিয়ে তারা প্রাইভেট পড়ে আসছে। আসাদের তো সে সুযোগ বা অর্থ কোনটাই নেই, তবে কি হবে আসাদের? সে কি ভাল ফলাফল করতে পারবে না? তাকেও কি নিয়তির হাতে নিজের ভবিষ্যতকে সঁপে দিতে হবে? সে প্রশ্নের উত্তর মেলে না।
আসাদরা দমে যাবার পাত্র নয়, আসাদরা ফেরে, তারা ফিরবেই।
আসাদ যে কলেজে পড়তো, সে কলেজ থেকে একটু দূরেই ছিলো সদর উপজেলা। একটুখানি উন্নত সে জায়গাটায় একটা ছোট্ট কম্পিউটারের দোকান ছিলো। পড়ালেখায় যখন আসাদ সত্যিই এমন অদ্ভুত শিক্ষকদের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছিল না, এই দোকানটি তার জন্যে দেবদূত হয়ে দেখা দেয়। ইন্টারনেটের জাদুর ছোঁয়ায় সে ফেসবুক চালাতে শেখে। কিন্তু আসাদ ফেসবুকে সময় নষ্ট করার মতো ছেলে নয়। ফেসবুকে সে খুঁজতে থাকে শিখার মতো জিনিসগুলো। এভাবেই হঠাৎ একদিন তার চোখে পড়ে একটা সাইট, নামটাই অবাক করা, 10 Minute School!
দশ মিনিটের এই ছোট্ট স্কুলে আবার পড়ালেখা চলে একটু অন্যভাবে। এখানে আছে কুইজ, আছে নানান শিক্ষামূলক ভিডিও ক্লিপ, আছে বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন লাইভ ক্লাস! আসাদের সমস্য ছিলো জৈব রসায়নে, জীববিজ্ঞানে, আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানেও। এই সাইটটা থেকে কয়েকটা লাইভ ক্লাস করে তার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। ক’দিন আগে যে আসাদ ভাবতো- তার দ্বারা কিছু হবে না, সেই আসাদ হঠাৎই বুঝতে পারে, চেষ্টা করলে সব-ই সম্ভব!
এতটুকু পড়ে নিশ্চয়ই ভাবছেন এ লেখাটিও সেই চর্বিত চর্বণ, এক বিজয়ীর সব বাধা পেরিয়ে বিজয়মুকুট ছিনিয়ে আনবার আরেকটা পুরনো, ক্লিশে গল্প। কিন্তু না। বাস্তবতা বড্ড কঠিন। বাস্তবতা নিষ্ঠুর, পাষাণ। উপরের আত্মবিশ্বাসী আসাদ শুধুই এক কল্পনার নাম। কল্পজগতের আদর্শ আসাদ হয়তো উপরের কাজগুলো করে, কিন্তু বাস্তবের আসাদ আলাদা। সে এসবের কিছুই করে না। সে আর দশটা গ্রামের ছেলের মতোই সাধারণ। বাস্তবের আসাদ পড়ালেখা করতে ইন্টারনেট ব্যবহার করে না, তার অন্তর্জালে প্রবেশের মূলে আছে নিখাদ বিনোদন। অন্য অনেকের মতোই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয় সে।
হয়তো আসাদ সত্যিই 10 Minute School এর মতো কোন সাইট খুঁজে পেয়েছিলো, হয়তো পায়নি। কিন্তু সত্যিটা হলো, আসাদ কোন মহাপুরুষ নয়। সে-ও উঠতি বয়সের এক কিশোর, তারও আছে একটি চঞ্চল মন। তাই ইন্টারনেটের খারাপ দিকগুলোর সাথে পরিচিত হতে সময় লাগেনি তার।
একটা পর্যায়ে এসে পড়াশোনার থেকে আসাদের কাছে এই ভার্চুয়াল রঙ্গিন জগত বেশি চিত্তাকর্ষক মনে হয়। আস্তে আস্তে সে তলিয়ে যায় অন্ধকারে। একে খারাপ শিক্ষক, তার ওপর অন্তর্জালের কু-প্রভাব- তার ভবিষ্যতটা কেমন অন্ধকার দেখায়। আসাদের আর অদম্য মেধাবী হয়ে ওঠা হয় না, হারিয়ে যায় সে।
আসাদের এভাবে হারিয়ে যাবার পেছনে মূল কারণটাই হলো সঠিক দিক নির্দেশনার অভাব। গল্পের প্রথম দিককার ‘আদর্শ ছাত্র’ আসাদ হওয়াটা প্রায় অসম্ভব, কিন্তু ঠিক-ঠাক নির্দেশনা পেলে এই হারিয়ে যাওয়া আসাদই হয়ে উঠতে পারতো আত্মবিশ্বাসী। সে হয়তো সত্যিই 10 Minute School এর মতো সাইট থেকে অনেক কিছুই শিখতে পারতো, হতে পারতো বিজয়ী। আসাদ হতে পারতো তাদের গ্রামের গৌরব, লোকে গর্ব করতো তাকে নিয়ে। কিন্তু তাকে কেউ সাফল্যের রাস্তাটা দেখিয়ে দেয়নি। না হলে গল্পের শেষটা অন্যরকম হতো।
আসাদ এক কাল্পনিক চরিত্র। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এমন অনেক আসাদ লুকিয়ে আছে। শুধুমাত্র পথ দেখিয়ে দেবার অপেক্ষায় আছে তারা । এই লেখাটি তাদেরই জন্যে। পৃথবিীর যে প্রান্তেই নিবাস হোক না কেন, শিক্ষকের অভাব হোক বা না হোক, অন্তর্জাল ব্যবহার করে আজ নিজেই সব শেখা যাচ্ছে। দরকার শুধু সে পথ চিনে নেয়ার। এই পথ চিনে নিলেই আসাদেরাও করবে বিশ্বজয়। আসাদরা দমে যাবার পাত্র নয়, আসাদরা ফেরে, তারা ফিরবেই।
১০ মিনিট স্কুলের লাইভ এডমিশন কোচিং ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে সরাসরি চলে যেতে পারেন এই লিঙ্কে: www.10minuteschool.com/admissions/live/
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি আপনার লেখাটি ই-মেইল করুন এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন