নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে জল্পনা কল্পনার যেমন শেষ নেই তেমনি এ নিয়ে গুজবেরও অন্ত নেই। নতুন শিক্ষাক্রম ভালো না মন্দ সে বিতর্কে আজ যাব না। আজ নাহয় আমরা নতুন শিক্ষাক্রমকে যেভাবে সাজানো হয়েছে সে আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকি। এ পুরো ব্লগটি থেকে আপনারাই সিদ্ধান্ত নেবেন, কেমন হতে যাচ্ছে এ নতুন শিক্ষাক্রম।
নতুন শিক্ষাক্রমে বেশ কিছু নতুন বিষয় যেমন যুক্ত হয়েছে, তেমনি বাতিল হয়েছে অনেক পুরনো বিষয়। আবার, কিছু বিষয়কে ভিন্নরূপে এনে পুরো শিক্ষাক্রমকেই ঢেলে সাজানো হয়েছে। আমাদের নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে তৈরি এ ব্লগ সিরিজ আপনাকে পুরো বিষয়গুলো নিয়ে ধারণা দেবে।
তো চলুন, শুরু করা যাক আলোচনা!
নতুন শিক্ষাক্রম কেন জরুরি?
আমাদের পূর্ববর্তী পাঠ্যক্রমের দিকে তাকালেই নতুন শিক্ষাক্রমের গুরুত্ব অনুধাবন করা সম্ভব। পুরাতন বইগুলো সৃজনশীলতার জন্য তৈরি করা হলেও, প্রকৃতপক্ষে এগুলো তাত্ত্বিকভাবেই রয়ে গেছে। বাস্তবিক অর্থে পুরাতন বইগুলো দিয়ে সৃজনশীলতা চর্চার সুযোগ তেমন ছিল না। পাশাপাশি, মুখস্ত নির্ভর একটি শিক্ষাব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দেশে বিদ্যমান থাকায়, দেশে জ্ঞান চর্চার তেমন সংস্কৃতি গড়ে ওঠে নি। বরং মুখস্তবিদ্যাকে পূর্বের শিক্ষাক্রম প্রাধান্য দিত।
২০২৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জন। কিন্তু যদি আমরা এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো, ২০২৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৯২ হাজার ৫৯৫ জন। পার্থক্যটা এখানেই দৃশ্যমান। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় ভালো করেও এইচএসসি পরীক্ষায় এসে হোঁচট খায়। এজন্যই নতুন শিক্ষাক্রমে এই জায়গাগুলোতে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা সকলে একই বিষয় শিখবে। ফলে, বিজ্ঞান থেকে সামাজিক বিজ্ঞান, সকল জ্ঞানই শিক্ষার্থীরা পাবে। আবার, মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা তথা এসএসসি পরীক্ষাও শুধুমাত্র দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের উপর হওয়ায় শিক্ষার্থীদের উপর পরীক্ষার চাপ অনেকটাই কমবে। একই কাজ করা হয়েছে উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা তথা এইচএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রেও। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে যা মিলিয়ে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হবে।
নতুন শিক্ষাক্রমে হাতে কলমে প্রয়োগিক শিক্ষা ও বাস্তব জীবনের সাথে জড়িত শিক্ষাকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। পুরাতন শিক্ষাক্রমে বইগুলো শুধুমাত্র তাত্ত্বিক জ্ঞানের দিককে বিবেচনা করে বানানো হলেও এই ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবে নতুন পাঠ্যক্রমের বইগুলো। ফলশ্রুতিতে, নতুন পাঠ্যক্রম তৈরি করাটা জরুরি ছিল, বলাই বাহুল্য।
নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়সমূহ
নতুন শিক্ষাক্রমে সবগুলো বইই নতুনভাবে তৈরি করা হয়েছে সম্পূর্ণ নতুন সিলেবাস প্রণয়নের মাধ্যমে। নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়গুলো হলো:
বাংলা
বাংলা ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে সাহিত্য ও ব্যাকরণকে একিভূত করা হয়েছে। পাশাপাশি সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। পূর্বের ন্যায় শুধু গল্প ও কবিতায় সীমাবদ্ধ না রেখে সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এর বাইরে, শিক্ষার্থীদের নিজেদের সৃজনশীল লেখার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যাতে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে লেখালেখির অভ্যাস গড়ে তুলতে পারে।
এক্ষেত্রে, পূর্বের সিলেবাস অনুযায়ী শিক্ষার্থীকে একটি প্রেক্ষাপটের উপর ভিত্তি করে কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো। যাকে আমরা সৃজনশীল প্রশ্ন বলি। কিন্তু এখন সেরকম স্ট্রাকচার থাকছে না।
ধরা যাক, একজন শিক্ষার্থী একটি কবিতা বা গল্প পড়েছে। কবিতা বা গল্প পড়া শেষে শিক্ষার্থীকে পাঠ থেকে বিভিন্ন উচ্চারণ শেখানো হবে। কিংবা লেখা থেকে সাধু ও চলিত ভাষার পার্থক্য শেখানো হবে। অথবা লেখাটি পড়ে তাকে সংক্ষেপে প্রকাশ করা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রয়োগিক দিকগুলো শেখানো হবে। আবার, ছকের মাধ্যমে সেগুলো কতটা শিখেছে তা যাচাই করা হবে। শুধু তাই নয়, লেখায় যেসব বিষয় পড়বে, সেগুলো ইন্টারনেট বা বিভিন্ন সোর্স থেকে যাচাই করে ছক পূরণ করতে হবে এবং মতামত ও জিজ্ঞাসা থাকলে তা লিখতে হবে। ফলে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে পড়াশোনা করবে শিক্ষার্থীরা।
ইংরেজি
ভাষা ও যোগাযোগ বিষয়ক আরেকটি বই হলো ইংরেজি বিষয় নিয়ে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের আগের মতো মুখস্ত বিদ্যায় আটকে না রেখে সৃজনশীল লেখালেখির উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ইংরেজি বিষয়ে ভালো করার জন্য ভোকাবুলারি তথা শব্দ ভান্ডারকে যুক্ত করা হয়েছে। ফলে, শিক্ষার্থী যা পড়বে তা বুঝে বুঝে পড়তে পারবে। এর সাথে সাথে শ্রেণিভিত্তিক পর্যায়ক্রমে ইংরেজি ব্যাকরণ নিয়েও প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ইংরেজির ক্ষেত্রে পাঠ্যের শেষে সে পাঠ্য নিয়ে লেখকের মন্তব্য ও শিক্ষার্থীর নিজের মন্তব্য নিয়ে আলোচনা করার জন্য ছক দেয়া থাকে। ফলে, শিক্ষার্থীকে পাঠ্য পড়ে যেমন বুঝতে হবে তেমনি সেটা নিয়ে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাও তৈরি করতে হবে। অনেকক্ষেত্রে পাঠ্যের ব্যবহৃত শব্দ থেকে বাক্য তৈরির কাজ থাকে। এভাবেই শিক্ষার্থীরা টাস্কভিত্তিক পড়াশোনার মাধ্যমে শিখবে।
গণিত
গণিত বইটি পূর্বের গণিত বইয়ের আদলেই হচ্ছে। তবে, গণিতের পাশাপাশি অ্যানালিটিক্যাল অ্যাবিলিটি ও ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ে শিক্ষার্থীদের বিকাশ ঘটাতে বাড়তি কিছু সংযোজন হচ্ছে। নতুন এ বইয়ে বুঝে বুঝে গণিত শেখার পাশাপাশি বাস্তব অভিজ্ঞতার থেকে শেখার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে চিত্র সংযোজন ও বাস্তব জীবনের সাথে সংযুক্ত বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে সাজানো হয়েছে গাণিতিক বিষয়াবলী।
আগে দেখা যেত, একটি গাণিতিক সমস্যা কীভাবে সমাধান করতে হয় সেটা শিখলেই হতো। এখন সে জায়গা দখল করেছে, বাস্তব জীবনের সাথে কীভাবে এই সমস্যাটাকে যুক্ত করা যায়, সে বিষয়ে জানা। ফলে, শিক্ষার্থীরা গণিতকে অনুভব করতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়।
আবার, শিক্ষার্থীদেরকে অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে গণিতের বিষয়গুলোকে বাস্তবিক উপায়ে প্রয়োগ করার চর্চা করানো হচ্ছে এই নতুন শিক্ষাক্রমে। এসব বিষয় এ বইটিকে একটি সময়োপযোগী বই হিসেবে গড়ে তুলছে।
বিজ্ঞান
পূর্বের বিজ্ঞান বইয়ের আদলে হতে যাচ্ছে এই বিজ্ঞান বইটি। তবে, আনা হয়েছে আমূল পরিবর্তন। বিজ্ঞান যেন আগের মতো মুখস্ত ও তাত্ত্বিক না হয় সে লক্ষ্যে বাস্তবিক ও প্রয়োগিক দিকগুলোকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে হাতে কলমে শিক্ষা লাভ করবে।
এ লক্ষ্যে বিজ্ঞান বইকে দুইটি বইয়ে ভাগ করা হয়েছে।
- বিজ্ঞান: অনুসন্ধানী পাঠ
- বিজ্ঞান: অনুশীলন বই
বিজ্ঞান: অনুসন্ধানী পাঠ: এ অনুসন্ধানী পাঠ বইটি মূলত থিওরিটিক্যাল পড়াশোনার জন্য। কোনকিছু নিয়ে গবেষণা করতে হলে এর মূল বিষয় যেমন জানা প্রয়োজন তেমনি এই বই থেকে বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ জিনিস থেকে খুঁটিনাটি বিষয়াবলী সবকিছুই এখান থেকে শিক্ষার্থীরা শিখবে। তবে, অন্যান্য বইয়ের মতোই এখানেও পরিবর্তন এনে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে শিখন পদ্ধতি যুক্ত করা হয়েছে।
বিজ্ঞান: অনুশীলন বই: এ অনুশীলন বইটি শিক্ষার্থীর জন্য একটি ওয়ার্কশিট হিসেবে কাজ করবে। পুরো নবম শ্রেণি জুড়ে শিক্ষার্থীদের বেশ কিছু গবেষণাধর্মী কাজ করতে হবে। অনুসন্ধানী বই পড়তে পড়তে শিক্ষার্থীরা হাতে কলমে নানান বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। সে অভিজ্ঞতার আলোকে এই ওয়ার্কশিট ব্যবহার করে তারা তাদের এই গবেষণাভিত্তিক পড়াশোনা চালিয়ে যাবে।
ডিজিটাল প্রযুক্তি
ডিজিটাল প্রযুক্তি বইটি পূর্বের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বইয়ের নতুন রূপ। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বইটি নিয়ে শিক্ষার্থীদের সমালোচনার শেষ ছিল না মুখস্ত বিদ্যাকে প্রাধান্য দেয়ায়। তাই, নতুন এ বইটি এ সমস্যাগুলোকে কাটিয়ে উঠছে। নতুন বইটিতে পূর্বের মতো পুরাতন প্রযুক্তিকে বাদ দিয়ে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন টাস্ক দেয়ার মাধ্যমে প্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয়গুলোকে হাতে কলমে করার বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যেমন ধরা যাক, কী করে একটি গুগল ফর্ম তৈরি করে একটি স্টাডি করবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী শুধু বইয়েই বিষয়টি শিখবে না বরং হাতে কলমে কাজ করে শিখবে। এভাবেই বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তি বিষয়ক জ্ঞান অর্জন করবে।
জীবন ও জীবিকা
জীবন ও জীবিকা বিষয়টিতে শিক্ষার্থীদের প্রয়োগিক দিকে অভিজ্ঞ করে তোলা হবে যাতে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান শুধু বই-পুস্তকের জ্ঞানের মাঝেই সীমাবদ্ধ না থাকে। এই বইটি তৈরি হয়েছে শিক্ষার্থীদের স্কিল ডেভেলপমেন্ট করার উদ্দেশ্যে। ফলে, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কাজে দক্ষতা বৃদ্ধি হবে এর পড়াশোনা ও হাতে কলমে প্রয়োগের মাধ্যমে।
নতুন এ বইয়ে কীভাবে সংসারের বাজেট করা যায়, কীভাবে জমি কেনাকাটা করা যায়, জমি কেনাকাটার পর কীভাবে দলিল ও অন্যান্য নথি তথা ডকুমেন্ট ম্যানেজমেন্ট করতে হবে সেসব বিষয়, কীভাবে বিনিয়োগ করতে হবে ইত্যাদি বিষয় বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে বর্ণনা করা আছে। সেগুলো শেখার পর একজন শিক্ষার্থীকে কিছু টাস্কের মাধ্যমে আবার সেগুলো প্রয়োগ করতে হবে।
এভাবেই শিক্ষার্থীরা জীবন ও জীবিকার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো শিখবে। পাশাপাশি শিক্ষার্থী অবস্থায়ই ব্যবসার খুঁটিনাটি জেনে ব্যবসা শুরু করার বাস্তব জ্ঞান অর্জন করে নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য গড়ে তুলবে। এবং সবগুলো কাজই নিজেকে করতে হবে অর্থাৎ করতে করতে শিখবে।
ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান
আগে বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় নামের যে বইটি ছিল, অনেকটা তেমনই এই ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইটি। বইটিতে আলোচনা করা হয়েছে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, বাংলা অঞ্চলের ইতিহাস, বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংঘ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে।
তবে, পরিবর্তন আছে অনেক দিক দিয়েই। আগে শুধুমাত্র ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়ানো আর বোঝানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে এর বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে শিক্ষার্থীরা শিখবে। অনেক অধ্যায়ে শিক্ষার্থীরদের বিভিন্ন জরিপ করতে হবে তার আশেপাশের কিংবা এলাকার মানুষদের দিয়ে। এভাবেই তারা একটি জায়গায় মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো ও সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে জ্ঞান অর্জন করবে। সেটাও আবার নিজেদের হাতে কলমে কাজ করার মাধ্যমে। ফলে তাদের আর পূর্বের মতো মুখস্ত নির্ভর হতে হবে না।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা
পূর্বের শারীরিক শিক্ষা বইয়ের সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের যোগসূত্র ঘটিয়ে এই বইটি তৈরি করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল এটি জানলেও স্বাস্থ্য রক্ষা নিয়ে তেমন গুরুত্ব আমরা দিই না। আর, মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বললে, সেটি তো একদমই নয়।
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের মধ্যে তেমন কোন গুরুত্বই দেখা যায় না। আমরা শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যকেই গুরুত্ব দিয়ে অভ্যস্ত। এই চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটানোর প্রয়াসে এতে মানসিক স্বাস্থ্যকেও যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া, আগের মতো শারীরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা তো থাকছেই। সাথে থাকবে স্বাস্থ্য বিষয়ক বিস্তর আলোচনা।
বিভিন্ন কাজে শারীরিক ও মানসিক কীরকম প্রভাব পড়ে সেগুলো শিক্ষার্থীরা নিজেরাই ওয়ার্কশিটে তাদের দেয়া কাজ করতে করতে শিখবে। ফলে, নিজেরাই দেখতে পারবে কোন ধরণের কাজে নিজেদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় এবং কোন ধরণের কাজে নিজেদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়।
ইসলাম / হিন্দুধর্ম / বৌদ্ধধর্ম / খ্রিষ্টধর্ম শিক্ষা
এই বইটি পূর্বের ধর্ম ও নৈতিকতা বইয়ের আদলে তৈরি। তবে, এতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। ধর্মীয় শিক্ষা শুধু জ্ঞান অর্জনের জন্যই নয় বরং ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও এর প্রয়োগ রয়েছে। সে প্রয়োগের বিষয়টি মাথায় রেখেই এই বইয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতার সম্মিলন ঘটানো হয়েছে।
ধরা যাক, শিক্ষার্থীদের নামাজের বিষয়গুলো শেখানো হবে। পূর্বের বইয়ে নামাজ সম্মন্ধে জ্ঞান দেয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন শিক্ষার্থীদের নামাজ আদায় করে চেকলিস্ট পূরণ করতে হবে। ফলে, শিক্ষার্থীরা শুধু পড়বেই না বরং বাস্তবে সেই কাজগুলো করতে করতে শিখবে।
শিল্প ও সংস্কৃতি
শিল্প ও সংস্কৃতি বইতে শিক্ষার্থীদের শিল্প মননের বিকাশ ও সংস্কৃতিমনা করে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে একজন শিক্ষার্থী ছোট অবস্থা থেকেই তার সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়ে বেড়ে উঠবে।
সঙ্গীত চর্চা, নৃত্য চর্চা, কবিতা আবৃত্তি, চিত্র অংকন ইত্যাদি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বিষয়াবলীতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে সহায়তা করবে এই বই। হাতে কলমে শেখার কারণে এসব নিয়ে তারা বাস্তবে সাহিত্য চর্চার সুযোগ পাবে। আমাদের দেশে সাহিত্য চর্চাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হয় না আবার শেখার সুযোগটাও তেমন নেই। ফলে, এই বিষয়ের প্রয়োগ অনেক শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের সাহিত্যিক হওয়ার স্বপ্নের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করবে।
নতুন শিক্ষাক্রমে বিষয়ভিত্তিক কী কী পরিবর্তন?
নতুন শিক্ষাক্রমে বলা যায় পূর্বের শিক্ষাক্রমের প্রায় সবই বদলে দিয়ে ঢেলে সাজানো হয়েছে। এখানে তার কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হলো।
নতুন শিক্ষা কাঠামো
নতুন শিক্ষা কাঠামো পূর্বের কাঠামো থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন থেকে নবম শ্রেণিতেই শিক্ষার্থীদের বিভাগ পছন্দ করতে হবে না। বরং নবম ও দশম শ্রেণিতেও পর্যন্ত আগের মতো গ্রুপভিত্তিক বিষয় না রেখে সকলে একই বিষয়ে পড়াশোনা করবে।
বিভাগ পছন্দ করতে হবে উচ্চমাধ্যমিক তথা কলেজ ভর্তির সময়। তখন শিক্ষার্থীরা আগের মতো বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা থেকে পছন্দমতো নিজের বিভাগ বেছে নিতে পারবে।
নতুন সিলেবাস
পূর্বের সিলেবাস বাতিল করে সম্পূর্ণ নতুন সিলেবাস প্রণয়ন করা হয়েছে। পুরাতন সিলেবাস বই পুস্তক ভিত্তিক থাকায় নতুন সিলেবাসে ক্লাসরুমের বাইরে শিক্ষার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। ফলে, শিক্ষার্থীরা জ্ঞান অর্জনে কোন গণ্ডির মধ্যে আটকে না থেকে সৃজনশীল ও চিন্তাশীল মানুষ হতে শিখবে। নতুন সিলেবাসে পড়াশোনা হবে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে। শিক্ষার্থীরা বই পড়ে সে অনুযায়ী বাস্তব জগতে কাজগুলোর বাস্তবায়ন করবে। এগুলোর মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হবে।
নতুন পাঠ্যবই
নতুন সিলেবাসের উপযোগী করতে বইগুলোকেও সম্পূর্ণ নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। এমনকি পূর্বের বইয়ের বিষয়বস্তুও বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ নতুনভাবে বইগুলো সাজানো হয়েছে। পূর্বের সিলেবাসের সাথে এখানে মূল পার্থক্যটিই হলো, পূর্বে বাস্তব অভিজ্ঞতাভিত্তিক পড়াশোনা ছিল না। সম্পূর্ণ পড়াশোনাই ছিল বই কেন্দ্রিক। এখন থাকে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জগতে কাজ করতে করতে শিখবে। থাকবে না আগের মতো পরীক্ষা ভীতি।
নতুন শিখন পদ্ধতি
নতুন শিখন পদ্ধতিতে পড়াশোনা এখন আর ক্লাসে এবং বইয়ের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে না। নতুন শিখন পদ্ধতিতে হাতে কলমে প্রয়োগিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি, শিক্ষার্থীদের বুঝে বুঝে পড়ে সেটা বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে শেখার করে বইগুলো তৈরি করা হয়েছে।
নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি
শুধু যে সিলেবাস, বই, শিখন পদ্ধতি বদলে গেছে, তা কিন্তু নয়। এখন থেকে পরীক্ষা পদ্ধতিও বদলে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের কোন পরীক্ষা দিতে হবে না। তার বদলে থাকবে পর্যায়ক্রমিক মূল্যায়ন। পর্যায়ক্রমিক মূল্যায়নে শিক্ষার্থীদের বইয়ে উল্লিখিত বিভিন্ন কাজ হাতে কলমে করে শিখতে হবে। সাথে থাকবে উপস্থিতি ও অন্যান্য বিষয়ের উপর নম্বর। অর্থাৎ, পরীক্ষার চাপ কমাতে পরীক্ষার চেয়ে পর্যায়ক্রমিক মূল্যায়নে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ফলে, শিক্ষাথীরা আনন্দের সাথে শিখবে।
অন্যদিকে, পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষা আর হবে না। এসএসসি পরীক্ষা হবে শুধু দশম শ্রেণির সিলেবাসের উপর এবং এইচএসসি পরীক্ষা হবে দুই ভাগে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে। দুটো পাবলিক পরীক্ষার ফল গড় করে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হবে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রতি দীর্ঘকালের ভয়ের অবসান ঘটবে, বলাই যাচ্ছে।
নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি
আগের মতো যেহেতু আর পরীক্ষা নেই সেহেতু এখনকার মূল্যায়নে নম্বর যুক্ত হবে না। এখন ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বৃত্ত এসব আকৃতির মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করা হবে। এসব আকৃতির অর্থ:
- চতুর্ভুজ: সাধারণ – শিক্ষার্থীর যত্ন নেয়া প্রয়োজন।
- বৃত্ত: মধ্যম – শিক্ষার্থীর উন্নতি হচ্ছে।
- ত্রিভুজ: উত্তম – শিক্ষার্থীর সর্বোত্তম উন্নয়ন হয়েছে।
কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা
-
নতুন শিক্ষাক্রম কী?
নতুন শিক্ষাক্রম হলো ২০২৩ সাল থেকে বাংলাদেশের শিক্ষাক্রমে সংযোজিত শিক্ষাক্রম যা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে ক্লাসের গণ্ডির মধ্যে শেখার জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে প্রয়োগিকভাবে শেখার দিকটিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তবে, এ নিয়ে বেশ আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে যাতে অভিভাবকগণ মনে করছেন, নতুন শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা বিমুখ করছে।
-
নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়গুলো কী কী?
নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়গুলো হচ্ছে:
- বাংলা
- ইংরেজি
- গণিত
- বিজ্ঞান
- ডিজিটাল প্রযুক্তি
- ধর্ম শিক্ষা
- জীবন ও জীবিকা
- ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান
- স্বাস্থ্য সুরক্ষা
- শিল্প ও সংস্কৃতি
-
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠছে কেন?
নতুন শিক্ষাক্রমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, পরীক্ষার চাপ কমিয়ে দেয়া। তার বদলে এখানে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ধারাবাহিক মূল্যায়ন তথা “কন্টিনিউয়াস অ্যাসেসমেন্ট” কে। পাশাপাশি, এখানে মুখস্ত নির্ভরতা ও গাইড বই নির্ভরতা কমিয়ে আনার পরিকল্পনায় পাঠ্যক্রম সাজানো হয়েছে।
কিন্তু অভিভাবকদের মতে, পরীক্ষার চাপ কমানোতে পড়াশোনা করছে না শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি, অ্যাসাইনমেন্ট করার নামে প্রচুর টাকা ও সময় অপচয় করা হচ্ছে। এবং অনেকক্ষেত্রে শিক্ষকদের হাতে নম্বর দেয়ার ক্ষমতা চলে আসায় শিক্ষকরা স্বেচ্ছাচারিতা করে বলেও অনেকে অভিযোগ করেছে। এসব নিয়েই নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠছে জনমনে।
নতুনরূপে অনলাইন ব্যাচ ২০২৪ (৬ষ্ঠ-১০ম শ্রেণি)
কোর্সটিতে যা যা পাচ্ছেন:
-
নতুন শিক্ষাক্রম কেন করা হয়েছে?
নতুন শিক্ষাক্রম করার মূল কারণ হচ্ছে, শিক্ষার্থীদেরকে শুধুই গৎবাঁধা নিয়মের পড়াশোনায় বেঁধে না রেখে বইয়ের জ্ঞানের পাশাপাশি বাস্তবমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার চাপ থেকে বের করে আনা হয়েছে পর্যায়ক্রমিক মূল্যায়ন তথা “কন্টিনিউয়াস অ্যাসেসমেন্ট” যুক্ত করার মাধ্যমে। ফলে, শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাকেন্দ্রিক পড়াশোনার থেকে বের করে এনে সারাবছরই আনন্দের সাথে পড়াশোনার সাথে যুক্ত রাখা হচ্ছে।
-
নতুন শিক্ষাক্রমের সুবিধা কী?
নতুন শিক্ষাক্রমের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এতে শিক্ষার্থীদের মুখস্ত ও গাইড বই নির্ভরতা কমবে। ফলে, শিক্ষার্থীরা নিজেদের সৃজনশীলতা ও চিন্তাশীলতার বিকাশ ঘটাতে পারবে। পাশাপাশি তারা লাভ করবে বাস্তব অভিজ্ঞতা। এর বাইরে, পরীক্ষার চাপ থেকে শিক্ষার্থীদের অনেকটাই রেহাই দেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে পাঠ্য বইগুলোও সেভাবেই সাজানো হয়েছে।
বইয়ে বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিষয়গুলোকে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে অনুধাবন করে সে অনুযায়ী প্রয়োগ করার প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। ফলে, আনন্দের সাথে শেখার সুযোগ তৈরি হবে বলে আশা রাখা যায়।
-
নতুন শিক্ষাক্রমের সমস্যাগুলো কী?
নতুন শিক্ষাক্রম বেশ কিছু দিক দিয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের দ্বারা সমালোচিত হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমের প্রধান সমস্যাগুলো হলো:
- শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা বিমুখ ও মোবাইল কেন্দ্রিক গড়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে।
- শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের পর্যাপ্ত প্রয়োগ নিয়ে চিন্তার জায়গা তৈরি হচ্ছে।
- শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।
- শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণার অভাব রয়েছে।
শেষ কথা
নতুন শিক্ষাক্রমে প্রায় সবকিছুই এতটা পরিবর্তিত হয়েছে যে, সকলের মনে এ নিয়ে প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক। নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। এ লেখাটিতে নতুন শিক্ষাক্রমের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি, শিক্ষাক্রম নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তরও দেয়া হয়েছে। নতুন এ শিক্ষাক্রমটির সঠিক প্রয়োগ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে অনেক এগিয়ে নেবে তা বলাই বাহুল্য। আর ভুল প্রয়োগ পূর্বের সৃজনশীল ভিত্তিক শিক্ষাক্রমের মতোই মুখ থুবড়ে পড়বে।
তাই, নতুন এ শিক্ষাক্রমের সঠিক প্রয়োগই আমাদের কাম্য। আশা করা যায়, সময়ের সাথে সাথে নতুন শিক্ষাক্রমটি সৃজনশীল ও মেধাবী শিক্ষার্থী তৈরির সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।
নতুন কারিকুলাম নিয়ে বিস্তারিত জানতে দেখে নিন আমাদের এই ব্লগ গুলো:
- এক নজরে নতুন শিক্ষাক্রম ২০২৪: জানার আছে যা কিছু
- বাংলাদেশের শিক্ষাক্রমের একাল-সেকাল
- নতুন কারিকুলামে একক ও দলীয় কাজ
নতুন কারিকুলামে ৬ষ্ঠ-৯ম শ্রেণির পড়ালেখা নতুন উদ্যমে শুরু করতে টেন মিনিট স্কুল নতুনরূপে নিয়ে এসেছে ‘অনলাইন ব্যাচ ২০২৪’:
তথ্যসূত্র:
- জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২
- জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১
- শিক্ষায় আসবে যেসব পরিবর্তন | দৈনিক ইত্তেফাক
- শিক্ষক বাতায়ন
১০ মিনিট স্কুলের ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে সরাসরি চলে যেতে পারেন এই লিংকে: www.10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন