কীভাবে উপস্থাপনা শুরু করতে হয়? জেনে নাও কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপস্থাপনা কৌশল

March 19, 2023 ...

কয়েকদিন আগেই এক টিভি চ্যানেলের আড্ডা ঘরানার অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আমার ডাক পড়লো। আমি, আমার পূর্বপরিচিত দুইজনসহ আরো কয়েকজন ছিলাম। কোনো কারণে শ্যুটিং শুরুতে বেশ দেরি হচ্ছিলো, এইদিকে সময় চলে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই অনেকে বিরক্ত হয়ে উঠছিলো। দুয়েকজন তো এমনকি বাড়ি চলে যেতেও চাইলো!

এমন সময় উপস্থাপিকা আপা আসলেন, আর ঘটনা ঘটলো তখনই। আপা এসে দুটো কথা বলার সাথেই পরিবেশটা কেমন হালকা হয়ে এলো, সবার মন মেজাজ ঠিক হয়ে গেল, আবার এনার্জি ফিরে পেয়ে সবাই পুরোদমে মন দিলো অনুষ্ঠানে।

অনুষ্ঠান বেশ ভালো হলো। শ্যুটিং থেকে বের হয়েই ভাবলাম, ওই বিরক্ত হয়ে ওঠা মানুষগুলো মুহূর্তের মাঝেই কিভাবে উৎসাহ ফিরে পেলো? বুঝলাম, এটা সম্মানিত উপস্থাপিকা আপার কাজ। উনি একটা প্রায় তেঁতে ওঠা পরিবেশকে উপস্থাপনা কৌশল দিয়ে মুহূর্তের মাঝে ঠান্ডা করে সবাইকে একটা সুন্দর অনুষ্ঠান উপহার দিতে সাহায্য করলেন।

বুঝতেই পারছো উপস্থাপনা ও কথা বলার কলাকৌশল একটা অনুষ্ঠানের সফলতায় কতোটা অবদান রাখতে পারেন। ভেবে দেখ, আপা যদি মাথা খাটিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারতেন, আমাদের অনুষ্ঠান এতো সুন্দর হওয়া তো দুরের কথা, ভন্ডুল হতেও সময় লাগতোনা এতটুকু।

News Presentation Course

কোর্সটি করে যা শিখবেন:

  • প্রফেশনাল নিউজ প্রেজেন্টার হবার জন্য প্রয়োজনীয় সকল স্কিলের আদ্যোপান্ত
  • নিউজ প্রেজেন্টারদের অডিশন ও নিয়োগ প্রক্রিয়া
  • মেকাপ থেকে শুরু করে লাইভে যেকোনো পরিস্থিতি সামলানোর কৌশল
  •  

    টকশো হোক কিংবা সাংস্কৃতিক – একটা অনুষ্ঠান কেমন হবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করে উপস্থাপকের উপস্থাপনা কৌশল এর ওপর। আচ্ছা, একজন উপস্থাপক কী এমন করেন যেটা সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানে সুন্দর একটা পরিবর্তন এনে দেয়? মূলত এই প্রশ্নের উত্তর নিয়েই আজকের এই লেখা। এই লেখা পড়ে তুমি বুঝে যাবে উপস্থাপনা করার নিয়ম এবং সেরা উপস্থাপকদের সফলতার গোপন রহস্য।

    চলো তাহলে জেনে নেয়া যাক উপস্থাপনার হাতেখড়ি!

    উপস্থাপনা কী ও উপস্থাপনা করার নিয়ম

    উপস্থাপনা বলতে আমরা অনেকে হয়তো বুঝি কেবলই একটা অনুষ্ঠানের সিরিয়াল ধরে কিছু নাম বলে যাওয়া, অথবা টকশোর ক্ষেত্রে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু আসলেই কি তাই? মোটেই না! উপস্থাপনা হচ্ছে একটা অনুষ্ঠান সুন্দরভাবে পরিচালনা করার অনেকগুলো কৌশল, একেক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে যেটা একেকরকম হতে পারে।

    উপস্থাপনা কিন্তু মোটেই চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। জীবনে একবার হলেও পাব্লিক স্পিকিং এর অভিজ্ঞতা আছে আমাদের অনেকের। নতুনদের কাছে পাব্লিক স্পিকিং রীতিমতো ভয়ের, এমনকি প্যানিক এট্যাকের কারণ। আর উপস্থাপনাকে বলতে পারো পাব্লিক স্পিকিং এর বড়ভাই।

    উপস্থাপনা কৌশল (2)
    Photo: Freepik

    কাজেই যার একবার উপস্থাপনা জানা হয়ে যায়, তার জন্য অনেক কিছুই একসাথে সহজ হয়ে যায়। এর মাঝে একটি হলো: আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজের কথাগুলো পুরো পৃথিবীর সামনে বলতে পারা।

    উপস্থাপনা হতে পারে চমৎকার একটা ক্যারিয়ার অপশন। একজন উপস্থাপক যেহেতু তাঁর কথাগুলো খুব সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেন, সেহেতু তাঁর মাধ্যমে সমাজে কোনো পরিবর্তন আনাটাও কিন্তু সম্ভব।

    আমরা সবাই ছোটবেলায় বিটিভিতে কমবেশি ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানটি তো দেখেছিই। দেখেছি কিংবদন্তি উপস্থাপক হানিফ সংকেত কীভাবে তার অসাধারণ উপস্থাপনা কৌশল ব্যবহার করে বিনোদনের মধ্য দিয়ে সুন্দর বার্তা পৌঁছে দেন লাখো মানুষের কাছে। উপস্থাপক হিসেবে শাইখ সিরাজ কে দেখেছি কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষি ঐতিহ্য বর্তমান প্রজন্মের কাছে সফলতার সাথে পৌঁছে দিতে, যার কারণে আমাদের নতুনদের অনেকে এখন আধুনিক কৃষির প্রতি অগ্রহী হয়ে উঠেছে।

    এগুলো তো আমাদের প্রায় সবার নিজ চোখে দেখা। এছাড়াও বিশ্বজোড়া আমাদের দেখা-না দেখা উপস্থাপকেরা অনেক সুন্দর কাজ করে চলছেন। বর্তমান প্রজন্মেও বাংলাদেশে অনেক মেধাবী ও সফল উপস্থাপক আছেন যারা অনুষ্ঠান পরিচালনার পাশাপাশি পরিবর্তন আনতেও সাহায্য করছেন।

    উপস্থাপনা কৌশল: কিভাবে উপস্থাপনা শুরু করতে হয়?

    যেকোনো অনুষ্ঠানের শুরুটা যদি চিত্তাকর্ষক না হয়, তাহলে দর্শক বা অতিথি সহজেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন। অনুষ্ঠানের শুরু সুন্দর করার ক্ষেত্রে উপস্থাপকের ভূমিকাই মূল। নিখুঁত অনুষ্ঠানের জন্য চাই দক্ষ একজন উপস্থাপক। ভালো একটা স্ক্রিপ্ট আর পূর্বপ্রস্তুতির পাশাপাশি কিছু উপস্থাপনা কৌশল অবলম্বন করা যায়। নিচে অনুষ্ঠান শুরু করার এমন কিছু আইডিয়া নিয়েই আলোচনা করছি।

    ১) দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করা

    অনুষ্ঠানের শুরুতেই যদি দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করার মতো কোনো কিছু করা যায়, তবে বাকি অনুষ্ঠান ভালো যাবার একটা পাকাপোক্ত সম্ভাবনা তৈরী হয়। আমার পরামর্শ হচ্ছে “দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করছি”- এর মতো কথা না বলে এমন কিছু করা যেন দর্শক নিজ থেকেই কৌতুহলী হতে পারেন।

    উদাহারণস্বরুপ, অনুষ্ঠানের সাথে যায় এমন একটা মজার কৌতুক দিয়ে শুরু করা যেতে পারে, অথবা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে একটা সংক্ষিপ্ত ভিডিও দিয়ে। দর্শক বিনোদন পেলেই ধরে নাও তুমি একটা সুন্দর অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত!

    ২)শ্রোতাদের কল্পনা করতে বা ভাবতে লাগিয়ে দেয়া

    একজন মানুষের মস্তিষ্ক যখন সরব থাকে, তার মনোযোগ আকর্ষণ করাও সহজ হয়। যদি অনুষ্ঠানের শুরু করা যায় একটা কল্পনা দিয়ে, তাহলে কিন্তু মন্দ হয়না!

    এক্ষেত্রে হয়তো তুমি অনুষ্ঠানের থিমের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটা “কেমন হতো যদি অমুক ব্যাপারটা এমন না হয়ে তেমন হতো?” -জাতীয় প্রশ্ন দিয়ে শুরু করতে পারো, তাহলে তোমার দর্শকও কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই তোমার কল্পনা করা পরিস্থিতিটা নিজেরা কল্পনা করা শুরু করে দিবে। ব্যাস, পেয়ে গেলে একসাথে অনেক অনেক দর্শকের মনোযোগ!

    সবার জন্য Vocabulary

    ইংরেজি ভাষায় নিজের ভোকাবুলারি সমৃদ্ধ করুন সহজ কিছু টেকনিক ব্যবহার করে। মুনজেরিন শহীদের সাথে ভোকাবুলারি শিখে বিভিন্ন ইংরেজি টেস্টে ভালো স্কোর অর্জন করুন।

     

    ৩) ভবিষ্যত বা অতীত দিয়ে শুরু করতে পারো

    রাজনীতিবিদদের বক্তৃতায় এই ব্যাপারটি অনেক লক্ষ্য করে থাকবে। তারা অতীতে কোনো খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে বর্তমানে এসে পৌঁছেছেন, অথবা ভবিষ্যতে কী কী সাফল্য অর্জন করবেন, এমন কথা দিয়ে শুরু করেন। মানুষের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে এটি হতে পারে তোমার মাধ্যম!

    উদাহারণস্বরুপ ধরো মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটি অনুষ্ঠানে তুমি আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান উল্লেখের মাধ্যমে শুরু করতে পারো, অথবা মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে সমৃদ্ধ করতে কীভাবে অবদান রাখতে পারে তা নিয়ে বলতে পারো।

    কোনো পরিস্থিতি অথবা ঘটনা বর্ণনার সময় তোমার কাজ হচ্ছে তুমি যা-ই বলছো, দর্শক যেন তা কল্পনা করতে শুরু করে দেন। এক্ষেত্রে সুন্দর বাচনভঙ্গি, শুদ্ধ উচ্চারণ আর বিরামচিহ্নের সঠিক ব্যবহার তোমাকে সাহায্য করবে।

    ৪) প্রবাদ অথবা সঙ্গতিপূর্ণ কবিতার লাইন

    অনুষ্ঠান শুরুর বাক্য হিসেবে কবিতার লাইন অথবা কোনো প্রবাদ ব্যবহার করা নতুন কিছু নয়। কবিতার লাইন প্রাসঙ্গিক হলে অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য অনেকাংশে বেড়ে যায়।

    তুমি যদি উপস্থাপনার ক্ষেত্রে কোনো ধরণের স্লাইড ব্যবহার করো, তাহলে বলার সময় স্লাইডেও লাইনগুলো তুলে দিতে পারো। এটি দর্শককে বুঝতে, কল্পনা করতে সাহায্য করবে।

    ৫) গল্প অথবা ঘটনা দিয়ে শুরু করা

    এটা অনেকটা প্রথম কৌশলের মতোই। এখানেও তোমার মূল কাজ দর্শককে তোমার ভাবের জগতে নিয়ে যাওয়া। অনুষ্ঠানের মূল ধারণা আর অনুষ্ঠানের তাৎপর্য বোঝার ক্ষেত্রে কাজে আসবে এমন একটা সত্যিকার অথবা কাল্পনিক গল্প দিয়ে তুমি শুরু করতে পারো। গল্প কিন্তু মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করার একটা ভালো হাতিয়ার! রসিকতার মধ্য দিয়েও গল্প বলা যায়।

    অনুষ্ঠানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা থাকলে সেটা  শুরুতে বলার চেষ্টা করতে পারো।

    ৬) নিজের অথবা দর্শকদের জীবন নিয়ে গল্প বলা:

    শ্রোতারা গল্প শুনে উপভোগ করেন, এটা তো আমরা জানলামই। আর গল্পটির সাথে যখন দর্শক-শ্রোতা নিজের জীবনের মিল পাবেন, তখন গল্পটি হয়ে উঠবে আরো অসাধারণ সুন্দর।

    উপস্থাপক হিসেবে তোমার নিজের কোনো ঘটনা, অথবা দর্শকদের জীবনের সাথে মিলে যায় এমন কোনো ঘটনা দিয়ে শুরু করতে পারো। এতে করে দর্শকের সাথে তোমার একটা সম্পর্ক তৈরী হবে অনুষ্ঠানের শুরুতেই।

    ৭) দর্শকদের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা

    এটা অনুষ্ঠান শুরু করার আরেকটি সুন্দর উপস্থাপনা কৌশল। সাধারণত সেশন জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করেই সবসময় শুরু করা হয়। এছাড়াও যেকোনো অনুষ্ঠান শুরু করার সময় প্রশ্ন করলে অনুষ্ঠানে সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ থাকে।

    উপস্থাপনা
    Photo: Pixabay

    ৮) পরিসংখ্যানে শুরু!

    তুমি যদি তোমার অনুষ্ঠানের একটি খুব অর্থপূর্ণ শুরু চাও, এবং বুঝতে না পারো কিভাবে উপস্থাপনা শুরু করতে হয়, তবে পরিসংখ্যান দিয়ে শুরু করা হতে পারে সবচাইতে ভালো অপশন। তোমার অনুষ্ঠান ধরো স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা। তুমি শুরু করতে পারো তোমার স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি জরিপের মাধ্যমে। এতে করে অনুষ্ঠানে একটা ভাবগম্ভীরতা আসবে, পাশাপাশি দর্শকের মনোযোগও আকৃষ্ট হবে।

    তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন খুব কঠিন কোনো উপাত্ত চলে না আসে, যা দর্শকদের বুঝতে সমস্যা হয়।

    উপস্থাপনা কৌশল: উপস্থাপনায় নতুন হলে যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখবে

    ১) সোজা-সাপ্টা রাখতে হবে

    সবার আগে যেটা বলবো, মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। আর মনে রাখতে হবে তুমি কী ধরণের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছো। একটা অনুষ্ঠানে অনেক ধরণের মানুষ থাকতে পারেন। তোমার কথা যেন সবারই বুঝতে সুবিধা হয়।

    একটা কথা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই, সহজ যেকোনো কিছুই সুন্দর। তোমার বলার বিষয় কঠিন হলেও, তুমি কতো সহজে সেটাকে উপস্থাপন করতে পারছো এটা জরুরী। উপস্থাপনার সময় মাথায় অনেক ধরণের চাপ থাকতে পারে, অনেক দায়িত্ব নিয়ে বুঝে শুনে কথা বলতে হয়। কিন্তু সহজ-সাবলীলতা একবার আয়ত্ত করে ফেলতে পারলে পুরো ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে যায়।

    দর্শকের যেন কোনোভাবেই বুঝতে অসুবিধা না হয় যে তুমি কী বলতে চাইছো।

    ধরো তুমি একটা ফুটবল ম্যাচ উপস্থাপনা করছো। এখানে তোমার অনেক পরিসংখ্যানের তথ্য তুলে আনতে হবে। তোমার মাথায় রাখতে হবে কীভাবে সবচাইতে সহজে তথ্যগুলো দর্শকদের জানানো যায়। শুধু তা-ই না, এর পাশাপাশি তোমাকে দর্শকদের বিনোদনের ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হবে। আগে থেকেই প্র্যাক্টিস আর যথেষ্ট প্রস্তুতির মাধ্যমে অনুষ্ঠান সোজা-সাপ্টা রাখার কৌশল আয়ত্ত করা যায়। অনুষ্ঠানে থাকা জরুরী, এমন মূল পয়েন্টগুলোর একটা তালিকা তৈরী করে হাতের কাছে রাখা যায়। এতে করে মূল বিষয়ের বাইরে চলে যাওয়ার ভয়টা থাকবেনা।

    ২) অতিথিকে অপ্রীতিকর অবস্থা থেকে বাঁচাতে হবে

    অনেক অনুষ্ঠানেই উপস্থাপক অতিথির সাথে সরাসরি কথা বলেন। অনেকসময় দেখা যায় উপস্থাপক কিংবা দর্শকের কথার বিপরীতে অতিথি একটা অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়ে যান। একজন উপস্থাপক হিসেবে তোমার দায়িত্ব হচ্ছে এটা নিশ্চিত করা যে তোমার অতিথি যেন অপ্রীতিকর অবস্থায় না পড়েন এবং কোনো অবস্থাতেই অপমানিত বোধ না করেন।

    ৩) সবকিছু গায়ে লাগানো যাবেনা

    অতিথি যেমন অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়তে পারেন, তেমনি তুমিও কিন্তু যেকোনো সময় একটা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে পড়তে পারো। কখনো হয়তো অপমানিত বোধ করতে পারো। একজন সেরা উপস্থাপক হিসেবে তোমার কাজ হবে যতোটা সম্ভব ওই পরিস্থিতিকে হাসিমুখে এড়িয়ে যাওয়া। যদি তা একান্তই সম্ভব না হয় তখন অবশ্য আলাদা ব্যাপার! তখন তোমার অন্য কৌশল অবলম্বন করতে হবে। তবুও কোনো অবস্থাতেই অনুষ্ঠান ভন্ডুল হতে দেয়া যাবেনা। (এই ব্যাপারে তোমার ধৈর্য কম থাকলে উপস্থাপনার দিকে পা না বাড়ানোই ভালো!)
    একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, তোমার দর্শকেরা তোমাকে বুঝতে না-ই পারেন। কোনো সমস্যায় পড়লেও একজন উপস্থাপক হিসেবে তোমাকে তোমার অনুষ্ঠান হাসিমুখে শেষ করতে হবে।

    ৪) অনুষ্ঠানের কেউ বন্ধু না!

    একজন উপস্থাপকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা। কিন্তু তোমার এটাও মাথায় রাখতে হবে যে  দর্শকদের কেউই তোমার বন্ধু না!

    কী, শুনতে অদ্ভূত লাগছে তো? কিন্তু এটাই সত্যি। দর্শকদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা, তাদের সাবলীল হতে সাহায্য করা একজন উপস্থাপক হিসেবে তোমার দায়িত্ব। কিন্তু বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতে করতে কাউকে তোমার বন্ধু ভেবে বসার ভুল করতে যেওনা। তাই বলে আবার এই না যে অতিথি কিংবা দর্শকের সাথে তোমার কোনো সম্পর্কই নেই। সম্পর্ক আছে, কিন্তু এর পুরোটাই আদতে কাজের সম্পর্ক; ইংরেজিতে যাকে বলে প্রফেশনাল ফ্রেন্ডশিপ।

    ৫) সীমাহীন ধৈর্য থাকা চাই

    তোমার যদি কোনোভাবে মনে হয় তোমার ধৈর্যধারণক্ষমতা কম, তাহলে উপস্থাপনা তোমার জন্য নয়। সব ক্যারিয়ারেই কমবেশি ধৈর্যের প্রয়োজন হয়, কিন্তু উপস্থাপনার ক্ষেত্রে এটা অপরিহার্য। উপস্থাপনার সময় যেহেতু সরাসরি অন্য মানুষদের সংস্পর্শে আসা হয়, সেহেতু অনেক ধরণের কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে।

    যেমন ধরো কোন একটা অনুষ্ঠানে একজন দর্শক তোমাকে অকারণে একটা বিষয়ে দোষ চাপিয়ে দিতে পারেন, এমনকি কটাক্ষ করে উপহাস করতে পারেন। অনেকসময় দর্শক অথবা অতিথি এমন কথা বলতে পারেন যা তোমার আদর্শিক দিককে মানেনা। হোক সেটা টক শো, হোক সেটা সভা অথবা অন্য কোনো অনুষ্ঠান, তোমার ধৈর্য অটুট থাকা চাই।

    মনে রাখবে, উপস্থাপনার জগতে ধৈর্যই আর হাসিমুখই তোমার ব্রহ্মাস্ত্র।

    উপস্থাপনা করার নিয়ম: ১০টি গুরুত্বপূর্ণ উপস্থাপনা কৌশল

    নতুন উপস্থাপকদের জন্য পরামর্শ তো জানা হলো, এবার আসি উপস্থাপনার কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস-এ। একজন সফল উপস্থাপক হতে হলে এই বিষয়গুলো অবশ্যই মাথায় রাখা চাই।

    ১) আত্মবিশ্বাসী হতে হবে

    উপস্থাপনায় অনেকসময় তোমার অভিজ্ঞতা নেই, এমন কাজও তোমাকে করতে হতে পারে। আবার অনেকসময় দেখা যায় অনেক অভিজ্ঞরাও কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খান। অভিজ্ঞতা থাকুক আর না-ই থাকুক, আত্মবিশ্বাস থাকাটা অনেকটা অপরিহার্য। পাব্লিক স্পিকিং এর ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস কতোটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা সবাই জানি। উপস্থাপনার ক্ষেত্রেও কিন্তু এর ব্যাতিক্রম না!

    একজন উপস্থাপককে পরিস্থিতি বুঝে কাজ করতে হয়, আর এটা করার জন্য নিজের ওপর বিশ্বাস থাকাটা জরুরী।

    ২) একজন সফল উপস্থাপক কিন্তু একজন এটেনশান সিকার!

    কী, অবাক লাগছে? এটেনশান সিকার শব্দটাকে আমরা মোটামুটি নেতিবাচক একটা গুণের কাতারেই ফেলি। কিন্তু তুমি যদি একজন সফল উপস্থাপক হতে চাও, তাহলে এটেনশান সিক করা শিখে নাও।

    আমি যা বলতে চাইছি- একটা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা শুরুর পরমুহূর্ত থেকে উপস্থাপকের প্রধান কাজ থাকে দর্শক/ অতিথির মনোযোগ ধরে রাখা। আর এটেনশান সিকিং এজন্যই গুরুত্বপূর্ণ। ওপরে উপস্থাপনা শুরুর যে করেকটি কৌশলই দিয়েছি, তার প্রায় সবগুলোই দর্শকের মন আকর্ষণ করার। তোমার কাজ হচ্ছে এটা নিশ্চিত করা, যে তারা যেন সবাই-ই তোমার কথা পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে শোনেন।

    ৩) পোশাকের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা

    পোশাক কি উপস্থাপনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ? উত্তর হচ্ছে- হ্যাঁ। ধরো তুমি একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে একটা এমিনেমের লোগো ওয়ালা শার্ট পরে উপস্থাপনা করতে গেলে। তোমার কল্পনাও করতে হবেনা যে ব্যপারটা কতোটা অদ্ভূত দেখাবে। দর্শকও হয়তো তোমাকে গ্রহণ করবেন না।

    কিভাবে উপস্থাপনা শুরু করতে হয়
    Photo: Pexels

    পোশাকের ক্ষেত্রে তোমাকে নিজের ইচ্ছা থেকে দর্শকের পছন্দের দিক বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। একজন উপস্থাপকের প্রতিটি সুক্ষ্ম বিষয় মাথায় রেখেই পোশাক নির্বাচন করা উচিত। অনুষ্ঠানের ভাবের সাথে যায় এমন মার্জিত পোশাক পরা উচিত। দর্শকের কাছে এর মাধ্যমে একটা ইতিবাচক ভাব আসে।

    ৪) স্পষ্ট উচ্চারণে বোধগম্য ভাষায় কথা বলতে হবে

    উপস্থাপনার ক্ষেত্রে বাচনভঙ্গির থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো স্পষ্ট, বোধগম্য ভাষায় কথা বলা। উপস্থাপকের কণ্ঠ নিচু না হওয়াই ভালো। চেষ্টা করতে হবে কথার স্পষ্টতা যেন এমন হয় যে একজন অমনযোগী শ্রোতাও ঠিকমতো শুনতে পান।

    উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ফ্লুয়েন্সিও ততোটা গুরুত্বপূর্ণ না, যতোটা স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলয়া গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তোমার কথার মাঝে বিরাম থাকলে দর্শকের কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু তোমার কথা বোঝা না গেলে পুরো অনুষ্ঠানেই সমস্যা হয়ে যাবে।

    এক্ষেত্রে তোমার জটিলতা কাটিয়ে উঠতে নিয়মিত অনুশীলন করতে হবে। আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা বলতে হবে। আর অনুশীলনের সময় তোমার কথাগুলো রেকর্ড করবে। পরে সেটি শুনে তুমি নিজেই নিজের ভুলের জায়গা গুলো বুঝতে পারবে।

    ৫) দর্শকের দিকে তাকানো

    উপস্থাপনা হোক কিংবা পাব্লিক স্পিকিং, আই কন্টাক্ট কিন্তু থাকা চাই-ই। অনেকসময় দেখা যায় কথা বলার সময় কেউ কেউ ছাদের সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলে। এটা করা যাবেনা। তুমি যাদের লক্ষ্য করে কথা বলছো, আত্মবিশ্বাসের সাথে তাদের দিকে তাকিয়েই তোমার কথা বলতে হবে।

    এখন ধরো একটা অনুষ্ঠানে অনেক অনেক মানুষ। উপস্থাপনার সময় তুমি দিশেহারা হয়ে পড়ছো যে কাকে ছেড়ে কার দিকে তাকাবে। এই ঝামেলা একবার আমার সাথে হয়েছিলো কিশোর আলোর একটা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে গিয়ে। আমি যা করলাম, পুরো দর্শকসারিকে তিনটা ভাগে ভাগ করলাম, এরপর প্রতি ভাগ থেকে সামনে-পেছনে মিলিয়ে কয়েকজনের চেহারা মনে মনে ঠিক করে নিলাম। এরপর কথা বলার সময় তাদের দিকে বেশি বেশি তাকিয়ে কথা বললাম।

    ৬) হাতে স্ক্রিপ্ট না রেখে বুলেট পয়েন্ট রাখো

    অনেকে উপস্থাপনার সময় পুরো একটা স্ক্রিপ্ট হাতে নিয়ে সেটা দেখে দেখে বলে। ফলে যা হয়, দর্শকের দিকে তাকানোই হয়না। (আমি ছোটবেলায় স্কুলে বেশ কয়েকবার এমন করেছি।) আমার পরামর্শমতে, একটা পুরো স্ক্রিপ্ট হাতে না রেখে, মূল বিষয়গুলো একটা ছোট্ট কাগজে টুকে রাখা যায়। এতে করে কোনো কথা বাদ পড়ার সম্ভাবনা থাকেনা, পাশাপাশি একাধারে স্ক্রিপ্টের দিকে না তাকিয়ে দর্শকের দিকেও মনোযোগ দেয়া হয়।

    ও কথা বলার কলাকৌশল
    Photo: Freepik

    ৭) হাসিমুখ ওষুধের মতো

    একদিন শীতের সন্ধ্যায় আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। কোনো একটা কারণে মন বেশ খারাপ ছিলো। এক চাচি আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় আমার ঘড়িতে কয়টা বাজে জিজ্ঞেস করলেন। আমি ওনাকে সময় বললাম, আর উনি আমার দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হাসলেন। হঠাৎ করে আমার মন কেমন ভালো হয়ে গেল! আমি বুঝলাম, একজন মানুষের হাসিমুখ অনেক বড় পরিবর্তনও আনতে পারে।

    হাসিমুখ তোমার উপস্থাপনার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিবে, তোমার কথার প্রতি দর্শকের মনোযোগ বাড়িয়ে দিবে, আর অনুষ্ঠানে একটা ইতিবাচক ভাব এনে দিবে।

    শুধু উপস্থাপনাই না, আমার পরামর্শ হলো, সবসময়ই হাসার চেষ্টা করবে। তুমি হাসছো মানে তুমি তোমার নিজেকে আর আশেপাশের মানুষকে ভালো থাকতে সাহায্য করছো।

    ৮) যা বলছি, তা বলা যাবে তো?

    এমন অনেক ব্যাপার থাকে যেগুলো নিয়ে কথা না বলাই ভালো। একজন উপস্থাপক সবসময় চোখ-কান খোলা রাখবে, আর খেয়াল রাখবে যে যা বলা হচ্ছে, তা আসলে বলা অনুচিত না!

    কী বলতে হবে জানা যেমন জরুরী, কী বলা যাবেনা জানাটাও তেমন জরুরী।

    ৯) পরিস্থিতি সামাল দিতে জানা

    এটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা বৈশিষ্ট্য, যেটা সব উপস্থাপকের আয়ত্তে আনতে হয়। অনেকসময় অনুষ্ঠান যেমন চিন্তা করা হয়েছিলো অমন নাও হতে পারে, ঘটে যেতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা। উপস্থাপকে মাথা ঠান্ডা রেখে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। কোনোভাবেই উত্তপ্ত হওয়া চলবেনা।

    ১০) শেষ ভালো যার..

    একজন উপস্থাপক অনেক চেষ্টার মাধ্যমে ধরো একটা অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছে, কিন্তু শেষে এসে উপসংহার টানেনি। অনুষ্ঠানে কেমন একটা অতৃপ্ত ব্যাপার থেকে যাবে। অনুষ্ঠানটি যদি হয় দর্শককে কোনো একটা বিষয় জানানো নিয়ে, তাহলে দেখা যাবে পুরো অনুষ্ঠানে মনোযোগ ধরে রাখার পরেও দর্শক উপসংহারের অভাবে কোনো স্পষ্ট ধারণা পাচ্ছেনা।

    একজন উপস্থাপক পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে কী করেছে, এটির ধারণা দিতে হবে শেষে এসে। এর সাথে সহানুভূতি আর আবেগপূর্ণ কিছু কথা জুড়ে দিয়ে সুন্দরভাবে অনুষ্ঠানের ইতি টানা যায়। সম্ভব হলে দর্শককে পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে মনোযোগ ধরে রাখা এবং সাড়া প্রদানের জন্য ধন্যবাদ দিতে পারো। অনুষ্ঠানের ইতি টানার কাজটি কিন্তু শুরুর মতোই দক্ষতার সাথে বিশেষ মনোযোগ দিয়ে করতে হবে।

    অনুষ্ঠানের শেষ কথাগুলো যেন দর্শককে অনুপ্রেরণা দেয়, শক্তি দেয়।

    উপস্থাপনার হাতেখড়ি নিয়ে আমার আলোচনা এখানেই শেষ। যেকোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্টে জানাতে পারো।

    উপস্থাপনার গুছানো সুন্দর পৃথিবীতে তোমাকে স্বাগতম!

    ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি অনলাইন ব্যাচ ২০২৩

    দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ঘরে বসেই দেশসেরা শিক্ষকদের সাথে যুক্ত হও ইন্টারেক্টিভ লাইভ ক্লাসে, নাও ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণির সম্পূর্ণ সিলেবাসের 💯তে💯 প্রস্তুতি!

    আপনার কমেন্ট লিখুন