পুরোটা পড়ার সময় নেই? ব্লগটি একবারে শুনে নাও!
ছোট্ট সেই ছেলেটি:
নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজের মাঠে কার্লোস রেক্সাস হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। মাঠের সবথেকে ছোটখাটো, সবথেকে দুর্বল ছেলেটা তার থেকে আধহাত লম্বা সব খেলোয়াড়দের বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে একের পর এক গোল দিয়েই যাচ্ছে! বলটা মনে হচ্ছে চুম্বক দিয়ে ওর পায়ে লাগানো আছে, পা থেকে সরছেই না! বাকি খেলোয়াড়রা একটু পর মনে হলো হাল ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল, আর ছোট ছেলেটা বড় বড় গোল দিতে লাগলো!
এখানে কার্লোস রেক্সাসের পরিচয়টা দেয়া ভালো। বার্সেলোনার সাবেক খেলোয়াড় ও কোচ এই ভদ্রলোকের তখনকার কাজ ছিল দেশে বিদেশে ঘুরে ঘুরে বার্সার বিখ্যাত ‘লা মেসিয়া’ একাডেমির জন্যে প্রতিভাবান ফুটবলার খুঁজে বের করা। ফুটবলের ভাষায় যাকে বলে ‘স্কাউট’।
অদ্ভুত আবিষ্কার:
কার্লোস রেক্সাস আর্জেন্টিনায় এসেছিলেন প্রতিভার খোঁজে। সেবার আর্জেন্টিনার কিশোর ফুটবলারদের দেখে তেমন মন ভরছিল না তাঁর, তিনি খুঁজছিলেন এমন কাউকে, সবার মাঝে অনন্য হবে যে, ইংরেজিতে ‘Standout’ বলা হয় যাকে। বোকা জুনিয়র্স থেকে শুরু করে অন্যান্য বড় বড় আর্জেন্টাইন ক্লাব ঘুরে যে খোঁজ তিনি পাচ্ছিলেন না, নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজের মতো ছোট ক্লাবের মাঠে বুঝি তাঁর মনের মতো ফুটবলার পেয়ে গেলেন! বুঝে গেলেন, এই মানিক হাতছাড়া করা হবে বিশাল বোকামি।
ছেলের নাম লিওনেল মেসি। বাবা হোর্হে মেসি ছিলেন পেশায় স্টিল ফ্যাক্টরির ম্যানেজার। মা সেলিনা কাজ করতেন কারখানায়। রেক্সাস সটান চলে গেলেন মেসির বাবা-মা এর কাছে। একেবারে সোজাসাপ্টা বলে দিলেন, বার্সেলোনার একাডেমির জন্যে তাঁদের মেসিকে চাই। মেসির বাবা-মার উত্তরটা অবাক করে দিলো তাঁকে।
বিরল এক সমস্যা:
“মেসি আর বড় হবে না?” কার্লোস রেক্সাস যেন আকাশ থেকে পড়লেন। হোর্হে মেসি খুলে বললেন। মেসির একটা বিরল সমস্যা আছে। তার গ্রোথ হরমোনের বড় একটা ঘাটতি আছে, আর এই গ্রোথ হরমোন না থাকলে সে আর কখনো বড় হতে পারবে না। হোর্হে-সেলিনা মিলে ডাক্তার দেখিয়েছেন, এই সমস্যার সমাধানও পেয়েছেন।
কিন্তু নিম্নমধ্যবিত্ত আয়ের এই দম্পত্তির পক্ষে প্রতি মাসে শ’য়ে শ’য়ে ডলার খরচ করে মেসির থেরাপি করা অসম্ভব। আর তাই মেসিকে নিয়ে তাঁরা মহা শঙ্কিত, বাচ্চা ছেলেটার কী যে হবে!
সমস্যা থাকলে সমাধান থাকবেই!
সবকিছু জেনেও হাল ছাড়লেন না রেক্সাস। মানুষটা হার মানতে জানেন না। সেবারের মতো ফিরে গেলেন তিনি বার্সেলোনায়, সাথে নিয়ে গেলেন ছোট্ট মেসির পায়ের অস্বাভাবিক জাদুর স্মৃতি। শুধু ফিরলেনই না, বার্সা বোর্ডকে রাজিও করালেন মেসির হরমোনের চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্যে। সময়টা একবিংশ শতাব্দীর প্রথম বছর, ২০০০ সাল।
আরেকটা সমস্যা ছিল, মেসি বাবা-মাকে ছাড়া কীভাবে থাকবে? সেটারও সমাধান হলো, মেসির বাবা-মা চলে এলেন স্পেনে, ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া নিলেন। এক মেসির জন্যে এতোটা ত্যাগ স্বীকার করলেন হোর্হে-সেলিনা দম্পতি- নিয়তি তাঁদের এই ঋণ সুদসমেত ফেরত দিতে দেরি করেনি!
আরও পড়ুন: জেনে নিন মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের ১০০+ কিবোর্ড শর্টকাট!
স্পেনজীবন, বন্দী জীবন:
বার্সেলোনায় প্রথম দিকে মেসি একেবারেই মানিয়ে নিতে পারছিল না। আর্জেন্টিনার সাথে স্পেনের অনেক ফারাক, ততদিনে কিশোর মেসি সেটা ভালোমতোই বুঝে ফেলেছে। লা মেসিয়ায় প্র্যাক্টিসের সময়টাই শুধু ভালো লাগে তার, ফুটবল যে মেসির বড় আপন! অন্য সময়টায় কেমন একটা বন্দী ভাব হয় তার। ধীরে ধীরে এই সমস্যা থেকেও বের হতে পারলো মেসি, লা মেসিয়ায় সেস্ক ফ্যাব্রেগাস, জেরার্ড পিকের মতো বন্ধু জুটে গেল তার!
লা মেসিয়ার খেলোয়াড়দের সাধারণত চার পাঁচ বছর লেগে যায় মূল একাদশ এমনকি বার্সা বি দলে সুযোগ পেতে। মেসি এখানেই অনন্য। লা মেসিয়ায় যোগ দেয়ার তিন বছরের মধ্যেই নিজের কারিকুরি দিয়ে সুযোগ করে নেন বার্সেলোনা মূল দলে! সালটা ২০০৩।
অভিষেক:
বার্সেলোনা দলে তখন রোনালদিনহো, ক্লাইভার্টদের মতো তারকার মেলা। সেখানেও নিজের শৈলী দেখাতে ভুল করেনি মেসি, ষোল বছর বয়সেই বার্সেলোনা কোচের চোখে পড়ে যেতে দেরি হলো না মেসির।
সে বছর মূল দলে আরো একজন তারকার অভিষেক হয়েছিল। নাম তাঁর আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, যাকে বলা যায় একবিংশ শতাব্দীর সেরা মিডফিল্ডারদের একজন। মেসির অবশ্য মূল দলে মোটামুটি নিয়মিত হতে আরো সময় লেগেছে।
হরমোনের ঘাটতি, বাবা-মায়ের দরিদ্রতা- কোনকিছুই তাঁকে রুখতে পারে নি সেরা হওয়া থেকে।
২০০৫ সাল। পহেলা মে। দিনটা আজও স্প্যানিশ ফুটবলের রেকর্ড বুকে অমলিন, মাত্র ১৭ বছর বয়সে বার্সেলোনার পক্ষে কনিষ্ঠতম গোলদাতা হিসেবে গোল করে মেসি, যে রেকর্ডটা আজো কেউ ভাঙ্গতে পারে নি কেউ। সে বছরই অনূর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপ জিতে বিশ্ব ফুটবলে মেসি জানান দিয়ে দেয় নিজের প্রতিভার।
ফুল সিলেবাস কোর্সে যা যা থাকছে:
৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি অনলাইন ব্যাচ ২০২৪
সাফল্যগাঁথা:
সেই যে শুরু, এরপর থেকে মেসিকে আর রুখে কে? ২০০৯ থেকেই একরকম অপ্রতিরোধ্য লিওনেল মেসি, পাঁচ পাঁচবার বিশ্বসেরা ফুটবলার হয়েছেন, এর মধ্যে টানা বিশ্বসেরা হয়েছেন চারবার! নামের পাশে একগাদা রেকর্ড, একগাদা এওয়ার্ড। বার্সার ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোল করেছেন, করিয়েছেন। বার্সার হয়ে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ছয়টি কাপ জিতেছেন, আরো কত শত কৃতিত্ব যে তাঁর ঝুলিতে, বলে শেষ করা যাবে না।
সবথেকে বড় কথা হলো, বিশ্বের সেরা দু’জন খেলোয়াড়ের একজন হবার পরেও, পৃথিবীর সবথেকে ধনী অ্যাথলেটদের একজন হবার পরেও মেসি এখনও ওল্ড বয়েজের সেই নির্লিপ্ত, সরল ছোট্ট ছেলেটিই আছেন। যশ তাঁকে ছোঁয়নি, অহমিকা তাঁকে আঁকড়ে ধরেনি।
আর তাই মেসিই বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় কি না, এমন প্রশ্নে মেসির সহজ সরল উত্তর:
“কে সেরা এটা আমার মাথাব্যথা নয়, বার্সেলোনা রিয়াল মাদ্রিদের থেকে ভালো খেললেই চলবে!”
বিশ্বসেরা হবার পরেও তাঁর এই নম্রতা আমাদের মুগ্ধ করে, অবাক করে। প্রতিনিয়ত ফুটবলের জাদু দিয়ে মুগ্ধ করছেন যিনি সারা বিশ্বকে, বাস্তব জীবনে সেই মেসিই অদ্ভুত সরল! সম্প্রতি বিয়েও করেছেন ছোটবেলার বান্ধবী আন্তোনেল্লা রোকুজ্জোকে। এত যশ, এত বিত্তের মালিক হয়েও উদ্দাম জীবনযাপন তাঁকে টানেনি, মেসি রয়ে গেছেন সেই ছোটবেলার মেসিই।
অপ্রাপ্তি:
মেসির ক্যারিয়ারে একটাই অপ্রাপ্তি, দেশের হয়ে অলিম্পিকের বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট ছাড়া আর কিছুই জেতা হয় নি তাঁর। একটা বিশ্বকাপের খুব দরকার এই কিংবদন্তীর। ২০১৪-তে বিশ্বকাপের খুব কাছাকাছি গিয়েও ছুঁতে পারেনি আর্জেন্টিনা, দলটির আশা ভরসা সব এই মেসিকে ঘিরেই। রোজারিওর সেই ছোট্ট ছেলেটি আজ আর্জেন্টিনা দলের ক্যাপ্টেন, বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নটাও বোনা মেসিকে ঘিরেই।
মেসি কেবল আর্জেন্টাইন এক কিংবদন্তী কিংবা বার্সার সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়ই নন। সারা বিশ্বের হাজারো মানুষের জন্যে এক অনুপ্রেরণা লিওনেল আন্দ্রেস মেসি কুচ্চিতিনি নামের ছোটখাটো এই ফুটবল খেলোয়াড়। হরমোনের ঘাটতি, বাবা-মায়ের দারিদ্য- কোনকিছুই তাঁকে রুখতে পারে নি সেরা হওয়া থেকে।
সকল বাধাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে অমরত্বের পথে এগিয়ে গিয়েছেন মেসি, সাফল্যের স্বর্ণশিখর আগলে নিয়েছে তাঁকে, পরম যতনে। এই বিশ্বকাপই সম্ভবত তাঁর শেষ সুযোগ, আর্জেন্টিনার হয়ে অমরত্ব অর্জনের, পারবেন কি মেসি?
এই লেখাটির অডিওবুকটি পড়েছে লুবাবা জারিন।
১০ মিনিট স্কুলের লাইভ এডমিশন কোচিং ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে সরাসরি চলে যেতে পারো এই লিঙ্কে: www.10minuteschool.com/admissions/live
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আমাদের কোর্সগুলোর তালিকা:
- Communication Masterclass by Tahsan Khan
- Facebook Marketing Course by Ayman Sadik and Sadman Sadik
- ঘরে বসে Freelancing by Joyeta Banerjee
- ঘরে বসে Spoken English Course by Munzereen Shahid
- Study Smart Course by Seeam Shahid Noor
আপনার কমেন্ট লিখুন