পুরোটা পড়ার সময় নেই? ব্লগটি একবারে শুনে নাও!
খুব সকালে ক্লাস থাকায় ভার্সিটিতে চলে আসলাম তাড়াতাড়ি। ১ম ক্লাস শেষ হল। পরের ক্লাস একটু দেরিতে শুরু হবে। তাই, টাইম পাস করার জন্য ভাবলাম,মধুর ক্যান্টিনে যাব-ঐখানে ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্ক টা অনেক শক্তিশালী! কিন্তু ক্যান্টিনের সামনে এসে দেখি-এখনো ক্যান্টিনের দরজা খোলে নি। কি করা যায়-ভাবতে লাগলাম। সামনে হাঁটা দিব, এমন সময় কে যেন ডেকে উঠলো-“ কোথায় যাচ্ছিস? সামনে এসে বস!
“আমি পিছনে ফিরে কাউকে দেখলাম না।
এমন সময় আবার শোনা গেল- “এই, আমতলার সামনে এসে বস!”
আমি বসলাম। মধুর ক্যান্টিনের সাথে আমার সরাসরি কথা হচ্ছে! কয়জনের এই সৌভাগ্য হয়!!
আমাদের কথা শুরু হল।
আমি : কি খবর আপনার?
মধুর ক্যান্টিন : তুই দরজা বন্ধ দেখে চলে আসছিলি? জানিস , যখন এটা নবাবদের বাগানবাড়ি ছিল, তখন কত মানুষ বাইরে থেকে এক ঝলক আমাকে দেখেই খুশি হয়ে যেত?
আমি : নবাব, কোন নবাব?
মধুর ক্যান্টিন : এই তো তোদের জেনারেশনের সমস্যা! শুধু ফেসবুকেই যতসব বাহাদুরি! ইতিহাস নিয়ে কোন আগ্রহ নেই!
আমি : আপনি বলতে থাকেন। শুনি সেই ইতিহাস।
মধুর ক্যান্টিন : তৈরির সময় থেকেই(১৯০৪ সালে) ঢাকার নবাবদের বৈঠকখানা হিসেবে এই ঘরটি ব্যবহার করা হত। তখনকার নবাবদের উদ্যোগে তাদের দান করা জমির ওপর ঢাকা ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয় । এখন মধুর ক্যান্টিনটি যে জায়গায়, সেই বিল্ডিং এ একটি জলসাঘর ছিল নবাব আমলে।
আমি : মধুদা কবে এখানে আসেন?
মধুর ক্যান্টিন : মধুদার বাবা আদিত্য চন্দ্র দে ব্রিটিশ পুলিশের কাছ থেকে ২টি ছনের ঘর ৩০ টাকা দিয়ে কিনে এই এলাকায় ক্যান্টিন চালানো শুরু করেন।
আমি : ৩০ টাকা দিয়ে ২টি ঘর কিনেছিলেন! এখন তো ২টি ঘরের ছবি বড় করে কালার প্রিন্ট দিলেও এর চেয়ে বেশি টাকা লাগবে!
মধুর ক্যান্টিন : আরে গাধা, তখন ১ মণ চালের দাম ছিল ২ টাকা; ১টাকায় ৮ কেজি চিনি পাওয়া যেত ; ১ কেজি ডালের দাম ছিল ৬ পয়সা , ১ কেজি আটার দাম ছিল ২ পয়সা, ১ কেজি ময়দার দাম ছিল ৪ পয়সা!
আমি : ইশ, ঐ আমলে জন্মালে আমি আইফোন কিনতে পারতাম !
মধুর ক্যান্টিন : বাজে কথা রাখ! তো যা বলছিলাম- মধুদার বাবা আদিত্য চন্দ্র দে এক সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে ক্যান্টিনের দায়িত্ব পড়ে তার ছোট ছেলে মধুসূদন দে- আমাদের মধুদার ওপর। তিনি ১৯৩৪-৩৫ সাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বাবার সাথে খাবারের ব্যবসা শুরু করেন।
আমি : তখন মধুদার বয়স কত ছিল?
মধুর ক্যান্টিন : ১৫ বছর।
আমি : মাত্র ১৫ বছর!
মধুর ক্যান্টিন : অবাক হচ্ছিস? তোরা তো ১৫ বছর বয়সে ফেসবুক চালাতে পারলেই নিজেকে খুব বড় ভাবা শুরু করিস! আর মধুদা এই বয়সে সংসারের হাল ধরেছিলেন! ১৯৩৯ সালে বাবার মৃত্যুর পর মধুদা নিজেই ধরেন ব্যবসার হাল।
আমি : তিরিশের দশকে তো ওপার বাংলার অনেক বিখ্যাত মানুষও আসতেন এখানে?
মধুর ক্যান্টিন : তোরা বই পড়িস না? তা পড়বি কেন?
আমি : বই পড়ি তো- মুখবই (Facebook)!
মধুর ক্যান্টিন : তোরা তো ঐটাই পড়বি! বুদ্ধদেব বসু তাঁর লেখা “আমার যৌবন” বইয়ে স্মৃতিচারণ করে গেছেন: “বিশ্ববিদ্যালয় কম্পাউন্ডের এক প্রান্তে টিনের চালওয়ালা দর্মার ঘর, ভিতরে মলিনবর্ণ টেবিলের পাশে লম্বা ন্যাড়া টুল পাতা। এখানেই আমরা ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ করে থাকি, যেহেতু সারা তল্লাটে দ্বিতীয় কোন চা-ঘর নেই। আদিত্যর ভোজ্যতালিকা অতি সীমিত,কোনদিন তার স্বহস্তে প্রস্তুত মিষ্টান্ন ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না চায়ের সঙ্গে, কিন্তু তাতেও কিছু যায় আসে না আমাদের। গদ্য-পদ্য সমস্ত খাদ্যই আমাদের পক্ষে উপাদেয় ও সুপ্রাচ্য, সেগুলোর রাসায়নিক গুণাগুণ নিয়ে চিন্তিত হবার মতো দুর্দিন তখনও বহু দূর। আমাদের বন্ধুর দল ছুটির ঘন্টায়, কখনও কেউ ক্লাস পালিয়ে বসি গোল হয়ে ঘন ঘাসের উপর ঘনিষ্ট হয়ে আর ফরমায়েশের পর ফরমায়েশ ছাড়ি আদিত্যকে। অনেকখানি মাঠ পেরিয়ে আমাদের কলহাস্য ধ্বনিত হয় এক ক্লাসঘরে, যেখানে চারু বন্দোপাধ্যায় কবি কঙ্কন পড়াচ্ছেন। দাম দেবার জন্য পকেট হাতড়াবার প্রয়োজন নেই; লিখে রেখো এই বলাই যথেষ্ট। এই আদিত্যের এবং আমার পুরানো পল্টনের মুদিখানায় সিগারেটের দেনা পরিশোধ না করেই আমি ঢাকা ছেড়ে ছিলাম, সে কথা ভেবে আজকের দিন আমার অনুশোচনা হয়।”
আমি : “মধুর ক্যান্টিন”- এই নামটা কিভাবে আসে?
মধুর ক্যান্টিন : ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের দাবিতে ডাকসু (DUCSU) শুরু হয়। কলা ভবনের পাশে মধুদার দায়িত্বে ক্যান্টিন প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্যান্টিনটি যদিও ডাকসুর ছিল, তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী- কর্মচারীরা এটাকে ‘মধুর স্টল’ বা মধুর ক্যান্টিন বলেই ডাকতেন। ১৯৬২ সালে এখনকার কলাভবনের শিক্ষকদের লাউন্জ রুমে সরানো হয় এটা। এখানে বছর পাঁচেক চলার পরে ১৯৬৭ সালে এটি চলে আসে এখনকার মধুর ক্যান্টিনে।
এমন সময় দূর থেকে গান ভেসে আসে। কোন একটা ডিপার্টমেন্টের Rag Day হচ্ছে মনে হয় । তাহসানের গান বাজছে ……
মধুর ক্যান্টিন: এই তাহসান ছেলেটা তো বেশ পপুলার।
আমি : উনি তো মহান!
মধুর ক্যান্টিন : ইয়ার্কি করছিস? তোরা ছেলেরা তাহসানকে দেখতে পারিস না কেন?
আমি : কে বলেছে দেখতে পারি না! আমার সাথে উনার কত মিল! উনি তো আমার ক্যাম্পাসের বড় ভাই- উনি যেখানে পড়েছেন, আমিও এখন সেখানে পড়ছি। উনি যে কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করেছেন, আমিও সেখান থেকে এইচ এস সি পাশ করেছি। আমার সাথে উনার শুধু একটাই পার্থক্য – উনার উপর মেয়েরা “ক্রাশ” খায়, আর আমাকে মেয়েরা পারলে গালে একটা “ঠাশ” করে বসিয়ে দেয়!
মধুর ক্যান্টিন : শোন এই ছেলেটার কারণে একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে । আগে আমাদের দেশের মেয়েরা শাহরুখ খান, ঋত্বিক রোশন, সিদ্ধার্থ মালহোত্রা- এদের উপর ক্রাশ খেত, এখন তাহসানের উপর মেয়েরা “ক্রাশ” খায়। আগে আতিফ আসলাম, অরিজিত সিং -এদের গান শুনে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিত, এখন তাহসানের গান শুনে আর নাটক দেখে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়।
আমি : সেটা অবশ্য ঠিক বলেছেন।
মধুর ক্যান্টিন : তোরা এখনকার ছেলেরা অবশ্য সবকিছু একটু দেরিতে বুঝিস! অথচ পঞ্চাশের দশকের ছেলেরা আমার গুরুত্ব আগেই বুঝে ফেলেছিল!
আমি : কিভাবে?
মধুর ক্যান্টিন : পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৫১ সালে। তখন থেকেই মধুর ক্যান্টিনে আসা-যাওয়া শুরু হয় যুব কর্মীদের। ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মধুর ক্যান্টিনই ছিল ভাষা আন্দোলনের কর্মীদের অঘোষিত ক্যাম্প। ঐ বছর ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাকালেও এ ক্যান্টিন জড়িত ছিল। এ সময়ই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন মধুদা। ১৯৫৪ যুক্তফ্রন্ট, ১৯৫৮, ১৯৬০, ১৯৬২’র শিক্ষানীতিবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফার প্রধান পরিকল্পনা ও পরিচালনার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল এ ক্যান্টিন। ১৯৬৮ এবং ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুথ্থানের সময় অনেক ব্যস্ত ছিল মধুর ক্যান্টিন। এখানকার আমতলা, বটতলায় অনেক রাজনৈতিক মিটিং হতো। কিন্তু যখন পুলিশ বাঁধা দিত, তখন ছাত্ররা দৌঁড়ে আশ্রয় নিতেন মধুদার নিরাপদ ছায়ায়।
আমি : তাহলে তো মধুদাও অনেক জনপ্রিয় ছিলেন?
মধুর ক্যান্টিন : তা তো অবশ্যই! মধুদার চায়ের কাপে তৃপ্তির চুমুক দেয়নি- এমন নেতা খুঁজেই পাওয়া যাবে না! এখানে ভাষা আন্দোলনের সৈনিক সালাম, বরকত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ কামালসহ বর্তমান জাতীয় নেতাদের মধ্যে প্রায় সবার পা পড়েছে! সবার প্রিয় ছিলেন মধুদা। তিনি ক্যান্টিন চালানোর পাশাপাশি সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। তাঁর অমায়িক ব্যবহার ও সেবার মাধ্যমে সবাইকে তিনি আগলে রাখতেন। যখন বিভিন্ন ছাত্র নেতারা গা-ঢাকা দিতেন পাকিস্তানী সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে, তখন যোগাযোগ শুধু থাকত মধুদার সঙ্গে। ছোট ছোট চিরকুটে খবর সরবরাহ করতেন তিনি। এ ছাড়া ক্যান্টিনের বিভিন্ন গোপন জায়গায় তিনি প্রয়োজনীয় পোস্টার লুকিয়ে রাখতেন ।
আমি : তাহলে নিশ্চয়ই পাকিস্তানি সরকারের অনেক কড়া নজর ছিল এই রেস্তোরাঁর উপর?
মধুর ক্যান্টিন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও মধুর ক্যান্টিনের রাজনীতিকে কখনও আলাদা করে দেখেনি তখনকার সরকার। ১৯৭০-এর নির্বাচনের আগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ১৯৭১-এর মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনের ডাকের সময় মূল কর্মকাণ্ড এখানেই অনুষ্ঠিত হত। তাই ’৭১-এ হানাদার বাহিনীদের কু-নজর ছিল এই ক্যান্টিনের ওপর। ঘাতকেরা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ভাঙতে চেয়েছিল মধুর ক্যান্টিন। পরে তারা নিরস্ত হলেও পরের দিন(২৬ মার্চ) মধুদাকে কেউ দয়া করে নি।
আমি : কি হয়েছিল পরের দিন?
মধুর ক্যান্টিন : ঘাতকের দল মধুদার বাড়িতে গিয়ে প্রথম গুলি চালায় মধুদার সদ্য বিবাহিত ছেলে রণজিৎ কুমার ও তার স্ত্রী রিনা রাণীকে। মধুদার স্ত্রী যোগমায়াও রক্ষা পাননি সেদিন। আর মধুদাকে নিয়ে যাওয়া হয় জগন্নাথ হলের মাঠে। তারপর……
(আমি চুপ করে রইলাম কিছুক্ষণ)
মধুর ক্যান্টিন : YouTube এ “ Jagannath Hall Genocide 1971” লিখে Search করিস- অনেক কিছু দেখতে পাবি ।
এমন সময় ক্যান্টিনের দরজা খুলতে শুরু করে। আমি জিজ্ঞেস করি, “আবার একদিন কি আপনার সাথে কথা হবে?”
কোন উত্তর পাওয়া যায় না।
আমি ক্যান্টিনের ভেতরে ঢুকি। আজকে বাংলাদেশের খেলা আছে। খেলা শুরু হলে এখানে দাঁড়ানোর জায়গাও থাকবে না! এখানে এত মানুষের সাথে একসাথে খেলা দেখতে দেখতে ওয়াই-ফাই অন করে দিয়ে ফেসবুক চালানোর মজাই আলাদা! আমি একটা চেয়ারে বসলাম। ওয়াই-ফাই অন করে YouTube এ ঢুকলাম। “ Jagannath Hall 1971” লিখে Search করলাম। ভিডিও গুলো দেখে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকলাম। একটা লাল –সবুজ পতাকার জন্য কত আত্মত্যাগ! আজকের উন্নত দেশ আমেরিকার স্বাধীনতার পর ২৪০ বছর কেটে গেছে। আর আমাদের এই দেশটার বয়স মাত্র ৪৫ বছর!এই অল্প সময়ে আমাদের অর্জনও কম নয়। এই দেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই-৩০ লাখ শহীদের রক্ত নিশ্চয়ই বৃথা যাবে না!
১০ মিনিট স্কুলের লাইভ এডমিশন কোচিং ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে সরাসরি চলে যেতে পারো এই লিঙ্কে: www.10minuteschool.com/admissions/live/
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন