ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী এবং ঢাকা বিভাগের প্রধান শহর। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মেগাসিটি নামেও খ্যাতি আছে ঢাকার। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত ঢাকা আয়তন ও জনসংখ্যার- উভয় দিক দিয়েই বাংলাদেশের বৃহত্তম শহর। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরের জনসংখ্যা প্রায় ১.৫ কোটি। প্রায় দেড় কোটি মানুষের ঢাকা জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের নবম এবং সর্বাপেক্ষা জনবহুল শহরগুলোর মধ্যে একটি। বাহিরের জগতের কাছে ঢাকা পরিচিত মসজিদের শহর, রিকশার রাজধানীর মত হাজারো নামে পরিচিত। আধুনিক ঢাকা গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী এক ইতিহাস। সেই মোঘল আমল থেকে সিরাজউদ্দৌলা, সেখান থেকে পাকিস্তানী শাসনের পর মুক্তিযুদ্ধ এবং সবশেষে আধুনিক ঢাকা- অল্প সময়ের মধ্যেই ঢাকা নিজের ঝুলিতে পুরেছে বেশ কিছু ইতিহাস।
ঢাকার নামকরণের ইতিহাস:
ঢাকার নামকরণের সঠিক ইতিহাস নিয়ে ব্যাপক মতভেদ রয়েছে। কথিত আছে যে সেন বংশের রাজা বল্লাল সেন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভ্রমণকালে সন্নিহিত এক জঙ্গলে দেবী দুর্গার একটি মূর্তি খুঁজে পান। দেবী দুর্গার প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ রাজা বল্লাল সেন ঐ এলাকায় একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। যেহেতু দেবীর বিগ্রহ বা মূর্তি গুপ্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিলো, তাই বল্লাল সেন সেই মন্দিরের নামকরন করেন ঢাকেশ্বরী মন্দির। মন্দিরের নাম থেকেই কালক্রমে স্থানটির নাম ঢাকা হিসেবে গড়ে ওঠে।
অনেক ঐতিহাসিকদের মতে, মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর যখন ঢাকাকে সুবা বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন, তখন সুবাদার ইসলাম খান আনন্দের বহিঃপ্রকাশসরূপ শহরে ঢাক বাজানোর নির্দেশ দেন। এই ঢাক বাজানোর কাহিনী লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা থেকেই এই শহরের নাম ঢাকা হয়ে যায়।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ঢাকার জুড়ি মেলা ভার। ধারণা করা হয়, কালের বিবর্তনে ঢাকা প্রথমে সমতট, পরবর্তীতে বঙ্গ-গৌড় প্রভৃতি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে মুসলমানেরা ঢাকা দখলে নিয়ে নেয়। মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের ফরমান অনুযায়ী, ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুলাই ঢাকাকে সুবা বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেসময়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামানুসারে ঢাকার নাম জাহাঙ্গীরনগর রাখা হয়। সম্রাট জাহাঙ্গীর যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন ঢাকার এই নাম বজায় ছিল।
রাজধানী ঢাকার ইতিহাস:
পূর্বে সম্রাট আকবরের আমলে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার প্রাদেশিক রাজধানী ছিলো বিহারের রাজমহল। সুবা বাংলায় তখন চলমান ছিল মোঘল বিরোধী স্বাধীন বারো ভুঁইয়ার রাজত্ব। বারো ভুঁইয়ার হাত থেকে বাংলাকে মুক্ত করতে ১৫৭৬-১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বারংবার চেষ্টা চালানো হয়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম খান চিশতীকে রাজমহলের সুবাদার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তিনি ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার ভৌগলিক অবস্থান বিবেচনা করে রাজধানী বিহারের রাজমহল থেকে সরিয়ে ঢাকায় স্থাপন করেন। সুবাদার ইসলাম খান চিশতীর দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ৫ বছরের মাথায় বারো ভুঁইয়াদের পতন ঘটে ও বর্তমান চট্টগ্রামের কিছু অংশ বাদে পুরো সুবা বাংলা মোঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা সুবা বাংলার রাজধানী হলেও সুবা বাংলার রাজধানী বার বার পরিবর্তন করা হয়েছে। ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে সুবাদার শাহ সুজা রাজধানী আবার বিহারে স্থানান্তর করেছিলেন। শাহ সুজার পতন ঘটলে ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে সুবাদার মীর জুমলা আবার ঢাকাকে রাজধানী হিসেবে আখ্যা দেন। এরপর বেশ কয়েকবছর ঢাকার অধীনে রাজধানীর মর্যাদা থাকে। ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে সুবাদার মুর্শিদকুলি খান রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থাপন করেন। ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার রাজধানী ছিলো কলকাতা, ঢাকা নয়। বঙ্গভঙ্গের পর ১৯০৫ সালে ঢাকাকে আসাম ও বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
আরো পড়ুন: বিশ্ব কাঁপানো পাঁচটি অমর ছবি
শিক্ষিত ঢাকার ইতিহাস:
সময়টা তখন ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দ, ১৫ই জুলাই। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের তত্ত্বাবধানে দুজন বিশিষ্ট শিক্ষক জে. রিজ ও পার্বতীচরণ চট্টোপাধ্যায় স্থানীয় বিদ্যানুরাগীদের নিয়ে ৬ হাজার টাকার সরকারী সহায়তায় ঢাকার সদরঘাটের কাছে ইংলিশ ফ্যাক্টরি হাউজের পুরনো দোতালা বাণিজ্য কুঠি ভাড়া নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি সরকারী ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যার নাম দেয়া হয়েছিলো ঢাকা গভর্নমেন্ট স্কুল। এই স্কুলই ছিলো গোটা উপমহাদেশের প্রথম সরকারী ইংরেজী স্কুল। সেসময় স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন জে. রিজ ও পার্বতীচরণ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সহকারী প্রধান শিক্ষক। ১৮৪১ সালে এই স্কুল থেকেই জন্ম হয় দেশের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজ। সেসময় ঢাকা কলেজ ছিলো পুরো ভারত উপমহাদেশের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
স্কুল শাখাটির নাম পাল্টে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল রাখা হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা কলেজ থেকেই জন্ম নিয়েছিলো বর্তমানে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামের খ্যাতি পাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকার মাটিতে শিক্ষাবিস্তারের এই বংশ পরম্পরা ছিলো তখনকার বাংলায় শিক্ষাবিপ্লব।
হরেক নামের ঢাকার ইতিহাস:
ঢাকার বিভিন্ন অংশের নামকরণের পেছনেও কিন্তু রয়েছে নানা ইতিহাস। তেমনি কয়েকটি হলো-
ইন্দিরা রোড:
এই এলাকায় এককালে এক হিন্দু ভদ্রলোক নিজের একটি বিশাল অট্টালিকা নির্মাণ করেন, সঙ্গে নির্মাণ করেন অট্টালিকার গা ঘেঁষা এক সড়ক। তিনি তার বড় মেয়ে ইন্দিরার নামে সড়কটির নামকরণ করেন, যা এখন ইন্দিরা রোড নামে পরিচিত।
পিলখানা:
বন্য হাতিদের পোষ মানানোর জায়গাকে মূলত পিলখানা বলা হয়। বর্তমানে বিজিবির সদর দপ্তর অবস্থিত পিলখানা স্থানে ইংরেজ শাসনামলের ব্যবহৃত হাতিদের পোষ মানানো হতো। এই স্থানটি ছিলো সেই সময়ের সর্ববৃহৎ পিলখানা।
এলিফ্যান্ট রোড:
পিলখানা থেকে হাতির বহরকে গোসলের জন্য নিয়ে যাওয়া হতো বর্তমানের হাতিরঝিল নামক স্থানে। যে রাস্তা দিয়ে হাতিগুলোকে নেয়া হতো, সেই রাস্তার নাম দেয়া হয়েছিলো এলিফ্যান্ট রোড। পথের মাঝে ছোট একটি পুল ছিলো। পুল শুনেই বুঝতে পারছো যে জায়গাটির নাম হাতিরপুল।
কাকরাইল:
উনিশ শতকের শেষ দিকে ঢাকার কমিশনার ছিলেন মিস্টার ককরেল। শহরে নতুন এক এলাকা তৈরি করে কমিশনার নামকরণ করেন কাকরাইল।
রমনা পার্ক:
বিরাট ধনাঢ্য ব্যাক্তি ছিলেন রমনাথ বাবু। তিনি রমনা কালীমন্দির নামে বিশাল এক মন্দির তৈরি করেন। মন্দির সংলগ্ন ছিলো বিশাল এক বাগান, সঙ্গে খেলাধুলার জায়গা। এভাবেই গড়ে ওঠে রমনা পার্ক।
পল্টন:
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক প্লাটুন সেনাবাহিনী ছিল এই স্থানে। প্লাটুন শব্দ থেকেই পল্টন নামটির আবির্ভাব। পরবর্তীতে এই পল্টনকে দুইভাগে ভাগ করে নয়াপল্টন ও পুরাতন পল্টন নাম দেয়া হয়। নয়াপল্টন ছিল আবাসিক এলাকা এবং পুরান পল্টন ছিল বাণিজ্যিক এলাকা।
ধানমন্ডি:
ধানমন্ডি এলাকায় একসময় হাট বসতো, যা বিখ্যাত ছিল ধান ও অন্যান্য শস্য বিক্রয়ের জন্য।
ফার্মগেট:
কৃষি উন্নয়ন, কৃষি ও পশুপালনের জন্য ব্রিটিশ সরকার ঢাকায় একটি ফার্ম বা খামার তৈরি করে। সেই ফার্মের প্রধান ফটক বা গেট থেকে এই এলাকার নাম ফার্মগেট করা হয়। ফার্মগেটেই বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট অবস্থিত।
ডাক্কা থেকে ঢাকার ইতিহাস:
আজকে আমরা যেভাবে ঢাকা উচ্চারণ করি বা বইপত্রে লেখা দেখি, তা কিন্তু এসেছে খুব বেশিদিন হয়নি। ঢাকার জন্মের পর থেকেই এর উচ্চারণ ঢাকা না হয়ে বরং ছিলো “ডাক্কা।” এমনকি ইংরেজী বানানেও ছিলো Dacca । পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। এরপর কেটে যায় ১১ বছর। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকার ঢাকার সরকারী নাম “ডাক্কা (Dacca)” থেকে পরিবর্তন করে “ঢাকা (Dhaka)” রাখে।
ঢাকার অন্যান্য ইতিহাস:
মসলিন:
ঢাকার নামের সাথে সাথেই একটা সময় ভেসে আসতো মসলিনের নাম। শোনা যায়, ঢাকাইয়া মসলিন এতটাই পাতলা ছিলো এবং এর কারুকাজ এতটাই সূক্ষ্ম ছিলো যে একটি মসলিন শাড়ি ভাঁজ করে ছোট একটি ম্যাচের বাক্সে অনায়েসেই ভরে রাখা যেত। ভাবতেও অবাক লাগে, তাই না? তারপরের কাহিনীটাও অনেকেরই জানা। ব্রিটিশরা ঢাকার মসলিনকে তাদের দেশে নিয়ে যায় এবং এখানকার কারিগরদের হাত কেটে দেয় যেন তারা পুনরায় মসলিন বানাতে না পারে।
বিউটি বোর্ডিং:
পুরান ঢাকায় অবস্থিত এই হোটেলটি ঢাকার ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। উপমহাদেশের বিখ্যাত বিভিন্ন কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, রাজনীতিবিদের পদচারনার সাক্ষী এই বিউটি বোর্ডিং। বাংলা সাহিত্যে যখনই ঢাকার কথা এসেছে, তখনই চলে এসেছে বিউটি বোর্ডিং এর নাম। বিউটি বোর্ডিং এ পাওয়া যায় আদি ঢাকা ও কোলকাতার নানান খাবারের পদ।
তারা মসজিদ:
আহসান মঞ্জিল, লালবাগের কেল্লা, সংসদ ভবনের মত স্থাপত্যগুলোতো আমরা কমবেশি সকলেই চিনি। তবে এমন একটি স্থাপনা রয়েছে, যা খুব বেশি একটা মানুষের কাছে জানা না থাকলেও প্রথম প্রজন্মের ঢাকার চাক্ষুষ নিদর্শন, আর সেটি হলো তারা মসজিদ। ঢাকার আরমানিটোলায় অবস্থিত এই মসজিদ ঢাকার মাটিতে মোঘল স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। ১৯২৬ সালে এই মসজিদের পুনর্নির্মাণ করা হয় এবং ১৯৮৭ সালে এই মসজিদ বর্ধিত করা হয়। এই মসজিদটি স্থাপন করেন ঢাকার বিখ্যাত জমিদার মির্জা গোলাম পীর।
হাজী বিরিয়ানি:
তখন ভারতবর্ষ ইংরেজদের দখলে, সাল ১৯৩৯। হাজী মোহাম্মদ হোসেনের হাত ধরে ঢাকার বুকে গড়ে ওঠে হাজী বিরিয়ানি নামক এক রেস্তোরা। এই রেস্তোরার বিশেষত্ব ছিলো এই যে, এখানে উন্নত চালের ভাত খাসির মাংসের সাথে বিক্রি করা হতো। কালক্রমে এই খাবার রূপ নেয় মোঘল আমলের বিরিয়ানির সাদৃশ। ঢাকার ইতিহাসের সাথে হাজী বিরিয়ানি এতটাই ব্যাস্ত যে কয়েকদিন আগে এই বিরিয়ানি বিশ্বখ্যাত ফুড রিভিউয়ার ট্রেভর জেমস ঢাকায় ছুটে এসেছে শুধুমাত্র এই বিরিয়ানির টানে।
বর্তমান সময়ে ঢাকায় রয়েছে নানান সমস্যা, রয়েছে দীর্ঘ যানজটের ক্লান্তি, অপরিকল্পিত নগরায়নের থাবা, দূষণে জর্জরিত এক শোকগাথা। কিন্তু তবুও, এই শহরের ইতিহাস গায় ঢাকার জয়গান, এখানের ইতিহাস বলে ঢাকার রূপকথা। চিরকুট ব্যান্ড আছেনা? ঢাকাকে নিয়ে ওদের গানটি ঠিক যেন উপরের লেখাগুলোকেই মিরর ইমেজ…
Microsoft Office 3 in 1 Bundle
কোর্সটি করে যা শিখবেন:
“এই শহর, জাদুর শহর, প্রাণের শহর ঢাকা রে”
Source:
http://www.fsmitha.com/h2/y26dcca.html
https://www.encyclopedia.com/places/asia/bangladesh-political-geography/dhaka
https://en.wikipedia.org/wiki/Dhaka
আমাদের কোর্সগুলোতে ভর্তি হতে ক্লিক করুন:
- Communication Masterclass by Tahsan Khan
- Facebook Marketing Course by Ayman Sadik and Sadman Sadik
- ঘরে বসে Freelancing by Joyeta Banerjee
- ঘরে বসে Spoken English Course by Munzereen Shahid
- Microsoft Office 3 in 1 Bundle
- Microsoft Word Course by Sadman Sadik
- Microsoft Excel Premium Course
- Microsoft PowerPoint Course by Sadman Sadik
১০ মিনিট স্কুলের ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে ভিজিট করুন: www.10minuteschool.com
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন