১.
আমার কাজিনের দলটা ভালোই বড়। নিজেকে এবং আমার বড়বোনকে বাদ দিলেও কাজিনের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। আমার কাজিন আছে ২২ জন। অর্থাৎ আমরা মোটমাট ২৪ জন ভাইবোন। এই বিশাল কাজিন গোষ্ঠীর মধ্যে আমি হলাম সবচেয়ে ছোট বোন। তাই ছোটবেলা থেকেই ভালোই আদর পেয়ে এসেছি বড় ভাইবোনদের কাছ থেকে। এবং যেহেতু আমি সবচেয়ে পিচ্চি সদস্য আর সেই আমিই কিনা পড়ছি ভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারে তাই হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতেই পারছো আমি স্কুলে থাকতেই খালা হয়ে গিয়েছি অনেকবার।
সেই যে ছোট থেকে আদর পেয়ে আসছি সেই আদরে আস্তে আস্তে ভাগ বসাচ্ছে আমার কাজিনদের ছেলে মেয়ে গুলো! আমার তেমন একটা অভিযোগ নেই অবশ্য। বাচ্চাগুলোর ন্যাকা ন্যাকা কণ্ঠে কেকা খালামণি শুনতে আমার ভালোই লাগে।
তো যাই হোক, আমরা কাজিনরা সবাই এক শহরে থাকি না। সবাই যে যার লাইফ নিয়ে অনেক অনেক ব্যস্ত। কেউ কেউ ঢাকায় থাকি, কেউ কেউ চট্টগ্রাম, কেউ সিলেট, কেউ ময়মনসিংহে থাকি। বলা যায়, আমার এই বিশাল কাজিন গ্রুপটা দেশের নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে আছে। গেলো ইদের ছুটিতে আমরা সবাই আমাদের নানুবাসায় ইদ করলাম। ব্যাপক হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে দিয়ে দিন কাটালাম।
এই ইদের ছুটিতেই আবার আমার এক কাজিনের ছেলের জন্মদিন পড়লো। রাজ্য, সাত পেরিয়ে আটে পড়লো মাত্র। যেহেতু আমাদের কাজিনদের তেমন দেখা সাক্ষাৎ হয় না তাই আমি ভাবলাম রাজ্যর জন্মদিন সেলিব্রেট করে একটা বিশাল পার্টি করতে পারলে মন্দ হয় না!
তো আমি কি করলাম, বীরদর্পে গিয়ে আমার বড় কাজিনদের ঘোষণা দিয়ে আসলাম আমি রাজ্যর জন্মদিন পালন উপলক্ষ্যে একটা পার্টির আয়োজন করব। পাশাপাশি এটাও বলে আসলাম পার্টির সব দায়িত্ব আমার। তোমরা শুধু পার্টিতে আসবে এইটাই। যদিও বড় ভাইয়া আপুরা অনেকবার বলেছে ওরা পার্টিতে কিছু হেল্প করতে চায় টাকা পয়সা দিয়ে আমি অনেক ভাব নিয়ে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি। আর রাজ্যও ভারী খুশি কেকা খালামণি ওর বার্থডে করবে!
২.
আমি খুব ভাব নিয়ে কাজ শুরু করলেও আমার এই ভাবটা বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। কারণ, অর্থ সংকট। একটা বড় বার্থডে পার্টি আয়োজন করার মতো পর্যাপ্ত টাকা ছিল না। মূলত, খাওয়া দাওয়া আর কেকের পিছনের সব টাকাই শেষ করে ফেলেছি আমি! কিন্তু পার্টির মূল আকর্ষণ হচ্ছে সেটির ডেকোরেশন! অথচ সেটি করার মতো আমার কাছে টাকাই নেই! ডেকোরেশন ছাড়াও কোনোরকমে পার্টি আয়োজন করা যায়, তবে আমি নাছোড়বান্দা। রাজ্যকে যখন প্রমিজ করেছি একটা সুন্দর বার্থডে পার্টি হবে তখন সেই পার্টিতে সবই থাকবে।
তো আমি বসে বসে ভাবতে লাগলাম। কিভাবে একদম কম খরচে বলতে গেলে প্রায় বিনামূল্যে অথচ অনেক অনেক চমৎকারভাবে ডেকোরেশনটা সারা যায়।
ভাবতে ভাবতেই যেন আমার মাথার জট খুলে গেলো! ইউরেকা বলে চিৎকার দিয়ে সাথে সাথে কাজে লেগে পড়লাম। হাতের আশেপাশে যত কাগজ, রঙ্গিন কাগজ, খবরের কাগজ, রং, পেন্সিল, কাঁচি সব নিয়ে বসে পড়লাম।
ফলাফল কি জানো? একটি জমকালো বার্থডে পার্টি। আয়োজক হিসেবে আমি পুরোপুরি সফল! আর রাজ্য পিচ্চিটার খুশি দেখে তো মন জুড়িয়ে গিয়েছিল।
তো যেই জিনিসটার জন্য আজকে আমাকে সফল আয়োজকের খেতাব দেওয়া হলো আজকে সেটিই তোমাদের সাথে শেয়ার করতে যাচ্ছি যাতে করে তোমরা কখনো আমার মতো অর্থসংকটে পড়ো তারপরো অনেক ধুমধাম করে যেকোনো কিছু আয়োজন করতে পারতো।
আমাকে হেল্প করা বিষয়টাকে বলে অরিগ্যামি। এই অরিগ্যামির জন্যই আমি আমার ভাবটা বজায় রাখতে পেরেছিলাম সেদিন!
৩.
অরিগ্যামি (Origami) শব্দটা আসলে জাপানিজ আর্টের সাথে অনেক বেশি পরিচিত। আসলে অরিগ্যামি হচ্ছে জাপানিজ ক্র্যাফট।
আচ্ছা এখন ব্যাপারটা হচ্ছে, এই যে আমি এত অরিগ্যামি অরিগ্যামি করছি জিনিসটা আসলে কি? কাগজ দিয়ে বিভিন্ন বস্তু বানানোর শিল্পকেই অরিগ্যামি বলে। ঐ যে আমরা ছোটবেলাতে নৌকা, প্লেন এসব বানাতাম না? আসলে অইগুলোই হলো অরিগ্যামি। তবে অরিগ্যামি শুধু নৌকা আর প্লেন বানানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। সামান্য এক কাগজ দিয়েই যে কত কিছু বানানো যায় সেই শিল্পকেই বলে অরিগ্যামি।
ধরো, তোমার কাছে এক টুকরো কাগজ আছে। সেটি তুমি বিভিন্নভাবে ভাঁজ করলে। একবার ডানদিকে ভাঁজ করলে আরেকবার বাম দিকে এভাবে করতে করতে সেই এক টুকরো কাগজ থেকেই একটা কিছু বানিয়ে ফেললে! কাগজের ভাস্কর্য বলতে পারো। এই যে যা করলে কাগজ দিয়ে সেটিকেই অরিগ্যামি বলছি।
আগেই তো বলেছি, অরিগ্যামির সূত্রপাত হয়েছে জাপানে। তাই শব্দটির উৎপত্তিও যে জাপানে সেটা বলাই বাহুল্য। অরি (Ori) মানে হচ্ছে ভাঁজ করা আর কামি (kami) মানে হচ্ছে পেপার। পরবর্তীতে কামি (kami) থেকে শব্দটা গ্যামি (gami) হয়েছে। এইভাবে কাগজ ভাঁজ করে নতুন কিছু বানানোর শিল্পের নাম হয়েছে অরিগ্যামি।
৪.
এখন কথা হচ্ছে অরিগ্যামি উদ্ভব কখন থেকে? অরিগ্যামির উদ্ভব বা আবিষ্কার নিয়ে কেউ আসলে সঠিক তথ্য দিতে পারেন না। তবে ইতিহাসবিদরা মনে করেন যেহেতু কাগজ নিয়ে মূল কাজ অরিগ্যামিতে তার মানে নিশ্চয়ই কাগজ আবিষ্কারের পরপরই এর উদ্ভব ঘটেছে। কাগজ আবিষ্কার করা হয় চীনে। ১০৫ খ্রিস্টাব্দের আশেপাশে করে। তারপর ষষ্ঠ শতাব্দীতে কাগজ জাপানে আসে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বা বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের হাতে করে।
কোর্সটি করে যা শিখবেন:
Facebook Marketing
সেই থেকে ধারণা করা হয় কাগজ ভাঁজ করার শিল্পটি আস্তে আস্তে শুরু হয়। প্রাচীন জাপানে কাগজকে অনেক দামি বস্তু হিসেবে ধরা হতো। তাই এটি আর্কিটেকচারে ব্যবহৃত হতো। আবার কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা বিয়ের অনুষ্ঠানেও অরিগ্যামির প্রচলন দেখা যেত।
শিন্তো (Shinto) ধর্মালম্বীদের বিয়েতে কাগজের প্রজাপতি বানানো হতো যা কিনা বিয়ের বর-কনের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। আবার সামুরাই যোদ্ধারা একে অপরকে এই কাগজের ভাঁজ করা শিল্প ব্যবহার করে উপহার দিতো, যা কিনা শুভকামনা বোঝাতো। তাই বলা যায় যে, হিউয়ান আমলে জাপানের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অরিগ্যামি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং অরিগ্যামি জাপানিজ ক্র্যাফটকে সমৃদ্ধ করতে এক বিশাল অবদান রাখছে সেই প্রাচীনকাল থেকেই।
এখন অরিগ্যামি অনেক বেশি নতুনত্বে ভরপুর। এই মর্ডান অরিগ্যামির জনক বলা হয় আকিরা ইয়োশিজাওয়াকে (Akira Yoshizawa, 14March, 1911- 14March, 2005)।
Akira Yoshizawa
তাঁর নিজের হিসেব অনুযায়ী ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ৫০ হাজারেরও বেশি অরিগ্যামিক মডেল বানিয়েছিলেন। কাগজের এই শিল্পকে তিনি দিয়েছেন এক নতুন মাত্রা। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে তিনি অরিগ্যামির কাজ শুরু করেন এবং নানারকমের জিনিস বা মডেল বানাতে থাকেন। শুধু তাই নয়, কাগজ ভাঁজ করে যে এত সব নতুন জিনিস বানানো যায় তার টেকনিক গুলোও তিনি লিপিবদ্ধ করে রাখেন।
তিনি সর্বমোট ১৮ টি বই লিখেছেন অরিগ্যামি টেকনিক নিয়ে। নিজের জন্মদিনেই মৃত্যুবরণ করা এই খ্যাতিমান ব্যক্তি Yoshizawa Randlett System নামে এক ডায়াগ্রামিং সিস্টেম তৈরি করেছেন Samuel Randlett কে সাথে নিয়ে। আমরা জানি, বিভিন্নভাবে কাগজ ভাঁজ করা যায়। একেকরকমের ভাঁজ আমাদের একেকরকমের মডেল বানাতে সাহায্য করে। সেই বেসিক ভাঁজের কথাই উল্লেখ আছে তার সিস্টেমটিতে।
বর্তমানে সারাবিশ্বে অরিগ্যামি শিল্পে তাঁর এই সিস্টেমটিকেই মেনে চলছে। এবং বানিয়ে যাচ্ছে হরেক রকমের বস্তু।
৫.
নানারকমের অরিগ্যামি আছে। সামান্য এক টুকরো কাগজ দিয়েও যে এত কিছু তৈরি সম্ভব তা ভাবলেই অবাক হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। যেমন ধরো, প্রথমেই বলা যাক কিরিগ্যামির কথা।
কিরিগ্যামি (Kirigami) :
কিরি (kiri) মানে হচ্ছে কাটা আর গ্যামি (gami) মানে হচ্ছে কাগজ। কিরিগ্যামির ক্ষেত্রে মাত্র দুইটি জিনিস লাগে। সেটা হচ্ছে কাগজ এবং আরেকটি হচ্ছে কাঁচি বা এন্টি কাটার। এখানে কোনো গ্লু লাগে না। কিরিগ্যামি আসলে অরিগ্যামিক আর্কিটেকচার (Origamic Architecture)।
Kirigami
একদম সহজ কথায় বুঝালে বলতে হয়, কিরিগ্যামি হচ্ছে পপ আপ আর্ট। আমরা ইদানিং পপ আপ বই দেখি না? সেগুলোই কিরিগ্যামি। দুইভাঁজ করা কাগজ খুললেই হুট করে একটা প্রাসাদ চোখে পড়বে! কি মজার তাই না?
মডুলার অরিগ্যামি (Modular Origami):
একে বলে ৩ডি অরিগ্যামি। এটা যেহেতু থ্রি ডাইমেনশনের কাজ তাই একটু জটিল বটে। আলাদা আলাদা কাগজের টুকরোগুলোকে জোড়া লাগানোর মধ্যেই জটিলতা দেখা যায়।
Modular origami
ওয়েট ফোল্ডিং অরিগ্যামি (Wet folding Origami):
নামেই পরিচয়! বুঝতেই পারছো জিনিসটা কি। অনেক সময় শুকনো কাগজ দিয়ে আমরা আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী আকার আনতে পারি না। কিন্তু কাগজটা যদি একটু ভিজা থাকে তাহলে নরম কাগজ দিয়ে সহজেই ইচ্ছামতো শেইপ আনা সম্ভব। আর কাগজ পরে শুকিয়ে গেলেই আমাদের মডেল তৈরি হয়ে যায়।
৬.
পাখি বানাতে চাও? নাকি প্রজাপতি? নৌকা? মাছ? প্লেন? বই? ফুল? ক্যামেরা? ল্যাপটপ? সবই বানানো যায় মাত্র একটুকরো কাগজ দিয়ে। তার জন্য অবশ্য কিছু বেসিক ভাঁজ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরি। নানারকম ফোল্ড বা ভাঁজ আছে। যেমন, Valley fold, mountain fold, balloon fold, kite fold, fish fold, nail fold, rabbit ear fold আরো কত কি!
আবার যদি একটা কাগজকে সমান তিনভাগে ভাগ করতে চাও তাহলে ঐটিকে বলে Z fold. চারভাগ করতে চাইলে বলে Gate fold. পাঁচভাগ করতে চাইলে সেটি হবে Stair fold.
Source : www.origami-make.org
পাশাপাশি কিছু শেইপের কথা জানতে হবে।
কিন্তু কথা হচ্ছে, এতকিছু শিখব কিভাবে? উত্তরটা একদমই সহজ! ইউটিউবে নানারকম চ্যানেল পাবে শুধু অরিগ্যামি শিখায়। যেমন ধরো, Kade chan, Henry pham, Jo nakashima, Happy folding ইত্যাদি। Kade chan এর কাগুজের গডজিলা বা Jo nakashimar ড্রাগন দেখলে মুগ্ধ না হয়ে পারবে না!
৭.
এই যে খালি অরিগ্যামি নিয়ে বলেই যাচ্ছি, এরকম পেপার কেটে, ভাঁজ করে জিনিস বানিয়ে লাভ কী? মূলত, এটি একটি রিয়েক্রিশনাল জিনিস। তবে যারা আমার মতো প্রায়ই অর্থসংকটে ভুগো তাদের জন্য এটি আয়ের উৎস হিসবে কাজ করতে পারে। কারণ, আমি আগেই বলেছি রাজ্যর বার্থডে পার্টির কথা। আমি একদম কোনো খরচ ছাড়াই কাগজ দিয়ে জিনিস বানিয়ে সুন্দর করে ডেকোরেশনের পার্টটা সেরে ফেলেছিলাম।
তোমরা চাইলে ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করতে পারো। আর তা করতে পারো ঘরে বসেই। এবং এতে মূলধন ও লাগবে অনেক অনেক কম। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডেকোরেশনের অর্ডার নিতে পারো শুধু তাই নয় ছোটখাটো মডেল বানিয়ে তা বন্ধুদের কাছে বিক্রিও করতে পারো! তাই বলছি, বসে না থেকে, এখনি শিখে নাও না অরিগ্যামি। এবং টুকটাক ব্যবসা শুরু করে দাও। আর যারা আমার মতো বার্থডে পার্টির আয়োজন করতে ভালোবাসো তোমরা অরিগ্যামি স্কিল ঝালাই করে নিয়ে নিজের ভাবটা একটু বাড়িতে নিতেই পারো!
তথ্যসূত্র :
১। http://www.origami-make.org/howto-origami-fold.php
২। http://www.origami.as/Info/history.php
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন