ক্ষ্যাপাদের ইতিকথা

October 1, 2018 ...
পুরোটা পড়ার সময় নেই? ব্লগটি একবার শুনে নাও।

ময়- ভোর ৫টা বেজে ৪৬ মিনিট। আমার বারান্দা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস খুব চমৎকার দেখা যায়। ঢাকা ইতোমধ্যে রোজকার রীতি মেনে তার ধর্ম ব্যক্ত করা শুরু করে দিয়েছে। মাঝেমধ্যে দুয়েকটা গাড়ির হর্ন শোনা যাচ্ছে, জানলার বাইরে শত পাখিদের আনাগোনা, মা পাখি উড়াল দিল পূবের দিগন্তে; তার মানিকদের পেটের দায়ে। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। শেয়ালের বিয়ে হচ্ছে। শ্রমিকরা বেরিয়ে পড়েছে গ্রাসাচ্ছদনের উদ্দেশ্যে। জীর্ণ সাদা কাপড়ে এক সন্ন্যাসী ফকিরের কণ্ঠ থেকে ভেসে আসছে:   

 “সময় তো থাকবে না গো মা।
    শুধুমাত্র কথা রবে
           কথা রবে, কথা রবে মা, জগতে কলঙ্ক রবে।।”

কথাটি সাধক রামপ্রসাদের। গানের কথা ও সুরের সামনে একেবারে নিরুত্তর দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওঁর জগৎ-সাধনায় সামাজিক কথার স্থানই বা কোথায়? প্রশ্নটা আমাকে বিগত কয়েকদিন প্রচুর ভাবিয়েছে।
আমার সৌভাগ্য, যে আমার অনুজ জীবনবৃত্তান্তে আমি কিছু বাউল সাধকদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। আজ আমার উদ্দেশ্য তাঁদের নিয়ে কিছু কথা বলার (যা বাউলদের জন্য রীতিমত কলঙ্কের চিহ্ন। তবে এ যেন আমারই অযোগ্যতা, কিংবা অজ্ঞতা। স্বীকারোক্তি দিয়ে দিচ্ছি)। বাউলদের সম্পর্কে যথাসম্ভব ঐতিহাসিকভাবে বলার প্রয়াস করব। কেননা তাঁদেরকে হয় ঐতিহাসিকভাবে বুঝতে হবে, নইলে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয়টি এখনও আমার যোগ্যতার ঊর্ধ্বে।

বাউল কী:

যেকোনো সংস্কৃতির মতো বাংলায়ও গানের উদ্ভবের কিছু প্রাগৈতিহাসিক গল্প আছে। কীভাবে বাংলার মানুষ গান গাইতে শিখল, সুরের উঠা-নামার কাঠামো আয়ত্ত করতে শিখল, তা শাস্ত্রীয় সংগীতের ইতিহাস পড়ে বোঝা তো যাবে; তবে গানের গতিবেগ, রাগরাগিনীর জন্ম নিয়ে তেমন তথ্যপ্রমাণ নেই। বাউলদের গানের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই।
বাউল সমাজ ও গান আমাদের ভু-খণ্ডের এক অনন্য অস্তিত্বের নাম। বাউল কারা, তা নিয়ে একটু পরে বলছি। প্রথমে শব্দের উৎপত্তি নিয়ে খোলাসা করা যাক।
যদিও ‘বাউল’ এখন একটি বংশগত পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে ‘বাউল’ কেবলই সমাজের একটি প্রচলিত শব্দমাত্র। এমনকি, স্বয়ং লালন ফকিরও ‘বাউল’ শব্দটি দ্বারা নিজের পরিচয় জাহির করেননি।
বস্তুত, বাউল শব্দের উৎপত্তি নিয়ে অনেকেরই অনেক মতবিরোধ আছে। কেউ কেউ বলেন বাউল শব্দটির উৎপত্তি ‘বাতুল’ থেকে। এই ‘বাতুল’ শব্দটির অর্থ উন্মাদ, ক্ষ্যাপা বা পাগল। কেউ কেউ বলেন শব্দটি এসেছে ‘বায়ু’ থেকে। আবার কেউ বলেন ‘ব্যাকুল’ থেকে শব্দটি আসে। এছাড়া ‘ব্রজকুল’ তো আছেই। ‘বাউল’ শব্দটি ভাঙলে সন্ধিটি দাঁড়ায় বা+উল। ‘বা’ শব্দের অর্থ বায়ু এবং ‘উল’ এর অর্থ অনুসন্ধান করা। অর্থাৎ, যে বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে, তারই খোঁজ এই ক্ষ্যাপাদের। আহমদ শরীফ তাঁর ‘বাউলতত্ত্ব’ গ্রন্থে বলেন, “কারোর কারোর মতে ‘বায়ু’ শব্দের সাথে ‘ল’ যুক্ত হয়ে, বায়ুভোজী উন্মাদ কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাসক্রিয়ার দ্বারা সাধনাকারী অর্থে বাউল শব্দ তৈরি হয়েছে।”

তোমরা অনেকেই জানো, রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশার কিছু সময় কুষ্টিয়ার শিলাইদহে কাটান। তখন তিনি কিছু বাউল মানুষদের সংস্পর্শে আসেন এবং বিভিন্নরকমের ভাব বিনিময় করেন। শাস্ত্রীয় সংগীতের কঠিন কাঠামোর বাইরে, সরল সুরে বাঁধা কথাও যে মানুষের আবেগ উচ্ছ্বসিত করতে পারে, রবীন্দ্রনাথ লালন ফকিরের গান শুনেই তা প্রথম অনুভব করেন। এজন্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানেও আমরা বাউল গানের আবহ অনুভব করতে পারি। বঙ্গভঙ্গের সময়কার তাঁর অধিকাংশ দেশপ্রেমের গানই বাউল সুরের। এমনকি, আমাদের জাতীয় সংগীতের সুরও একটি বাউল গানের সুর। তাঁর দীর্ঘ বাউল সান্নিধ্য এবং পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি উপলব্ধি করেন, যে বৌদ্ধদের মহাযান পন্থী থেকে বাউলদের উদ্ভব।

গবেষক সৈয়দ মোস্তফা কামালের মতে, জগমোহন গোসাঈ বাউল আদর্শের প্রবর্তক। তাঁকে আদি বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক হিসেবেও গণ্য করা হয়। বাউল সম্প্রদায়ের মূল সাধনা দেহকেন্দ্রিক এবং চৈতন্যের মধ্যে যে বিরাজ করে, সেই আত্মা, সেই মনের মানুষ। এই সংসারে মনের মানুষ, পরমেশ্বরের সন্ধান পাওয়া তাঁদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য বৈকি। তবে বাউল সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, কোনও প্রচলিত বা প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে এই সত্তার সান্নিধ্য পাওয়া যায় না। চাই সাধনা, উপলব্ধি, গুরুপরম্পরার একান্ত আশ্রয়।

Image result for বাউল

বাউল কারা:

তোমরা অনেকেই হয়তো একতারা হাতে, খোঁপা বাঁধা, গেরুয়া কাপড় পরা কিছু মানুষ দেখে থাকবে যারা নৃত্যের সাথে সাথে মানবধর্মী গান গেয়ে থাকেন। তোমরা কেউ কেউ এতদিন তাঁদেরকে বাউল হিসেবে ধরে নিলেও তাঁরা অনেকেই প্রকৃতপক্ষে বাউল নয়। তারা অনেকেই বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী।

চৈতন্যদেবের সহচর নিত্যানন্দের ফলে বৈষ্ণব ধর্মের প্রসার অনেক বেশি হয়। তাঁর পুত্র বীরভদ্র যখন বৈষ্ণবধর্ম ত্যাগ করে বাউল আদর্শ আদর্শিত হন, তখন ধর্মত্যাগের অপরাধবোধ থেকে নিত্যানন্দ বীরভদ্রকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন এবং বীরভদ্র অতঃপর বীরভূমে গিয়ে থাকা শুরু করেন। বাউলদের অগ্রগতিতে বীরভদ্রের প্রভাব অনস্বীকার্য। ফলে বলতেই হয়, যে বাউল দর্শনে বীরভদ্রের প্রভাব থাকায় তাঁর পূর্বসূরীদের, অর্থাৎ বৈষ্ণব দর্শনের প্রভাবও কোথাও না কোথাও থেকে গেছে। এজন্য অনেকে গেরুয়া কাপড়ের সন্ন্যাসীদের বাউল বলে ধরে নেন।    

চৈতন্যদেবের ধর্মপ্রচারের ভাষা ছিল বাংলা ভাষা। যদিও তিনি শাস্ত্রীয় কথা কমই বলেন, তবে জীবের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রীকৃষ্ণের নাম জপার মাধ্যমকেই তিনি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতেন। ফলে, এই নাম জপা অনেকগুলো ধ্বনির ঐকতানে একটি সুরে রূপান্তরিত হয়। যা কোনও অর্থেই শাস্ত্রীয় সংগীতের আওতাভুক্ত নয়। এই কীর্তনের সুর হয় অত্যন্ত সরল; তবে আবেগের বহুমাত্রিক স্রোতও এতে বিদ্যমান। বৈষ্ণবধর্মের প্রগতির সাথে সাথে বৈষ্ণব কীর্তনের প্রভাব বাউল গানে লক্ষ করা যায়। বঙ্গদেশে পারস্যের সুফি সাধকদের আবির্ভাবের পর এদেশে বহু সংখ্যক মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁদের ঐতিহ্যগত সঙ্গীত শমা, যেখানে বিধাতার নিরানব্বইটি নামের যিকির করা হয় সুরের মাধ্যমে, সেই শমা সঙ্গীতের সাথে সাথে সুফিবাদী আদর্শের কিছু বিষয়বস্তু আত্মস্থ হয়েছে বাউলদের দ্বারা।

বাউলদের কোনও জাত-বিবেচনা, বংশ নেই। না আছে কোনও বিশেষ প্রাতিষ্ঠানিকতার আঁচড়। এই দলের মূলেই আছে যেকোনও গোঁড়ামির বাইরে এসে মানবপ্রেমকে অনুভব করা। গুরুপরম্পরা বাউল সম্প্রদায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অর্থাৎ, প্রত্যেক বাউলের একজন বাউল হয়ে ওঠার মধ্যে আছে একজন দীক্ষিত গুরুর প্রভাব, যিনি আবার তার দীক্ষা নিয়েছেন নিজের গুরু থেকে। এভাবে বাউল দর্শন, মানবপ্রেম শাখা-প্রশাখার মতো বিস্তার লাভ করে। বলা যেতেই পারে, এই গুরুপরম্পরা বৈষ্ণবধর্ম ও সুফিবাদের একটি পরোক্ষ প্রভাব।

অনেকেই মনে করেন বাউল দর্শনের মানুষ সমাজ, সংসার থেকে বিচ্যুত একটি গোষ্ঠী, যারা স্বল্পজ্ঞানের অধিকারী এবং ধর্মবিরোধী। তবে এই ধারণাটি সম্পূর্ণভাবে ভুল। সব ধর্মের দর্শন বাউল দর্শনে এতই গভীরভাবে পড়েছে, যে তারা প্রত্যেক ধর্ম, ধর্মের সৌন্দর্যের স্থান নিয়ে প্রাজ্ঞ হতে পেরেছে।

কিন্তু বাউলদের অনেকেই যে অর্থে ধর্মবিরোধী মনে করেন, আদতে তাদের সমালোচনার জায়গাটি ধর্ম নয়, বরং ধর্মের নামে ভেদাভেদ সৃষ্টিকারীদের প্রতি। যার গন্ধ পাওয়া যায় বাউলদের অনেক গানের ভেতরে। সমাজে জাত, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি যখন প্রখর হয়ে উঠেছিল, তখন সেই অবস্থার ব্যঙ্গ করে লালন ফকির বলেন-

“আসবার কালে কি জাত ছিলে
এসে তুমি  জাত নিলে,
কি জাত হবা যাবার কালে
সে কথা ভেবে বল না।।

জাত গেল জাত গেল বলে
এ কি আজব কারখানা।।”

ইংরেজি ভাষা চর্চা করতে আমাদের নতুন গ্রুপ- 10 Minute School English Language Club-এ যোগদান করতে পারো!

লালন ফকির:

সতেরো শতকের আগে বাউলদের সেই অর্থে উদ্ভব ঘটেনি। তবে আঠারো শতকের প্রায় শেষদিকে লালনের মাধ্যমে বাউল সম্প্রদায় একটি পূর্ণতা পায়। অসম্ভব প্রতিভাবান এই মানবধর্মী, সমাজ-সংস্কারক বাউল মানুষটি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। তবে বাউল দর্শন লালন ফকিরের উপস্থিতি ছাড়া সূর্যহীন পৃথিবীর মতো। কাজেই তাঁকে নিয়ে বলতেই হয়।
তোমরা ইন্টারনেটে, বইয়ে লালন ফকির সম্পর্কে অনেক তথ্য পেয়ে থাকবে। যদিও সত্যি বলতে লালন কোথায় জন্মান, তিনি কীভাবে বেড়ে ওঠেন, কোথায় কোথায়, কার সংস্পর্শে বেড়ে ওঠেন, এগুলোর অধিকাংশ তথ্যের কিছুই ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত নয়; বরং এগুলো কেবল কিছু কিংবদন্তিমাত্র। তাঁকে ঘিরে শত-শত কেচ্ছা, গল্প জর্জরিত কিছু লোককথা আছে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে অনেক গবেষক লোকের মুখে যেসকল কথা শোনেন, সেগুলোর মধ্যে থেকেই লালনের কাল্পনিক কিছু জীবনী গড়ে ওঠে। আজও লালন ফকিরের আদি জীবন সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে একটি বিস্ময়ের ও কৌতূহলের বস্তু। আমিও তোমাদের ধারণা দেয়ার জন্য সেই লোককথা থেকে ব্যক্ত করছি।

লালনের জন্ম নিয়ে মতবিরোধের শেষ নেই। তবে এ সত্যি, তিনি তাঁর জন্মপরিচয় কোনও শিষ্যকেই দেননি। কথিত আছে, তিনি একবার তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে পড়লে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। তৎকালীন সময়ে এই রোগের কোনও চিকিৎসা কারোর জানা ছিল না। তাই তিনি দ্রুতই মারা যাবেন ভেবে তাঁর সঙ্গীরা তাঁকে নদীতে ভাসিয়ে দেন। তখন একজন মরমী ফকির, সিরাজ সাঁঈ তাঁকে তুলে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। সিরাজ সাঁঈজির যত্নে লালন সুস্থ হয়ে ওঠেন। সুস্থ হবার পর লালনকে তাঁর হদিস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি এর কিছুই বলতে পারেননি। এমনকি নিজের নামও নয়। ‘লালন’ নামটি সিরাজ সাঁঈজিরই দেয়া।

Image result for বাউল

মরমী সাহিত্য, গানও আমাদের দেশের লোকসঙ্গীত। যার ধারাবাহক স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম। একাদশ শতাব্দিতে ইরানে এবং এর পার্শ্ববর্তী স্থানগুলোতে গজনি সুলতান আক্রমণ করলে অনেক সুফি-দরবেশ সেখান থেকে তুরস্কে এবং বিশেষ করে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন তাঁদের শান্তির বার্তা নিয়ে। দিল্লিতে সুফি ‘চিশতি’ ধারার প্রবর্তক খাঁজা মইনুদ্দিন থেকে শুরু করে ক্রমশ নিযামুদ্দিন আউলিয়া, এবং বঙ্গদেশে বাবা শাহ্‌জালালের (তাঁদেরকে আমার বিনম্র সালাম) আবির্ভাব ভারতবর্ষে একটি নতুন শিল্প, সাহিত্য এবং সঙ্গীতের ধারা নিয়ে আসে। যাকে মরমী ধারা বলা হয়। সিরাজ সাঁঈ এই মরমী ঘরানার লোক ছিলেন এবং লালনের দীক্ষিত করার ভার তিনিই নেন।

ফলে লালনের অনন্য প্রতিভা বাদেও তাঁর দানবিক জ্ঞানের কর্তৃত্ব সিরাজ সাঁঈজিকেও দিতে হয়। এভাবে লালনের গুরুপরম্পরার শুরু। গুরুর সান্নিধ্যে লালন প্রত্যেকটি ধর্ম এবং বিশেষ করে হিন্দু ও ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি খেয়াল করেন, তাঁর সমাজের সরল মানুষ অত্যন্ত স্থূলভাবে নিজের ধর্মকে জীবনে স্থান দিচ্ছেন যা আদত ধর্মের আদর্শ থেকে অনেক দূরে। তৎকালীন সমাজে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষদের সহ্য করতে পারত না। জাতপাত নিয়ে বাড়াবাড়ি করে, নৈরাজ্যের সৃষ্টি হওয়া ছিল ওই সমাজে নিত্যদিনের অবস্থা। পরিস্থিতিটি লালনের মনে গভীর দাগ ফেলে। তিনি বুঝতে শিখলেন যে মানুষের মুক্তি সেদিনই হবে যেদিন তারা জাত-বিবেচনার ঊর্ধ্বে এসে একে-অপরকে ভালোবাসতে শিখবে।

লালন তাঁর জীবদ্দশায় প্রায় হাজারখানেক গান সৃষ্টি ও সুর করেন। ‘সৃষ্টি’ এই অর্থে, যে তিনি কোনও গানই রচনা, বা লিপিবদ্ধ করেননি। কাজেই গুরুপরম্পরার স্থান ও প্রয়োজনীয়তা বাউল দর্শনে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে আসে। বর্তমানে ‘লালনগীতি সমগ্র’ গ্রন্থাকারে পাওয়া গেলেও আগে লোকসঙ্গীতের মতোই লালনের গান মানুষের মুখে মুখে ছিল।

তাঁর গানে আমরা সমাজের গোঁড়ামির বিপক্ষে এক বিদ্রোহের ভাব অনুভব করতে পারি। তবুও যেন তাঁর সরলতা শিশুর মতো, দর্শনের ওজন ঠিক ততটাই ভারী। এজন্য আজও বাঙালীদের শত শত জটিলতার সমাগমে লালন ফকিরের গান একটু স্বস্তির নিশ্বাসের কারণ।

সমাজ সংস্কারে তো বটেই, তাছাড়া সমাজের ভাবধারার অগ্রগতিতে তাঁর গান গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। প্রায় আড়াইশো বছর পরেও বঙ্গদেশে লালনের আঁচ স্পষ্ট। আধুনিক গীতিকার থেকে শুরু করে পথে হেঁটে যাওয়া সাধারণ মুখ; এমনকি খেয়া নৌকার আধা-যাযাবর মাঝিটির মুখেও বাউলের সুর। এখন তো বেতার-টেলিভিশনেও কিছু বিখ্যাত বাউল গীতিকারদের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে।

সাহিত্যের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে লালন শাহ্‌ একজন অমায়িক সাহিত্যিকের নাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, এছাড়া অসংখ্য ভারতবর্ষীয় কবি বাদেও মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গও একজন লালনভক্ত ছিলেন। সর্বপ্রথম কলকাতায় এসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে আসলে তিনি লালনগীতির সঙ্গে পরিচিত হন। রীতিমতো তাঁর মজ্জায় তিনি লালনকে গ্রহণ করতে ভুল করেননি। ফলে অ্যালেন গিন্সবার্গের কবিতায় লালনের গানের কাঠামো স্পষ্ট। লালনের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা অনুমান করতে তোমরা তাঁর রচিত After Lalon Shah’ কবিতাটি পড়ে দেখতে পারো।

হাসন রাজা: 

বাউলদের মধ্যে আরেকজন কালজয়ী পুরুষ হলেন হাসন রাজা। তাঁর জন্ম সিলেটে একটি সম্ভ্রান্ত হিন্দু জমিদার পরিবারে। বাবা শাহ্‌জালালের আবির্ভাবের প্রায় পাঁচশো বছর পরে, তখন সিলেটে ফার্সি-আরবি শেখার প্রচলন ছিল। সেখানকার এক ফার্সি ভাষাবিদের পরামর্শের পর তাঁর নাম রাখা হয় হাসন রাজা। এভাবেই এই সাধকের জীবনের আরম্ভ। যদিও লালনের মতো জীবনের প্রথমভাগ থেকেই তিনি ভাবানুরাগী ছিলেন না। যৌবনে তিনি দাপটের সঙ্গে জমিদারী চালিয়ে গেছেন। কেবল জমিদারিই নয়; বরং রীতিমতো ভোগবিলাসের সঙ্গে কাটতে থাকে তাঁর জীবন। যে কারণে অনেকের কাছেই হাসন রাজা ছিলেন কঠোর সমালোচনার পাত্র।

তবে তাঁর জীবনকে দেখার ভঙ্গিমায় পরিবর্তন আসে যখন তিনি প্রথমবার তাঁর প্রেম, দিলারামকে দেখেন। সেই প্রথম দেখাতেই নিজের অজান্তে তিনি গেয়ে বসেন ‘সোনা বন্দে আমারে দোয়ানা বানাইল, দেওয়ানা বানাইল, দেওয়ানা বানাইল মোরে ফাগল খরিল।’ সেই সুর ও কথার সামনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। কোত্থেকে এলো এই সুর, এই কথা! এই ভাবনার পরে একদিন এক আধ্যাত্মবাদী চিন্তার আগমন তাঁকে বদলে দিল চিরকালের জন্য। মনে ভর করল নানা বৈরাগ্যের চিন্তা-চেতনা। সেই ভাবনাগুলোকেই গানের রূপ দিতে লাগলেন তিনি।

দেখতে দেখতেই ভাবনাগুলো তাঁর ভেতরকার জগৎ এতটাই সমৃদ্ধ করে, যে তিনি আশেপাশের মানুষদের দেখাশুনা করা শুরু করলেন। গাঢ়ভাবে অনুভব করতে লাগলেন মানুষের দীনতা, সরল; তবে নিরবকাশ বেদনাভরা জীবন। সেটিই প্রতিনিয়তই ফুটে ওঠে তাঁর গানে ও গানের কথায়। এজন্যই হাসন রাজা বলেন-

‘ভাল করি ঘর বানাইয়া, কয়দিন থাকমু আর
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি পাকনা চুল আমার।।’

লালন ফকিরের মতোই হাসন রাজার গানের সংখ্যার সঠিক হিসাব মেলেনি। তবে তাঁর গানের সংকলিত ‘হাছন উদাস’ গ্রন্থে প্রায় দুইশ’টি গান পাওয়া যায়। এছাড়া বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর কিছু গান প্রকাশিত হয়েছে। ঈশ্বরপ্রেম, মানববেদনা, আত্মসংশয় ইত্যাদি বিষয়বস্তু তাঁর গানে এসেছে বারবার। নিজেকে বাউল বলে মাঝে মাঝে পরিচয় দিলেও অনেকের মতে তিনি মূলত মরমি সঙ্গীতের লোক ছিলেন। তবুও বাউল দর্শনের এক অনন্যপুরুষ হিসেবে আজও বাউল সাধকগণ তাঁকে স্মরণ করে থাকেন।

ফকির লালন শাহ্‌ বাদেও বঙ্গদেশে তাঁর আগে ও পরে অসংখ্য বড় বড় বাউল গীতিকার, সাধক আসেন যাদের সুর বাউল দর্শনকে ধীরে ধীরে সাবালক করেছে। বিশেষ করে শাহ্‌ আবদুল করিম এবং আধুনিককালে পবন দাশ বাউল, শামসুল হক চিশতি প্রমুখ বাউল গানের শ্রেষ্ঠ ধারাবাহক। তাঁদের শিষ্যরা এখন অব্দি বাউল গানের আদত ধারাকে আগলে রেখেছেন।

একটি দেশের সংস্কৃতির একটি বড় অংশ হল সঙ্গীত। যা দিয়ে একটি গোটা সময়ের, সমাজের নিয়ম, কল্পনার বিস্তার, বেদনা-উচ্ছ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু বোঝা সম্ভব। আর সেক্ষেত্রে ভারতবর্ষ এবং বিশেষ করে বাংলার মাটি গান সুরের মাধ্যমে বিশেষভাবে নির্মাণ করেছে নিজের সভ্যতার ক্রমবিকাশ। কাজেই বাংলার মাধুর্য, বাংলার মানুষের জীবন, তাদের ইতিকথা বুঝতে হলে বেশি করে শুনবে বাংলা লোকসঙ্গীত। বাউল বাংলা সঙ্গীতের মহাপ্লাবনের একটি অংশমাত্র। পল্লীগীতি, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, ভাটিয়ালি, কৃষ্ণকীর্তন ছাড়াও বাংলায় আছে বহু ঘর-ঘরানার সমাহার।

বাউল গান এদেশে বহুল প্রচলিত হলেও বাউলদের নিয়ে আমাদের জনসাধারণের এখনও অনেক ভুল ধারণা থেকে গেছে। অনেকেই তাঁদের সামাজিক অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন। হয়তো এর ঐতিহাসিক, সামাজিক তাৎপর্য সম্পর্কে আমরা অনেকেই বুঝতে শিখিনি বলে। তবে কী আর করার! এও তো সত্যি; যে দিনশেষে ক্ষ্যাপাদেরকে ক্ষ্যাপারাই ভাল বোঝে। 


১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com

৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি অনলাইন ব্যাচ ২০২৩

দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ঘরে বসেই দেশসেরা শিক্ষকদের সাথে যুক্ত হও ইন্টারেক্টিভ লাইভ ক্লাসে, নাও ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণির সম্পূর্ণ সিলেবাসের 💯তে💯 প্রস্তুতি!

আপনার কমেন্ট লিখুন