১৯৩৯ সাল। ব্রিটেন সবেমাত্র তখন জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সারা বিশ্বের পরাশক্তিরা তখন দুই দলে বিভক্ত— ইংল্যান্ড, আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে গ্র্যান্ড অ্যালায়েন্স এবং ইতালী, জার্মানী আর জাপানকে নিয়ে অ্যাক্সিস পাওয়ার। আকাশে জার্মান বিমান এবং সমুদ্রে জার্মান ইউবোটের আক্রমণে সমগ্র ইউরোপ তখন আতংকিত। জার্মান সৈন্যরা নিজেদের মধ্যে আসন্ন আক্রমণের খবর আদান-প্রদান করার জন্য “Enigma” নামক এক ধরণের কোডিং ডিভাইস ব্যবহার করতো। তাদের সেই কোডেড মেসেজগুলো সারাদিন আকাশ-বাতাসে ভেসে বেড়াতো। ব্রিটিশ সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ সেই মেসেজগুলো ধারণ করতে পারলেও তার মর্মোদ্ধার করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হতো। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। ধরুন, ব্রিটিশ বাহিনী একটি জার্মান মেসেজ ধরে ফেললো যাতে লেখা: BUUBDLMNOEFO. এই বর্ণগুলোর কোনো মানে নেই, তাই না?
এবার প্রতিটি বর্ণকে ইংরেজিতে তাদের পূর্ববর্তী বর্ণ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করুন। তাহলে, B এর স্থানে আসবে A, U এর স্থানে T। এভাবে পুরো মেসেজটি ডিকোড করলে দাড়াঁয়: ATTACKLONDON. অর্থাৎ পরবর্তী আক্রমণ হবে লন্ডনে। কোডটি ভাঙার উপায় জানা না থাকলে সারা দিন চেষ্টা করেও এই মেসেজটি বোঝা বেশ দুষ্কর হয়ে দাড়াঁবে। এটাই হলো Cryptology-র মূল আইডিয়া। আপনার চোখের সামনে মেসেজটি ভেসে বেড়াবে; কিন্তু আপনি তার কোন অর্থই বুঝতে পারবেন না।
জার্মানরা Enigma ব্যবহার করে প্রতিদিন তাদের মেসেজ কোডিং করার পদ্ধতি পরিবর্তন করতো। তাই কেউ কোনভাবে একদিনের মেসেজ ডিকোড করে ফেললেও সেই পদ্ধতি ব্যবহার করে আর পরদিনের গোপন তথ্য পড়তে পারতো না। এই গোপন মেসেজ আদান প্রদানের টেকনোলজির কারণে জার্মানদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হারানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাড়িঁয়েছিলো। তখন মাত্র কয়েকজন গণিতবিদ নিজেদের অংকের জোড়ে জার্মানিকে পরাজিত করে। সেই গণিতপাগগল দলের অধিপতি অ্যালান টিউরিং এর গল্প আজ আপনাদের শোনাবো।
টিউরিং-এর জন্ম হয়েছিলো ব্রিটেনের এক মিলিটারী পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই গণিত এবং ক্রিপটোলজির নেশা তাকে পেয়ে বসে। স্কুলে তার বন্ধু ক্রিস্টোফারের অনুপ্রেরণায় টিউরিং কোড ব্রেকিং এর প্রেমে পড়ে যান। কয়েক বছর পর হঠাৎ যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে ক্রিস্টোফারের মৃত্যু ঘটে। সেই শোক থেকে পরিত্রাণের উপায় খুজঁতে গিয়ে টিউরিং নিজেকে পুরোপুরি কোডের জগতে ডুবিয়ে দেয়। অনেকেই ধারণা করে থাকে যে, স্কুলের সেই ছেলে বন্ধু ক্রিস্টোফারের সাথে টিউরিং এর গভীর প্রণয়ের সম্পর্ক ছিলো।
স্কুল শেষে টিউরিং ক্যামব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে উচ্চশিক্ষায় নিমগ্ন হন। মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি পরিসংখ্যানের “central limit theorem” প্রমাণ করে দেখান। এর বদৌলতে ক্যামব্রীজ তাকে কিংস কলেজের ফেলো হিসেবে নিয়োগ দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর ব্রিটিশ মিলিটারী ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ একটি কোড ব্রেকিং দল গঠন করে। সারা ব্রিটেনের শ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ, গণিতবিদ, দাবা খেলোয়াড়দেরকে একত্রিত করে ব্লেচলী পার্কে স্থাপিত হয় Government Code & Cypher School (GC&CS)। তাদের উদ্দেশ্য একটাই— Enigma-র কোড ভেঙে দেখানো।
প্রথম কয়েকমাস কাজ করার পরই সেই দলের অধিকাংশ সদস্য বেশ নিরাশ হয়ে পড়ে। এরা ব্রিটেনের বাঘা বাঘা কোড ব্রেকার। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঘাম ঝড়িয়ে তারা কাজ করে। পরদিন ভোর হতেই Enigma তার সেটিং পরিবর্তন করে এবং তাদের আগের দিনের সব কাজ বিফলে যায়। হতাশ হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। তবে সেই দলে একজন ছিলেন যার মাঝে হতাশা ভর করেনি। তিনি আমাদের অ্যালান টিউরিং। বিরক্তিকর ব্যাপার হলো, এই পুরো সময় জুড়ে টিউরিং মোটেও কোড ব্রেকিং-এ যুক্ত ছিলেন না। তার মতে, Enigma একটা মেশিন। মানুষের ব্রেইন দিয়ে কাজ করে একে হারানো অসম্ভব। Enigma-কে হারাতে হলে টিউরিং-কেও একটি মেশিন বানাতে হবে যা Enigma-র সম্ভাব্য সকল সেটিং গুলো মিলিয়ে আসল মেসেজটা একদিনের মধ্যেই বের করে দিতে পারবে।
পোলিশ কোড ব্রেকারগণ অনেকদিন আগেই এধরণের একটি মেশিনের আইডিয়া দিয়েছিলো। তাদের সেই সাধারণ আইডিয়াটিকে ব্যবহার করে টিউরিং প্রায় কয়েক হাজারগুণ শক্তিশালী এক মেশিন বানিয়ে ফেলেন। এর নাম দেয়া হয় “বোম্বে”। কিন্তু, তখন সময় হয়ে দাঁড়ায় বড় শত্রু। প্রাথমিক দিকের বোম্বে মেশিনটি একদিনের মধ্যে সকল সেটিংস মিলিয়ে আসল মেসেজটা খুজেঁ দিতে পারতো না। যুদ্ধে ইংল্যান্ডকে জিততে হলে তাদের দরকার একসাথে অনেকগুলো বোম্বে। এটা বানানো অনেক অর্থের ব্যাপার। ইতোমধ্যে ব্লেচলী পার্কের হাট-০৮ এর এই কোডার দলের উপর মিলিটারী বাহিনী অসম্ভব বিরক্ত হয়ে পড়েছিলো। তাই, যেকোন অর্থ আবদারে সরকারের কাছ থেকে শুধু নেতিবাচক উত্তর আসতে থাকে।
অবশেষে একদিন টিউরিং চিঠি লিখে বসেন ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রপ্রধান উইন্সটন চার্চিলকে। চার্চিল টিউরিং-এর আবদারের গুরুত্ব বুঝতে পেরে মিলিটারী ইন্টেলিজেন্সকে একটা নোট লিখেন: “টিউরিং যা যা চায় তার যোগান একদিনের মধ্যেই করে দাও। কাজ হবার পর আমাকে অবশ্যই অবহিত করবে। এটা রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট।”
এক চিঠিতেই বদলে গেল হাট-০৮ এর চিত্র। একের পর এক তৈরি করা হলো নতুন নতুন বোম্বে। টিউরিং এবং তার দল মিলে চেষ্টা করতে থাকলো কিভাবে এই মেশিনের কাজ করার সময় কমিয়ে আনা যায়। তারা বুঝতে পারে, কয়েকটি পরিচিত ডিকোডেড মেসেজ ধরিয়ে দিলে যন্ত্রটি খুব তাড়াতাড়ি কাজ করতে পারে। যেমন- জার্মানরা প্রতিদিন সকাল ৬-টায় আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাঠাতো। এই পরিচিত তথ্যটা বোম্বের প্রোগ্রামে ইনপুট দেয়ার সাথে সাথেই তার সম্ভাব্য সেটিংসের সংখ্যা অনেক কমে আসে এবং খুব সহজেই সেদিনের আসল মেসেজটা তারা বের করে ফেলে। যেই enigma-র কারণে গ্র্যান্ড অ্যালায়েন্সের সৈন্যদল নির্ঘুম রাত কাটাতো সেই enigma-র গুষ্টিউদ্ধার করে ফেললো কয়েকজন অঙ্কপাগল কোড ব্রেকার।
Enigma-র কোড ভাঙ্গাতেই টিউরিং-এর কাজের শেষ নয়। একবার চিন্তা করে দেখুন। ব্রিটেন যদি একের পর এক জার্মান ইউবোটগুলোকে সাগরে ডুবিয়ে দেয় এবং বিমানের আক্রমণকে নষ্ট করতে থাকে তাহলে জার্মানরা কি মনে করবে? তারা অবশ্যই বুঝে যাবে যে engima-র রহস্য ব্রিটিশরা বুঝে ফেলেছে। তখন তারা সপ্তাহান্তেই মেশিনের ডিজাইন পরিবর্তন করে ফেলবে। তাই, টিউরিং একটা পরিসংখ্যানিক পদ্ধতির প্রবর্তন করলেন যা পুরোপুরি ক্যালকুলাস নির্ভর। রিসিভার অপারেটিং কার্ভ— ব্যবহার করে তিনি কতগুলো আক্রমন ঠেকালে জার্মানদের মনে সন্দেহ দেখা দিবে না তা বের করে ফেললেন। অত:পর দৈবচয়নে নির্বাচিত আক্রমণগুলোর তথ্য ব্রিটিশ বাহিনীকে দেয়া হলো। একবার চিন্তা করে দেখুন? আপনি জানেন জার্মান বাহিনী আগামীকাল বিকাল পাচঁটায় হয়তো লন্ডনে আক্রমণ করবে। জানা সত্ত্বেও আপনি এর ব্যাপারে কিছুই করলেন না। কারণ একটাই— জার্মানরা যাতে সন্দিহান না হয়। জেনে শুনে মানুষকে মরতে দেয়ার এই সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে অনেকেই টিউরিংকে ঠান্ডা রক্তবিশিষ্ট দানব বলে ডাকতো।
দানব, মানুষ, গণিতবিদ, কোড ব্রেকার— যাই বলে ডাকুন না কেন! অ্যালান টিউরিং এর অবদানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় ২ বছর আগে শেষ হয়েছে যার ফলে কমপক্ষে ১৪ মিলিয়ন মানুষের জীবন বেঁচেছে। স্কুলের গণিত ক্লাসে কোড ব্রেকিং করা ছেলেটার ক্যালকুলাস আর অ্যালগরিদম সামনে জার্মানদের যুদ্ধবিমানগুলো হার মানে। অ্যালান টিউরিং এর সেই বোম্বে মেশিনকে অনেকেই আধুনিক কম্পিউটারের পথ প্রদর্শক হিসেবে মনে করে থাকে। টিউরিং কে বলা হয় The father of theoretical computer science.
যুদ্ধশেষে টিউরিং বেশ কিছুদিন ক্রিপটোলজি, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে গবেষণা করেন। তার বিখ্যাত গবেষণা নিবন্ধ “the imitation game” এ একটি যন্ত্র মানুষ নাকি রোবোট তা বের করার জন্য The Turing Test এর প্রচলন করেন। আজকালের যুগে আমরা AI নিয়ে যে মাতামাতি দেখি তার অনেক কিছুই অ্যালান টিউরিং এর মস্তিষ্ক প্রসূত জ্ঞান।
এই বিশাল গণিতবিদের শেষ পরিণতি কেমন ছিলো তা চিন্তা করতে পারেন? ছেলেবেলার স্কুলবন্ধুর গল্প শুনেই হয়তো আচঁ করতে পেরেছেন, অ্যালান টিউরিং ছিলেন সমকামী। তৎকালীন ব্রিটেনের আইনে সমকামিতাকে ক্রাইম হিসেবে বিবেচনা করা হতো। টিউরিং এর বাসায় একদিন চুরি হয়। সেই তদন্ত করতে এসে পুলিশ টিউরিং এর সমকামিতার ব্যাপারটা বুঝে ফেলে। কোর্টে এই পাপের শাস্তি স্বরূপ তাকে দুটি রাস্তা দেয়া হয়- কারাবাস অথবা নপুংশক হওয়া। নিজের মেশিনটার কাছে থেকে গবেষণা চালানোর জন্য টিউরিং কেমিক্যাল ক্যাস্ট্রেশন বা রাসায়নিকভাবে নিজেকে যৌনমিলনে অক্ষম করার শাস্তিটা গ্রহণ করেন। সেই থেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় টিউরিং-এর মনে ছেয়ে বসে রাজ্যের হতাশা। ১৯৫৪ সালের ৭ জুন পটাসিয়াম সায়ানাইড মেশানো আপেলে কামড় দিয়ে এই অসাধারণ কোড ব্রেকার মৃত্যুবরণ করেন। ২০০৯ সালে এক পাবলিক পিটিশনের ফলস্বরূপ ব্রিটেন রাজপরিবার টিউরিংকে রাজ-ক্ষমা প্রদান করেন। শুধু তাই নয়, সমকামিতার কারণে যত মানুষকে এখন পর্যন্ত সাজা দেয়া হয়েছিলো তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। অনেকেই ধারণা করে থাকে, অ্যাপেল কম্পিউটারের লোগোর সেই কামড় দিয়ে খাওয়া আপেলটা আসলে অ্যালন টিউরিং-এর প্রতি সম্মান জানিয়েই ডিজাইন করা হয়েছে।
Sometimes it is the people no one can imagine anything of who do the things no one can imagine. (Alan Turing)
আপনার কমেন্ট লিখুন