প্রাচীনকালে মঞ্চ নাটকে ব্যক্তির চারিত্রিক রূপ ফুটিয়ে তোলার জন্য নানা ধরনের মুখোশ ব্যবহৃত হত। অর্থাৎ মানুষের ভেতরের স্বত্তাকে তার মুখোশের মাধ্যমে প্রকাশ করার চেষ্টা করা হতো। সনাতন ঢঙে কুমোরদের মাটির পাত্র বানানোর দৃশ্য সবাই দেখেছেন। ঘুর্ণায়মান লাজুক কাঁদা মাটির ছাঁচ হাতের আলতো ছোঁয়ায় নিমেষেই ফুলদানি! ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের সেই ছাঁচটিও আসলে জন্মগতভাবে প্রাপ্ত (জেনেটিক) প্রবণতাতেই মোড়ানো থাকে। প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির স্বাভাবিক ব্যক্তিত্বের সুনির্দিষ্ট ধরন শৈশব থেকে বয়সন্ধি কালের পরিবারিক, সামাজিক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের নানান অভিজ্ঞতার আলোকে গড়ে ওঠে। অনেকটা কুমোরের সেই শৈল্পিক হাতের ছোঁয়ার মতন। তাতে কেউ হন রবীন্দ্রনাথ, আর কেউ হন ক্ষ্যাপাটে নজরুল!
এমন একটি মানসিক রোগ আছে, যার কারণে একজন মানুষ বাস করতে পারে প্রায় ১০০টির মতো বিচ্ছিন্ন সত্ত্বা নিয়ে। এই রোগের নাম Dissociative Identity Disorder বা মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার বা বহুসত্ত্বা রোগ।
আমরা প্রত্যেকেই জীবনের কোনো না কোনো সময় হয়তো বিচ্ছিন্নতা অনুভব করেছি। হয়ত কথা বলতে বলতে বা কাজ করতে করতেই হঠাৎ কোথাও হারিয়ে গিয়েছি, যাকে আমরা পোশাকি ভাষায় দিবাস্বপ্ন বলে থাকি। কিন্তু Dissociative Identity Disorder দিবাস্বপ্ন থেকে অনেক বেশি কিছু, যার ফলে মানুষের চিন্তা-ভাবনা ও অন্যান্য কাজের সাথে তার একটি বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। এই রোগে একজন মানুষের মধ্যে একাধিক ব্যক্তিত্বের প্রকাশ পায়। তা হতে পারে কোনো কাল্পনিক মানুষের, কোনো কল্পনার চরিত্রের, এমনকি কারো কারো মাঝে পশুপাখির স্বভাবও দেখা যায়! মানুষটি অনেকগুলো সত্ত্বার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলে, নিজেকে আর আলাদা করতে পারে না।
ঐ বিচ্ছিন্ন সত্ত্বাগুলো রোগীকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এবং যখন সে স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে, নিজের অন্য সত্ত্বাগুলো সম্পর্কে তার কিছু মনেও থাকে না, তার মনে হয় সে কোথাও হারিয়ে গিয়েছিল। একে সাইকোলজির ভাষায় ‘ব্ল্যাক আউট’ বলা হয়। একজনের মাঝে দু’য়ের অধিক ব্যক্তিত্বও দেখা যায়। এর সংখ্যা হতে পারে প্রায় ১ থেকে ১০০। তাই একে ‘মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার’ও বলা হয়।
লক্ষণ:
১। রোগী তার ব্যক্তিগত তথ্যগুলো ভুলে যেতে থাকে, যা সাধারণত তার ভুলে যাওয়ার কথা না ।
২। রোগী অনেক সময় অনুভব করে সে তার শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে ।
৩। তার মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা ও প্রচুর পরিমাণে হতাশা থাকে।
৪। মুড সুইং হয় প্রতিনিয়ত।
৫। ঘুমের সমস্যা দেখা যায়, যেমন– ঘুম হয় না, ঘুমের মাঝে ভয় পাওয়া, ঘুমের মাঝে হাঁটা ইত্যাদি ।
৬। অস্থিরতা, প্যানিক অ্যাটাক ও বিভিন্ন ধরনের ফোবিয়া দেখা যায়; যেমন– পুরনো স্মৃতি মনে পড়া এবং সেগুলোর প্রতি বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখানো।
৭। বিভিন্ন ড্রাগের প্রতি আসক্তি দেখা যায়।
৮। অনেক সময় হ্যালুসিনেশন হতে দেখা যায়।
পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় সাধারণ মানুষের মধ্যে মাত্র ০.০১% থেকে ১% এ রোগে আক্রান্ত। নারীদের মধ্যে এ রোগ বেশি দেখা যায়। বিচ্ছিন্নতাকে গাঢ় করে দেখলে, প্রায় ১ তৃতীয়াংশ মানুষ বলে থাকে, তারা অনুভব করে, তারা তাদের নিজেদের সিনেমায় দেখছে! এবং প্রায় ৭% মানুষ কোনো সনাক্তকরণ ছাড়াই মনে করে যে তাদের রোগটি রয়েছে!
সন্দেহ আমাদের জীবনের একটি অংশ। আমরা সন্দেহ করতে না চাইলেও এই ব্যাপারটি আমাদের সাথে ঘটে থাকে। এটি মূলত আমাদের স্বভাবগত সমস্যা। মন খুব বেশি সন্দেহপ্রবণ হলে তা আমাদের জীবনে নানা রকমের সমস্যা তৈরি করে। সন্দেহের কথা লিখতে গিয়েই জন পুল বলেছিলেন-
“সন্দেহপ্রবণ লোকেরা ক্রমশই নিঃশঙ্গ হয়ে পড়বে।“
প্যারানয়েড পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারে ভোগা মানুষদের সাথে এই উক্তিটি যেন একেবারে মিশে যায়। এই ডিসঅর্ডারে ভুক্তভোগী শ্রেণির মানুষ কারণ ছাড়াই অতিমাত্রায় সন্দেহ প্রবণ হয়। কাউকে বিশ্বাস করতে না পারা, খুব তুচ্ছ সাধারণ বিষয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, অনুমান নির্ভর নেতিবাচক মূল্যায়ন, সবকিছুতে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া প্রভৃতি তাদের নিত্যনৈমিত্যিক আচরণ হয়ে দাঁড়ায়।
আবার অনেকে সামাজিক যোগাযোগের বিষয়ে বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন বা আগ্রহী থাকেন না। কারো প্রশংসা বা বিরক্তিতেও তার ভ্রুক্ষেপ নেই। বন্ধু বান্ধবহীন একাকিত্বই যেন তার একমাত্র সঙ্গী। সন্দেহ একধরণের অভ্যাস, পাশাপাশি বড় ধরনের মানসিক রোগও। দিনকে দিন আমাদের আশেপাশে এই পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারে ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এই ডিসঅর্ডার থেকে উত্তরণের জন্য কিছু করণীয় আছে, জেনে নিন।
উপলব্দি
পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারের এসব বৈশিষ্ট্য আমাদের প্রত্যকের মাঝেই যৌক্তিকভাবে কম বেশি থাকে। তবে কি আমরা সবাই পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারে ভুগছি? উত্তর হচ্ছে ‘না’।
প্রথমেই আপনার মনের সন্দেহ কী শুধু সন্দেহ (স্বাভাবিক পর্যায়ের), নাকি তা সন্দেহ বাতিক (অসুস্থতা) তা বোঝার চেষ্টা করুন। বর্তমান ধারণা অনুযায়ী, জিন এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার জটিল পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ ও কর্মক্ষমতার বিপর্যয় ঘটলে এই সমস্যাগুলো প্রকটরূপে দেখা দিতে পারে। তাই উপলব্ধি এই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে প্রাথমিক ধাপ হিসেবে গণ্য করা হয়।
বাস্তবতার সাথে সংযোগ
আপনি যদি উপলব্ধি করতে পারেন যে আপনি সত্যিই সমস্যায় ভুগছেন তাহলে তা সমাধানের পথও আপনাকেই বের করতে হবে। যা কিছুই আপনার অবচেতন মনে আসুক না কেন একবার হলেও বাস্তবতার সাথে তা আপনার মিলিয়ে দেখতে হবে। সুনির্দিষ্ট বাস্তব কোনো প্রমাণ না থাকলে অকারণে সন্দেহ করবেন না এবং সন্দেহমূলক প্রশ্ন করে সম্পর্কের জটিলতা বাড়াবেন না। আপনি যা ভাবেন বাস্তবে কী আদৌ সেসবের অস্তিত্ব আছে কি না তা ভেবে দেখুন। যদি সুনির্দিষ্ট বাস্তব প্রমাণ থেকে থাকে, তারপরও আরেকটু সময় নিন। বিষয়টা ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করুন। সুনির্দিষ্ট বাস্তব কোনো প্রমাণ না থাকলে অকারণে সন্দেহ করা যাবে না।
নিয়মিত মেডিটেশন
মেডিটেশন এক প্রকার মনের ব্যায়াম। এটি সচেতনভাবে দেহ মন এবং মস্তিষ্ককে শিথিল করার আধুনিক বৈজ্ঞানিক এবং সহজ প্রক্রিয়া। মেডিটেশনের মাধ্যমে আমরা মনকে একাগ্র করি, নির্দিষ্ট কিছুক্ষ্ণের জন্য নিজেকে দূরে সরিয়ে আনি দৈনন্দিন জীবনের শত সমস্যা থেকে। এতে মনে প্রশান্তি আসে, ধীরে ধীরে কাজে মনোযোগ বাড়ে, নিজের প্রতি বিশ্বাস ফিরে আসে। বিজ্ঞানীদের মতে, মনোদৈহিক ৭৫ ভাগ রোগের কারণই টেনশন। তাই মেডিটেশন করলে আপনি অনায়াসেই শতকরা ৭৫ ভাগ মনোদৈহিক রোগ থেকে মুক্তি পাবেন। আর পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারও একটি মনোদৈহিক সমস্যার অন্তর্গত।
বন্ধুত্বকে কাজে লাগান
প্রতিনিয়ত হীনম্মন্যতায় না ভুগে ঘনিষ্ঠ কোনো বন্ধুর সাথে আপনার সমস্যা শেয়ার করুন। পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারে ভোগা মানুষদের বন্ধুবান্ধব অনেক কম থাকে। তারা বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে খুবই সচেতন থাকে আর খুব একটা মিশুক না হওয়ায় বন্ধুত্বও কম মানুষের সাথে হয়। কিন্তু যে অল্প সংখ্যক মানুষের সাথে সখ্যতা থাকে, তাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা প্রখর হয়। এরপরও যদি আপনি কোনো সদুত্তর বা সমাধান না পেয়ে থাকেন, তবে পরিবারের এমন কোনো সদস্যের শরণাপন্ন হউন, যার সাথে কথা বলে আপনি কিছুটা হালকা অনুভব করবেন।
চিকিৎসকের পরামর্শ
ব্যক্তিত্বের এসব শাখা–প্রশাখা যখন ধারাবাহিকভাবে ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবন চলার পথ আগলে ধরে বাধার সৃষ্টি করে করে তখন বিষয়টা নিয়ে ভাবা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে মনোরোগবিদের সঙ্গে দেখা করা ও সুনির্দিষ্ট ধরন অনুযায়ী পথ্য, তথ্য কিংবা পরামর্শও জরুরি হয়ে পড়ে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আপনি বিভিন্ন সাইকোলজিক্যাল থেরাপি নিতে পারেন যা এই ডিসঅর্ডারগুলো কাটিয়ে উঠতে আপনাকে সাহায্য করবে।
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন