ভালো বক্তা হওয়ার মতো ভালো শ্রোতা হওয়াও একটা অসাধারণ গুণ। ধরুন, আপনি কাউকে খুব আগ্রহ নিয়ে কোনো ঘটনা বলছেন কিংবা আপনার আনন্দ কষ্টের কথাগুলো ভাগাভাগি করতে চাইছেন কিন্তু সেই মানুষটা মনোযোগ দিয়ে শোনা দূরে থাক, কোনো আগ্রহই প্রকাশ করছে না! আপনার কেমন লাগবে? আর কখনো তাকে কিছু বলতে ইচ্ছে হবে কি? হবে না। তাই ভালো শ্রোতা হওয়া খুব জরুরি। এই গুণ দিয়ে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করা যায়, যাওয়া যায় তার খুব কাছাকাছি। অন্যের চোখে পৃথিবীটা কেমন তা জানা যায়।
চলুন দেখে নিই কী করে একজন ভালো শ্রোতা হওয়া যায়:
১) বেশি শুনুন, কম বলুন
কেউ যখন কথা বলে তখন তাকে বেশি বলার সুযোগ দিন। নিজে কম বলুন। মানুষের চোখে চোখ রেখে তার কথা শুনুন, এটি তাকে আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে উপলব্ধি করাবে। বারবার দৃষ্টি সরানো কিংবা অন্য কোনো কাজ করা আপনার ব্যস্ততা ও তার কথা শোনায় অনাগ্রহ নির্দেশ করে।
তাই যখন অন্য পক্ষ কথা বলছেন তখন শুধুই শুনুন। পরবর্তীতে সংক্ষেপে নিজের বক্তব্য তুলে ধরুন।
২) বক্তাকে বিচার করতে যথেষ্ট সময় নিন
বক্তার কোনো কথা তার প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করলেও সাথে সাথেই তাকে বিচার করবেন না। ধৈর্য্যের সাথে শুনতে থাকুন। সম্পূর্ণ ঘটনা না জানা পর্যন্ত আপনি তার সম্পর্কে ধারণা পোষণ করতে পারেন না, কেননা পরবর্তীতে গল্পের কোনো ভিন্ন মোড় থাকতেই পারে!
আবার, কোনো সমস্যার কথা বলামাত্রই তার সমাধান দেয়ার চেষ্টা করবেন না। আগে পুরো সমস্যাটা ভালোভাবে শুনুন, তার অবস্থানে নিজেকে বসিয়ে চিন্তা করুন। তারপর ভাবুন কোন পথে গেলে তার জন্য মঙ্গল হবে। তাছাড়া বলা শেষ হলে বক্তা নিজেই তার অভিব্যক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেবে যে তিনি এখন আপনার থেকে সমাধান বা পরামর্শ শুনতে চান। তাই সেই মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
৩) নিজের সাথে তুলনা করে কিছু বলবেন না
কেউ যখন তার কষ্টের কথা আপনার কাছে বলে তখন নিজের সাথে তুলনা করে কখনো কিছু বলবেন না। হোক আপনার কষ্ট তার কষ্টের থেকে বেশি। কারণ যার যার কষ্ট তার তার কাছে পাহাড়সম। ঐ সময়টাতে কষ্ট মেপে তাকে এর পরিমাণ বোঝানো সম্ভব না, তাই উচিতও না।
কথা শোনার সময় ‘আমি’, ‘আমার’ শব্দগুলো কম ব্যবহার করুন। এসব শব্দ আপনার আত্মকেন্দ্রিকতা প্রকাশ করে এবং বক্তাকে তার নিজের সম্পর্কে বলতে নিরুৎসাহিত করে।
আরো পড়ুন: জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম: বিদ্রোহী বাঙ্গালির প্রতিচ্ছবি
৪) সহানুভূতি প্রকাশ করুন
বক্তা কথা বলার সময় তার কথায় সাড়া দিন। মাথা নেড়ে সম্মতি জ্ঞাপন করুন যাতে সে বুঝে যে আপনি তার কথা শুনছেন। অনুভূতিজ্ঞাপক অব্যয় শব্দ ব্যবহার করুন যখন যেটি প্রয়োজন। তবে হ্যাঁ, তাকে থামিয়ে দিয়ে নয় বরং তার বাক্যের ফাঁকে ফাঁকে। আর আপনার এই সাড়া যেন মিথ্যে না হয়, নতুবা তা তাকে ব্যথিত করবে।
৫) যা বলা হয়েছে মনে রাখার চেষ্টা করুন
এটি ভালো শ্রোতা হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বক্তা যা বলে তা মোটামুটি মনে রাখার চেষ্টা করুন। নতুবা পরবর্তীতে আপনি এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে বসবেন যা তাকে বিব্রত করবে।
ধরুন বক্তা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, রোহানের সঙ্গে তার সমস্যা সম্পর্কে আপনাকে বলছে এবং আপনি আগে রোহানকে দেখেন নি। তো আপনি অন্তত তার নাম মনে রাখবেন যাতে আপনি বক্তার ঘটনার প্রবাহের সাথে আপনার মস্তিষ্ককে এগিয়ে নিতে পারেন। হতে পারে আপনি তুখোড় স্মৃতিশক্তির অধিকারী নন, সেক্ষেত্রে একবার জিজ্ঞেস করতেই পারেন, কিন্তু বারবার জিজ্ঞেস করাটা মোটেই উচিত না, এতে সে বুঝতে পারবে আপনি তার কথা ভালোভাবে শুনছেন না।
Communication Masterclass by Tahsan Khan
কোর্সটি করে যা শিখবেন:
৬) পরবর্তীতে খোঁজ নিন
এমন যেন না হয় যে, আপনি কেবল কথোপকথনের সময়ই ব্যক্তির কথা শোনেন এবং পরবর্তীতে এটি সম্পর্কে চিন্তা করেন না। যদি আপনি সত্যিই দেখাতে চান যে আপনি গুরুত্ব দিচ্ছেন, তাহলে আপনি পরবর্তী সময়ে যখন তার সাথে আবার দেখা হয় তখন অথবা মেসেজ বা ফোনকল করে জিজ্ঞেস করতে পারেন উক্ত ঘটনা সম্পর্কে এখন কী খবর ইত্যাদি ইত্যাদি।
অবশ্যই, খোঁজ নেয়া এবং বিরক্ত করার মধ্যে একটি পার্থক্য আছে। ধরুন, সে বলেছে তার চাকরি নিয়ে সমস্যা চলছে। এক্ষেত্রে অবশ্যই বারবার তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সে বিব্রত ও বিরক্ত হবে। এমনকি তার মনে প্রশ্ন জাগবে আপনি কি এই প্রার্থনা করছেন কিনা যে তার চাকরি না থাকুক! সুতরাং খোঁজ নেয়াটা বিষয়ের উপরও অনেকটা নির্ভর করে।
৭) যা করবেন না
আপনি একজন ভালো শ্রোতা হতে চান, সেক্ষেত্রে কিছু বিষয় যা করা যাবে না, সেগুলো জানাটা অবশ্যই জরুরি।
১. বক্তা কথা বলার সময় তার একটি বাক্যের মাঝে তাকে থামিয়ে দিয়ে কথা বলবেন না।
২. জেরা বা তর্ক না করে কিছু জানার বা বলার থাকলে ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করুন।
৩. বিষয় পরিবর্তন করার চেষ্টা করবেন না, এমনকি যদি এটি একটু অস্বস্তিকর হয়, তাও।
৪. কোনো সমস্যার কথা বলতে শুরু করামাত্রই বলবেন না “সব ঠিক হয়ে যাবে” বা “আরে সব শেষ হয়ে যাওয়ার মতো কিছু হয়নি।” এসব কথা তার সমস্যা বা অস্বস্তিবোধ লাঘব করে না। তাই মনোযোগ দিয়ে বরং তার পুরো সমস্যার কথাটি শুনুন। ভালো শ্রোতা হতে হলে মনোযোগ গুরুত্বপূর্ণ।
৮) আপনার বিশ্বস্ততার আশ্বাস দিন
যদি বক্তা আপনাকে তার ব্যক্তিগত ও গোপন কিছু বলে, তাহলে আপনি এটা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেবেন যে আপনি একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি যিনি নিজের মুখ বন্ধ রাখতে পারেন। বলুন যে সে আপনার উপর বিশ্বাস করতে পারে, যাই বলা হোক না কেন সেই কথা আপনার আর তার মধ্যেই থাকবে এবং আপনি মুখে যা বলেন সেটি করে দেখান। এরপরেও যদি সে আপনাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে না চায় তাহলে সে পুরোপুরি খুলে বলতে চাইবে না। এ থেকেই তা বুঝে নেবেন। সেক্ষেত্রে তাকে খুলে বলার বা আপনাকে বিশ্বাস করার জন্য জোর করবেন না, কারণ এটি তখন আরও আপনাকে সন্দেহের সৃষ্টি করবে।
আর হ্যাঁ, যখন আপনি বলবেন যে, কথাটি গোপন থাকবে, তা যেন সত্য হয় অর্থাৎ আপনি যেন তা মন থেকে বলেন। যদি না এমন পরিস্থিতি থাকে যা আপনাকে এটি থেকে নিজের মধ্যে রাখতে বাধা দেয়। বস্তুতঃ আপনি যদি সত্যিই বিশ্বস্ত হতে না পারেন, তবে আপনি কখনোই একজন ভালো শ্রোতা হতে পারবেন না।
৯) বক্তার কথা পুনরাবৃত্তি করে তাকে উৎসাহিত করুন
মাঝে মাঝে বক্তার কথা পুনরাবৃত্তি করে তাকে উৎসাহিত করুন। যেমন প্রসঙ্গ সাপেক্ষে বলতে পারেন, “ওহ তার মানে আপনি সেখানে যাননি। আমি হলেও যেতাম না”
সারকথা পুনর্বিবেচনা করুন। বক্তা কী বলেছে আপনার নিজের ভাষায় তা পুনর্বিবেচনা করে বোঝার জন্য এটি অত্যন্ত উপযোগী। এটি বক্তাকে আশ্বস্ত করে যে আপনি সত্যিই সে কি বলেছে তা শুনেছেন এবং তিনি যে অর্থে বলেছেন আপনি তা ধরতে পেরেছেন। যদি আপনি নিশ্চিত না হন যে আপনি ঠিক শুনেছেন বা বুঝেছেন কি না সেক্ষেত্রে কথাটি পুনরাবৃত্তি করার সাথে ‘আমি ভুল শুনে থাকতে পারি…’ বা ‘আমার ভুল হতে পারে….’ এমন বাক্যাংশ ব্যবহার করুন। একজন ভালো শ্রোতা বক্তাকে কথা বলতে উৎসাহ দেয়।
১০) অর্থপূর্ণ ও যৌক্তিক প্রশ্ন করুন
অর্থপূর্ণ ও যৌক্তিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা আপনার মনোযোগের সাথে কথা শোনা প্রমাণ করে। আপনি যদি ভালোভাবে বক্তার কথা বা ঘটনা শুনে থাকেন তাহলে আপনি শক্ত, সুন্দর, যৌক্তিক প্রশ্ন করতে পারবেন। অপরদিকে অবাঞ্চিত, অযৌক্তিক প্রশ্ন করলে বক্তা বুঝবে আপনি ভালোভাবে শুনেননি বা তার কথা বোঝেননি। শ্রোতা হিসেবে প্রাসঙ্গিক এবং যৌক্তিক প্রশ্ন করা আপনার আগ্রহের পরিচায়ক।
আরো পড়ুন: সাবলীল বক্তা হওয়ার জন্য ১০টি কার্যকরী উপদেশ
১১) পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রে…
পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই নিরপেক্ষতা অবলম্বন করতে হবে। কারও পক্ষপাতিত্ব করা যাবে না, এমনকি বক্তারও না। নতুবা এর পেছনে আপনার স্বার্থ আছে কিনা তা সন্দেহ করবে। আপনার নিজের অভিজ্ঞতার প্রাধান্য দেবেন না, কেননা আপনার সাথে যা ঘটেছে তার সাথেও একই ঘটবে এমন কোনো কথা নেই। তাই আপনার অভিজ্ঞতার কথা কেবল উল্লেখ করুন এবং কোন পথে গেলে কেমন হবে বিস্তারিত বর্ণনা করুন। তারপর তার জন্য কোনটি উত্তম হবে বলে আপনি মনে করেন সেই মতামত জানান। তাহলেই তার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হয়ে যাবে।
পরামর্শদাতা হিসেবে একজন শ্রোতার কাজ হল বক্তাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা, তার হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে দেয়া নয়।
১২) বক্তার অঙ্গভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করুন
এটি একজন ভালো শ্রোতা হবার অন্যতম পূর্বশর্ত। বক্তা অনেক ক্ষেত্রেই অঙ্গভঙ্গির মাঝে কথার বেশ খানিকটা লুকিয়ে রাখে। তার কথা শোনার পাশাপাশি তার অঙ্গভঙ্গি লক্ষ্য করলে তার কথা আরও গভীরভাবে সহজেই বোঝা সম্ভব।
আজ থেকে তবে এই বৈশিষ্ট্যগুলো আয়ত্ত করার অনুশীলন শুরু হোক। আপনিও হয়ে উঠুন একজন ভালো শ্রোতা, যাকে মানুষ ভরসা করে, ভালোবাসে, যার সাথে সুখ-দুঃখের সব কথা ভাগাভাগি করতে চায়। এটি আপনার জন্য এক অসম্ভব ভালো লাগার অনুভূতি নয় কি?
Reference:
https://www.wikihow.com/Be-a-Good-Listener
আমাদের কোর্সগুলোতে ভর্তি হতে ক্লিক করুন:
- Communication Masterclass by Tahsan Khan
- Facebook Marketing Course by Ayman Sadik and Sadman Sadik
- ঘরে বসে Freelancing by Joyeta Banerjee
- ঘরে বসে Spoken English Course by Munzereen Shahid
- Microsoft Office 3 in 1 Bundle
- Microsoft Word Course by Sadman Sadik
- Microsoft Excel Premium Course
- Microsoft PowerPoint Course by Sadman Sadik
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি আপনার লেখাটি ই-মেইল করুন এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন