১.
“ওমা! তুমি বাঁহাতি?”
“আল্লাহ! তুমি বামহাতে লিখো!!”
“আচ্ছা, বামহাতে কিভাবে লিখো?”
“এই তুমি খাও কোন হাতে?”
“আল্লাহ! ও কি ট্যালেন্টেড, ও বাঁহাতে লিখে!”
“এই, এই তুমি বামহাতে একটু লিখে দেখাও না।“
“মানুষ কিভাবে বামহাতে লিখতে পারে?”
“তুমি ডানহাতে লিখার চেষ্টা করো না কেন?”
“তুমি কি ছোটবেলা থেকেই এই হাতে লিখো?”
“আচ্ছা তুমি বাঁ হাতে কেন লিখো?”
তোমরা যারা আমার মতো বামহাতে লিখো তারা সবাই উপরের প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন কোনো না কোনো সময় হয়েছো তা আমি একদম নিশ্চিত করে বলতে পারি। বাঁহাতি হওয়া কেন মানুষ এত অবাক চোখে দেখে তার উত্তর আমি এখনো পেলাম না। তাই আমার নিজেকে মাঝেমাঝে এলিয়েন মনে হয়। আচ্ছা, আমরা কখনো তো এমন বললাম না, “ওমা, তুমি ডানহাতি! ডানহাতে কিভাবে লিখো? একটু লিখে দেখাও না প্লিজ!”
এরকম হাতে হাতে বৈষম্য আমার একদমই ভালো লাগে না। হাত তো হাতই। এর মধ্যে সবাইকেই ডানহাতি হতেই হবে এমন কোনো কথা আছে নাকি!
যাই হোক, এসব প্রশ্ন আমি সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। এবং হু, হাঁ কিংবা মুচকি হাসি দিয়ে প্রশ্নগুলো আমি এড়িয়ে যাই। কারণ একটাই, আমার সব প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। আমি জানি না আমি কেন বামহাতে লিখি বা আমি কেন বাঁহাতি।
যাই হোক, এ বয়সে এসে, এত বছর পর আমার নিজের মনের মধ্যেও প্রশ্নটা উদয় হলো? আমি কেন বাঁহাতি? অনেক গুগল টুগল করে কিছু জিনিস জানতে পারলাম। তাই আজকে আমার বাঁহাতি বিষয় নিয়ে একটু হাতাহাতি করার ইচ্ছা। পরবর্তীতে কেউ আবারো আমাকে এমন প্রশ্ন করলে আমি আবার এই ব্লগের লিংক পাঠিয়ে দিব! তোমরাও সেই কাজটাই করতে পারো!
২.
পৃথিবীর ৯০% মানুষই হচ্ছে ডানহাতি। আর বাকি ১০% এর মধ্যে আমরা পড়ি। সেক্ষেত্রে আমরা ভাব নিতেই পারি, আমরা একটু ব্যতিক্রম। তবে এই নিয়ে অনেক অনেক গবেষণা আছে। কেন মাত্র ১০% মানুষ বামহাতি বাকিরা ডানহাতি।
মানুষের মধ্যে এই বামহাতি ডানহাতি ব্যাপারটাই বা আসবে কেন? হাত তো হাতই! এর মধ্যে আবার এসব কেন? এতসব কেনর উত্তর খুঁজতে সায়েনটিস্টরা সেই কবে থেকে গবেষণা করে যাচ্ছেন! এখনো করছেন।
ব্যাপারটা হচ্ছে, মানুষ তার দুটো হাতেই সমান দক্ষ হয় না। কোনো না কোনো হাতে সে ভালো কাজ করতে পারে। যেমন তুমি একটি নির্দিষ্ট হাতে লিখো, কাজ করতে ঐ হাতটাই ব্যবহার করো, এমনকি ভারী জিনিস আলগাতে ঐ হাতটাই লাগে, মনে হয় যেন ঐটাতেই যেন শক্তি বেশি। সেই হাতটা হলো ডোমিনেন্ট হ্যান্ড (Dominant Hand)। আর সেটা যদি হয় ডানহাত তাহলে ডানহাতি (Right Handed)। আর আমার মতো শক্তিশালী হাত যদি হয় বামহাত তাহলে তুমি আমাদের দলে (Left Handed)। আবার এরকম ও হয়, কাজভেদে তোমার একবার বাম হাতে শক্তি বেশি আসে আরেকবার ডান হাতে। তাহলে তুমি মাঝামাঝি (Cross Dominance). এরকম মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে বড্ড কম! আবার তোমার হাত যদি সমান তালে চলে, ওরে বাবা! তুমি তো সব্যসাচী। ইংরেজিতে আমরা যাকে বলি Ambidextrous.
এখন আমরা কে কোন হাতি হবো সেটা কেমনে জানবো? মজার ব্যাপার হচ্ছে সেটা বেশিরভাগ সময় আমাদের জন্মের আগেই ঠিক হয়ে যায়। মানে আমরা যখন আমাদের মায়ের পেটে থাকি তখনই!
অনেক ধরনের গবেষণা আছে এই নিয়ে। কোনটা আসলে পুরোপুরি সঠিক তা বলা এক বামহাতির পক্ষে ডানহাতে লেখার চেয়েও অনেকগুণে বেশি মুশকিল।
আগে ধরা হতো আমাদের ব্রেইনের কাজের উপর নির্ভর করে আমরা বাঁহাতি হবো না ডানহাতি হবো।
তোমরা তো সবাই কম বেশি জানো আমাদের মগজ দুইভাগ করা। একদম মাঝ বরাবর ভাগ করা। একটার নাম রাইট হেমিস্ফিয়ার আরেকটার নাম লেফট হেমিস্ফিয়ার। তো এই দুইটি হেমিস্ফিয়ারের বিভিন্ন কাজ থাকে। আসলে ব্রেইন দ্বারাই সব নিয়ন্ত্রিত হয়। ব্রেইনে সিগনাল আসে, সে অনুযায়ী ব্রেইন নির্দেশ দেয় তারপর নির্দিষ্ট কাজটি হয়। এইভাবে পুরো দেহ যদি হয় একটা স্কুল, ব্রেইন হলো হেডমাস্টার।
যাই হোক, লেফট হেমিস্ফিয়ার আমাদের ভাষা, বলা এসব নিয়ন্ত্রণ করে। হাতের নাড়াচাড়া, কাজ এসব ও নিয়ন্ত্রণ করে। ভাষার বহিঃপ্রকাশের জন্য আমরা লিখি। আর যেহেতু লেফট হেমিস্ফিয়ার সেটা নিয়ন্ত্রণ করে যারা ডানহাতি তাদের ক্ষেত্রে ভাবা হয় তারা হচ্ছে লেফট ব্রেইনড মানুষ। মানে তাদের বামদিকের মগজ বেশি সচল! আর সেরকমই ভাবা হতো, যেহেতু বামদিকের ব্রেইন ডানহাতের কাজ নিয়ন্ত্রণ করছে সেহেতু নিশ্চয়ই বাম হাতি যারা তারা রাইট ব্রেইনড। মানে তাদের ডান মগজ বেশি চালু।
আগে এটার উপর ভিত্তি করেই বলা হতো, যাদের রাইট হেমিস্ফিয়ার সচল তারা হবে বামহাতি আর অন্যথা হলে ডানহাতি।
কিন্তু এটা একটা মিথ ছাড়া কিছুই নয়।
কে ডানহাতি হচ্ছে বা কে বামহাতি হচ্ছে এটা রাইট বা লেফট হেমিস্ফিয়ারের কাজ নির্ধারণ করে না। আগেই বলেছি, লেফট হেমিস্ফিয়ার ভাষা বিষয়ক কাজ করে। তার মানে এই না যে যারা বাম হাতে লিখছে তাদের ভাষার নিয়ন্ত্রণের কাজ করছে রাইট হেমিস্ফিয়ার। ৯৮% ডানহাতিরা হচ্ছে লেফট ব্রেইনড, তেমনি ৭০% বামহাতিরাও কিন্তু লেফট ব্রেইনড বা লেফট হেমিস্ফিয়ারই তাদের ভাষা নিয়ন্ত্রণ করে।
৩.
আচ্ছা এখন কথা হচ্ছে যদি ব্রেইন কোনহাতি হবো সেটা ডিসাইড করে না তাহলে করেটা কে? অনেক অনেক মতভেদ আছে এই নিয়ে।
জিনগত ব্যাপারও ডানহাতি বা বাঁহাতি হওয়ার পিছনে কাজ করে।
যদি বাবা মা দুইজনেই লেফটি হয় তাহলে তাদের সন্তান লেফটি হওয়ার চান্স হচ্ছে ২৫%। শুধু যদি মা বাঁহাতি হন তাহলে সেটা কমে দাঁড়ায় ২২% এ। আবার কেবলমাত্র বাবা যদি হন বাঁহাতি, সন্তান বাঁহাতি হওয়ার সম্ভাবনা আরো কমে যায়। কমে সেটা হয় ১৭%। এবং সবচেয়ে কম সম্ভাবনা থাকে যখন বাবা মা দুইজনই ডানহাতি হন। তখন বাঁহাতি হওয়ার চান্স থাকে মাত্র ১০%। আচ্ছা, এইখানে আমি কি একটু ভাব নিয়ে নিব? কারণ আমার বাবা মা দুইজনই ডানহাতি।
আবার জিনগত বিভিন্নতার কারণেও নাকি মানুষ বাঁহাতি হয়।
আরেকটা স্টাডিতে বলা আছে, মাতৃগর্ভে বাচ্চাদের অবস্থানের উপর নির্ভর করে এটি। তখন বাচ্চারা কোন আঙ্গুল মুখে দেয় সেটাই নাকি তাদের পছন্দের হাত নির্বাচন করে।
এটাও শোনা যায় নাকি, গর্ভবতী নারী তাদের প্রেগনেন্সির সময় বেশি চিন্তিত থাকলে নাকি তাদের বাচ্চা বাঁহাতি হয়!
এরকম নানারকম কথাবার্তা, গবেষণা লেগেই আছে।
জার্নাল ই লাইফ (Journal eLife) নতুন একটি স্টাডি পাবলিশ করেছে যেটা কিনা এই তর্কে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। সেখানে বলা আছে যে, আমরা কোন হাতে পারদর্শী হবো সেটা ব্রেইন ঠিক করে না। ঠিক করে সেটা স্পাইনাল কর্ড।
বাহু এবং হাতের নড়াচড়া শুরু হয় ব্রেইনের একটি জায়গা মোটর কর্টেক্স (motor cortex) থেকে। মোটর কর্টেক্স কি করে, একটা সিগন্যাল পাঠায় যা যায় স্পাইনাল কর্ডে, পরে সেই অনুযায়ী কাজ হয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, মাতৃগর্ভে থাকা ভ্রূণের ১৫ সপ্তাহের মধ্যেই সে কোন হাতি হবে তা নির্ধারণ হয়ে যায়। যদিও তখনও মোটর কর্টেক্স এবং স্পাইনাল কর্ড একে অপরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি। ব্রেইন তখনো শক্তপোক্ত হয়ে উঠেনি আরকি।
কিন্তু ততদিনে পেটের ভিতরের বাচ্চাটি নড়াচড়া শুরু করে দিতে থাকে। এবং সে তখনই তার প্রিয় হাত কোনটা হবে তা বেছে নেয়। মায়ের পেটে থাকাকালীন মাত্র ৮ সপ্তাহেই সে নাকি তার প্রিয় হাত কোনটা তার সাইন বোঝাতে থাকে। গবেষকরা তাই ধারণা করছেন যে, যেহেতু তখনও ব্রেইন হাতকে কন্ট্রোল করার মতো শক্তি হয়ে উঠেনি তার মানে নিশ্চয়ই স্পাইনাল কর্ড এর পিছনে ভূমিকা রাখছে।
নানারকম জেনেটিক ভ্যারিয়েশনের কারণে আমাদের জন্মের আগেই আমরা কোনহাতি হবো তা ঠিক করে ফেলে স্পাইনাল কর্ড।
৪.
এখন কথা হচ্ছে এতো মানুষ কেন ডানহাতি আর কেনই বা এত কম জন বাঁহাতি।
সেটারও অনেক ব্যাখ্যা আছে। সেটা বোঝানো যায় মানুষের বিবর্তন দিয়ে। মানুষের বিবর্তনের ক্ষেত্রে দুই ধরনের চাপ কাজ করে। কম্পিটিটিভ (Competitive) এবং কো অপারেটিভ (Co operative)। কম্পিটিটিভ প্রেশারের ক্ষেত্রে অনেকদিক দিয়েই এগিয়ে আছে বাঁহাতিরা। কিছু কিছু খেলাধুলা বাঁহাতিদের জন্য অনেক সহজ। তবে ডানহাতিদের জন্য নয়। পৃথিবীতে শুধু যদি খেলাধুলা আর কম্পিটিশন থাকতো তাহলে দেখা যেত, ৫০% বাঁহাতি আছে ৫০% ডানহাতি আছে। কিন্তু আমাদের সমাজ সেরকম নয়। এখানে কম্পিটিশনের পাশাপাশি আছে কো অপারেশন। মানুষ একে অপরকে সাহায্য করে। তাই মানুষের একে অপরের চরিত্র, আচরণ, কাজ এগুলোও অন্যের উপর প্রভাব ফেলে। এভাবেই সমাজের বিবর্তন হতে হতে কো অপারেশনের প্রভাবে বাঁহাতিদের পরিমাণ কমতে থাকে।
আরেকটা বড় কারণ হলো দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে বাম হাতকে অনেকেই অপয়া হাত মনে করে। এবং একটু খেয়াল করলেই লক্ষ করবে ডান বা রাইট মানে সব ভালো ভালো শব্দ বোঝায়। যেমন, Right, correct, dexterity, righteouse. আবার বাম হাতের বা লেফট মানেই খারাপ বোঝায়। লাটিন শব্দ sinister ফ্রেঞ্চ gauche, maldroit এসব শব্দ কিন্তু লেফটকে মাথায় রেখেই এসেছে। পুরাতন ইংরেজিতে লেফট মানে (lyft>left) হচ্ছে দুর্বল বা weak. অনেক জায়গায় বামহাতকে ব্ল্যাক ম্যাজিকেরও অংশ মনে করা হতো। তাই যুগ যুগ ধরে কেউ বাঁহাতি হলেই জোর করে তাকে ডানহাতে কাজ করতে অভ্যাস করানো হয়। বরং এখনো অনেককে বলতে শুনবে, “আমিও ছোটবেলাতে বাম হাতে লিখতাম। পরে ডান হাতে লিখি।“ মূলত, প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা কিছু ভুল ধারণার জন্যও অনেক বাঁহাতি এখন ডান হাতে লিখছে। নাহলে আমাদের মতো বামহাতির সংখ্যা নেহাত কম হতো না!
৫.
বাঁহাতিদের যেন মানুষের আগ্রহের শেষ নেই! তাই বাঁহাতিদের নিয়ে নানানরকমের মিথ আছে।
যেমন, বাঁহাতিরা অনেক বুদ্ধিমান হয়। আমাকেও বলা হয় (মাঝেমাঝে নিজেকে দেখে কথাটা যে ভুল তার প্রমাণ পাই)। শুনতে ভালো লাগলেও কথাটা আসলে পুরাই মিথ। মূল কারণ হচ্ছে, এ পৃথিবীটা আসলে লেফট হ্যান্ডেড মানুষদের জন্য তেমন একটা উপযোগী করে বানানো না। যেমন কাঁচি, ক্যান ওপেনার, গিটার, জিপার কোনো কিছুই কি বামহাতিদের জন্য বানানো হয়েছে? আর আমি যেটা সবচেয়ে বেশি ফেইস করি সেটা হলো ডানহাতলে টেবিলযুক্ত চেয়ারগুলোতে লেখা! ওবাবা! কিযে কষ্ট হয় আমার লিখতে!
তাই ডানহাতিবান্ধব এই পৃথিবীতে বামহাতিদের বেঁচে থাকতে নানানরকম উপায় বের করতে হয়। এই তো!
আরেকটা মিথ হচ্ছে, বামহাতিদের মধ্যে লিডার বা বিখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এটাও যুগে যুগে অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তি বাঁহাতি ছিলেন বলেই এই ধারণা জন্মেছে। যেমন, বারাক ওবামা, বিল ক্লিনটন, রোনাল্ড রিগ্যান, ডেভিড ক্যামেরুন ইত্যাদি।
আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে কারা বাঁহাতি বা কেনই তারা বাঁহাতি এটার একদম সঠিক কোনো উত্তর নেই। আমার কাছে হাত মানে হাতই বোঝায়। তুমি বাম হাতে কাজ করো আর ডান হাতে তাতে কি! তবুও নানানভাবে সময় অসময়ে বাঁহাতিদের নানা কথা শুনতে হয় যেটা অত্যন্ত খারাপ!
যাই হোক, আশা করি কেউ পরে আমাকে বা তোমাকে কেন বামহাতে লিখো এই প্রশ্ন করলে আর মুচকি হাসি দিয়ে প্রশ্নটি এড়িয়ে যেতে হবে না।
গেলো ১৩ আগস্ট নাকি ইন্টারন্যাশনাল লেফট হ্যান্ডেড ডে ছিল! ভাবছি নেক্সট বছর থেকে পালন করব! তুমিও করতে পারো!
তথ্যসূত্র:
১। https://www.rd.com/culture/why-people-left-handed/
২। https://www.rd.com/health/wellness/left-handed-people-myths/2/
৩। https://www.youtube.com/watch?v=TGLYcYCm2FM
৪। https://www.youtube.com/watch?v=yFhP6UJuQW4
৫। https://www.businessinsider.com/why-some-people-are-left-handed-2018-1
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন