ফোবিয়ার সাথে যে শুধু ভয়ই জড়িয়ে থাকে, তা কিন্তু নয়। এর সাথে থাকে কোনো বিষয় নিয়ে অস্বাভাবিক দুশ্চিন্তা, মাত্রাতিরিক্ত টেনশন, আতঙ্ক এবং বিরক্তি। আর সেই ভয়টাকে মোকাবেলা না করে এড়িয়ে যাওয়া। আমরা সাধারণত যুক্তিসংগত কারণেই উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তায় ভুগি। কিন্তু অমূলক কোনো কিছুর কারণে দুশ্চিন্তাই হলো ফোবিয়া।
লজ্জা আর ফোবিয়া এক জিনিস নয়, লজ্জাকে বলা যায় একধরনের অস্বস্তি। অল্পস্বল্প হলে এতে বিশেষ অসুবিধা হয় না। যেমন অপরিচিত কারো সাথে কথা বলার সময় আমরা অস্বস্তিবোধ করি। কিন্তু কিছুক্ষণ কথা বলার পরেই আড়ষ্ট ভাবটা আবার চলে যায়। এমনকি তখন কথাবার্তা উপভোগও করি।
আর ফোবিয়া হলো একধরনের দীর্ঘস্থায়ী ভয় বা মানসিক সমস্যা, যার কারণে মানুষ হঠাৎ করেই হতবিহবল হয়ে পড়ে। এজন্য সবার ক্ষেত্রে সেই বিষয়টা স্বাভাবিক হলেও ফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে সেটা হয় না। কোনো কিছুর প্রতি ভয় ৬ মাসের বেশি স্থায়ী থাকলে বুঝতে হবে সেটা ফোবিয়া।
কিন্তু কিছু কিছু মানুষ এই ছোট্ট ভয়টাকে এমনভাবে নিজেদের জীবনের সাথে জড়িয়ে ফেলে যে, তারা আর সেটা থেকে বের হতে পারে না। জীবনটাকেই তারা অদ্ভুত বানিয়ে ফেলে।
অনেক সময়, আমাদের সাথে কোনো ভয়ংকর জিনিস না ঘটলেও, আমাদের সামনে যদি সেটা ঘটে থাকে, সেই ভয়টা তখন ফোবিয়ায় রূপান্তরিত হয়। অনেকসময় টিভিতে পশুহত্যা দেখানো হলে আগে থেকে বলে নেওয়া হয় যাতে শিশুরা না দেখে। কেননা তারা এগুলো দেখলে তাদের মনে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
গত পর্বে আমরা বেশকিছু কমন ফোবিয়ার কথা জেনেছিলাম। চলো আজকে আরো কয়েকটা ফোবিয়া সম্পর্কে জেনে আসা যাক। আচ্ছা, তার আগে আমাকে একটা কথা বলো তো, তোমরা কি নিজেদের সাথে কোনো ফোবিয়ার মিল পেলে? যদি পেয়ে থাকো তাহলে জানাতে ভুলবে না কিন্তু!
কোর্সটি করে যা শিখবেন:
Personal Fitness
Mageirocophobia (রান্না করতে ভয়):
এই অদ্ভুত ফোবিয়াটি এসেছে গ্রীক শব্দ mageirokos থেকে, যার অর্থ দক্ষ রাঁধুনি। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই ফোবিয়াতে যারা ভোগে, তাদের বেশিরভাগই বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে বেঁচে থাকে। রান্না করার ঝামেলায় পড়তে চায় না। যা তাদের শরীরে বিরূপ প্রভাব ফেলে। যারা খুব ভাল রান্না করতে পারে, তাদের ভক্ত হয়ে যায়। নিজেরা ভাল রান্না করতে পারেনা বলে তাদের মধ্যে একধরনের হীনম্মন্যতা তৈরি হয়।
Eisoptrophobia (আয়নাকে ভয় পাওয়া):
Eisoptrophobia অর্থ হচ্ছে আয়নাকে ভয় পাওয়া। এসব রোগীরা আয়নার ভেতর দিয়ে অন্য এক জগতকে দেখতে পেয়ে ভয় পায়। এরা ভয়ের চেয়ে দুশ্চিন্তায় বেশি ভোগে।
Bibilophobia (বইভীতি):
একে এক কথায় বলা যায়, যেকোনো ধরনের বইয়ের প্রতি ভয়।
Cibophobia (খাবারের প্রতি ভয়):
ল্যাটিন ভাষায় ‘Cibos’ শব্দের অর্থ হলো খাবার। যাদের এই ফোবিয়া আছে, তাদের সন্দেহ থাকে, তার খাবারের মধ্যে কেউ কোনো ক্ষতিকারক দ্রব্য মিশিয়ে দিয়েছে। যার ফলে খাবার তার পাকস্থলিতে যাওয়া মাত্রই সে বমি করে দেয়। আবার অনেকে মনে করে খাবার খেলে সে অতিরিক্ত মোটা হয়ে যাবে। যে কারণে খাবার দেখলেই আঁৎকে ওঠে।
আরও পড়ুন:
ফোবিয়া: হরেক রকম মানুষের হরেক রকম ভয় (পর্ব ১)
ফোবিয়া: হরেক রকম মানুষের হরেক রকম ভয় (পর্ব ২)
Decidophobia (সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভয়):
এরা কখনোই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সবকিছুর জন্যই অন্যের উপর নির্ভরশীল। এমনকি তারা হ্যাঁ এবং না এর পার্থক্যও বুঝতে পারে না।
Xocolataphobia (চকলেটভীতি):
চকলেট খেতে কে না ভালোবাসে? তবে পৃথিবীতে একদল মানুষ আছে, যাদের চকলেট ফোবিয়া আছে! ইশ! কী কষ্ট তাদের, তাই না? এদের মধ্যে বেশিরভাগই চকলেটের তিতকুটে স্বাদের জন্য চকলেট খাওয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখে।
Didaskaleinophobia ( স্কুলে যেতে ভয়):
২-৫% বিদ্যালয়গামী শিশুদের মধ্যে এই ফোবিয়া আছে। ছোট থাকতে আমরা প্রায়ই বায়না ধরতাম স্কুলে না যাওয়ার। তবে যাদের Didaskaleinophobia আছে, তারা আসলেই স্কুলে যেতে ভয় পায়। বিশেষ করে ৪-৬ বছর বয়সী শিশুরা। কারণ, তারা তখনো বাসার বাইরে নিজের পরিচিত খোলস থেকে বের হয়ে অন্য কোথাও যেতে চায় না। এই সময়টায় যদি তাদের জোর করা হয়, তাহলে ভয়টা তাদের মাঝে স্থায়ী হয়ে যায়।
Kyrofelonoshophobia (কার্টুন ক্যারেক্টারকে ভয়):
কার্টুনপ্রেমীদের কাছে এখনো সবচেয়ে প্রিয় কার্টুন হলো ‘টম এন্ড জেরি’। আমরা ছেলেবুড়ো সবাই কার্টুন দেখতে ভালোবাসি। কিন্তু যাদের মধ্যে Kyrofelonoshophobia আছে, তারা কার্টুন দেখলে রীতিমত দৌড়ে পালাতে পারলে বাঁচে! কার্টুনে যারা নেতিবাচক চরিত্রে থাকে, তারা সেগুলোকে ভয় পায়। এমনকি রাতে স্বপ্নেও তারা এগুলোই দেখে।
এছাড়াও আরো অনেক ধরনের মজার ফোবিয়া আছে। যেমন: Pobophobia নামের এক ধরনের ফোবিয়া আছে, যার মানে হলো ফোবিয়ার ফোবিয়া!
হাসিখুশি থাকার ভয়কে Cherophobia বলে। যাদের মধ্যে এই ফোবিয়া আছে, তারা সবসময় সুখী থাকতে ভয় পায়। কারণ, তাদের মনে হয়, “যত হাসি তত কান্না, বলে গেছেন রামশর্মা।” তাই খুশি হতে গেলেই তাদের মনে হয় এরপরে খুব খারাপ কিছু ঘটবে।
‘hippopotomonstrosesquipedaliophobia’-র অর্থ হলো বড় আকারের শব্দের প্রতি ভয় থাকা(!)
আমরা অনেকসময়ই আমাদের চিন্তা-ভাবনাকে বশে আনতে পারি না। ধরা যাক আমি আজকে আমার টেবিলে গুছাবো না। নিজেই নিজেকে এবং বাসার সবাইকে জানালাম যে কাজটা আমি করবো না, তবুও আপনা-আপনি আমার হাতদুটো টেবিলের দিকে চলে গেল এবং আমি সব গোছাতে শুরু করলাম। এমনটা আমাদের সাথে প্রায়ই হয়। আমরা অনেক সময় এমন সব জিনিসকে ভয় পাই, যেগুলো সম্পূর্ণ যুক্তিহীন। অনেকক্ষেত্রে আমরা জানিও যে এটা যুক্তিহীন, তবুও ভয় পাই। আচ্ছা,ভয় পেতে কি তোমাদের ভালো লাগে?
ফোবিয়া আছে কিনা:
তোমার মধ্যে কোনো ফোবিয়ার লক্ষণ আছে কি না, তা বোঝার জন্য ঝটপট নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে ফেলো। যদি এইগুলোর মধ্যে ৪টি প্রশ্নের উত্তরও হ্যাঁ হয়, তাহলে বুঝতে হবে তুমি ফোবিয়ায় আক্রান্ত।
- হঠাৎ কোনো কিছু নিয়ে প্রচন্ড ভয়, অস্বস্তি, উৎকণ্ঠা লাগে?
- কোনো জায়গায় যেতে অস্বস্তিবোধ হয়, যার কারণে বাইরে বের হওয়াটা এড়িয়ে যাও?
- দরকারের সময় কেউ কাছে থাকবে না- এমন মনে হয়?
- কাজের জায়গায় সবাই তোমাকে ঘুরে ঘুরে দেখছে, এমন মনে হয়?
- নিজের চিন্তাভাবনার প্রতি নিজেরই কন্ট্রোল থাকে না?
- কোনোকিছু ঠিক আছে কি না তা বারবার দেখো?
- সমাজ, পরিবার, পড়াশুনা- এগুলো নিয়ে বেশি চিন্তিত?
- কখনো বড় কোনো এক্সিডেন্টের মুখোমুখি হয়েছো?
- টানা কিছুদিন ধরে হতাশ লাগছে? কোনো কিছু করার আগ্রহ পাচ্ছো না?
সূত্র: ‘Leave Your Passion’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ‘Phobia’
“It’s a universal truth that no parent wishes to acknowledge that the fear and phobias we are in thrall to in adulthood almost invariably connect back to childhood experiences.”
—-Mariella Frostrup
বেশির ভাগ ফোবিয়ার সূত্রপাত হয় ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা দিয়ে।
আমি আমার একটা ঘটনা বলি। আমি এখন ব্যাঙ অনেক ভয় পাই। আমার যখন ৬ বছর বয়স, তখন থেকেই ভয় পাই। অথচ এর আগে কিন্ত পেতাম না। একদিন স্বপ্নে দেখি যে একটা ব্যাঙ আমাকে খেয়ে ফেলছে (ছোটবেলায় কত না অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতাম!)। এটা দেখার পর দুই দিন আমি প্রবল জ্বরে ভুগি, এরপর থেকে আমি ব্যাঙ ভয় পাই, এমনকি ব্যাঙের ডাকও।
ফোবিয়ার শারীরিক লক্ষণ :
হার্টবিট বেড়ে যাওয়া, গলা-মুখ শুকিয়ে যাওয়া, প্রচণ্ড ঘাম, বুকে ব্যাথা, পেশিতে টান, কাঁপুনি, ঝিমঝিম ভাব, নিঃশ্বাস নিতে অসুবিধা, পেটে অসুবিধা, ডায়রিয়া, মাথা ঘোরা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
ফোবিয়ার মানসিক লক্ষণ:
অমূলক ভয়ের পরিস্থিতি, বাইরের লোকজন এড়িয়ে চলা, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, হতাশ লাগা।
“My phobias worsen as I get older. I’m scared of flying, driving. I’m terrified of sharks. I’m a germaphobe. But I try to face my fears; I do. Well, most of them.”
—Eli Roth
আমার মধ্যে ওই নির্দিষ্ট ফোবিয়াটা আছে, তার মানে এই না যে আমি ফোবিয়া দূর করার জন্য চেষ্টা করবো না। আমি অবশ্যই চেষ্টা করবো যাতে ভয়টা আমাকে আর কাবু করতে না পারে। আমার মনকে আমিই নিয়ন্ত্রণ করবো, আমার মন যেন আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে।
শুধু যে তোমার-আমার মতন আমজনতারই কেবল ফোবিয়া আছে, তা কিন্তু নয়। বরং অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদেরও ফোবিয়া রয়েছে! ‘পাইরেটস অব দ্যা ক্যারাবীয়ান’ তারকা জনি ডেপের রয়েছে ‘Coulrophobia’ নামের এক অদ্ভুত ফোবিয়া, যার অর্থ হচ্ছে ক্লাউন বা জোকারকে ভয় পাওয়া। কেননা তার মনে হয় জোকারের রঙিন চেহারার ভেতর এক মিথ্যা স্বত্ত্বা বাস করে, যা তার মধ্যে ভীতির সঞ্চার ঘটায়।
বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী কেটি পেরির রয়েছে ‘Nyctophobia’ বা অন্ধকারভীতি। তার মনে হয় অন্ধকারের ভেতর অশুভ অশরীরী কোনো কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে। এছাড়াও নিকোল কিডম্যান প্রজাপতি ভয় পান, ম্যাট ডেমনের রয়েছে সাপভীতি। অপরাহ উইনফ্রের ফোবিয়াটা একটু অদ্ভুত ধরণের। তিনি চুইংগাম ভয় পান, যাকে বলা হয় ‘ Chiclephobia’।
ফোবিয়া তোমার থাকবে নাকি থাকবে না, তা সম্পূর্ণ তোমার উপরেই নির্ভর করে। তুমি নিজে থেকে ঠিক না হতে চাইলে কেউই তোমাকে ঠিক করতে পারবে না। তাই নিজের উপর আস্থা রাখো। এমনকি আমিও আমার Cynophobia দূর করতে পুরোদমে কাজ করছি! তাই নিজের মধ্যে যদি কোনো ফোবিয়া দেখতে পাও, তাহলে সেটাকে নিছক মজা হিসেবেই নাও, বেশি সিরিয়াস হয়ে যেও না কিন্তু!
এই লেখাটির অডিওবুকটি পড়েছে আব্দুল্লাহ আল মেহেদী
আমাদের কোর্সগুলোর তালিকা:
- Communication Masterclass by Tahsan Khan
- Facebook Marketing Course by Ayman Sadik and Sadman Sadik
- ঘরে বসে Freelancing by Joyeta Banerjee
- ঘরে বসে Spoken English Course by Munzereen Shahid
- Study Smart Course by Seeam Shahid Noor
- Microsoft Office 3 in 1 Bundle
- Microsoft Word Course by Sadman Sadik
- Microsoft Excel Course by Abtahi Iptesam
- Microsoft PowerPoint Course by Sadman Sadik
- Personal Finance Course by Nafeez Al Tarik
১০ মিনিট স্কুলের ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে ভিজিট করুন: www.10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন