নবম-দশম শ্রেণীর হিসাববিজ্ঞান বইতে তুলনামূলক জটিল অধ্যায় কোনটি?” এ প্রশ্নের উত্তরে শতকরা ৮০ জনই বলেছে “আর্থিক বিবরণী“। বাকী ২০ জনের কেউ কেউ বলেছে “কঠিন বলতে আসলে কোনো শব্দ নেই” আর কেউ বলেছে “পুরো বইটাই তো বিষের মতোন লাগে”, আপু।
আজকে আমরা সেই মানুষগুলোকে টার্গেট করবো যাদের আর্থিক বিবরণী জটিল অধ্যায় বলে মনে হয়েছে। তো তাদের সাথে কথা বলে যা বুঝলাম তা হলো জাবেদা,খতিয়ান, রেওয়ামিল ইত্যাদি প্র্যাক্টিস করতে করতে সোজা হয়ে গেছে কিন্তু আর্থিক বিবরণী তে অনেক খুঁটিনাটি বিষয় রয়েছে যা মনে রাখতে অসুবিধা হয়। আর সবচেয়ে বেশি বুঝতে সমস্যা হয় সমন্বয়গুলোতে।
সমন্বয়! এতো মজার জিনিসটা কারো জটিল লাগলে কিভাবে হবে! চিন্তা এলো সমন্বয়গুলোকে কিভাবে একটু সোজাভাবে উপস্থাপন করা যায়।
চূড়ান্ত হিসাব বলতে বোঝায় কারবারের ক্রয়-বিক্রয় ও লাভক্ষতি হিসাব এবং উদ্বৃত্তপত্র।কারবারের আর্থিক অবস্থা নিরূপণ করে বিধায় একে আর্থিক বিবরণীও বলা হয়।
আর্থিক বিবরণী একেক ধরণের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে একেক রকমভাবে প্রস্তুত করতে হয়। অর্থাৎ একমালিকানা কারবার এবং যৌথ মূলধনী কারবারের আর্থিক বিবরণী কিন্তু ভিন্ন নিয়মে তৈরি করতে হয়। আজকে আমরা একমালিকানা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে আর্থিক বিবরণী প্রস্তুতের কিছু খুবই কমন সমন্বয় সম্পর্কে জানবো যেগুলো প্রায় প্রত্যেকটা অংক সমাধানে কাজে লাগবে।
আরো পড়ুন: ১০ মিনিটেই শিখে ফেলো পর্যায় সারণি
চূড়ান্ত হিসাব করার নিয়ম:
আন্তর্জাতিক হিসাবমান ০১ (International Accounting Standard- 01) অনুসারে চূড়ান্ত হিসাব প্রস্তুতের পাঁচটি ধাপ রয়েছে। ধাপগুলো হলো:
১. বিশদ আয় বিবরণী (Statement of Comprehensive Income)
২. মালিকানা সত্ত্ব বিবরণী (Statement of Changes in Equity)
৩. আর্থিক অবস্থার বিবরণী (Statement of Financial Position)
৪. নগদ প্রবাহ বিবরণী (Statement of Cash Flows)
৫. আর্থিক অবস্থার বিবরণীতে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় নোট ও গুরুত্বপূর্ণ হিসাবের নীতিমালা (Notes comprising a summary of significant accounting policies and other explanatory information)
এইবার চূড়ান্ত হিসাব প্রস্তুতির ধাপগুলো সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যাক।
কোর্সটি করে যা শিখবেন:
Personal Finance Course
১. বিশদ আয় বিবরণী:
বিশদ আয় বিবরণী দ্বারা নিট মুনাফা নির্ণয় করা হয়। এতে মুনাফাজাতীয় আয় এবং মুনাফাজাতীয় ব্যয়সমূহ লিপিবদ্ধ করা হয়। সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে শুধু সেবা আয় থেকে মোট ব্যয় বাদ দিলেই নীট মুনাফা পাওয়া যায়। অপরপক্ষে, আমরা জানি পণ্য ক্রয় বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আয়ের প্রধান উৎস হলো পণ্য বিক্রয়। এক্ষেত্রে নীট মুনাফা নির্ণয় পদ্ধতি হলো বিক্রয়লব্ধ অর্থ থেকে বিক্রিত পণ্যের ব্যয় বাদ দিলে মোট মুনাফা পাওয়া যাবে।মোট মুনাফার থেকে ব্যবসায়ের পরিচালন ব্যয় বাদ দিয়ে পাওয়া যাবে পরিচালন মুনাফা। তারপর পরিচালন মুনাফার সাথে অন্যান্য আয় যোগ করে প্রাপ্ত যোগফল থেকে ব্যয় বাদ দিলে নির্ণয় হবে নিট মুনাফা।
২. মালিকানাস্বত্ব বিবরণী:
প্রারম্ভিক উদ্বৃত্তের সঙ্গে অতিরিক্ত মুলধন যোগ করতে হবে। তারপর আর্থিক বিবরণী থেকে প্রাপ্ত নিট মুনাফা/ ক্ষতি সমন্বয় করতে হবে। নীট মুনাফা হলে যোগ এবং ক্ষতি হলে বাদ দিতে হবে। তার থেকে যেকোনো প্রকার উত্তোলন থাকলে তা বাদ দিতে হবে। সর্বশেষ সাধারণ সঞ্চিতি যোগ করে পাওয়া যাবে মালিকানাস্বত্বের সমাপণী উদ্ধৃত্ত।
৩. আর্থিক অবস্থার বিবরণী:
ব্যবসায়ের আর্থিক অবস্থা জানার জন্য হিসাবকালের শেষদিন যে বিবরণী প্রস্তুত করা হয়, তাই আর্থিক বিবরণী। আর্থিক বস্থার বিবরণি থেকে স্থায়ী সম্পদ, চলতি সম্পদ, স্থায়ী দায়,চলতি দায় এবং মালিকের মূলধনের পরিমাণ জানা যায়। সম্পদজাতীয় লেনদেন একসাথে যোগ করে তারপর দায়জাতীয় লেনদেন একসাথে যোগ করলে দেখা যাবে যে দুই পাশের উদ্ধৃতই সমান হবে।
চূড়ান্ত হিসাবের যতো সমন্বয়:
চূড়ান্ত হিসাব প্রস্তুত করা হয় রেওয়ামিলের হিসাবসমূহ থেকে। কখনো কখনো রেওয়ামিল বহির্ভূত কিছু তথ্যও আর্থিক বিবরণীতে অন্তর্ভূত করা। আর এই প্রক্রিয়াকে বলা সমন্বয়সাধন। আজ আমরা চূড়ান্ত হিসাবের এমন সব সমন্বয় দেখবো যা বুঝতে পারলে চূড়ান্ত হিসাব প্রস্তুত করা তোমার কাছে জলের মতোন সহজ হয়ে যাবেন
সমাপনী মজুদ পণ্য:
একটি হিসাবকাল শেষে যেসব পণ্য অবিক্রীত থেকে যায় সেগুলো সমাপনী মজুদ পণ্য বলে। অনেক সময় সমাপনী মজুদ পণ্যের দুটি মূল্য দেওয়া থাকে। একটি ক্রয়মূল্য এবং অপরটি বাজারমূল্য। হিসাববিজ্ঞানের রক্ষণশীলতার নীতি অনুসারে এক্ষেত্রে ক্রয়মূল্য এবং বাজারমূল্যের মধ্যে যেটি কম সেটিকে সমাপনী মজুদের মূল্য হিসেবে ধরতে হবে।
বিশদ আয় বিবরণীতে সমাপনী মজুদ পণ্য বিক্রিত পণ্যের ব্যয় থেকে বাদ দিতে হয়। অপরদিকে এটি ব্যবসায়ের চলতি সম্পদ বিধায় উদ্ধৃত্তপত্রে চলতি সম্পদ হিসেবে লিখতে হয়।
উদাহরণ : সমাপনী মজুদ পণ্য ৫০০০০ টাকা যার বাজারমূল্য ৪০০০০ টাকা।
অবচয়:
ব্যবহারজনিত কারণে স্থায়ী সম্পদের মূল্যের অবনতিকে অবচয় বলে।
হিসাববিজ্ঞানের মিলকরণ নীতি অনুসারে অবচয় ধার্য করা হয়। এটি ধার্যের ফলে সম্পত্তি ও মালিকানাস্বত্ব হ্রাস পায়। অবচয় ধার্য না করলে সম্পত্তি ও মালিকানাস্বত্ব বেশি দেখানো হয়।
বিশদ আয় বিবরনীতে অবচয়ের টাকাকে পরিচালন ব্যয় হিসাবে দেখাতে হবে। অপরদিকে, উদ্ধৃত্তপত্রে একে সংশ্লিষ্ট স্থায়ী সম্পত্তি থেকে বাদ দিয়ে দিতে হবে।
উদাহরণ : স্থায়ী সম্পত্তির অবচয় ১০% ধার্য করা হলো।
অগ্রিম ব্যয়:
নির্দিষ্ট হিসাবকালের প্রদত্ত ব্যয়ের অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করলে তা অগ্রিম ব্যয় বলে গন্য হয়।
অগ্রিম ব্যয়কে বিশদ আয় ব্যয় বিবরণীর সংশ্লিষ্ট ব্যয় থেকে বাদ দিতে হবে এবং উদ্ধৃত্তপত্রের চলতি সম্পদ পাশে দেখাতে হবে।
উদাহরণ : অগ্রিম বীমা সেলামী প্রদান ১০০০০ টাকা।
অগ্রিম আয়:
পরবর্তী হিসাবকালের অর্থ যদি চলমান হিসাবকালে পাওয়া যায়, তাহলে তাকে বলা হয় অগ্রিম আয়।
বিশদ আয় বিবরণীতে সংশ্লিষ্ট আয় থেকে বাদ দিয়ে দেখাতে হবে এবং উদ্ধৃত্তপত্রে চলতি দায় হিসাবে প্রদর্শন করতে হবে।
উদাহরণ : অগ্রিম বাড়িভাড়া পাওয়া গেলো ৬০০০ টাকা।
বকেয়া ব্যয়:
চলমান হিসাবকালে শেষে যদি দেখা যায় যে কোনো একটি ব্যয় পরিশোধ করা হয়নি,তবে তা বকেয়া ব্যয় হবে। এটি বিশদ আয় বিবরণীতে ব্যয়ের সাথে যোগ হবে এবং উদ্ধৃত্তপত্রে চলতি দায়ের পাশে বসবে।
উদাহরণ : বাড়িভাড়া বকেয়া রয়েছে ৯০০০০ টাকা।
প্রাপ্য আয়:
হিসাবকালে আয় প্রাপ্য হওয়া সত্ত্বেও তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাওয়া না গেলে তাকে প্রাপ্য আয় বলে।
এটি বিশদ আয় বিবরণীতে সংশ্লিষ্ট আয়ের সাথে যোগ হবে এবং উদ্ধৃত্তপত্রে চলতি সম্পদরূপে আসবে।
উদাহরণ : বিনিয়োগের অনাদায়ী সুদ ৭০০ টাকা।
অনাদায়ী পাওনা:
দেনাদার বা প্রাপ্য হিসাবের নিকট থেকে যে পরিমাপ অর্থ আদায় করা সম্ভব নয় তাকে অনাদায়ী পাওনা বলে। সমন্বয়ে অনাদায়ী পাওনা থাকলে তা আয় ব্যায় বিবরণীতে পরিচালন ব্যয় হিসেবে আসবে। অপরপক্ষে, উদ্ধৃত্তপত্রে সংশ্লিষ্ট দেনাদার থেকে অনাদায়ী পাওনার অংশ বাদ যাবে।
উদাহরণ : অনাদায়ী পাওনা ধার্য হলো ৪০০ টাকা।
নোট : রেওয়ামিল এবং সমন্বয় দুই জায়গায়ই অনাদায়ী পাওয়া থাকলে বিশদ আয় বিবরণীতে দুটি একসাথে যোগ করে দেখাতে হবে।
আরো পড়ুন: সঞ্চয় কী? জেনে নিন টাকা সঞ্চয় করার ৭টি গুরুত্বপূর্ণ টিপস!
অনাদায়ী পাওনা সঞ্চিতি:
অনাদায়ী পাওনা হতে সৃষ্ট সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবিলা করার জন্য মুনাফার একটি নির্দিষ্ট অংশ অনাদায়ী পাওনা/ কূঋণ/ সন্দেহজনক পাওনা সঞ্চিতি হিসেবে তুলে রাখা হয়।
একেও বিশদ আয় বিবরণীতে ব্যয়ের খাতে এবং উদ্ধৃত্তপত্রে সংশ্লিষ্ট চলতি সম্পদ থেকে বাদ দিয়ে দেখানো হয়।
উদাহরণ :১০% অনাদায়ী পাওনা সঞ্চিতি ধরা হলো।
নোট: সমন্বয়ে অনাদায়ী পাওনা থাকলে তাকে প্রথমে দেনাদার থেকে বাদ দিতে হবে।তারপর সেই টাকার উপর সঞ্চিতি ধরতে হবে।
মালিক কর্তৃক পণ্য উত্তোলন :
মালিক যেকোনো প্রয়োজনে কারবার থেকে পণ্য উত্তোলন করতে পারে। পণ্য উত্তোলন সাধারণত সমন্বয়ে থাকে।
এক্ষেত্রে বিক্রিত পণ্যের ব্যয়ে ক্রয় থেকে পণ্য উত্তোলন বাদ দিয়ে দেখাতে হবে। আর মালিকানাসত্ব বিবরণীতে নগদ উত্তোলনের সাথে যোগ করে মূলধন থেকে বাদ দিয়ে দেখাতে হবে।
উদাহরণ :কারবার হতে মালিকের ছেলের স্কুল বেতন পরিশোধ করা হলো ২০০০ টাকা।
মূলধনের সুদ :
ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে মালিক যে পরিমাপ অর্থ দেয় তাকে মূলধন বলে। আমরা জানি, ব্যবসায়ে মালিকের সত্ত্ব এবং কারবারের সত্ত্ব সম্পূর্ণ আলাদা। তাই মূলধনকে ব্যবসায়ের দায় হিসেবে ধরা হয়। আর মুলধনের উপর কখনও কখনও সুদ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
আর্থিক বিবরণী তে মুলধনের সুদ ব্যয় হিসেবে এবং মালিকানাসত্ত্বে মূলধনের সাথে যোগ করে দেখানো হয়।
উদাহরণ : মুলধনের উপর ৮% সুদ ধার্য করা হলো।
উত্তোলনের সুদ :
মালিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান থেকে যে পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করে তাকে উত্তোলন বলে। অনেক সময় কারবার মালিকের নিকট থেকে এ উত্তোলনের উপর নির্দিষ্ট হারে সুদ আদায় করে।
এই উত্তোলনের সুদ অন্যান্য আয় বিবরণীতে আয় হিসাবে এবং মালিকানাসত্ব বিবরণীতে মূলধন থেকে বাদ দিয়ে দেখতে হবে।
উদাহরণ : উত্তোলনের উপর ৫% সুদ ধার্য করা হলো.
বিলম্বিত বিজ্ঞাপন :
মাঝেমধ্যে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান কিছু খাতে খরচ করে যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে মুনাফাজাতীয় অথবা এক বছরের জন্য মনে হলেও, এর সুযোগ সুবিধা একাধিক বছর পর্যন্ত পাওয়া যায়। বিলম্বিত বিজ্ঞাপন এমন একটি খরচ। এক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন খরচকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে অবলোপন করার নির্দেশনা দেওয়া থাকে।
আয় ব্যয় বিবরণীতে অবলোপনকৃত অর্থ ব্যয় হিসেবে এবং উদ্ধৃত্বপত্রে তা বাকী অংশ বা বিলম্বিত অংশ অলীক সম্পদ হিসেবে দেখানো হয়।
উদাহরণ : বিজ্ঞাপন খরচের দুই পঞ্চমাংশ বিলম্বিত করা হয়েছে( রেওয়ামিলে বিজ্ঞাপন দেওয়া আছে ১০০০০)
চুড়ান্ত হিসাব করতে গেলে এই সমন্বয়গুলো বারবার তোমাকে সমাধান করতেই হবে। যেহেতু এই অংকগুলো অন্য অধ্যায়ের অংকের চেয়ে তুলনামূলক বড়, তাই সব খুঁটিনাটি মনে রাখা একটু কষ্টকর। তবে বারবার অনুশীলনের মাধ্যমে অংকগুলো আয়ত্ত্বে আনা খুবই সম্ভব। কারণ ছোটবেলা থেকেই তো আমরা শিখে আসছি
“গাইতে গাইতে গায়েন, বাজাতে বাজাতে বায়েন”!
আমাদের কোর্সগুলোতে ভর্তি হতে ক্লিক করুন:
- Communication Masterclass by Tahsan Khan
- Facebook Marketing Course by Ayman Sadik and Sadman Sadik
- ঘরে বসে Spoken English Course by Munzereen Shahid
- Microsoft Office 3 in 1 Bundle
- English Grammar Crash Course by Sakib Bin Rashid
- ঘরে বসে Freelancing by Joyeta Banerjee
১০ মিনিট স্কুলের ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে সরাসরি চলে যেতে পারেন এই লিঙ্কে: www.10minuteschool.com
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন