সাড়া জাগানো কন্সপিরেসি থিওরিগুলো প্রায় সমাধান হয়েই গেল বলতে গেলে। তবুও যদি সন্দেহ থেকেই থাকে তবে ভবিষ্যতে প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ব্লগ সাজানোর পরিকল্পনা আমার আছে। কিন্তু যুক্তি প্রমাণ দেখেও যদি বিশ্বাস করতে না চান তবে সেক্ষেত্রে আমি বিশ্বাসের কাছে পরাজিত। এই পর্বটিতে কোনো কন্সপিরেসি থিওরির সমাধানে যাচ্ছি না। এই পর্বে প্রমাণ করতে যাচ্ছি যে নাসা যে চাঁদে গিয়েছিল তার সত্যতা কি।
এখানে আমি পাশাপাশি থার্ড পার্টি অথেনটিকেশনের কথাও উল্লেখ করবো যারা নাসার ফান্ডে চলে না কিংবা আমেরিকার দালালও না। সেক্ষেত্রে ‘আমেরিকান প্রোপাগান্ডা’ কথাটি থেকে হয়তো মুক্তিলাভ করা যাবে।
আমি দেরী না করে সরাসরি মূল বিষয়ে প্রবেশ করি।
SELENE এবং অ্যাপোলো ১৫
ছবিটি লক্ষ করুন:
উপরের বাম ছবিটি ১৯৭১ সালে অ্যাপোলো ১৫ এর ক্রু দ্বারা তোলা হয়েছিল। এটা দেখে পঞ্চম পর্বের কথা মনে পরে গেল নিশ্চয়ই? যেখানে প্রমাণ করেছিলাম বেশ ভয়ানক একটি কন্সপিরেসি থিওরির সমাধান। যাই হোক এবার ডান পাশের ছবির দিকে তাকান। ডানের ছবিটি ২০০৮ সালে সেলেনে (SELENE) নামে পরিচিত একটি জাপানি চন্দ্রযান দ্বারা তোলা হয়েছিল। জাপানি ভাষায় এর নাম KAGUYA। যাই হোক এটি কক্ষপথে ঘুরপাক খাওয়ার সময় কয়েকটি ছবি তুলেছিল যার ত্রিমাত্রিক বা 3D ভিজ্যুয়ালিজেশন এটি। SELENE-এর ক্যামেরাটিতে বামের ছবির মতো পৃথক পাথরগুলি ধরার জন্য স্পষ্ট রেজ্যুলেশন ছিল না। ডানের এই ছবিটিকে বলে ট্যারেন ইমেজ(Terrain image)। আপনি গুগল ম্যাপে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখুন। বুঝতে পারবেন আশা করি।
তবে পাঠকরা এই বিষয়ে তো একমত যে দুটি ছবিই দৃশ্যত একই ভূখণ্ডের? চন্দ্রমিশন দুটি কিন্তু প্রায় ৩৭ বছরের আলাদা এবং দুটি পৃথক দেশের স্পেস এজেন্সিগুলি দ্বারা পরিচালিত।
এ থেকে কি বুঝা যায়? আচ্ছা আমি এখানেই সব প্রমাণ করে বিদায় নিচ্ছি না। চলুন SELENE-এর ফটোগ্রাফিগুলো থেকে আরও কিছু বিচার বিশ্লেষণ শুরু করি।
(Credit: NASA. Left Image: AS15-87-11719, Right Image: AS15-9430)
ছবিটি চন্দ্রপৃষ্ঠের প্রতিফলনজনিত পরিবর্তনকে নির্দেশ করে। বামের ছবিটি ল্যান্ডিংয়ের আগে এবং ডানের ছবিটি ল্যান্ডিং করার পরের ছবি। পরিবর্তন লক্ষ করতে পারছেন কিছুটা?
অ্যাপোলো ১৫ অবতরণের আগে এবং পরে পৃষ্ঠের প্রতিক্রিয়াশীল জনিত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে এখানে। বাম ছবিটি নিছক চন্দ্র মডিউল(অ্যাপোলো ১৫) থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এটি অ্যাপোলো ১৫ এর তোলা ছবি। ল্যান্ডিংয়ের পরে চাঁদের দ্বিতীয় কক্ষপথে আবর্তনরত ১১০ কিলোমিটার উচ্চতা থেকে কমান্ড পরিষেবা মডিউল থেকে ডান পাশের ছবিটি নেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ ডান পাশের ছবিটি হচ্ছে কমান্ড মডিউলের তোলা ছবি। সুতরাং এই চেনাশোনা এলাকায় ল্যান্ডিং সাইট রয়ে গিয়েছে তা সহজেই সেলেনের মাধ্যমে এখনো প্রমাণিত। আর ডান ছবিতে স্পষ্টত হালো স্পট বিদ্যমান। Halo বা হালো স্পট হচ্ছে জ্যোতিশ্চক্র বা দীপ্তিমান বর্ণবলয় বুঝায়। এই স্পটের কারণ একটাই, ইঞ্জিনের থ্রাষ্টারের ফলাফল। এখনো এই হালো স্পট ট্র্যাক করতে পারবেন গুগল মুনে গিয়ে।
3D view image around the Hadley Rille obtained by TC
অ্যাপোলো ১৫ মিশনের সময় মহাকাশচারীরা হেডলি রিলের কাছাকাছি মারে বাসাল্টের নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন। তারা নিশ্চিত করেছিলেন যে মারে ইম্ব্রিয়ামটি বেশিরভাগই লাভা প্রবাহের স্তর দ্বারা গঠিত ছিল, যার গভীরতা প্রায় দশ মিটারের কাছাকাছি।
এখানে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সেলেনের টিসি বা ট্যারেন ক্যামেরা বা থেকে প্রাপ্ত 3D দৃশ্যটি স্পষ্টভাবে রিলের প্রাচীরের উপরের অংশে লাভা প্রবাহের স্তরগুলি নির্দেশ করে যা অ্যাপোলো ১৫ মিশনের মহাকাশচারীদের তৎকালিন ভাষ্যমতে পুরোপুরি সঠিক। আর এই লাভা স্তরের খোঁজ অ্যাপোলো মহাকাশচারীরাই প্রথম অনুধাবন করেন যা পরবর্তীতে সেলেনে থেকে প্রাপ্ত ছবি দ্বারা সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। এই স্তর সম্ভবত প্রায় ৩.২ বিলিয়ন বছর আগে নির্মিত হয়েছিল।
এই ছবিটি ২৯ জানুয়ারী, ২০০৮ (জেএসটি) তে সেলেনের এইচডিটিভি (TC বা টেলিফোটো ক্যামেরা, আবার ট্যারেন ক্যামেরা ভেবে ভুল করবেন না) দ্বারা নেওয়া একটি কাটআউট। অ্যাপোলো ১৫ নভোযানের ল্যান্ডিং সাইট, পাশাপাশি মন্টেস অপেনিনুস, বামে হেইলি রিল এবং আর্কিমিডিস ক্র্যাটার (কেন্দ্রস্থলে) এই ছবিতে দেখা যায়। এগুলো পার করেই অ্যাপোলো ১৫ এর লুনার মডিউল নেমেছিল চন্দ্রপৃষ্ঠে।
Footprints
প্রায়ই দাবি করা হয় যে আমরা যদি সত্যিই চাঁদে যাই তাহলে পায়ের ছাপগুলো অবশ্যই সেই বায়ুমন্ডলহীন পরিবেশে অপরিবর্তিত রূপে রয়ে আছে এবং থাকবে। তাহলে হাবলের মতো একটি শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে সেই পায়ের ছাপগুলোর সরাসরি ছবি তুলে প্রমাণ করা সহজ হওয়া উচিতই বটে। কিন্তু হাবল এমন একটি শক্তিশালী টেলিস্কোপ যা সাধারণত ছায়াপথের গুপ্তচরবৃত্তিতে কাজ করে। এটি আলোকবর্ষ দূরের কোনো কিছুর অস্তিত্বের ধারণা দিতে পারবে, কিন্তু এটির চাঁদের মহাকাশযানের ছাপ বা পায়ের ছাপের মত সূক্ষ্ম ও বিশদভাবে ছবি তুলে প্রমাণ করার মতো রেজ্যুলেশন নেই। আর এখন অর্থাৎ ২০১৮ সালে এসে হাবলের সহায়তা নিয়ে পায়ের ছাপের ছবি তোলারও কোনো প্রশ্ন আসার কথা না, কারণ এসব আরও আগেই প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। শুধু আমাদের অজ্ঞতার চাদরটাই এখনো সরাতে পারিনি।
নিচের ছবিটি লক্ষ করুন:
অ্যাপোলো ১৪ মিশনের মহাকাশচারী অ্যালান শেপার্ড এবং অ্যাডগার মিচেলের রেখে যাওয়া হাঁটাহাঁটির পদচিহ্নগুলোএই ছবিটিতে দৃশ্যমান। চন্দ্র মডিউল এর মূল স্তরটিও দৃশ্যমান এই ছবিটিতে। (ক্রেডিট: নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টার / এএসইউ)
সৌভাগ্যক্রমে ২০০৯ সাল থেকে চাঁদের আশেপাশে কক্ষপথে প্রেরিত নাসার লুনার রকোনিসেন্স অর্বিটার(LRO বা এলআরও) নামের মহাকাশযান সকল ছবি পাঠিয়ে কন্সপিরেসি থিওরিগুলোর সমাপ্তি টেনেছে সেরা জবাব প্রদান করেই। এটি সমস্ত অ্যাপোলো ল্যান্ডিং সাইটগুলির সাম্প্রতিক ফটোগ্রাফ নিয়েছে। এই ছবিগুলো সঠিকভাবে সঠিক অবস্থানে অ্যাপোলো মহাকাশযান বা ফেলে যাওয়া ডিসেন্ট স্টেজের ছবিগুলো দেখাতে সক্ষম হয় এবং আশ্চর্যজনকভাবে মহাকাশচারীদের পায়ের ছাপও তুলতে সক্ষম হয়।
এখানে আরও দুটি ছবি লক্ষ করুন:
এই লিংকে গিয়ে এই ছবিটির একটি স্লাইডবার পাবেন। যা বামে থেকে ডানে নিলে পার্থক্য নিজ চোখেই দেখতে পাবেন। https://www.nasa.gov/mission_pages/LRO/news/apollo-sites.html
Larger version:
For details observation of this photo, please click this link here: https://www.nasa.gov/sites/default/files/images/584392main_M168000580LR_ap17_area.jpg
অ্যাপোলো ১৭ ল্যান্ডিং সাইটের দুটি এলআরও ছবি দেখতে পাচ্ছেন। প্রথম এক থেকে অন্যটি মুছে ফেলতে সাদা স্লাইডার বারে ক্লিক করুন এবং বাম থেকে ডানে টেনে আনুন। বাম ছবিটি ২০১১ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর মুক্তি পায়। আর ২০০৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এলআরও ইমেজের তোলা ডান ছবিটি একটি জুম-ইন ভার্সন যা ক্যাপচার করতে এলআরওকে নিম্নতর কক্ষপথে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। ছবিটি বাম ছবির চেয়ে লো কোয়ালিটির। আলোর এদিক সেদিক পার্থক্য, এলআরও ক্যামেরার কোণ এবং অন্যান্য ভেরিয়েবলগুলির কারণে ছবিটি পুরোপুরি লাইন আপ করা সম্ভব হয়নি।
(ক্রেডিট: নাসা গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টার / এএসইউ)
আপোলো ১৭ এর ল্যান্ডিং সাইটের চূড়ান্ত পায়ের ছাপসহ চাঁদের মাটিতে রোভার দ্বারা সৃষ্ট ট্র্যাকগুলি স্পষ্টভাবে ছবিতে দৃশ্যমান।
“আমরা চাঁদের নমুনা কোথায় নিয়েছি তা দেখার জন্য আরও স্পষ্টতার সাথে মহাকাশচারীর পদক্ষেপগুলি পুনরুদ্ধার করতে পারি”, বলেন নুহ পেট্রো গাস্বেলেটে, যিনি নাসা গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের চন্দ্র ভূতত্ত্ববিদ। সেই সাথে তিনি এলআরও প্রকল্পের বিজ্ঞান দলেরও সদস্য।
অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক মার্ক রবিনসন, যিনি লুনার রিকলনিসেন্স অর্বিটার ক্যামেরা (এলআরওসি)-এর প্রধান তদন্তকারী কর্মকর্তা, বলেন- “নিম্ন-উচ্চতায় সংকীর্ণ এঙ্গেলে ক্যামেরা দ্বারা তোলা চাঁদের পৃষ্ঠের ছবিগুলো আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে ধার দেয়। অ্যাপোলো ১৭’র ল্যান্ডিং সাইটে এখনো সেই রোভার ট্র্যাকের তীক্ষ্ণতা একটি দুর্দান্ত উদাহরণ। আগের ছবিগুলিতে রোভার ট্র্যাক দৃশ্যমান ছিল, কিন্তু এখন তারা পৃষ্ঠের উপর তীক্ষ্ণ সমান্তরাল রেখারূপে দেখা দেয়।”
ওয়াশিংটনের নাসা সদর দপ্তরের প্ল্যানেটরি বিজ্ঞান বিভাগের পরিচালক জিম গ্রিন বলেন, “এই ছবিগুলি আমাদের চমৎকার অ্যাপোলো ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দেয় এবং আমাদের সৌরজগতের অনুসন্ধানে এগিয়ে চলার জন্য আমাদের অণুপ্রেরণাকে ধরে রাখে।”
এলআরও গডার্ড কর্তৃক নির্মিত এবং পরিচালিত হওয়া এসব অনুসন্ধান প্রাথমিক গবেষণার জন্য ন্যাশনাল সদর দপ্তরে এক্সপ্লোরেশন সিস্টেম মিশন ডিরেক্টরেট দ্বারা অর্থায়ন করা হয়। এক বছরের সফল অনুসন্ধান অভিযানের পরে সেপ্টেম্বর ২০১০ সালে মিশনটি NASA’র মিশন পরিচালনায় বৈজ্ঞানিক গবেষণায় উদ্ভাবনের মনোযোগ আকর্ষণ করে।
Chandrayan-1
জাপানিজ সেলেনের মতো ভারতের চন্দ্রায়ণ-১ স্যাটেলাইট যানে ট্যারেন ম্যাপিং ক্যামেরা অ্যাপোলো হার্ডওয়্যার রেকর্ড করার জন্য যথেষ্ট রেজ্যুলেশন সম্বলিত ছিল না। যাই হোক সেলেনের মতোই, চন্দ্রায়ণ-১ স্বাধীনভাবে আপোলো ১৫ ল্যান্ডিং সাইটের চারপাশের হালকা ও এবড়োথেবড়ো মাটি প্রমাণ করে।
Change’s-2
চীনের দ্বিতীয় এই চন্দ্রমিশনটি বেশ দারুণ একটি অনিচ্ছাকৃত অনুসন্ধান চালিয়ে প্রমাণ করে দেয় নাসার চন্দ্রবিজয়ের কথা। ২০১০ সালে চালু হওয়া চ্যাং’ই-২, এটি চন্দ্র পৃষ্ঠের প্রয়োজনীয় ছাপসমুহ ধরে রাখতে সক্ষম। এটি অ্যাপোলো মিশনের ল্যান্ডিং সাইটের ছবিগুলো চিহ্নিত করার দাবি করেছে, যদিও প্রাসঙ্গিক ছবিসমূহ জনসমক্ষে চিহ্নিত করা হয়নি।
আজ এই পর্যন্তই থাক। পরবর্তী পর্বে আরও একটি প্রমাণ নিয়ে হাজির হবো।
তথ্যসূত্র এবং প্রয়োজনীয় ভিডিও:
http://global.jaxa.jp/press/2008/05/20080520_kaguya_e.html
https://www.nasa.gov/mission_pages/LRO/news/apollo-sites.html
https://en.wikipedia.org/wiki/Third-party_evidence_for_Apollo_Moon_landings
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন