সব ইমেইলই কিন্তু ফরমাল ইমেইল নয়। ফরমাল ইমেইল বা বিজনেস ইমেইল বলতে আমরা সেই ইমেইলকে বুঝি যা চাকরির অফিসে বা কর্মক্ষেত্রে বসের সাথে বা কলিগের সাথে যোগাযোগের জন্য আমরা আদান-প্রদান করে থাকি। আর এই ইমেইলগুলোর আদবকেতা হতে হয় পুরোদস্তুর পেশাদার। ন্যাশনাল ব্যুরো অফ ইকোনমিক রিসার্চের তথ্যমতে, করোনা পরিস্থিতিতে ওয়ার্ক ফ্রম হোমের সিচুয়েশনে কর্মীদের অন্য যেকোনো সময়ের থেকে বেশি মেইল আদান-প্রদান করতে হয়, এবং এ কাজে সময়ও দিতে হয় অন্য যেকোনো সময়ের থেকে বেশি।
ফরমাল ই-মেইল লেখার কিছু জরুরি নিয়ম
যদিও বর্তমানে হরহামেশাই ইমেইল, বিশেষ করে ফরমাল ইমেইল লিখতে হচ্ছে আমাদের, তবুও কোথায় যেন খামতিটা থেকেই যাচ্ছে বলে মনে করেন ক্যারিয়ার কোচ বারবারা প্যাচটার। বারবারা কর্পোরেট জগতের গ্রিটিং থেকে শুরু করে মেইলিং এবং যাবতীয় বিষয়াদি নিয়ে তার দি এসেনশিয়ালস অফ বিজনেস এটিকেট বইয়ে লিখেছেন। বইটিতে বারবার কর্পোরেট ইমেইলিং বিষয়েও পরামর্শ দিয়েছেন। আজকে আমরা সেখান থেকেই কিছু বিষয়ে আলোকপাত করবো।
-
মেইলের সাবজেক্ট যেন পরিষ্কার এবং স্ট্রেইটফরওয়ার্ড হয়
দেখুন, একটা মেইল খুলে পড়ে দেখা হবে কি না, সেটা কিন্তু সম্পূর্ণটাই নির্ভর করে তার সাবজেক্টের উপর। তাই এই ক্ষেত্রে হতে হবে, কনসাইজ। মানে কথা কম, কিন্তু সেটুকুতেই দরকারি বিষয়টা বলে দিতে হবে। যেমন, উদাহরণ দিয়ে বলতে গেলে, মিটিং-এর সময় বদল, প্রেজেন্টেশন বাবদে আর্জেন্ট মিটিং, ডেডলাইন এক্সটেন্ড করা প্রসঙ্গে ইত্যাদি হতে পারে সাবজেক্টের কিছু হাতেকলমে উদাহরণ।
-
ইমেইল অ্যাড্রেসটিও হতে হবে পেশাদার
কর্পোরেট জগতে পদচারণার প্রতিটি পদক্ষেপ হবে পেশাদার। সাধারণত চাকরির ক্ষেত্রে অফিস থেকেই মেইল অ্যাড্রেস দিয়ে দেয়ার কথা। সেক্ষেত্রে সমস্যা নেই, নাম পদবি যুক্ত করে প্রতিষ্ঠানের ডোমেইনের মেইল দিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু সমস্যা হয়, যখন পার্সোনাল মেইল ব্যবহার করবেন। মেইল অ্যাড্রেসে স্পষ্টভাবে আপনার নাম থাকবে এবং কোনো সংখ্যা দিতে পারেন। আদিকালের ফেসবুকীয় নাম একদমই পরিহার করতে হবে, যেমন প্রিন্সেস সাইফা, একাকী বালক ইত্যাদি যেন কোনোক্রমেই মেইলে না থাকে।
-
রিপ্লাই অল-এ চাপ দেয়ার আগে দুবার ভাবুন
মেইলে রিপ্লাই এবং রিপ্লাই অল বাটন দুইটি কিন্তু কাছাকাছিই থাকে, তাই সাবধান। রিপ্লাই অল সাধারণত বেশিরভাগ সময়েই কাজে লাগে না, পক্ষান্তরে রিপ্লাইই বেশিরভাগ সময় ব্যবহার করতে হয়। রিপ্লাই অল দিলে পূর্বের মেসেজটা যার থেকে এসেছে, তার কাছে তো যাবে বটেই, সাথে আগের সেন্ডার যে যে রিসিপিয়েন্টদের মেইল পাঠিয়েছে সবার কাছে আপনার রিপ্লাইটা চলে যাবে। তাই রিপ্লাই দেবার আগে দুবার ভাবুন, কেউই কিন্তু অযাচিত মেইল চায় না। আর সিসি/বিসিসি নিয়েও যত্নবান থাকবেন, সবসময় বিসিসি ব্যবহার করাই নিরাপদ, এতে এক সেন্ডার অন্যজনের কন্টাক্ট ডিটেইলস দেখতে পায়না। আর সিসি দিলে সবাই সবার তথ্য পেয়ে যায়, যা কাম্য নয়।
-
মেইলের শেষে নিজের একটা সিগনেচার ব্লক দিন
মেইলের একদম শেষে একটা সিগনেচার ব্লক সবসময় ব্যবহার করা ভালো। এতে যোগাযোগে সুবিধা হয়, আর টেম্পলেট সেভ করে রাখলে আপনারও আর বারবার লিখতে হবে না। এতে থাকবে নাম, পদবি, প্রতিষ্ঠানের নাম, আর কন্টাক্ট নাম্বার। তবে মাথায় রাখার বিষয় হল, এখানকার ফন্ট, কালার নরমাল রাখাই ভালো। বেশি রংচঙা হলে পেশাদার ভাবটা চলে যাবে।
-
সম্বোধনে যেন না হয় গড়বড়
ইনফরমাল সম্বোধন ত্যাগ করতে হবে। যেমন, Hey you guys, Hi folks, Yo guys এ জাতীয় বাক্যাংশ এড়িয়ে চলাই শ্রেয়। কারণ, এগুলো কর্মক্ষেত্রের প্রফেশনাল ভাব বজায় রাখে না। এগুলোর বদলে হাই হ্যালো বলে ফার্স্ট নেম সম্বোধন করাই শ্রেয়। আরেকটা কথা, টু হুম ইট মে কন্সার্ন ও পরিহার করা উচিত। সরাসরি সম্বোধনে এগোলেই ভালো। আর জেন্ডার নিরপেক্ষ সম্বোধনই বাছাই করা উচিত। এবং নামের সংক্ষিপ্তরূপ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও জেনে নিয়ে করা ভালো। মানে হাই মাইকেল এর স্থলে হাই মাইক তখনই লেখা যাবে যদি জানা থাকে যে, মাইক বললে তিনি আপত্তি করবেন না।
-
বিস্ময়সূচক চিহ্ন বেশি একটা না দেয়াই ভালো
বাস্তবজীবনে কথার ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন আবেগ-অনুভুতিতে কথা বলে থাকি। কিন্তু লেখার ক্ষেত্রে, আরও বিশেষ করে ফরমাল ইমেইলে কিন্তু তেমন একটা আবেগঘন হয় না। তাই বিস্ময়সূচক চিহ্নের ব্যবহার এমনিতেই কম হয়। আর তারপরও যেখানে আপনি নিশ্চিত নন যে, বিস্ময়চিহ্ন দেয়া সঠিক হবে কি না, সেসকল ক্ষেত্রে না ব্যবহার করাই উচিত হবে।
-
বেশি ইমোশনাল অবস্থায় মেইলের রিপ্লাই দেয়া থেকে বিরত থাকুন
আমরা মানুষ মাত্রই আবেগপ্রবণ, আবেগের মাথায় নেয়া সিদ্ধান্ত অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক নাও হতে পারে। তাই আবেগের বশে কিছু লিখে না ফেলাই ভালো, কথায় আছে বেটার লেট দ্যান সরি; অর্থাৎ দেরিতে কাজটা করুন কিন্তু তারপরও এমন কাজ করে বসবেন না যার জন্য পরে লজ্জিত হতে হয়। তাই আবেগ প্রশমিত হয়ে গেলে, স্বাভাবিক অবস্থায় ঠাণ্ডা মাথায় মেইলের রিপ্লাই দিন।
-
টিমে ভিন্ন সংস্কৃতির সহকর্মীও থাকতে পারেন, সবাইকে সম্মান করুন
অনেকসময়ই দেখা যাবে, টিমে অনেক ভিন্ন চিন্তার, ভিন্ন সংস্কৃতির, মতাদর্শের কলিগ থাকতেই পারেন। তাদের সাথে আপনার মত, পথ, চিন্তা, চেতনা নাও মিলতে পারে। বরং না মেলাই স্বাভাবিক, তাই এসকল ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী নিজের মত যেন তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। নিজের লেখার দ্বারাও যেন কেউ কষ্ট না পায়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
-
ফন্টে থাকুক স্বাভাবিকতা
স্পোর্টি ফন্ট আমরা সবাই পছন্দ করি, তাই না? কিন্তু সমস্যা হলো কী, যখন প্রফেশনাল জগতে কাজ করছি, তখন কিছুটা সাধ-আহ্লাদ তো বাদ দিতেই হয়। তেমনি এটাও একটা। রং-বেরঙের বাহারি ডিজাইনের, কমিক্সের ফন্ট কর্পোরেট জগতে যেন চলে না আসে! মানলাম আপনি অ্যানিমে-পোকা, কার্টুনিস্ট ঘরানার, কিন্তু ফরমাল কাজের জন্য কিছুটা ত্যাগই না হয় করলেন। সাধারণ ফন্টগুলোই যেমন টাইমস নিউ রোমান, ক্যালিব্রি বা এরিয়াল এগুলোর কোনো একটা বেছে নিতে পারেন। আর রং কালোই সর্বত্র মানানসই।
কিছু টিপস
এবারে কিছু অতিরিক্ত উপদেশের কচকচানি নিয়ে এলাম। নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, বকবকানি আর বেশি বাকি নেই।
-
প্রুফরিড! প্রুফরিড!! প্রুফরিড!!!
আপনার ভুল-ত্রুটি কিন্তু কোনোটিই প্রাপকের নজর এড়িয়ে যাবে না। তাই সতর্ক থাকুন, স্পেল চেকারের ভরসায় বসে থাকা বোকামো। লেখা শেষে নিজেই আরেকবার রি-চেক দিন। সেই বিখ্যাত মজার ঘটনাটি হয়তো অনেকেই জানেন, এক ভদ্রলোক স্পেলচেকারের উপর আশ্বস্ত হয়ে ছিলেন, নিজে প্রুফ-রিড না করেই মেইল পাঠিয়ে দেন। শেষে পাঠানোর পর খেয়াল করেন ‘Sorry for the inconvenience’ এর জায়গায় তিনি লিখে ফেলেছেন ‘Sorry for the incontinence!’
-
একটু টোটকা, মেইল অ্যাড্রেস শেষে যোগ করুন
আপনি কিন্তু কখনই চাইবেন না, অর্ধেক, অপূর্ণাঙ্গ লেখা মেইল প্রাপকের কাছে চলে যাক। এজন্য সতর্কতার অংশ হিসেবে পুরো ইমেল বডিটি লেখার শেষে মেইল অ্যাড্রেস যোগ করতে পারেন। যাতে ভুলে হলেও কখনও সেন্ড বাটনে চাপ লেগে অসম্পূর্ণ মেসেজ চলে যাবে না।
-
ইমেইলের রিপ্লাই দিন, যদিও সে মেইলটি ভুলে আপনার কাছে এসে থাকে
ইমেইলের রিপ্লাই দেয়া খুব ভালো অভ্যাস, এটার চর্চা করতে পারেন। একটি ইমেইল আপনার কাছে এসেছে মানে, সাধারণত তা পড়ে সে অনুযায়ী অ্যাকশন নেয়া জরুরি। তার সাথে সাথে প্রেরক সেটির রিপ্লাই পেলে খুশি হন। এমনকি কখনও কোনো মেইল যদি ভুলেও চলে আসে, সেক্ষেত্রেও রিপ্লাই দিতে পারেন এই বলে যে, হ্যালো অমুক, আপনি বোধ হয় ভুলে মেইলটা আমাকে করেছেন। আপনি যেন সঠিক ব্যক্তির কাছে মেইলটা পাঠিয়ে দেন, সেজন্য এই রিপ্লাইটা দেওয়া। ধন্যবাদ। এতে উভয়পক্ষই লাভবান হবে।
শেষকথা
আর সবশেষ কথা হল প্রাইভেসি বজায় রেখে কাজ করুন, কারণ কর্পোরেট দুনিয়ায় যেকোনো কিছুই অঘোষিতভাবে পাবলিক। অর্থাৎ যদিও আপনি একজনকে মেইলটা পাঠাচ্ছেন, প্রকারান্তরে সবাই মেইলটা দেখতে পাবে- এরকম বিষয় মাথায় রেখে পাঠানোই শ্রেয়। আর মেইলের ভাষার/ভিতরের অ্যাটাচমেন্টের জন্য যেন পরবর্তীতে বিব্রত হতে না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি কাম্য। আর দুয়েকটা দিকে নজর রাখবেন, উইকেন্ডে মেইল পাঠাবেন না, এর বদলে শিডিউল করে রাখবেন। আর ইমেইল বডি সুন্দর করে সাজাবেন। সবদিক ঠিকঠাক থাকলে মেইল পাঠানো, বা মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ এমন আহামরি কঠিন কিছু না যে আপনি পারবেন না। অবশ্যই পারবেন, সঠিক আদবকেতার মিশেলে কর্পোরেট যোগাযোগে হয়ে উঠুন এক্সপার্ট এমনটাই আমরা চাই।
References:
- 15 Email Etiquette Rules Every Professional Should Follow, Inc.
- The Essentials of Business Etiquette, Barbara Pachter. ISBN: 9780071811262.
- 15 email etiquette rules every professional should know, Business Insider.
আপনার কমেন্ট লিখুন