ইউক্রেন সংকট
এই দশকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ধরা যায় রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর স্নায়ু যুদ্ধের রেশ শেষ হয়ে যাওয়া নিয়ে যখন সারা বিশ্ব আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছিল, ঠিক তখনই রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ যেন আবার সেই স্নায়ু যুদ্ধকে নতুন রূপে আমাদের সামনে এনে হাজির করলো।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা করোনা অতিমারী পরবর্তী পৃথিবীর কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে অনেক তত্ত্ব নিয়ে ইতোমধ্যেই হাজির হয়েছেন। আর এমন সময়ে পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণ যে আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে একটা বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে তা অবশ্যম্ভাবীভাবেই বলা যায়।
এখন প্রেসিডেন্ট পুতিন কী কারণে ইউক্রেন আক্রমণের মত একটি বড় পদক্ষেপ নিলেন এই প্রশ্নটি সবার মনে। আমি এই লেখায় চেষ্টা করবো কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করার। একইসাথে এই আক্রমণের যৌক্তিকতা ও ফলাফল নিয়েও নিজস্ব মতামত ব্যাখ্যা করবো।
ভ্লাদিমির পুতিনের সাইকোলজি
যেকোনো রাষ্ট্রপ্রধানের সাইকোলজি, তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনেকাংশেই সেই রাষ্ট্রের গতিপ্রকৃতি ঠিক করে দেয়। ভ্লাদিমির পুতিন গত ২৩ বছর যাবৎ বিভিন্ন রূপে রাশিয়ার নেতৃত্বে আছেন। এর আগে তিনি ছিলেন দুনিয়া কাঁপানো গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির এজেন্ট। স্নায়ু যুদ্ধের প্রভাব যে তাঁর মনোজগতে বেশ ভালোভাবেই বিধিবদ্ধ তা পুতিনের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পলিসিতে বেশ ভালোভাবেই বোঝা যায়।
আর এ কারণেই ২০০৮ এর জর্জিয়া যুদ্ধ, ২০১৪ এর ক্রিমিয়া দখল আর এবারে ইউক্রেন আক্রমণ প্রত্যেকটি জায়গায় যে ব্যাপারটি সবার সামনে মূর্ত হয়ে উঠেছে তা হল ভ্লাদিমির পুতিনের সোভিয়েত জাতীয়তাবোধ। এ কারণে অনেকেই আশংকা করছেন এই যুদ্ধের শেষ কি ইউক্রেনে যেয়েই হবে নাকি এই দাবানল আরো অনেক দিকে অগ্রসর হবে? যদি হয়, তাহলে ইউরোপ যে আবারো একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে তা বলাই বাহুল্য।
আমেরিকার অর্থনীতিতে মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের প্রভাব
সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমেরিকার দিন ভালো যাচ্ছে না। আফগানিস্তানে দীর্ঘ ২০ বছরের বেকার যুদ্ধ যেন আরেকটি ভিয়েতনাম যুদ্ধের লজ্জা লেপন করলো বিশ্ব পরাশক্তিদের গায়ে। তার ওপর, করোনা অতিমারীতে আমেরিকা যে পরিমাণ ভুক্তভোগী হয়েছে, নিজের দেশেই বিশ্ব পরাশক্তিরা এখন ইমেজ সংকটে। আর বিশ্ব অর্থনীতিতে চায়নার উত্থান এবং করোনা অতিমারী ভালোভাবে সামাল দেয়া যেন আমেরিকার বৈশ্বিক ইমেজকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
আমেরিকার অর্থনৈতিক কাঠামোতে মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের বেশ বড় প্রভাব রয়েছে। ব্যাপারটা একটু সহজ করে ব্যাখ্যা করি। আমেরিকার অর্থনীতি অনেকটাই অস্ত্র বেচা-বিক্রির ওপর নির্ভরশীল। তাই বিশ্বে কোনো জায়গায় যুদ্ধ লাগাটা আমেরিকার অর্থনীতি চালিয়ে রাখার জন্যই দরকার। আমরা যদি ইউক্রেন সংকটে রাশিয়াকে একপক্ষীয়ভাবে দোষারোপ করে থাকি তাহলে ভুল হবে। কারণ, আমেরিকা খুব ভালো করেই রাশিয়ার ইনসিকিউরিটির কথা জানে। ন্যাটো যদি রাশিয়ার দোরগোড়ায় চলে যায়, তাহলে রাশিয়া সেটাকে কোনোভাবেই ভালোভাবে নেবে না এটা আমেরিকা ভালোই জানে। এমনকি এই একই ব্যাপার আমেরিকার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
বিসিএস প্রিলি লাইভ কোর্স
কোর্সটিতে যা যা পাচ্ছেন:
১৯৬২ সালে কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসের সময় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন তো এই একই কাজই করতে চেয়েছিল। এখন কিউবাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের মিসাইল থাকা আমেরিকার জন্য যেরকম থ্রেট ঠিক একইরকম থ্রেট তো ইউক্রেনে আমেরিকার মিসাইল থাকা! ১৯৬২ সালে আমরা দেখেছি কীভাবে আমেরিকা রাশিয়ার বিরুদ্ধে রিয়্যাক্ট করেছে। সেই সময় একটি নিউক্লিয়ার যুদ্ধ বেঁধে যায় যায় এমন অবস্থাই কিন্তু হয়েছিল। তবে জন এফ কেনেডি এবং নিকিতা ক্রুশ্চেভের রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় সংকটটি যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়নি।
এত কিছু জেনেও আমেরিকা কিন্তু একবারও বলেনি তারা ইউক্রেনকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করবে না। কারণ তারা নিজেরাও রাশিয়াকে যুদ্ধের জন্য প্রলুব্ধ করতেই চেয়েছিল। আর যুদ্ধ হলেই অস্ত্র বিক্রি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাশিয়াকে কোণঠাসা দুটোই করা যাবে। আমেরিকা তার ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের লক্ষ্য পূরণে এখানে অনেকটাই সফল। শুধুমাত্র বেশকিছু বেসামরিক মানুষের জীবন আর সম্পদ নষ্ট হল। আমেরিকার ভাষায় তো এটাকেই বলে ‘Collateral Damage’.
ইউক্রেনের ভুল
যদিও এখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জিয়েলেন্সকি জাতীয় বীরে পরিণত হয়েছেন তবে তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার যথেষ্ট ঘাটতি এখানে প্রকাশ পেয়েছে। প্রতিটা রাষ্ট্রের বোঝা উচিত সে কোন বাস্তবতায় অবস্থান করে। একটি নিউক্লিয়ার সুপারপাওয়ারের সাথে সীমানা শেয়ার করে সেইখানে তারই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে যোগ দেয়ার চিন্তা করা রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। এখানে ইউক্রেন খুব স্বাভাবিকভাবে একটি শান্তিপূর্ণ ‘বাফার স্টেটের’ মত আচরণ করতে পারতো। ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরীতা নয়’ এই স্ট্র্যাটেজিতে থাকলে সেটি ইউক্রেনের জন্যও ভালো হতো। এখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট যখন বলেন বিভিন্ন দেশের নেতাদের ফোন দিয়ে কারো কাছ থেকে সহায়তা পাননি- তখন এই ধরনের অভিযোগ অনেকটাই শিশুতোষ, এই ধরনের আবেগের জায়গা বিশ্ব রাজনীতি নয়। এসব কথা বলে পপুলিস্ট নেতা তিনি হতে পারবেন, এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে তাঁর জনপ্রিয়তাও অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু দেশ হিসেবে ভুক্তভোগী হলো ইউক্রেন।
আরো পড়ুন: উচ্চশিক্ষায় রিকমেন্ডেশন লেটার: কেন? কীভাবে?
পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণ কি আসলেই যুক্তিযুক্ত?
সকল যুদ্ধ তত্ত্ববিদ-যেমন সান জু, চাণক্য, ক্লসউইটজ, একটা ব্যাপারে একমত। আর সেটা হলো, যুদ্ধ করতে হলে আগে ঠিক করা প্রয়োজন, ‘আমি কেন যুদ্ধ করছি? কী জন্য যুদ্ধ করছি?” নেপোলিয়ন বলেছিলেন, “If you want to take Vienna, take Vienna.” অর্থাৎ যা জেতার জন্য এসেছো তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকো। এর বাইরে যেয়ো না। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের ক্ষেত্রে বারবার এই প্রশ্নটাই আমার কাছে এসেছে,”রাশিয়া কেন যুদ্ধ করছে? এই যুদ্ধ থেকে সে কী জিততে চায়?” যদি ইউক্রেনকে ভয় দেখানোই উদ্দেশ্য হয় তাহলে রাশিয়া-ইউক্রেন বর্ডারে ২ লক্ষ সৈন্য জড়ো করে রাখাই ইউক্রেনকে কিংবা পশ্চিমা শক্তিকে ভয় দেখানোর জন্য যথেষ্ট। যুদ্ধের মত একটা বড়ো পদক্ষেপে যাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা ছিল না।
এরকম একটা সময়ে যুদ্ধের মত বড়ো কোনো পদক্ষেপে যাওয়ার আগে এই প্রশ্নগুলোর পরিষ্কার উত্তর থাকা দরকার ছিল। আর এরকম শক্তিশালী কারণের অভাবে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য রাশিয়াকে যে মূল্য পরিশোধ করতে হবে তা রাশিয়া কতটুকু করতে পারে এখন সেটাই দেখার বিষয়।
কোর্সটিতে শিক্ষার্থীরা পাবে:
ভার্সিটি B Unit + গুচ্ছ এডমিশন কোর্স ২০২২
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের ভবিষ্যৎ
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কাঠামোতে নতুন স্নায়ু যুদ্ধের সূচনাবিন্দু হিসেবে কাজ করবে। তবে এই স্নায়ু যুদ্ধের মূল খেলা যতটা না আমেরিকা বনাম রাশিয়া থাকবে তার চেয়ে বেশি থাকবে আমেরিকা বনাম চীন। রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা এমনিতেও বিশেষ ভালো ছিল না। এই যুদ্ধের পর বিভিন্ন অর্থনৈতিক অবরোধ রাশিয়াকে মোটামুটি একঘরে করে ফেলবে। এতে যেটি হবে রাশিয়া আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে চীনের ওপর। আর রাশিয়ার বিপুল জ্বালানি ভাণ্ডার চীনের বিশাল জ্বালানি ক্ষুধা মেটাতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এতে পূর্ব ইউরোপে চীনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান আরও সুদৃঢ় হবে।
বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকার এখন সবচাইতে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী চীন, আর রাশিয়ার চীনের ওপর নির্ভরতা এই প্রতিযোগিতাকে আরো বাড়িয়ে দেবে। তবে সবার মনে যে প্রশ্ন, এই যুদ্ধ কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটাবে কি না? কারণ, রাশিয়ার মতো একনায়কতান্ত্রিক একটি দেশে যুদ্ধে যাওয়াটা যতটা সহজ, ইউরোপের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর জন্য ততটা সহজ নয়। আর আমেরিকা নিজেই চাইবে না এখন একটি ফুল স্কেল যুদ্ধে যেতে। এর চেয়ে অস্ত্র বেচে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া আর রাশিয়াকে ইউক্রেনের সামনে এগিয়ে কোণঠাসা করে দেয়া আমেরিকার জন্য রথ দেখা আর কলা বেচার মতই লাভজনক। তাই আমার মতে, এই মুহূর্তে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা করার সময় আসেনি। তবে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি সবসময় আনপ্রেডিক্টেবল। প্রেডিক্টেবল হলে তো আর দুটো বিশ্বযুদ্ধ হতো না!
লেখক:
কে. এম. রাফসান রাব্বি
সাবেক সহকারী পরিচালক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
৪০তম বিসিএস ‘প্রশাসন ক্যাডার’-এ সুপারিশপ্রাপ্ত (মেধাক্রম: ৪৮)
আমাদের কোর্সগুলোর তালিকা:
- Communication Masterclass by Tahsan Khan
- Facebook Marketing Course by Ayman Sadik and Sadman Sadik
- ঘরে বসে Freelancing by Joyeta Banerjee
- ঘরে বসে Spoken English Course by Munzereen Shahid
- Study Smart Course by Seeam Shahid Noor
আপনার কমেন্ট লিখুন