মূলত ‘ব্রিজ’ বা সেতু বলতে আমরা বুঝে থাকি নদী, খাল ইত্যাদি পারাপার কিংবা দুইটি উপত্যকার মাঝে সংযোগ করার সুবিধাজনক একটি রাস্তা। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে মানুষের সুবিধার জন্য হাজারো ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে সমস্ত ব্রিজই একটি নদী বা উপত্যকার দুটি পয়েন্ট সংযোগ করার জন্য একটি সুবিধাজনক রাস্তা হিসেবে পরিচিত নয়, বরং এর মধ্যে অসংখ্য ব্রিজ রয়েছে বিশ্বে যা একেকটি বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান। লক্ষ লক্ষ পর্যটক বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটে আসে সেসব ব্রিজ পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে।
বিশ্বখ্যাত এমন কয়েকটি ব্রিজ বা সেতু সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক, যা স্থাপত্য শিল্পের অলঙ্কার এবং প্রযুক্তির বিস্ময় ও একই সাথে পর্যটকদের প্রিয় স্থান।
ব্রুকলিন সেতু, নিউইয়র্ক
উনবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য নিদর্শন ব্রুকলিন ব্রিজ। নিউইয়র্কে অবস্থিত এই সেতুটি বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থাপনাগুলোর একটি। ১৮৬৯ সালে শুরু হয় এর নির্মাণ কাজ এবং ১৪ বছর পর ব্রিজটি ব্যবহারের জন্য খোলা হয়। ইস্ট নদীর ওপর নির্মিত ব্রিজটি ম্যানহাটন ও ব্রুকলিনকে যুক্ত করেছে।
ব্রুকলিন ব্রিজ মূলত একটি ঝুলন্ত সেতু। দুটি বিশালাকার টাওয়ার অসংখ্য ক্যাবল দিয়ে ধরে রেখেছে পুরো সেতুটিকে। টাওয়ার দুটির মাঝের দূরত্ব ৪৮৬ মিটার (১,৫৯৫.৫ ফুট)। আর সেতুটি ১.৮ কিলোমিটার (৫,৯৮৯ ফুট) দীর্ঘ। বড় টাওয়ারটির উচ্চতা ৮৪ মিটার (২৭৬ ফুট)।টাওয়ার দিয়ে টানা দেওয়া স্টিল ব্রিজটির ক্যাবল বা তার টানা সেতুর নকশা যে কাউকে চমকে দেবে। ব্রিজটি যখন নির্মাণ করা হয়, এটিই ছিল নিউইয়র্কের সবচেয়ে উঁচু হাতেগোনা কয়েকটি স্থাপনার একটি।
নিউইয়র্ক সিটির ল্যান্ডমার্ক ব্রুকলিন ব্রিজ। ম্যানহাটনের সঙ্গে নিউইয়র্ক সিটির যোগ করে দিয়েছে ব্রিজটি। ৬টি লেনে চলে গাড়ি। এলিভেটেড ট্রেন চলার সুযোগও রয়েছে। পথচারী ও বাইসাইকেল যাত্রীদের চলার জন্য আলাদা লেন রয়েছে। ১৮৮৩ সালের পর থেকে এখনো সমান গুরুত্ব নিয়ে ব্রিজটি ব্যবহার করছে সাধারণ জনগণ। রাতের শহর নিউইয়র্ক কখনো ঘুমায় না। যুক্তরাষ্ট্রের বুকের মধ্যখানে থাকা নিউইয়র্কের পূর্ব পাশের নদীর ওপর ব্রিজটির অবস্থান।
বহু আগেই শত বছর পেরিয়ে যাওয়া ব্রিজটির ওপর দিয়ে প্রতিদিন ১ লাখ ৫০ হাজার গাড়ি ও পথচারী পারাপার হয়। এক যুগেরও বেশি সময়ের এই নির্মাণযজ্ঞ বিশ্বকে দেখিয়েছে প্রকৌশলবিদ্যার অন্যতম সফল ডিজাইন। ১৪ বছরের এই নির্মাণযজ্ঞে হাত লেগেছিল মাত্র ৬০০ শ্রমিকের। সে সময়ই ব্রিজটি তৈরিতে খরচ হয় ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৩৫ বছর পুরনো ব্রিজটির নকশা করেছিলেন জন অগাস্টাস। ১৯১৫ সালে ব্রিজটির নাম সরকারিভাবে ‘ব্রুকলিন ব্রিজ’ ঘোষণা করা হয়।
গোল্ডেন গেট সেতু, সান ফ্রান্সিসকো
১৯১৬ সালে ব্রিজটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যস্ততায় এ সেতুটির প্রতি মনোযোগ দিতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। সেতু নির্মাণের আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয় ১৯৩৩ সালে এবং প্রায় বাইশ বছর ধরে এর নির্মাণ কাজ চলে। সেতুটির দৈর্ঘ্য ২.৭ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ২৭.৪০ মিটার (৯০ ফুট)। ব্রিজটিতে লেন আছে মোট ছয়টি। স্যান ফ্রান্সিসকোর সঙ্গে মেরিন কান্ট্রির যোগাযোগ ব্যবস্থার আশ্চর্য নিদর্শন এই সেতুটি।
যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোর অহংকার বলা যায় গোল্ডেন গেট ব্রিজকে। শুধু নামেই গোল্ডেন গেট না কাজেও সোনার মতো দামি ও গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজ এটি। দৃষ্টিনন্দন ব্রিজের তালিকা করলেও নাম চলে আসবে এটির। যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৌশলী জোসেফ বার্মেনের সেরা কাজ এটি। ১৯৩৭ সালে এই ব্রিজটি সবার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল। সানফ্রান্সিসকোর পশ্চিম তীরের এই ব্রিজটি গোটা শহরের আইকন। এর রং নিয়েও চোখ ধাঁধানো ধাঁধা রয়েছে। রোদে পোড়া ব্রিজটি দেখতে লাল টকটকে হলেও আর্কিটেকচারের দল কিন্তু বলছে রংটি কমলা। না, শুধু কমলা বললে ভুল হবে, ইন্টারন্যাশনাল অরেঞ্জ বা ‘বিশ্ব স্বীকৃত কমলা’ বলাই ভালো। ঘন কুয়াশায় ব্রিজটি দেখতে মায়াবী। মনে হবে কুয়াশার চাদরে ডুবে গিয়েছে ব্রিজের অন্য প্রান্ত। কবি-সাহিত্যিকরা একটু এগিয়ে বলেছেন, কুয়াশায় স্বর্গের দুয়ারে গিয়ে বুঝি ঠেকেছে ব্রিজের অপর প্রান্ত! ৯০ ফুট প্রশস্ত বিশাল এই ব্রিজটি দৈর্ঘ্য ৭৪৬ ফুট। সবচেয়ে বড় স্প্যানটি ৪ হাজার ২০০ ফুটের! চমকে গেলেন? এ তথ্য শুনে চমকে ওঠাই স্বাভাবিক।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ছবি তোলা হয়েছে যে জায়গাগুলোর, তাদের মধ্যে অন্যতম এই সেতুটি। এই সেতুটি দেখতে প্রতিদিন হাজার হাজার ভ্রমণপিপাসু মানুষ ভিড় করে। ব্রিজটি ‘সোনালী দুয়ার’ নামেও পরিচিত। ব্রিজটি বেশি জনপ্রিয় তাদের কাছে যারা পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করতে কিংবা সাইক্লিং করতে পছন্দ করেন।
সিডনি হারবার সেতু, অস্ট্রেলিয়া
পৃথিবী বিখ্যাত ব্রিজগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে সিডনি হারবার ব্রিজ। গিনেজ বিশ্বরেকর্ড অনুযায়ী বিশ্বের একক স্প্যানবিশিষ্ট সবচেয়ে প্রশস্ত সেতু হলো এই ব্রিজটি। সিডনি হারবার সেতুটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইস্পাত তোরণ সেতু, যার উচ্চতা পানির স্তর থেকে ১৩৪ মিটার বা ৪৪০ ফুট উপরে। অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থিত এ ব্রিজটি বিশ্বের মানুষের কাছে এতটাই পরিচিত যে অনেক ক্ষেত্রে এটিকে অস্ট্রেলিয়ার পরিচয়বাহী চিহ্ন হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। প্রায় ১ হাজার ১৪৯ মিটার দীর্ঘ এ সেতুটি নির্মাণ করতে সে সময় লেগে গিয়েছিল প্রায় দশ বছর। সেতুটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৩২ সালের ১৯ মার্চ খুলে দেওয়া হয়।
সেতুটি নির্মাণে সে সময় খরচ হয়েছিল প্রায় ৬২ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড। কিছুটা কান্নাও মিশে আছে সেতুটি নির্মাণের সঙ্গে। কমপক্ষে ১৬ জন শ্রমিক প্রাণ হারান সেতুটি নির্মাণের সময়। সিডনির বাসিন্দাদের কাছে ‘কোর্ট হ্যাঙ্গার’ বলে অভিহিত এ সেতুটিকে যখন খুলে দেওয়া হয় তখন এটি প্রথমবারের মতো সিডনির বিখ্যাত পোতাশ্রয়ের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তের মধ্যে সংযোগ রচনা করে। চালু হওয়ার প্রথম দিকে প্রতিদিন সেতুটি অতিক্রম করত প্রায় ১১ হাজার যানবাহন। কিন্তু বর্তমানে সেতু ব্যবহারকারী যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজারে। এখানে অনুষ্ঠিত হওয়া বিশ্ববিখ্যাত আতশবাজির খেলা হচ্ছে সিডনি হারবার ব্রিজের মূল বিশেষত্ব। সেতুটির অসাধারণ সৌন্দর্যের জন্য এটি অস্ট্রেলিয়ার একটি আন্তর্জাতিক প্রতীক হয়ে আছে।
সায়োসে পল, ইরান
পানির ওপর ইরানের সবচেয়ে দীর্ঘ স্থাপত্য সায়োসে ব্রিজ। সায়োসে ব্রিজটির নির্মাণশৈলী এখনো স্থপতিদের বিস্ময় জাগায়। পানির ওপর দোতলা এই ব্রিজটি দেখে মনে হবে তোরণের ওপর তোরণ বসানো রয়েছে। ফারসি ভাষায় সায়োসে মানে ৩৩ ব্রিজ বা ৩৩টি খিলান রয়েছে যে ব্রিজে। ব্রিজটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১৫৯৯ সালে। শেষ হয় তিন বছর পর। ১৬০২ সালে এটি খুলে দেওয়া হয়।
২৯৮ মিটার দীর্ঘ এবং ১৩.৭৫ মিটার প্রশস্ত ব্রিজটিতে ৩৩টি স্প্যান রয়েছে। সবচেয়ে দীর্ঘ স্প্যানটি ৫.৬ মিটার উঁচু। ব্রিজটির স্থাপত্যশৈলীর কারিশমা অনেকেরই অজানা। জায়ান্দে নদীর ওপর থাকা ব্রিজটির নকশার কারণে পানির স্রোত হুট করেই বেড়ে যায়— যা অনেকে ভাবতেই পারেনি। দক্ষিণ প্রান্তে যেখানে ব্রিজটি এসে থেমেছে সেখানে ছোট ছোট ঘর বানিয়ে পধচারীদের বিশ্রামের ব্যবস্থা ছিল। দুই তলা ব্রিজের পথচারীদের হাঁটার জন্য ব্রিজের দুইপাশেই ধনুকের মতো জানালা রয়েছে।
টাওয়ার ব্রিজ লন্ডন, মার্কিন যুক্তরাজ্য
লন্ডন ডকসে প্রবেশাধিকার বজায় রাখার জন্য থিমস থেকে ইসের উপর টাওয়ার ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়েছিলো ১২০ বছর আগে। এই অসাধারণ স্থাপত্যকে লন্ডনের সবচেয়ে জনপ্রিয় আইকন হিসেবে ধরা হয়। যুক্তি দিয়ে বলতে গেলে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর স্থাপত্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার মতো একটি নির্মাণকাজ। ব্রিজটির চমৎকার ডিজাইন আপনাকে তাক লাগিয়ে দেবে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থেকে আর চারপাশের আরো অনেকটা সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে সময়টা দারুণ কাটবে এ স্থানে।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, বাংলাদেশ
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। নির্মাণের পর ১০০ বছর পেরিয়ে যাওয়া হার্ডিঞ্জ ব্রিজটি রয়েছে পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে। ব্রিটিশরা এই ব্রিজ তৈরি করতে সে সময় খরচ করে ৩ কোটি ৫১ লাখ ৩২ হাজার ১৬৪ টাকা। ইতিহাস বলছে, দেশি-বিদেশি পর্যটকের যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের সুবিধার্থে নদীর ওপর ব্রিজ তৈরির প্রস্তাব পেশ করা হয়। ১৯০৮ সালে ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করে তৎকালীন সরকার।
২৪ হাজার ৪০০ শ্রমিক দীর্ঘ ৫ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৯১৪ সালের শেষের দিকে ব্রিজটির কাজ শেষ করে। ১৯১৫ সালের ১ জানুয়ারি পরীক্ষামূলকভাবে ডাউন লাইন দিয়ে প্রথম মালগাড়ি চালানো হয়। দুই মাস পর ৪ মার্চ ডবল লাইন দিয়ে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়। সেদিনই ব্রিজটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হাডিঞ্জ। তার নামানুসারে ব্রিজটির নামকরণ হয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ১০০ বছরের গ্যারান্টি দিয়ে বলেছিল, এ সময়ের মধ্যে ব্রিজটির কোনো প্রকার পরিবর্তন ঘটবে না। সেটাই সত্যি হলো।
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন