পুরোটা পড়ার সময় নেই? ব্লগটি একবার শুনে নাও।
পরস্পর ভাব বিনিময় কিংবা যোগাযোগের জন্য মুখের ভাষা ব্যবহার করি আমরা, যাকে বলি ‘কথা’। কিন্তু যোগাযোগ স্থাপনে কথাই সব নয়। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, আমরা মুখের ভাষা দিয়ে শতকরা সর্বোচ্চ ৪০ ভাগ মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি। তাহলে বাকি ৬০ ভাগ হয় কীভাবে? এখানেই আসে “ইশারা ভাষা” বা “সাইন ল্যাংগুয়েজ” এর কেরামতি!
“সাইন ল্যাংগুয়েজ” বলতে কী বুঝায়?
শিশুর কণ্ঠে অ-আ-ক-খ বর্ণমালা পরিচয়ে ভাষার সাথে প্রথম সম্পর্ক গড়ে ওঠে, কিন্তু যে শিশুটির মুখে শব্দ ফোটে না, প্রকৃতি যাকে শব্দ শুনতে পাবার সুযোগ করে দেয়নি, তারও কিন্তু নিজের ভাষা আছে। সে ইশারায় মনের ভাব প্রকাশ করে।
মনে করো লাইব্রেরী কক্ষে যেখানে পিনপতন নীরবতা সেখানে তোমার বন্ধু ফোনে ফিসফিস করে কথা বলতেছিল। আর কিছুক্ষন এভাবে চলতে থাকলেই লাইব্রেরিয়ান চলে আসবে বকা দিতে, অবস্থা বেগতিক দেখে তুমি ঠোঁট গোল করে তর্জনী ঠোঁটের কাছে এনে “ফিশশশ!” মতো একটা শব্দ করলে তাতেই তোমার বন্ধু বুঝে গেল এখনই ফোন রাখতে হবে!
এই যে হাত আর ঠোঁটের ইশারায় তুমি বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করলে, এটাই হচ্ছে মনের ভাব প্রকাশের বাকি ৬০ ভাগ অংশ- বডি ল্যাংগুয়েজ বা শারীরিক ভাষা।
শরীরের নানা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে যে শব্দমালা সাজিয়ে ভাবের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় তা-ই হচ্ছে বডি ল্যাংগুয়েজ। আর সাইন ল্যাংগুয়েজ হচ্ছে বডি ল্যাংগুয়েজেরই একটা অংশ। মূলত মূক ও বধির লোকদের ভাব বিনিময়ের জন্য এ ভাষাটি ব্যবহার করা হয়।
সাইন ল্যাংগুয়েজের গুরুত্ব
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম ও দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজি ও স্প্যানিশের পর তৃতীয় প্রধান ভাষা হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে সাইন ল্যাংগুয়েজ। গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ সর্বোচ্চ ৯৩ ভাগ পর্যন্ত বডি ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করে ভাব বিনিময়ে! কারণ হিসেবে গবেষকরা বলেন- মুখের কথার চেয়ে ইশারার ভাষা বেশি কার্যকর। সেজন্যই মানুষ বডি ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
বাংলাদেশে ব্রিটেনের ইশারা ভাষার রীতিকে অনুসরণ করা হয়। এখানে ইশারা ভাষার প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৪ সালে সরকারি মূক ও বধির বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য কাজ করছে- “সোসাইটি অব দি ডেফ অ্যান্ড সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজার্স” এর তথ্য অনুযায়ী শুধু বাংলাদেশেই শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ, পৃথিবীজুড়ে এ সংখ্যা প্রায় ৭ কোটি মানুষ, এবং তাদের সবার মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম এই সাইন ল্যাংগুয়েজ।
তাই ভাষাটি শিখে ফেললে অনন্য একটি দক্ষতাই অর্জনের পাশাপাশি ৭ কোটি মানুষের সাথে যোগাযোগ করার, তাদের গল্প শোনার, তাদের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার থেকে নিজেকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছো তুমি!
আমেরিকান সাইন ল্যাংগুয়েজ (ASL)
মজার ব্যাপার হচ্ছে মুখের ভাষার মতো ইশারা ভাষাও দেশভেদে জাতিভেদে বিভিন্ন রকম হয়! এ মুহূর্তে পৃথিবীতে প্রায় দেড়শো’র কাছাকাছি সাইন ল্যাংগুয়েজ রয়েছে। মুখের ভাষার ক্ষেত্রে আমেরিকান ইংরেজি যেমন বিশ্বজুড়ে বহুল প্রচলিত, আমেরিকান সাইন ল্যাংগুয়েজ বা ASL- ও ইশারা ভাষার ক্ষেত্রে দারুণ জনপ্রিয়। চলো জেনে নেওয়া যাক ASL এ প্রাথমিক পর্যায়ে কথোপকথনের কিছু কৌশল।
Basic ASL Signs
শুরুতেই দেখে নেওয়া যাক Alphabet কে সাইন ল্যাংগুয়েজে কিভাবে প্রকাশ করা হয়।
অক্ষরজ্ঞান হলো, এবার দেখা যাক সংখ্যাকে কোন কোন সংকেতের সাহায্যে প্রকাশ করা হয়।
সহজেই অনুমেয়, আর দশটি ভাষার মতো ASL শিখতেও প্রয়োজন প্রচুর পড়াশোনা এবং অধ্যবসায়। তবে আমরা দৈনন্দিন জীবনে বহুল ব্যবহৃত কিছু সংকেত শিখে নিতে পারি সহজেই।
Hello
অনেকটা স্যালুট দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত কপালের কাছে এনে হাতের তালু মেলে ধরতে হবে।
Excuse me
এক হাতের তালু মেলে ধরে অন্য হাতের আঙ্গুলগুলো তালুর এমাথা থেকে ওমাথা আলতোভাবে ঘষতে হবে।
Help
এক হাতের তালু মেলে আরেক হাত তার উপর বসিয়ে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে হবে। সে অবস্থায়ই দুহাত আস্তে করে ওপরে উঠাতে হবে।
Hospital
হাতের দু’আঙ্গুল অপর হাতের কাঁধের কাছে নিয়ে একবার উপর নিচ এবং একবার আড়াআড়ি ঘষতে হবে (একটা কাল্পনিক ক্রস আঁকতে হবে)।
Hurry
দু’হাত মুঠো করে কেবল তর্জনী আর মধ্যমা বের করে ওপর-নিচ ওঠা-নামা করতে হবে।
Thank you
এক হাত চিবুকের কাছে আনতে হবে (আগে বিয়েতে বর যেভাবে মুখের কাছে রুমাল চেপে থাকতো অনেকটা সেরকম), তারপর হাত সামনে বাড়িয়ে দিতে হবে।
How much?
দুই হাতের আঙ্গুলগুলো একসাথে রাখতে হবে এমনভাবে যেমনটা আমরা লবণ নেওয়ার সময় করি, তারপর হাত উপরে এনে তালু মেলে হাত নাড়াতে হবে যেন হাতে কিছু নিয়ে আলতো করে ঝাঁকানো হচ্ছে।
Don’t know
আমরা রোদের ভেতর কোথাও তাকানোর সময় চোখ বাঁচাতে এক হাত চোখের উপর যেভাবে রাখি সেভাবে রাখতে হবে, তারপর আলতোভাবে ঘাম ঝেড়ে ফেলার মতো হাত নাড়তে হবে।
Sorry
হাত মুঠি করে বুকের কাছে নিয়ে বৃত্তের মতো করে ঘুরাতে হবে।
Understand/Don’t understand
হাত মুঠো করে মুখের পাশে এনে তর্জনী মেলে ধরতে হবে। এখন “Understand” বোঝাতে চাইলে মাথা ওপর-নিচ নাড়তে হবে, আর “Don’t understand” বোঝাতে চাইলে আড়াআড়ি নাড়তে হবে।
মুখের এক্সপ্রেশন যথাযথভাবে ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ!
Why
এক হাত কাঁধের সামনে এনে তালু ভাঁজ করে কেবল বুড়ো আঙ্গুল এবং কনিষ্ঠা বের করে রাখতে হবে।
Hungry
আমরা অনেকে পেটপুরে খেয়ে যেমন পেটে চাপড় মারি, সেরকম ভাবে এক হাত গলার নিচ থেকে পেট পর্যন্ত উপরনিচ বুলাতে হবে আলতোভাবে।
Quiet
দুই হাত মুখের কাছে এনে ক্রস সাইন তৈরি করে হাত দু’টো দুই দিকে ছড়িয়ে দিতে হবে নেতিবাচক ভঙ্গিতে।
লক্ষ্য রাখতে হবে যে বিষয়টি
হাত-মুখ-শরীরের অঙ্গভঙ্গিমার মাধ্যমে এই ভাষাটি প্রাণবন্ত হয়ে জীবনী শক্তি পায় মানুষের মাঝে। খুব সহজেই যে কেউ এই ভাষায় বুঝতে পারে মনের ব্যাকরণ! তাই যতটা সম্ভব প্রাণবন্ত থাকতে হবে।
আনন্দের সংকেতে মুখে হাসি ফোটানো, দুঃখের সংকেতে বিমর্ষ ভাব, ইতিবাচক/নেতিবাচক সংকেতে মাথা নাড়ানো- এগুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। মুখের এক্সপ্রেশন যথাযথভাবে ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ।
ASL শেখার জন্য Apps
খুব প্রাথমিক কিছু সংকেত জানা হলো। আরো শিখতে চাইলে সেজন্য চমৎকার কিছু অ্যাপস রয়েছে, প্লে স্টোরে গেলেই সেগুলোর খোঁজ মিলবে। যেমন:
ASL American Sign Language
চমৎকার একটি অ্যাপ ইশারা ভাষার জন্য। এখানে জীবিনে বিভিন্ন বিষয় যেমন “খাওয়াদাওয়া, স্কুল, রাস্তাঘাট, কাজ” এমন নানাবিধ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় শব্দে ভাগ করা আছে, এছাড়া কথোপকথন, সংখ্যা, বর্ণ ইত্যাদি আলাদাভাবেও শেখার ব্যবস্থা রয়েছে।
ProDeaf Translator
এখানে সাইন ল্যাংগুয়েজের অনুবাদ পাওয়া যাবে। এনিমেটেড ক্যারেক্টার বিভিন্ন সংকেত অঙ্গভঙ্গি করে দেখায় এবং সেগুলোর অর্থ জানায়।
ASL শেখার জন্য Youtube
যেহেতু ভাষাটি বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিমার মাধ্যমে প্রকাশিত, তাই শিখতে চাইলে ভিডিও দেখাই সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম। এজন্য দারুণ কাজের কিছু চ্যানেল রয়েছে ইউটিউবে। যেমন:
https://m.youtube.com/channel/UCze42SSwKeotHUSIJS6MPcA
https://m.youtube.com/user/billvicars
https://m.youtube.com/channel/UCsuBAbMlPGJ95w3mwhz-30g
https://m.youtube.com/channel/UCs79SiE-PD3AUy2clzrSlog
শেষ কথা
ইশারা ভাষা অনেক ক্ষেত্রে মুখের ভাষার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ভাষা হিসেবেই নয়, বডি ল্যাংগুয়েজ শেখার মাধ্যম হিসেবেও এর অনন্য তাৎপর্য রয়েছে। এর সঠিক প্রয়োগ ঘটাতে পারলে নিজেকে নতুন করে উপলব্ধি করতে পারবে।
যেমন একজন সাধারণ অভিনেতা আর তুখোড় অভিনেতার পার্থক্য যদি বুঝতে চাও, তাহলে সবার আগে নজর দিতে হবে বডি ল্যাংগুয়েজের দিকে। সাধারণ অভিনেতারা যেখানে নিজেকে চেপে রাখে, তুখোড় অভিনেতারা সেখানে সাবলীলতা নিয়ে আসে কথা বলার ধরণ, এক্সপ্রেশন ইত্যাদিতে। উপস্থাপকদের লক্ষ্য করলে তাদের অঙ্গভঙ্গিই তোমাকে অনেক কিছু বুঝিয়ে দেবে।
তাই সঠিক বডি ল্যাংগুয়েজ আয়ত্ত করতে পারলে চমৎকার ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠবে, সবার মাঝে অনন্য হয়ে উঠবে তুমি।
১০ মিনিট স্কুলের লাইভ এডমিশন কোচিং ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে সরাসরি চলে যেতে পারো এই লিঙ্কে: www.10minuteschool.com/admissions/live
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন