আমাদের বাংলাদেশ স্বাধীন হবার প্রায় পঞ্চাশ বছর হতে চললো। ১৯৭১ সালের মার্চের শেষ দিকে শূরু হওয়া সংগ্রাম ক্রমেই রক্তক্ষয় ও যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছিলো। বাংলাদেশকে হানাদার মুক্ত করতে বাঙ্গালীরা নয়টি মাস যুদ্ধ করেছিলো জীবন বাজি রেখে। সমস্ত শ্রেনী পেশার মানুষ অংশ নিয়েছিলো তাতে। বঙ্গপিতা শেখ মুজিবর রহমানের অমীয় ডাক ‘তোমাদের কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো’ সবাই গেথে নিয়েছিলো হৃদয়ে। আর তাই তো যুদ্ধে যেতে পিছুপা হয়নি সাধারণ ছাত্র কিংবা ছাপোষা কর্মকর্তা। কিন্তু যুদ্ধের এই প্রেক্ষাপট কি একাত্তর সালের মার্চেই তৈরী হয়েছিলো?
একটা দেশ স্বাধীন করা চাট্টিখানি কথা নয়। তা তুমি অন্যান্য দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস ঘাটলেই বুঝতে পারবে। বাংলাদেশের মানুষেরা স্বয়ংসম্পূর্ন হয়েও ভিনদেশী শাষকদের কাছে গোলামী করেছে বারংবার। ব্রিটিশরা প্রায় একশো নব্বই বছর শাষণ করেছে আমাদের। অমানষিক নির্যাতন চলেছে তখনকার মানুষের উপর। নীল চাষীদের কে নিয়ে ব্রিটিশরা যে বর্বরতা দেখিয়েছে তা ইতিহাসে বিরল। আমরা ব্রিটিশ থেকে মুক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু তখনই জেকে বসলো পাকিস্তানি শাষকেরা। পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলের সবাই ঠিকমতো নাগরিক সুবিধা পেলেও বঙ্গদেশ যেন ছিলো তাদের হুকুমের গোলাম। তাদের কাছে আমরা ছিলাম নিরীহ। কিন্তু বাঙালীদের রক্তে ধীরে ধীরে জেগেছে মুক্তির নেশা। তবে এই মুক্তির আকুতিকে নেশায় পরিনত করেছে আমাদের আন্দোলনের মাধ্যমে বিভিন্ন অধিকার আদায়ের ইতিহাস। মুলত ১৯৫২ সালেই আমরা যখন পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলাম ভাষার তরে রক্ত দেয়ার জন্য, তখনই বিশ্ববাসী টের পেয়েছিলো একটা বড় ‘ঝড়’ তবে আসছে। তখনই আমরা দেশকে এক সময় স্বাধীন দেখতে পাবো বলে কল্পনা করেছিলাম। এমন সময় বেশ কিছু আন্দোলন আমাদের মুক্তিকামী মানুষকে উস্কে দিতে বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিলো। তার মধ্যে অন্যতম হলো ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান।
উনসত্তরের অভ্যুত্থান ছিলো বাঙালী জাতির মুক্ত হওয়ার পেছনে বড় একটি প্রভাবক। যেটি নিরীহ মানুষকে মুক্তির জন্য একটি যুদ্ধের প্রতি মানসিক ভাবে প্রস্তুত করেছিলো। তার ফলাফল আমরা ইতিহাসে উজ্জ্বল ভাবেই দেখতে পাই। কেননা উনসত্তর সালের শুরুর দিকে বিখ্যাত গণ অভ্যুত্থানের কারণেই মুলত আয়য়ুব খানের স্বৈরাচারী শাষনের সমাপ্তি ঘটে। এবং ফলশ্রুতিতে তার ঠিক দুই বছর পর তৃতীয় বছরের মাথায় স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর অভ্যুত্থানের হিসেবে তিন বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ চিরতরে দখল মুক্ত হয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ লাভ করতে সক্ষম হয়। যুক্তিগত কারণেই উনসত্তরের গণ মানুষের অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
যে কোন বড় মাপের আন্দোলনই শুরু হয় কোন না কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট নিয়ে। উনত্তরের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটের ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। এ আন্দোলনের পূর্বে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর ঘটনা ঘটে। ইতিহাসবিদদের মতে এর সবগুলোই গন অভ্যুত্থান কিংবা একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের পেছনে রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে সময়ের ক্রম অনুসারে সাজালে চলে আসে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, তার ঠিক দুই বছর পর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন। ১৯৬৮ সালে আগরতলাম ষড়যন্ত্র মামলার কথা। ইতিহাসবিদদের ধারণা, এর ঠিক পর উনসত্তর সালের গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশকে মুক্ত করার দাবী তরান্বিত হয়। আর এসব ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে বেশ কিছু মানুষের নাম ও তাদের কর্মকান্ড। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন সোহরাওয়ার্দী কিংবা শেখ মুজিবুর রহমান সবাই এসব আন্দোলনে ছিলেন সক্রিয় নেতা। তাদের সাথে ছিলেন তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কালজয়ী ছাত্র নেতারা।
এবার চলে যাই উনত্তরের গণ অভ্যুত্থান ইস্যূর প্রেক্ষাপট নিয়ে। এই আন্দোলনের সুচনা ঘটেছিলো মুলত তৎকালীন স্বৈরাচারী শাষক আয়য়ুব খান বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্রে করে। আর এই আন্দোলনের শুরু থেকেই নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগঠন তথা ডাকসু। তাদের সাথে ছিলো সব বিভাগের সাধারণ ছাত্ররা। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। যিনি এখন বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় সংসদের একজন সদস্য এবং মন্ত্রীসভাতেও তিনি রয়েছেন। এখনকার মন্ত্রীসভায় থাকা রাশেদ খান মেনন এবং মতিয়া চৌধুরীও ছিলেন অভ্যুত্থানের আন্দোলনে। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান কার্যকর করা হয়। এর দুই বছর আগে ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তখন বাধ সাধে তৎকালীন স্বৈরাচারী শাষক দলের আমলারা। তারা কখনোই চাইতো না পাকিস্তানের সংবিধান একটি গনতান্ত্রিক ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বান্ধব হোক। কেননা তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো আমৃত্যু ক্ষমতায় টিকে থাকা ও বাঙালীদের মত নিরীহ মানুষদেরকে তাদের কৃতদাস করে রাখা। মজার ব্যাপার হচ্ছে পাকিস্তানের এখনকার শোচনীয় অবস্থার জন্য তৎকালীন শাষকেরা সমানভাবে দায়ী। তারা এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি ও তারুন্যমেধা নিয়ে ঈর্ষান্বিত।
তো চুয়ান্ন সালে যখন পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের চেষ্টা চালানো হয়েছিলো তখন সামরিক-বেসমারিক কিছু নীল নকশায় থাকা আমলাদের কারণে তা ভণ্ডুল হয়ে যায়। যখন ১৯৫৬ সালে সংবিধান প্রণয়ন করা হয় তখন তার দুই বছরের মধ্যেই একটি জাতীয় নির্বাচন দেবার কথা ছিলো। কিন্তু তারা জানতো নির্বাচন দিলে আওয়ামীলীগ জয়যুক্ত হবার আশংকা রয়েছে। এতে করে পূর্ব পাকিস্তান হাতছাড়া হয়ে যাবার ভয় ছিলো। তাই পুনরায় সংবিধান নিয়ে সামরিক-বেসামরিক আমলারা মিলে ষড়যন্ত্র চালায়। ১৯৫৮ সালের শেষের দিকে অক্টোবরের সাত তারিখ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইসকান্দার মির্জা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খান নূনকে বরখাস্ত করেন। এবং পূর্ব পরিকল্পিতভাবে পাকিস্তানের সংবিধান বাতিল করেন। এতে করে সহজভাবে তারা দেশে সামরিক শাষন জারি করেন। ঠিক বিশ দিনের মাথায় জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন। যদিও তিনি ক্ষমতায় গিয়ে ঘোষনা করেছিলেন যে, তিনি দেশকে রক্ষা করতেই এসেছেন। এবং খুব তাড়াতাড়িই দেশকে অস্থিতিশীল অবস্থায় পরিনত না করেই বেসমারিক ব্যক্তিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তিনি সামরিক ব্যারাকে ফিরে যাবেন। কিন্তু এই ঘোষণা দেয়া আইয়ুব খানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে দরকার হয়েছিলো উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান। জীবনও দিতে হয়েছে অসংখ্য মানুষকে।
কোর্সটিতে যা যা পাচ্ছেন:
বিসিএস প্রিলি লাইভ কোর্স
তবে এর আগেই পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার সংগঠিত যুদ্ধের মাধ্যমেই প্রায় প্রমান হয়ে গিয়েছিলো পাকিস্তানের শাষকরা পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলার মানুষদের অধিকার কিংবা নিরাপত্তার ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। আর এটি বুঝতে পেরেই শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবী উত্থাপন করেছিলেন। এই দাবীগুলোকে পাকিস্তানী শাষকগোষ্ঠী নিজেদের পতন ও দেশ ভাঙ্গনের মুল হাতিয়ার হিসেবে গ্রহন করে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিবকে (তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধীতে ভূষিত হননি) গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করা হয়। এতে দেখানো হয় মুজিব ও তার সঙ্গী অনুসারীরা পুর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার পায়তারা চালাচ্ছে ভারতকে সঙ্গে নিয়ে। ১৯৬৮ সালের ২১ এপ্রিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল চালু করে শেখ মুজিব সহ তার সতীর্থদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু করেন। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, এটি ছিলো একটি রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা আর যার অবধারিত শাস্তি মৃত্যুদন্ড!
দ্রুত ক্ষমতা ছাড়বেন বলে বিভিন্ন ছলচুতায় সেই ক্ষমতার সময় গিয়ে দাঁড়ায় দশ বছরে। আটষট্টি সালে ক্ষমতার দশ বছরে তিনি ‘উন্নয়নের এক দশক’ নামে একটি প্রহসন ও তামাশামুলক উৎসবের আয়োজন করেন। যেখানে স্বৈরাচারী শাষকগোষ্ঠী আইয়ুব খান তার তামাশার উৎসব পালন করছেন সেইসময় ঢাকার সেনানিবাসে শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলানোরও এক তামাশার মামলা দায়ের করে বিচার করা হচ্ছে।
আইয়ুব খান তার কুটচাল কিন্তু অব্যাহত রেখেছিলেন। ৬৮ সালের নভেম্বরে পিপলস পার্টির প্রধান ও এবং তারই এক সময়কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে গ্রেফতার করেন। এদিকে মাওলানা ভাষানী আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে জনতাকে এক করতে সমর্থ্য হন। এবং এসব কারণে আস্তে আস্তে অনেক মানুষের আক্রোশের মধ্যে পড়েন আইয়ুব খান। কিন্তু তিনি তার কাজ চালিয়ে যান। খুন দ্রুত সময়ে কালক্ষেপণ না করেই বিরোধী দলের নেতাদের বিভিন্ন অভিযোগ দেখিয়ে জেলে ভরতে শুরু করেন। কিন্তু তিনি বুঝতেই পারেননি তিনি নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছেন।
বস্তুত আইয়ুব খানের এতদিনে টিকে থাকার পেছনে বড় কারণ ছিলো তার বিরুদ্ধে থাকা দলগুলোর মতানৈক্য। রাজনৈতিক দলগুলোতে নিজেদের মধ্যে আক্রোশ, অনৈক্য, সীমাহীন সন্দেহ দানা বেঁধে ছিলো। এমনকি শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে ঘোষিত মানুষের দাবী আদায়ের নিমিত্তে ছয় দফা প্রকাশের পরও খোদ আওয়ামীলীগের মধ্যেই একধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। নিজেদের মধ্যে সংগঠিত সমস্যাই আইয়ুব খানের নষ্ট রাজনীতি ভর করে ক্ষমতায় টিকে থাকাকে শক্ত করেছিলো। আমরা এর থেকে খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারি যে একটার শক্তি কত! একতা থাকলে যে কোন অপশক্তিকে পরাজিত করা সম্ভব। যেটি ১৯৬৯ সালে পূর্ব বাংলার ছাত্র ও বিদ্রোহী জনতার মাধ্যমে একটি গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় স্বৈরাচারী সরকারের পতনের মাধ্যমে প্রমানিত হয়েছিলো।
তো আমরা আবার আগের জায়গায় ফিরে যাই। আইয়ুব খানের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য একের পর কুটচাল নস্যাৎ করার লক্ষ্যে শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বড় আন্দোলনে যেতে বাধ্য হয়। ১৯৬৯ সালের একদম শুরুতেই তারা একটি দাবীপত্র পেশ করে। জানুয়ারির ১৪ তারিখ টাটা এগারো দফা দাবী প্রকাশের মাধ্যমে কর্মসূচি ঘোষণা করে। তারা দাবী ঘোষণা করে নিজের বিপদ জেনেও রাজপথে নেমে পড়ে। এটি ছিলো পাকিস্তানি শাষকগোষ্ঠীদের দিকে ছোড়া পূর্ব বাংলার মানুষদের চ্যালেঞ্জ। যারা একসময় (১৯৭১ সালে) নিজেরাই নিজেদের দেশ মুক্ত করে নিজের দেশের মালিকানা গ্রহন করেছিলো।
শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি সহ্য করবেনা আইয়ুব খান তা সবার জানাই ছিলো। কিন্তু পুরো পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে উঠে যখন রাজপথে নামার সপ্তাহ পার হবার আগেই আন্দোলনকারী ছাত্রের মৃত্যু হয়। মুলত ২০ জানুয়ারি ছিলো ছাত্র সংসদ পরিষদের ডাকা ধর্মঘট। যাদের আহবানে সাড়া দিয়ে ঢাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেদিন ধর্মঘট পালন করা হয়। সেদিন সকাল এগারোটার দিকে ঢাবির কলাভবণের সামনে ছাত্রদের সংক্ষিপ্ত একটি সমাবেশ শেষ করে একটি মিছিল বের করবার কথা ছিলো। যথাসময়ে মিছিলটি বের হয়৷ সেই মিছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে বর্তমান স্থান চানখাঁরপুল গেলে পুলিশ ও তৎকালীন সীমান্ত রক্ষা বাহিনী ইপিআর কোন রকম উস্কানি কিংবা প্রয়োজন ছাড়াই টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ শুরু করে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই সেই অবস্থাতেই গুলি বর্ষণ চালানো হয়। সেই স্থানেই আহত হয় শ’খানেক ছাত্রছাত্রীরা। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনেই পুলিশ কতৃক গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন আসাদুজ্জামান আসাদ।
রাজপথে থাকা একটি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা ও আসাদের মৃত্যু সেটকে গণ অভ্যুত্থানে রূপান্তর করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে শুরু হয় লাগাতার হরতাল।
অন্যদিকে আইয়ুব খান সরকার আন্দোলন ঠেকাতে প্রায় সব ধরণের ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। গ্রেফতার, নির্যাতন, হামলা, কারফিউ এমনকি ১৪৪ ধারা জারি করার পরও আন্দোলন থামার তাদের প্রায় সকল চেষ্টাই ব্যর্থতে রূপান্তরিত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে রাস্তায় নামে সেনাবাহিনী।
২৪ জানুয়ারি হরতাল চলাকালে ঢাকার নবম শ্রেনীর শিক্ষার্থী পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। তেজগাঁও এলাকায় শিশুকে দুধ পান করার সময় শিশুর মা আনোয়ারা বেগম নিহত হন। সেই রাতেই কারফিউ ভঙ্গ করে ছাত্ররা একটি মিছিল বের করে। তাতেও পুলিশ ও সেনাবাহিনী গুলিবর্ষণ করে। সেখানেও অনেক শিক্ষার্থী নিহত হন। এত মানুষ মারা যায় যে, মাঝেমাঝেই পল্টনে গায়েবানা জানাজা হতো। তার ইমামতি করতেন মাওলানা ভাষানী।
অবস্থা শুধুই খারাপের দিকে যাচ্ছিলো। পূর্ব বাংলার আন্দোলনের দামামা পশ্চিম পাকিস্তানেও বেজে উঠে। আইয়ুব খান বুঝতে পারেন, পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাচ্ছে৷ তিনি আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। সে বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বিচার চলাকালীন সময়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহরুল হককে ঢাকা সেনানিবাসের কারাগারে পুলিশি হেফাজতে গুলি করে হত্যা করা হয়। একটি জ্বলন্ত শিখাতে তারা আগুন ঢেলে দেয়।
তার দু’দিন পর সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টর শামসুজ্জোহা।
জনতার আন্দোলন এতটাই ভয়াবহ রূপ নেয় যে তার দুদিনের মাথায় অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয়। এবং এই মামলায় অভিযুক্ত সকল বন্দি আসামীকে মুক্তি দিতে তারা বাধ্য হয়।
পেছনে ফিরে তাকালে আসলে কল্পনা করাও দুস্কর হয়ে পড়ে যে দিনগুলো কেমন ভয়াবহ ও অগ্নিঝড়া ছিলো। বৃষ্টির মত গুলি করে মানুষ মারা হচ্ছিলো শুধু ক্ষমতার জন্য। কিন্তু সে সময় মাওলানা ভাষানী তার নেতৃত্বে দেশের রাজনীতির একটি হাল ধরেছিলেন বলা চলে। অন্যদিকে বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে একটি গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাক হানাদারদের প্রায় কফিনে পুরে দেন। সেই কফিনের শেষ পেরেকটি ঠোকা হয়েছিলো ১৯৭১ সালে। মুলত সেসময় স্বার্থহীন ভাবে বাঙালী ছাত্রদের আত্মত্যাগ আমাদের আজকের এগিয়ে যাবার প্রেরণা। আর সেসময় নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে আমাদের দেশকে হানাদার মুক্ত স্বাধীন একটি দেশ তৈরীর জন্য এগিয়ে দেয়া সেসব শহীদ বীরদের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা।
★সূত্রঃ
*মুক্তিযুদ্ধ আর্কাইভ
*উইকিপিডিয়া
*কালের কণ্ঠ
*প্রথম আলো
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন