পুরোটা পড়ার সময় নেই? ব্লগটি একবার শুনে নাও।
তায়কোয়ন্দো হলো জীবন চলার পথে প্রয়োজনীয় এক প্রকার রণ কৌশল। তবে প্রকৃত অর্থে বলা যায়, তায়কোয়ন্দো হলো আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্রবিহীন লড়াইয়ের কৌশল। তায়কোয়ন্দোতে শরীরকে বৈজ্ঞানিকভাবে আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয়। তায়কোয়ন্দোর মাধ্যমে মানুষ অর্জন করে নিবিড় শারীরিক ও মানসিক প্রশিক্ষণ।
তায়কোয়ন্দো এক প্রকার মার্শাল আর্ট এবং একই সাথে দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় খেলা। তায়কোয়ন্দোতে যেসব বিষয়ের সংমিশ্রণ ঘটেছে সেগুলো হলো-
- যুদ্ধ কৌশল
- আত্মরক্ষা
- খেলাধুলা
- ব্যায়াম
- কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধ্যান এবং দর্শনের সম্মীলন
সারা বিশ্বের মার্শাল আর্ট ফর্মগুলোর মধ্যে তায়কোয়ন্দো সবচেয়ে জনপ্রিয়। বর্তমানে প্রায় সাত কোটিরও বেশি তায়কোয়ন্দো অনুশীলনকারী রয়েছে। এটি একটি অলিম্পিক খেলাও বটে। ২০০০ সালে অলিম্পিক ক্রীড়ায় তায়কোয়ন্দো সংযুক্ত করা হয়। তায়কোয়ন্দোর সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক হচ্ছে এর মাধ্যমে রাস্তাঘাটে যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে খালি হাত ও পা দিয়েই শত্রুর মোকাবেলা করা যায় এবং যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়।
তায়কোয়ন্দো কেন শেখা প্রয়োজন
শারীরিক ও মানসিক উন্নয়নের জন্য তায়কোয়ন্দো শেখা প্রয়োজন। শত্রু বা খারাপ মানুষের অতর্কিত, অনৈতিক আক্রমণ হতে রক্ষার জন্য তায়কোয়ন্দো শেখা উচিত বলে আমি মনে করি। তায়কোয়ন্দো চর্চা করলে আত্মবিশ্বাসী, আত্মরক্ষায় পারদর্শী, সুশৃংখল ও স্বাস্থ্যবান হওয়া যায়। তায়কোয়ন্দো প্রশিক্ষণের সময় শরীরের নাজুক ও সংবেদনশীল অংশগুলো রক্ষার জন্য হেড গার্ড, চেস্ট গার্ড, হ্যান্ড গার্ড, গ্লাভস, শিন গার্ড, গ্রোয়েন গার্ড ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় বলে ঝুঁকির মাত্রাও কম থাকে। কেবল মাত্র আত্মরক্ষা নয় তায়কোয়ন্দো শেখা হলে যে কোন বিষয়ে ফোকাস করাও সহজ হয়, যা পড়াশোনার ক্ষেত্রেও কাজে লাগে। তায়কোয়ন্দো অনুশীলনের ফলে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকা যায় এবং মনও সুস্থ থাকে।
তাই সবার উচিত তায়কোয়ন্দো শেখা এবং এর নৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশ ও জাতিকে গর্বিত করা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তায়কোয়ন্দো
বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের কাছে দক্ষিণ কোরিয়ার এই মার্শাল আর্টটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। দেশে বর্তমানে প্রায় ৬০ থেকে ৭০টি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দেড় লাখ শিক্ষার্থী তায়কোয়ন্দো প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। তায়কোয়ন্দো খেলার চেয়েও আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে বর্তমানে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করছে। এছাড়া অন্যান্য খেলার তুলনায় এটি অতটা ব্যয়বহুল না হওয়ায় সকলেরই এর প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।
রাজধানী ঢাকায় তায়কোয়ন্দো শেখার জন্যে তোমরা চাইলে নিম্নোক্ত স্থানে যোগাযোগ করতে পারো:
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক তায়কোয়ন্দো ফেডারেশন
অনুমোদিতঃ
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়,
এশিয়ান তায়কোয়ন্দো ফেডারেশন (ATF),
ইন্টারন্যাশনাল তায়কোয়ান্দো ফেডারেশন (ITF) .
কক্ষ নং-২৯৫, মাওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম, ঢাকা।
মোবাইলঃ ০১৭১১-০৭২৮৪৪;
ফোনঃ ০২-৯৫৮৫৫৫
ওয়েবসাইটঃ www.itf-bd.org
তায়কোয়ন্দো শেখার ৭টি প্রয়োজনীয় দিক
বেশিরভাগ মানুষ তায়কোয়ন্দো বা অন্যান্য মার্শাল আর্টের চর্চা, সুবিধা-অসুবিধা ও শৃঙ্খলা সম্পর্কে যখন চিন্তা করে তখন তারা সাধারণত প্রতিরক্ষা বিষয়ক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের সুবিধাগুলির উপরই বেশি গুরুত্ব দেয়। তবে তোমরা নিশ্চয়ই শারীরিক স্বাস্থ্যকে উপেক্ষা করতে চাইবে না। তায়কোয়ন্দো সব বয়সী শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আকারে স্বাস্থ্য সুবিধার ক্ষেত্র তৈরি করে। এছাড়া জীবন ধারণের সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও অবদান রাখে। চলো জেনে নেই তায়কোয়ন্দো শেখার প্রয়োজনীয় দিকগুলো:
১. হৃদযন্ত্র এবং রক্ত সঞ্চালনের উন্নতি:
তায়কোয়ন্দোর প্রশিক্ষণের সময় শরীরের প্রায় সকল পেশি ক্রিয়াশীল থাকে এবং হৃদপিন্ডের কার্যকারিতাও বৃদ্ধি পায়। হৃদস্পন্দনের হার বৃদ্ধির ফলে শরীরের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। প্রতিদিন মাত্র ৩০ মিনিটের অনুশীলন তোমার প্রয়োজনীয় সেসব চাহিদা পূরণ করে যা তোমার একটি সক্রিয় ও কর্মক্ষম দিন অতিবাহিত করার জন্য প্রয়োজন।
২. স্বাস্থ্যকর উপায়ে ওজন হ্রাস:
তোমার হৃদস্পন্দনের হার বৃদ্ধি পাওয়ার দরুণ তোমার শরীরের রক্ত সঞ্চালনও বৃদ্ধি পায় এবং তোমার শরীরের বিভিন্ন পেশী সমূহ সক্রিয় হয়ে ওঠে। এতে করে শরীরের অতিরিক্ত ক্যালোরি খরচ হয়। এভাবেই নিয়মিত ও ধীরগতিতে ক্যালোরি খরচ তোমাকে স্বাস্থ্যকরভাবে ওজন কমাতে সাহায্য করে।
৩. সুদৃঢ় পেশি গঠন:
Taekwondo-Information.org এর একটি পোস্টে বলা হয়েছে, “তায়কোয়ন্দোর অন্যতম একটি শারীরিক সুবিধা হল যে এটি আমাদের পেশীসমূহ, হাড়, টেনডন, জয়েন্ট ও লিগামেন্ট আরো শক্তিশালী করে তোলে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পরিলক্ষিত হয় পেশীর উপর। যদিও এর অনুশীলন পেশীর ভর ও আকার বৃদ্ধি করতে পারে না কিন্তু প্রশিক্ষণের দরুন যতই তোমার শরীরে ফ্যাটের পরিমাণ কমতে থাকবে ততই তোমার পেশী সমূহ আরো সুগঠিত হবে।
৪. শরীরের নমনীয়তা বৃদ্ধি:
তায়কোয়ন্দো প্রশিক্ষণের প্রতিটি সেশন এর শুরুতে প্রশিক্ষকগণ বেশ কিছুটা সময় শিক্ষার্থীদের স্ট্রেচিং করাতে ব্যয় করেন, যা আমাদের শরীরের নমনীয়তা বা ফ্লেক্সিবিলিটি বাড়িয়ে তোলে। এছাড়া দৈনন্দিন জীবনে এটি আমাদের পেশিতে টান খাওয়া এবং জয়েন্ট এ চোট পাওয়া থেকেও রক্ষা করে।
৫. শরীরের কষ্ট সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি:
যেহেতু তায়কোয়ন্দো অনুশীলনের জন্যে তোমার পেশী শক্তিশালী হচ্ছে এবং হৃদপিণ্ডও আরও সক্রিয় হচ্ছে, সব মিলিয়ে তোমার কষ্ট সহিষ্ণুতা আরো বৃদ্ধি পাবে। এটি তোমাকে ক্লান্ত হওয়া ছাড়াই দীর্ঘতর সময় কাজ করতে সক্ষম করবে।
৬. চাপ হ্রাস:
অন্যান্য শারীরিক ক্রিয়া-কলাপ এবং ব্যায়ামের মতো তায়কোয়ন্দোও চাপ প্রতিরোধে সহায়তা করে এবং পেশীতে টান, মাথাব্যথা, দীর্ঘস্থায়ী বাতের ব্যথার মতো শারীরিক অসুস্থতার তীব্রতাকে হ্রাস করে। তায়কোয়ন্দো অনুশীলন কেবলমাত্র শারীরিক নয়, মানসিক উন্নতিও সাধন করে। এটি মনকে প্রফুল্ল রাখে এবং মানসিক স্থিরতা বাড়ায়।
৭. জিম এর বিকল্প হিসেবে তায়কোয়ন্দো:
নিজে স্বাস্থ্য নিয়ে বেশি সচেতন মানুষগুলো শরীরকে সুগঠিত করতে জিমের শরণাপন্ন হয়। কিন্তু তায়কোয়ন্দো জিমের বিকল্প হিসেবে এবং অনেক ক্ষেত্রে আরো ভালো একটি উপায় হিসেবে কাজ করতে পারে।
প্রথমত জিমে ব্যায়াম করা অনেকটাই খরচসাপেক্ষ। প্রতি মাসে অনেকগুলো টাকা জিমের পিছনে ঢালতে হয় যা অনেকেরই সামর্থের বাইরে। অপরদিকে তায়কোয়ন্দোতে খুবই কম খরচে তুমি তোমার শরীরকে সুগঠিত করতে পারবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তায়কোয়ন্দো শেখার মাসিক খরচ ২০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
এছাড়া জিমে সাধারণত একাকী বা একজন প্রশিক্ষকের উপস্থিতিতে ক্রমাগত শরীর সুগঠিত করার অনুশীলন চালিয়ে যাওয়া একদমই আনন্দদায়ক নয় এবং তা মনের ওপরে চাপ সৃষ্টি করে। শারীরিক কষ্টের চেয়েও মানসিক নিরানন্দের কারণে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়ে এবং জিমে যাওয়া একদমই ছেড়ে দেয়। অন্যদিকে তায়কোয়ন্দোতে তুমি অনেকের সাথে আনন্দপূর্ণ পরিবেশে সুশৃংখলভাবে অনুশীলন সম্পন্ন করতে পারবে।
এছাড়া এটি একটি সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক মানের খেলাও বটে যা যথেষ্ট উৎসাহের যোগান দিতে সক্ষম।ফলে তুমি আগ্রহ ও আনন্দের সহিত শরীরের উন্নতি ঘটাতে পারবে।
তায়কোয়ন্দো শব্দের উৎপত্তি
তায়কোয়ন্দো শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে কোরিয়ান ভাষা থেকে। “তায়”, “কোয়ন”, “দো” এভাবে ভেঙে ভেঙে লিখলে অর্থটি দাঁড়াবে লাথি, ঘুষি, কৌশল। তবে সঠিক অর্থে “তায়” (TAE) অর্থ, পা দ্বারা লাথি বা চূর্ণ-বিচূর্ণ করার জন্য লাফিয়ে ওঠা বা উড়ে যাওয়া। “কোয়ন”(KWON) নির্দেশ করে মুষ্ঠিকে। মূলত হাতের মুষ্টি দ্বারা ঘুষি মারা বা ধ্বংস করা। “দো” (DO) মানে হল কৌশল বা পথ। এভাবে সব মিলে তায়কোয়ন্দো বলতে বোঝায় মানসিক প্রশিক্ষণের সহিত আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্রবিহীন লড়াই। তায়কোয়ন্দোতে দক্ষতার সাথে পাঞ্চ, কিক, ব্লক এবং ডজ এর সঠিক সমন্বয়ে প্রতিপক্ষকে দ্রুত ধ্বংস বা পরাজিত করা।
মাথা সমান উচ্চতায় কিক করা, লাফিয়ে এবং ঘুরে ঘুরে কিক করা ইত্যাদি কৌশলের ওপর জোর দেওয়া তায়কোয়ন্দোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
তায়কোয়নদোর ইতিহাস (History of Taekwon-Do)
কোরিয়ার দীর্ঘ পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসের সাথে তায়কোয়নদোর ইতিহাস জড়িত। কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে এই আত্মরক্ষা শৈলীর প্রকাশ ঘটে ও উন্নয়ন ধারা অব্যাহত থাকে। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে কোরিয়ায় মার্শাল আর্টগুলোর চর্চা প্রাচীনকালেই শুরু হয়েছিল।
বর্তমানে তায়কোয়ন্দো একটি পদ্ধতিগত আক্রমণ ও আত্মরক্ষার শৈলী যা বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। তায়কোয়ন্দোর পুরো প্রক্রিয়াটির সূচনা, উন্নয়ন ও নামকরণ করেন কোরিয়ার সাবেক সেনা কর্মকর্তা “জেনারেল চয় হং হি”। তাকে তায়কোয়ন্দোর জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়। ১৯৫৫ সালের ১১ এপ্রিল, তিনি তাঁর নিজস্ব পদ্ধতিতে তৈরি করা আত্মরক্ষামূলক কৌশলের নামকরণ করেন “তায়কোয়ন্দো”। তিনি তায়কোয়ন্দোকে তখন কোরিয়ার পুরো সামরিক বাহিনীর মাঝে ছড়িয়ে দেন। ১৯৫৭ সালে তায়কোয়ন্দোর প্রথম রাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গঠিত হয় যার নাম ছিল “কোরিয়া তায়কোয়ন্দো অ্যাসোসিয়েশন” (KTA)। একই বছর ২২ মার্চ ”ইন্টারন্যাশনাল তায়কোয়ন্দো ফেডারেশন” (ITF) গঠিত হয়। এটি তায়কোয়ন্দোর প্রথম আন্তর্জাতিক সংস্থা। খুব অল্প সময়ের মাঝে তায়কোয়ন্দো পুরো বিশ্বে জনপ্রিয় মার্শাল আর্ট হিসেবে জায়গা করে নেয়।
জেনারেল চয় হং হি’র মতে, “আদর্শ ও দর্শন অনুসরণ না করা পর্যন্ত কোন মার্শাল আর্টের শিক্ষার্থীকে তায়কোয়ন্দোর ছাত্র বলে বিবেচনা করা হয় না।” আধুনিক বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর, বিশেষ করে নিউটনের পদার্থবিদ্যা- যা শিক্ষা দেয় “সর্বোচ্চ শক্তির কৌশল”। এর উপর ভিত্তি করেই তায়কোয়ন্দোর শারীরিক কৌশল প্রতিষ্ঠিত। পরবর্তীতে “সামরিক আক্রমণ কৌশল ও আত্মরক্ষা নীতি” তায়কোয়ন্দোতে যোগ করা হয়।
বাংলাদেশ তায়কোয়ন্দোর প্রবর্তক হলেন,
মাস্টার সোলায়মান সিকদার
৬ষ্ঠ ড্যান ব্ল্যাকবেল্ট (ITF).
তায়কোয়নদোর আদর্শিক দিক
আত্মিক দিক থেকে তায়কোয়ন্দোর রয়েছে ঐতিহ্যগত ভিত্তি। নৈতিক ও আদর্শিক দিক থেকে তায়কোয়ন্দোর রয়েছে ঐতিহ্য এবং নিজস্ব দর্শন। তায়কোয়ন্দোর নীতি গ্রহণকারীদের জন্য নিম্নলিখিত আদর্শগুলো গুরুত্বপূর্ণ-
- ন্যায়পরায়ণতা ও শারীরিক শক্তি বৃদ্ধির পর সব সময় ন্যায়বিচারের পক্ষে অবস্থানের আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা।
- ধর্ম, জাতীয়তা, প্রতিযোগিতা অথবা আদর্শিক সীমার বাইরে তায়কোয়ন্দোর অনুসারীদের সাথে এক থাকা।
- শান্তিময় মানবিক সমাজ গঠনে নিবেদিত থাকা যেখানে ন্যায়বিচার, নৈতিকতা, বিশ্বাস ও মানবিকতা প্রচলিত থাকবে।
তায়কোয়ন্দো এমনি এক মার্শাল আর্ট যা কেবল আত্মরক্ষা ও ন্যায়বিচারের জন্যই ব্যবহৃত হয়। এর মূল তত্ত্ব ও আদর্শ যদি অনুসরণ করা হয়, তবে তায়কোয়ন্দো কেবল মার্শাল আর্ট হিসেবেই নয়, নান্দনিক শিল্প, বিজ্ঞান ও খেলাধুলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
তায়কোয়ন্দোর মতবাদ (Tenets of Taekwon-Do)
তায়কোয়ন্দোর মতবাদগুলো প্রত্যেক আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য পথ নির্দেশকের কাজ করে। তায়কোয়ন্দো শেখা অনেকাংশে নির্ভর করে এই তত্ত্বগুলো পালন ও বাস্তবায়ন করার দৃষ্টিভঙ্গির উপর।
নিম্নোক্ত পাঁচটি তত্ত্বকে তায়কোয়ন্দোর মতবাদের ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়।
- সৌজন্য (Courtesy)
- সততা ( Integrity)
- অধ্যবসায় (Perseverance)
- আত্মনিয়ন্ত্রণ (Self-control)
- অদম্য স্পৃহা(Indomitable Spirit)
যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের পিটসবার্গ এ অবস্থিত ইয়াং ব্রাদার্স ইনস্টিটিউট তায়কোয়ন্দোর ষষ্ঠ মতবাদ : উদারতা (Modesty) যুক্ত করে।
তায়কোয়ন্দোর অন্যান্য প্রতিষ্ঠান আরো মতবাদ প্রদান করে থাকতে পারে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ের প্রশাসনিক অঞ্চল শ্যাম্পেইন এ অবস্থিত “হান’স তাইকোয়ন্দো স্কুল” উপরোক্ত পাঁচটি মতবাদ ছাড়াও সমাজসেবা (Community service) ও সহমর্মিতা (Compassion) নামে আরও দুটি মতবাদ যুক্ত করেছে; যা বিশেষ করে ব্ল্যাকবেল্ট ধারীদের জন্য প্রযোজ্য।
শিক্ষার্থীদের শপথ (Students Oath)
তায়কোয়ন্দোর প্রতিটি ক্লাস শুরু হওয়ার পূর্বে শপথ বাক্য পাঠ করানো হয়। শপথ বাক্য পাঠ সাধারণত দুই ভাবে করা হয়। প্রথমত, শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের পরে শপথবাক্যগুলো পুনরাবৃত্তি করে অথবা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দ্বারা একযোগে শপথ বাক্যগুলো উচ্চারিত হয়। শপথ বাক্য পাঠ করানোর উদ্দেশ্য হল তায়কোয়ন্দো অনুশীলনরত প্রতিটি শিক্ষার্থীকে তাদের শিল্প-সংস্কৃতি, প্রশিক্ষক, অন্যান্য শিক্ষার্থী, জনগণ ও সমাজের প্রতি দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া। তায়কোয়ন্দোর শপথগুলো হলো-
১. আমি তায়কোয়ন্দোর মতবাদগুলো অনুসরণ করব।
২. শিক্ষক ও বয়ঃজ্যেষ্ঠদের শ্রদ্ধা করব।
৩. কখনোই তায়কোয়ন্দোর অপব্যবহার করব না।
৪. স্বাধীনতা ও ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে আমি সেরা হব।
৫. আমি এর থেকেও শান্তিময় পৃথিবী গড়ে তুলবো।
নৈতিক শিক্ষা ( Moral Culture)
তায়কোয়ন্দো বলতে সুন্দর শারীরিক গঠন আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ বুঝায় কিন্তু এতে অনেকাংশে জোর দেওয়া হয়েছে নৈতিক শিক্ষার উপর। যেন একজন ক্রীড়াবিদ সুনিপুণ চরিত্র সম্পন্ন হয়ে গড়ে ওঠে।
তায়কোয়ানদোর দর্শন (Philosophy of Taekwon-Do)
নীতি-নৈতিকতা ও আত্মিক মানের উপর তায়কোয়ন্দো দর্শনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত যেখানে মানবকল্যাণ মিশে আছে। তায়কোয়ন্দোর প্রত্যেক “তুল” বা নমুনা (Pattern) কোরিয়ার সকল অবিস্মরণীয় ব্যক্তিদের চিন্তা ও কর্মকাণ্ড প্রকাশ করে। কাজেই তায়কোয়ন্দোর শিক্ষার্থীদের মাঝে সেই সকল চিন্তা ও লক্ষ্যের প্রতিফলন ঘটে যার ভিত্তিতে “তুল” এর নামকরণ করা হয়েছে। তায়কোয়ন্দো দর্শনের উল্লেখযোগ্য কিছু দিক:
০১. যেখানে যাওয়া দুষ্কর হতে পারে সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা থাকা এবং কঠিন কাজ করার মতো সামর্থ্য থাকা।
০২. অসহায়ের প্রতি নম্র ও বলবান অন্যায়কারীদের প্রতি কঠোর থাকা।
০৩. নিজের অর্থ ও অবস্থানের উপর কেবল তৃপ্ত থাকা, দক্ষতার উপর নয়।
০৪. যা শুরু করা হয় তা শেষ করা, তা যত ছোট বা যত বড়ই হোক না কেন।
০৫. কেবলমাত্র সেই সকল মানুষের শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা থাকা উচিত যারা ধর্মের, প্রচেষ্টার ও আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
০৬. কোন বড় লক্ষ্য তাড়া করাকে কখনোই হতাশা বা হুমকি হিসেবে বিবেচনা না করা।
০৭. চলনের (Movement ) মাধ্যমে অর্থাৎ আচরণ ও দক্ষতা প্রকাশ করে শিক্ষা দেওয়া উচিত, কথাবার্তার মাধ্যমে নয়।
০৮. সব সময় নিজের মধ্যে থাকা, যদিও তোমার লক্ষ্যে হয়তো পরিবর্তন আসতে পারে।
০৯. নিজের শিক্ষক নিজেই হওয়া।
১০. তরুণ অবস্থায় বল দিয়ে, বৃদ্ধ অবস্থায় পরামর্শ দিয়ে সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধনে অবদান রাখা।
তায়কোয়ন্দোর প্রশিক্ষণ রহস্য (Training Secret of Taekwon-Do)
তায়কোয়ন্দোর সাথে অন্যান্য মার্শাল আর্ট এর একটি বিশেষ পার্থক্য আছে, সেটি হলো এর প্রশিক্ষণ রহস্য। তায়কোয়ন্দো কৌশল প্রয়োগের মান কঠোর পরিশ্রম ও নিবিড় প্রশিক্ষণ এর উপর নির্ভরশীল নয়, এটি নির্ভর করে একজন সত্যিকারের যোগ্য প্রশিক্ষক সঠিক প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে নিয়মানুবর্তিতায় উৎসাহী করার পাশাপাশি কতটুকু সক্ষম করতে পারল তার উপর। আগ্রহ ও ইচ্ছাশক্তি থাকলে স্বল্প পরিশ্রমে দ্রুত তায়কোয়ন্দোর কলা-কৌশলগুলো সঠিকভাবে আয়ত্ত করা সম্ভব।
অনুশীলনের পোশাক (Training Suit)
কৌশল,দার্শনিক তত্ত্ব, আত্মিক ভিত তৈরি ও প্রতিযোগিতার নিয়মে অন্যান্য পূর্বদেশীয় মার্শাল আর্টের চেয়ে ভিন্ন হওয়ায় একে তায়কোয়ন্দো নামকরণ করা হয়েছে। একই কারণে, তায়কোয়ন্দোর অনন্য এক পোশাক রয়েছে। প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতার জন্য প্রাথমিক প্রয়োজনীয়তা মেটানোর ক্ষেত্রে পোশাক ‘ডো বক’ যথেষ্ট বলে মনে করা হয়। কেননা-
- পোশাক বা ‘ডো বক’ পড়ার পর একজন শিক্ষার্থীর মনে নিজেকে তায়কোয়ন্দোর অংশ বলে দৃঢ় বিশ্বাস গড়ে উঠতে থাকে।
- তায়কোয়ন্দোর পোশাক প্রত্যেকের দক্ষতা ও সাংস্কৃতিক শিক্ষার স্তর ধারণ করে।
- সনাতন তায়কোয়ন্দো অনুসরণকারীদের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক পার্থক্য গড়ে দেয় পোশাক ‘ডো বক’।
কোরিয়ার ঐতিহ্যগত পোশাকের রঙের সঙ্গে সঙ্গতি রাখার জন্য শার্ট ও প্যান্টের রং অবশ্যই সাদা হতে হয়। শার্ট-প্যান্ট ছাড়াও তায়কোয়ন্দো অনুশীলনকারীদের পোশাকের অন্যতম একটি অংশ হলো কোমরবন্ধনী যেটি র্যাংক ভেদে ভিন্ন ভিন্ন রঙের হয়ে থাকে। ছয় ধরণের বা রংয়ের কোমর বন্ধনী বা বেল্ট রয়েছে: সাদা, হলুদ, সবুজ, নীল, লাল, কালো।
বয়স নয়, কে কতটা দক্ষ তার ভিত্তিতে প্রশিক্ষণার্থীদের সাদা, হলুদ, হলুদ-সবুজ, সবুজ, সবুজ-নীল, নীল, নীল-লাল, লাল, লাল-কালো, কালো ইত্যাদি রংয়ের বেল্ট প্রদান করা হয়। কালো বেল্টের ক্ষেত্রে আবার র্যাংক ভেদে ভিন্নতা দেখা যায়।
শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য আমাদের সকলেরই দিনের কিছুটা সময় শরীর চর্চায় ব্যয় করা উচিত। ব্যস্ত জীবনে এই সময়টুকু সর্বাধিক উপযুক্ত ব্যায়াম বা ক্রীড়ায় নিযুক্ত করা উচিত। সার্বিক বিচারে তায়কোয়ান্দো হতে পারে শরীরচর্চার সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম।
তথ্যসূত্রঃ
১.https://en.m.wikipedia.org/wiki/Taekwondo
২.https://www.thoughtco.com/history-style-guide-tae-kwon-do-2308282
৩.https://www.thoughtco.com/taekwondo-vs-karate-2308292
৪.https://www.teamusa.org/usa-taekwondo/v2-getting-started-in-taekwondo/what-is-taekwondo
৫.https://www.emaxhealth.com/12410/physical-benefits-taekwondo
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন