Learning Quotient (LQ): ভবিষ্যতের দুনিয়ায় সাফল্যের মাপকাঠি

March 13, 2019 ...

“অমুকের আইকিউ আইনস্টাইনের সমান”,  “তমুকের আইকিউ ২০০ এর বেশি”… এই জাতীয় খবর আমরা প্রায়ই খবরের কাগজ কিংবা বিভিন্ন নিউজ পোর্টালে দেখতে পাই। এত বেশি আইকিউ এর অধিকারী মানুষ কীভাবে থাকতে পারে ভেবে প্রবল বিস্ময়ে আমাদের চোখ দুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চায়, আমাদের কান কটকট করতে শুরু করে, নাক চটচট করতে শুরু করে। নিজের আইকিউ পরিমাপের আশায় আমরা ‘আইকিউ পরিমাপের ১০১টি উপায়’ লিখে গুগলে সার্চ করি, তারপর বিভিন্ন ওয়েবসাইটে আইকিউ টেস্টের জন্য তৈরি করা বিভিন্ন রকম আজগুবি প্রশ্ন দেখে রীতিমতো বিষম খাই। তারপর সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর ঠিকঠাক মতো দিতে না পেরে “আমার আইকিউ নিশ্চয়ই একেবারেই কম”, কিংবা “আমার মতো গাধার আইকিউ আর কতই বা হবে” ভেবে আফসোস করতে থাকি।

আইকিউ নিয়ে আমাদের এই যে এত চিন্তা, তা কেবল এই কারণেই যে; আইকিউ নিয়ে আমাদের সমাজে প্রচারণা কিংবা সচেতনতা… দুই-ই একটু বেশি হয়। ফলে আইকিউ নামের এই জিনিসটার সাথে আমরা মোটামুটি সবাই পরিচিত।

দারুণ সব লেখা পড়তে ও নানা বিষয় সম্পর্কে জানতে ঘুরে এসো আমাদের ব্লগের নতুন পেইজ থেকে! The 10-Minute Blog!

কথায় বলে, “প্রচারেই প্রসার।” আইকিউ নিয়ে এত বেশি প্রচারের ফলে আমাদের সব চিন্তাভাবনার নিউক্লিয়াসে দিব্যি বসে আছে এই আইকিউ। অথচ নিউক্লিয়াসে বসে থাকা আইকিউ বা Intelligence Quotient (IQ) এর তুলনায়  ডিএনএ সদৃশ এলকিউ বা Learning Quotient (LQ) এর গুরুত্ব যে কোনো অংশেই কম নয়, সেটা আমরা বলতে গেলে কেউ-ই তেমন জানি না। আসলে, Learning Quotient (LQ) এর নাম শুনেছে, এমন মানুষই তো আমাদের দেশে হাতে গোনা যায়। অথচ, সাফল্যের জন্য আইকিউ যত বেশি দরকার, তার চেয়ে অনেক বেশি দরকার Learning Quotient বা LQ।

Learning Quotient (LQ) কী?

Learning Quotient (LQ) এর পোশাকি সংজ্ঞা দিতে গেলে সেটা বুঝতেই দু-চার মিনিট হা করে তাকিয়ে থাকতে হতে পারে। একেবারে সহজ ভাষায় বলতে গেলে, Learning Quotient বা LQ হচ্ছে Learning to learn। ‘শিখতে হবে’, এই জিনিসটা শিখতে পারাই হচ্ছে Learning Quotient।

কথাগুলো হজম করতে কষ্ট হচ্ছে? “শিখতে হবে এটা আবার শেখে কেমন করে” জাতীয় প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে? চাইলে কিন্তু আমরা ব্যাপারটাকে আরো একটু কঠিন করে দিতে পারি, একেবারে পুরো ইংরেজি সংজ্ঞায় চলে গিয়ে!

LQ is being able and willing to derive meaning from all kinds of experience. It’s figuring out what to do when you don’t know what to do.

এবার বরং সহজ সরল ব্যাখ্যায় আসি। ধরা যাক, তুমি ইংরেজিতে বড্ড কাঁচা, প্রত্যেক পরীক্ষায় নিয়ম করে সাড়ে তেত্রিশ পেয়ে কোনো রকমে উতরে যাও। কিন্তু তোমার শখ হয়েছে বিদেশে পড়তে যাওয়ার। ইংরেজিটা তো ভালো করে শিখতেই হবে! এখন উপায়?

ইংরেজি শেখার জন্য তুমি শুরুতেই সিদ্ধান্ত নিলে তোমার ভোকাবুলারি বৃদ্ধি করার। ভোকাবুলারির উপর একটা বই কিনে আনলে, যার মধ্যে এক হাজার নিত্য ব্যবহার্য ইংরেজি শব্দ আছে। তুমি এক মাসে বইটা একেবারে ভালো মতো কণ্ঠস্থ করে ফেললে!

কিন্তু ইংরেজি ভাষায় তো শব্দ সংখ্যা মোটেও এক হাজার না! আরো হাজার হাজার শব্দে সমৃদ্ধ ইংরেজি ভাষা। তুমি যত বেশি শব্দ শিখে ফেলবে, তত ভালো ভাবে তুমি বিদেশিদের সাথে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে পারবে। এদিকে তোমার বিদেশ যেতে আরো দুই মাস সময় বাকি। এই দুই মাসে তোমার পরিকল্পনা হতে পারে দু’রকম।

প্রথমত, চাইলেই তুমি আরো দুই হাজার ইংরেজি শব্দ শিখে ফেলতে পারো। প্রথম মাসে যেরকম কষ্ট হয়েছে, তার চেয়ে লাভ কিন্তু বেশিই হয়েছে। কাজেই আরো হাজার দুয়েক শব্দ শিখে নিলে যে আরো বেশি লাভ হবে, সেটা নিশ্চয়ই বুঝতেই পারছো!

পুরো ব্যাপারটাকে চাইলে আরেক ভাবেও সাজানো যেতে পারে। ধরা যাক তুমি গরম ধোঁয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দিতে দিতে ভাবলে, “আরে ধুর, এক হাজার শব্দ তো শিখেই ফেলেছি, এতেই চলবে। শুধু শুধু কষ্ট করে আর শেখার প্রয়োজন নেই।” এই ভেবে তুমি বাকি দুই মাসে নতুন কোনো শব্দ শিখলে না।

তোমার এই দু’ রকম ভাবনার পার্থক্যই হচ্ছে Learning Quotient বা LQ এর সীমারেখা। তোমার প্রথম ভাবনাটি ছিল LQ, অন্যদিকে দ্বিতীয় ভাবনাটি হচ্ছে অলসতা।

তাহলে LQ হচ্ছে, নতুন কিছু শেখার আগ্রহ। ‘শিখতে হবে’, এই কথাটি শিখে নেয়া। নতুন নতুন জ্ঞান আহরণ করা, দক্ষতা অর্জন করা, নিজেকে আরো শাণিত করার পাশাপাশি অর্জিত দক্ষতা আর জ্ঞানকে বাস্তব জীবনে কাজে লাগানোই হচ্ছে Learning Quotient এর সার্থকতা।

Learning Quotient (LQ) কেন দরকার?

“Learning to learn is the key to become a leader.” ~ Geeks and Geezers

বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের  একটা তত্ত্ব আছে, যেটাকে বলা হয় যোগ্যতমের টিকে থাকা  বা Survival of The Fittest. প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই এই পৃথিবীতে কেবল তারাই টিকে থাকে, যারা অন্যদের তুলনায় বেশি যোগ্য।

ফিজিক্সের অলিগলিতে ভ্রমণ!

মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব, মানুষের বুদ্ধিমত্তা আর জ্ঞান সাধনা তাকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করেছে। সেই প্রাচীন কালে আদিম মানুষ কর্তৃক আগুন আবিষ্কারের পর থেকেই জ্ঞান ও চিন্তাভিত্তিক সভ্যতার যাত্রা শুরু হয়, ক্রমান্বয়ে সে সভ্যতা আজকের এই উৎকর্ষের চরম অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। বর্তমানে এই প্রতিযোগিতার যুগে টিকে থাকতে হলে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা দরকার তা হচ্ছে ক্রমাগত নিজের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটানো। Learning Quotient বা LQ ঠিক সেই জিনিসটাই বলছে। নতুন কিছু শেখা, নিজের জ্ঞান ও দক্ষতার বৃদ্ধি ঘটানোর ইচ্ছা আর সামর্থ্য হচ্ছে LQ; কাজেই এই প্রতিযোগিতার যুগে LQ এর গুরুত্ব কতখানি তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রকৃতপক্ষে, প্রত্যেককেই যার যার ক্ষেত্রে টিকে থাকা ও অবস্থান মজবুত করার জন্য LQ বৃদ্ধি করতে হবে। LQ নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশের জন্যেও অপরিহার্য। একজন নেতার অবশ্যই ভালো পরিমাণে LQ থাকতে হবে। কেননা সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার গুণ অর্জনের জন্য LQ এর গুরুত্ব অপরিসীম।

The signature skill of a leader is the ability to process new experiences, and to integrate them into their life.

 যখন কারো মধ্যে নতুন কিছু শেখার ইচ্ছে নষ্ট হয়, তখনই তার মধ্যকার সমস্ত সম্ভাবনার বিনাশ ঘটে। এ কারণে গবেষকদের মতে, “When any of us lose that ability, we no longer grow.”

Learning Quotient (LQ) এর প্রভাব

মোট ১০টি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের উপর চালানো এক জরিপে LQ এর প্রভাবের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন বয়সী, বিভিন্ন ধর্মের এবং বিভিন্ন বয়সের মানুষের মধ্যে এ জরিপটি চালিয়ে দেখা যায়, যাদের মধ্যে শেখার আগ্রহ ও সামর্থ্য তথা Learning Quotient বেশি, তাদের প্রত্যেকের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে।

১। এ ধরনের মানুষেরা বিভিন্ন জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে এবং জটিল সব সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জন করে।

২। এ ধরনের লোকেরা আত্মবিশ্বাসী হয় এবং কঠিন পরিস্থিতিতে মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতে পারে।

৩। তারা চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসে, একই কাজ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে করার চেষ্টা করে।

৪। তারা টিমওয়ার্কে দক্ষ হয়, সহকর্মীদের উৎসাহিত করে। নিজের দক্ষতা দিয়ে প্রথম চেষ্টাতেই ইতিবাচক ফলাফল বের করে আনতে পারে।

৫। এমন মানুষেরা সৃজনশীল প্রকৃতির হয়ে থাকে। ফলে উদ্যোক্তা হিসেবে তাদের ক্যারিয়ার বেশ সফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদে যারা কর্মরত আছে, তাদের সাফল্যের ২৫ শতাংশই নির্ভর করে Learning Quotient এর উপর। এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষার প্র্যাক্টিকাল মার্ক্সের একদম সমান! এই অংশটুকু মিস করে গেলে মোটেও এ প্লাস পাওয়া সম্ভব নয়!

Learning Quotient (LQ) এর অভাব

কর্মীদের Learning Quotient (LQ) কম হওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠাএর উৎপাদনশীলতা কমে যায়। এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো

১। একমুখী চিন্তাধারা: নতুন ধরনের চিন্তা জন্ম নেয় না, সৃজনশীলতা নষ্ট হয়। ফলে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।

২। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস: Learning Quotient না থাকলে সব সময় এক ধরনের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস কাজ করে। ফলে ভুল-ত্রুটিগুলো ঠিক করার দিকে মনোযোগ থাকে না, বরং ‘আমিই সঠিক’ জাতীয় একটি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে, যা যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্যই ক্ষতিকর।

৩। কমিউনিকেশন গ্যাপ: শেখার আগ্রহ না থাকার পারস্পরিক আদান-প্রদান, তথা শেয়ারিং তেমন একতা দেখা যায়  না। ফলে কমিউনিকেশন গ্যাপ গড়ে ওঠে, যা যেকোনো টিমওয়ার্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

৪। দক্ষতার অভাব: সর্বোপরি, Learning Quotient (LQ) কম থাকায় সবচেয়ে ক্ষতিকর বিষয়টি হচ্ছে, যথাযথ দক্ষতা গড়ে ওঠে না। ফলে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাওয়া সম্ভব হয় না।

ছাত্রজীবনে Learning Quotient (LQ)

ছাত্রজীবনে Learning Quotient এর গুরুত্ব নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। যে সময়টা ভবিষ্যত জীবনের বীজ বপনের সময়, সে সময়টাতেই যদি শেখার আগ্রহ না থাকে, তাহলে পুরো জীবনটাই বৃথা যাওয়ার সম্ভাবনা! কাজেই Learning Quotient (LQ) অর্জনের সেরা সময় নিঃসন্দেহে ছাত্রজীবন।

তাহলে Learning Quotient (LQ) অর্জনের উপায়?

এক কথায়, কোনো বাঁধা-ধরা নিয়ম নেই। নিজের ভেতরকার শেখার আগ্রহটাকে বাড়িয়ে তোলাটাই সবচেয়ে বড় কাজ। কেননা শেখার আগ্রহই Learning Quotient (LQ), কাজেই কৌতূহল আর জিজ্ঞাসা যত বাড়বে, Learning Quotient ও ততই বাড়বে।

চিত্রে দেখানো বিষয়গুলো এক্ষেত্রে কাজে আসতে পারে।

0plJlOxS1y yMp7ee2tASjmUNSMJBcGhWqHWOpEHRgawt3g5XUTZvugEJaYJ9bQQc1yn5m RvuXySrCiQP6YQVLcxNLxaQmJ7foaa3Ic 0TRAW1SuZg4Ys2jv52Wa 2ok3ryuZ2

শেষ কথা

সাফল্যের জন্য Learning Quotient (LQ) বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান সভ্যতা পুরোপুরি জ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক সভ্যতা। ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও দক্ষতা, সেই সাথে সৃজনশীলতা ও টিমওয়ার্কই এখন সাফল্যের অস্ত্র। কাজেই এসব দিককে যে যত বেশি ঝালিয়ে নিতে পারবে, সাফল্য ততই তার হাতের মুঠোয় চলে আসবে।

আর সাফল্যকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসার জন্য এইটুকু কাজ তো অবশ্যই করতে হবে।

খুব বেশি কিছু না, নিজের কৌতূহল আর আগ্রহকে কেবল একটুখানি বাড়িয়ে নেয়া।

খুব বেশিই কষ্টের কাজ কি?

রেফারেন্স

https://bit.ly/2CURQSW


১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com

৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি অনলাইন ব্যাচ ২০২৩

দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ঘরে বসেই দেশসেরা শিক্ষকদের সাথে যুক্ত হও ইন্টারেক্টিভ লাইভ ক্লাসে, নাও ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণির সম্পূর্ণ সিলেবাসের 💯তে💯 প্রস্তুতি!

আপনার কমেন্ট লিখুন