বাংলার ইতিহাসে ইউরোপীয়দের আগমন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বলা হয়ে থাকে, ইউরোপীয়রা বাংলায় না আসলে আজ আমাদের জীবনধারা অনেকটাই অন্যরকম হতো। ইউরোপীয়দের আগমন আর ইংরেজদের দ্বারা দুই দফায় প্রায় দু’শো বছর শাসিত হওয়ার কারণে বাংলায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন দিকে বিশদ পরিবর্তন এসেছে।
বাংলার ইতিহাস জানতে হলে তাই শুরুর দিকেই জানতে হবে ইউরোপীয়দের এই ভুখন্ডে আসা এবং বাংলায় বৃটিশ শাসনামলের কথা। অপরিচিত বীজ থেকে শেকড় ছড়িয়ে ইউরোপীয়রা এই ভূখন্ডে কীভাবে দ্রুতই বিশাল বটগাছ হয়ে গেল, সেই আলোচনা থাকছে আজকের পুরোটা ব্লগজুড়ে।
আশা করি পুরোটা পড়ার পর বাংলায় ইউরোপীয়রা কীভাবে আসলো, কেন আসলো, তাদের আসায় বাঙালীদের প্রতিক্রিয়া কী ছিলো, এবং তাদের আগমনে বাংলার ওপর কী কী প্রভাব পড়েছিলো- এই বিষয়গুলো সহজেই বুঝতে পারবে। তো গল্পে গল্পে জনাশোনা শুরু করা যাক!
ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের ভারতে আগমন
শুরুটা হয়েছিলো বাংলার ঐশ্বর্যের প্রতি পশ্চিমাদের তীব্র আকর্ষণ দিয়ে। সেসময়ে বাংলার গ্রামে গ্রামে গোলাভরা ধান-গোয়ালভরা গরুর গল্প আমরা সবাই জানি। শুধু এই না, বাংলায় স্বয়ংসম্পূর্ণ এই গ্রামগুলো ছিলো কুটিরশিল্পে সমৃদ্ধ। তাঁতিরা দক্ষ হাতে বুনতেন জামদানি-মসলিনের মতো মূল্যবান কাপড়। এসব কাপড়কে ইউরোপীয়দের তৈরী করা কাপড় থেকে বেশি উন্নতমানের মনে করা হতো। তাছাড়া বাংলায় সুগন্ধি মসলাসহ বিভিন্ন মূল্যবান দ্রব্যের প্রাচুর্য ছিলো। আর উর্বর পলিমাটি তো নদীবাহিত বাংলার চিরকালেরই আশীর্বাদ । যেকোনো শস্য খুব সহজেই ফলানো যেত বাংলার উর্বর মাটিতে।
এসব পণ্য এদেশের সহজ-সরল মানুষের কাছে কমদামে কিনে বিদেশে চড়া দামে বিক্রি করতে পারতো বণিকেরা। আর এখান থেকেই এই ভূখন্ডের প্রতি তাদের আগ্রহ জন্মায়। পৃথিবীজোড়া বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বণিকেরা এসে জাহজ বোঝাই করে বিভিন্ন দ্রব্য নিয়ে যেতেন। ইউরোপীয়দের আগমন নতুন ইতিহাসের জন্ম দেয়।
ইউরোপীয়দের মাঝে বাংলায় প্রথম আগমন ঘটে পর্তুগিজদের। এরপর আসে ইংরেজরা। ইংরেজদের পরে বাংলায় একে একে আসে ওলন্দাজ, ফরাসি এবং দিনেমাররা। অবশ্য ব্যবসার কুটকৌশলের দিক থেকে ইংরেজদের সাথে কেউ পেরে উঠেনি। আস্তে আস্তে তাই ওলন্দাজ, ফরাসি, পর্তুগিজ এবং দিনেমাররা ব্যবসা গুটিয়ে অন্য ঠিকানায় পাড়ি দেয়। আর বাংলার মানুষদের ওপর জেঁকে বসে ইংরেজ ব্যবসায়ীরা।
বাংলায় ইউরোপীয়দের আগমনের ধারাবাহিক ক্রম-
পর্তুগিজ (১৫১৬) > ইংরেজ (১৬০০) > ওলন্দাজ (১৬৩০) > ফরাসি (১৬৭৪) > দিনেমার (১৬৭৬ )
পর্তুগিজদের বাংলায় আগমন
বলা হয়, পশ্চিমাদের মধ্য থেকে প্রথম ভারতবর্ষে এসেছিলেন পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামা। তিনি ১৪৯৮ সালে ভারতের কালিকট বন্দরে পৌঁছান। এরই ধারাবাহিকতায় পর্তুগিজরা ইউরোপীয়দের মধ্যে প্রথম বাংলায় আসে ১৫১৬ সালে, হুগলিতে। ১৫১৭ সলে তারা চট্টগ্রামে আসে এবং চট্টগ্রাম বন্দরকে পোর্ট গ্রান্ডে নামে পরিচিত করে তোলে। আস্তে আস্তে বাণিজ্যের নামে তারা দেশে সাম্রাজ্য গড়ে তোলার পরিকল্পনা করতে থাকে। তারা ১৫১৭ সালে হুগলিতে বাংলার প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে।
প্রথম আসা ইউরোপীয় বাণিজ্যিক দল হলেও, তাদের দস্যুতা ও অপকর্মের কারণে বাংলার তৎকালীন সুবেদার শায়েস্তা খান তাদের চট্টগ্রাম এবং সন্দ্বীপের দুটি ঘাটি দখল করেন। এরপর কোনোমতে টিকে থাকলেও অন্যান্য ইউরোপীয় বাণিজ্যিক দলের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এরা পরাজিত হয় এবং দেশত্যাগে বাধ্য হয়।
ওলন্দাজ ও দিনেমারদের বাংলায় আগমন
হল্যান্ডের অধিবাসীদের ওলন্দাজ বা ডাচ বলা হয়। আর ডেনমার্কের অধিবাসীদের দিনেমার। ওলন্দাজরা “ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী” গঠন করে উপমহাদেশে তাদের বাণিজ্য পরিচালনা করতো। আর দিনেমারদের কোম্পানীর নাম ছিলো “ডেনিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী।” এরা উভয়েই বাংলাসহ উপমহাদেশের বিভন্ন স্থানে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে। কিন্তু পর্তুগিজদের মতোই এরা ইংরেজদের চাতুর্যের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ১৭৫৯ সালে বিদরার যুদ্ধে ওলন্দাজরা শোচনীয়ভাবে ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়। ১৮০৫ সালের মধ্যে বাণিজ্যিক সফলতা ছাড়াই তোপের মুখে তাদের বাংলা ত্যাগ করতে হয়।
অন্যদিকে দিনেমাররা ১৬৭৬ সালে বাংলার শ্রীরামপুরে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে। কিন্তু তাদের ওলন্দাজ ভাইদের মতোই ১৮৪৫ সালে তারা দেশ ছেড়ে চলে যায় ইংরেজদের তাড়া খেয়ে।
ফরাসিদের আগমন
ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর তুলনায় সবার শেষে উপমহাদেশে আসে। ১৬৭৪ সালে তারা বাংলায় আসে এবং বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খানের কাছে গঙ্গাতীরের চন্দননগর নামক জায়গা কিনে নেয়। কয়েক বছরের মাঝেই চন্দননগরকে তারা শক্তিশালী বাণিজ্যকুঠিতে রুপান্তর করে। এরপর আস্তে আস্তে বাংলাসহ বিহার, উড়িষ্যায়ও তারা ঘাঁটি স্থাপন করে। ইংরেজদের মতোই ফরাসিদেরও লক্ষ্য ছিলো এদেশে সাম্রাজ্য স্থাপন করা।
কিন্তু যতদিনে ফরাসিরা বাংলায় আসে, ততদিনে ইংরেজরা এখানে বেশ শক্তপোক্ত জায়গা করে নিয়েছে। ইংরেজদের সাথে প্রতিযোগীতায় ফরাসিদেরও টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। ইংরেজদের ষড়যন্ত্র, রণকৌশল আর ধূর্ত রাজনীতির মুখে অনেক সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে শেষপর্যন্ত ফরাসিরা হার মানতে বাধ্য হয়। এছাড়াও পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাবের পক্ষ নেয়ায় ফরাসিরা ইংরেজদের চোখের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। ফরাসিরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যাবার পরবর্তীতে তাদের কুঠিগুলো ইংরেজদের দখলে আসে।
বাংলায় ইংরেজ শাসন:
এবার আসা যাক বাংলা প্রায় দুইশত বছর শাসন করা ইংরেজদের কাছে। উপর থেকেই আমরা জানতে পেরেছি, বাংলায় পর্তুগীজদের পরপরই আগমন ঘটে ইংরেজদের। এর মাঝে ওলন্দাজ, ফরাসি আর দিনেমাররা সহ অনেক ইউরোপীয় কোম্পানী এসেছে, কিন্তু ইংরেজদের প্রতিপত্তির কাছে কেউই টিকতে পারেনি। পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) থেকে ১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত ইংরেজরা বাংলা শাসন করে – একথা আমরা জানি।
কিন্তু অনেকেরই অজানা থাকতে পারে যে, এই প্রায় দুইশত বছরের শাসনকাল মোট দুইভাগে বিভক্ত ছিলো। প্রথম ভাগে শাসন করে ব্রিটিশ ইস্ট কোম্পানী। এই শাসনকাল ছিলো পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত। ১৮৫৮ এর পরবর্তী সময় থেকে ভারতভাগ পর্যন্ত শাসন করে সরাসরি বৃটিশ রাণী এলিজাবেথ।
কোম্পানীর ক্ষমতা গ্রহণ:
বিভিন্ন ঘৃণ্য কৌশল আবলম্বন করে ইংরেজরা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলা -কে পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত করে ও নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর কিছুদিন মীর জাফর এবং তার জামাতা মীর কাশেম -কে প্রতীকী ক্ষমতায় বহাল রাখা হয়। বস্তুত এটিও ছিলো ইংরেজদেরই ষড়যন্ত্রের অংশ। তারা বাঙালীদের শান্ত রাখার জন্য বাঙালী হিসেবে মীর জাফরকে সিংহাসনে বসায়। প্রকৃতপক্ষে শাসনক্ষমতা পুরোটাই ছিলো ইংরেজদের হাতে।
মীর জাফরের সাথে শাসনক্ষমতা নিয়ে ইংরেজদের বিরোধ দেখা দেয়। ইংরেজরা তখন মীর জাফরেরই জামাতা মীর কাশেমকে সিংহাসনে বসায়। মীর কাশেম ছিলেন স্বাধীনচেতা নবাব। বাংলা যেন পরাধীনতার শেকলে জর্জরিত না হয়ে পড়ে এজন্য মীর কাশেম কিছু পদক্ষেপ নেন। যেমন, ইংরেজদের সরাসরি শাসন থেকে বাঁচতে তিনি রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরে স্থানান্তর করেন। নিরাপত্তার জন্য দুর্গ নির্মাণ ও পরিখা খনন করান। নিজস্ব যুদ্ধাস্ত্র বানানোর ব্যবস্থা করেন।
মীর কাশেমের এসব কার্যক্রমে ইংরেজদের স্বার্থ চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয়। তারা মীর কাশেমকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করতে থাকে। মীর কাশেমের সাথে ইংরেজদের বিরোধ একপর্যায়ে চরম হয়ে দেখা দেয়, যা ১৭৬৪ সালে যুদ্ধের রুপ নেয়। ইংরেজদের সাথে মীর কাশেম ও তার মিত্রদের এই যুদ্ধই বক্সারের যুদ্ধ নামে পরিচিত। বক্সারের যুদ্ধের পর বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সরাসরি শাসনক্ষমতা গ্রহণ করে। অর্থাৎ বক্সারের যুদ্ধের পর ইংরেজরা সত্যিকার অর্থেই এদেশের মানুষের কোনো অভিমত তোয়াক্কা করেনি।
পূর্ব ভারতের এই অঞ্চলে এরপর যে শাসন-ব্যবস্থা চালু হয়, তা দ্বৈত শাসন নামে পরিচিত। নবাবের হাতে থাকে প্রশাসনিক দায়িত্ব, আর রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের পূর্ণ কর্তৃত্ব পায় কোম্পানি। কোম্পানির লোকেরা খাজনা আদায়ের নামে অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার শুরু করে দেয়। ১৭৭০-এ (বাংলা ১১৭৬) অনাবৃষ্টি হয়। দেশে দেখা দেয় চরম বিপর্যয় ও দুর্ভিক্ষ। কয়েক লক্ষ মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যান। এটাই ইতিহাসখ্যাত ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত। এরপর ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে কোম্পানির শাসন চলেছিল মূলত লাভজনক ব্যবসায়িক দৃষ্টি ও রীতিপদ্ধতিতেই।
এভাবেই ক্রমে বাংলার বুকে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী শাসনের নামে শোষণের শেকড় গেড়ে বসে। ক্ষমতা হাতে পেয়ে তারা ইচ্ছামতো বাণিজ্য করতে থাকে। শুধু কি তাই? এদেশ থেকে বিভিন্ন মূল্যবান সম্পদ নির্বিচারে জাহাজ বোঝাই করে তারা পাচার করতো। বিভিন্ন দ্রব্য তাদের প্রয়োজনানুসারে উৎপাদন না হলে তারা কৃষকদের উৎপাদনে বাধ্য করতো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উৎপাদনে বাধ্য করার জন্য কৃষকদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হতো। এই নির্মমতার সরাসরি প্রমাণ আমরা পাই তৎকালীন সাহিত্যকর্ম থেকে।
কোম্পানীর শাসনের নামে শোষন করার ঘৃণ্যতম চিত্র লক্ষ্য করতে তৎকালীন লেখক, কবি আর বুদ্ধীজীবীদের অসংখ্য সৃষ্টি রয়েছে। ইংরেজদের শোষণের অন্যতম শিকার ছিলেন বাংলার সাধারণ জনগণ, অর্থাৎ কৃষক সমাজ। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বাংলার সব শ্রেণি-পেশার মানুষ একপর্যায়ে প্রতিবাদ শুরু করে। যে যেভাবে পারে, কোম্পানীর শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো শুরু করে। ফকির আন্দোলন, তিতুমীরের আন্দোলন, ফরায়েজি আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষে সিপাহী বিদ্রোহ হয়।
মূলত সেনাবাহিনী কর্তৃক কোম্পানীকে আক্রমণ করা হয় এই বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। বিদ্রোহটি দ্রুতই সমস্ত ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে, এবং শক্তিশালী রুপ নেয়। ফলাফলস্বরুপ, কোম্পানী শাসনের পতন হয় বাংলাসহ পুরো ভারতবর্ষে। এরপর ভারতবর্ষে বৃটিশ সরকারের সরাসরি শাসন শুরু হয়। শুরু হয় একটি নতুন আমলের।
দ্বিতীয় দফা: বৃটিশ সরকারের শাসন
আগে ব্রিটিশ সরকারের হয়ে কোম্পানী শাসন করলেও, এই বিদ্রোহের পর ব্রিটেনের রাণী সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন এবং শাসনক্ষমতা নিজ হাতে তুলে নেন। পরবর্তী প্রায় একশো বছর সরাসরি বৃটিশ সরকার বাংলাসহ পুরো ভারতবর্ষ শাসন করে।
ব্রিটিশ সরকার দ্বারা সরাসরি ভারত শাসিত হওয়া এবং শিল্পবিপ্লবের কারণে ইউরোপ ও তার উপনিবেশোগুলোতে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন হয়। ফলে উপমহাদেশ এবং গ্রেট ব্রিটেনের অর্থনীতি একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হয়ে পড়ে। অবশ্য ভারতে পরিবহন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার মুখ্য পরিবর্তনগুলি সিপাহি বিদ্রোহের আগেই শুরু হয়েছিল। লর্ড ডালহৌসি বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।
এর ফলে ভারতে দ্রুতই বিভিন্ন প্রযুক্তির উন্নয়ন শুরু হয়। রেলপথ, সড়ক, খাল, সেতু ইত্যাদি নির্মিত হতে থাকে এবং টেলিগ্রাফ যোগাযোগ গড়ে ওঠে। এগুলির মাধ্যমে কাঁচামাল যেমন তুলা, নীল, মসলিন ইত্যাদি ভারতের ভিতরের বিভিন্ন দূরবর্তী জায়গা থেকে পরিবহন করে সহজেই নিয়ে আসা সম্ভব হয় ইংল্যান্ডে রপ্তানির জন্য। মূলত এই উন্নয়নের কারণ ছিলো ইংরেজদের একান্ত ব্যক্তিগত স্বার্থ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এই বাড়াবাড়ি শোষণকে একটা নতুন মাত্রা দেয়। বিশ্বযুদ্ধের কারণে খাদ্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংকট দেখা দেয় ইংরেজদের, ফলস্বরুপ তারা উপনিবেশোগুলোতে বাড়তি চাপ দেয়। প্রযুক্তিগত দ্রুততা আমাদের কৃষি অর্থনীতিকে অনেক পরিবর্তন করে।
তুলা ছাড়াও অনেক ধরণের খাদ্যশস্য এবং দ্রব্যাদি ব্রিটেনে রপ্তানি হতে থাকার ফলস্বরূপ, অনেক ক্ষুদ্র কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা বাজারগুলির অস্থিরতার কারণে জমি, গবাদি পশু, কৃষি উপকরন ইত্যাদি ঋণদাতাদের কাছে হারাতে থাকে। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি ভারতে বড় আকারের দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে থাকে।
যদিও ভারতীয় উপমহাদেশে দুর্ভিক্ষ এতদিনে নতুন কিছু ছিল না, কিন্তু এই দুর্ভিক্ষগুলির প্রভাব খুবই গুরুতর ছিল যার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যেতে থাকে। ব্রিটিশ সরকারের শাসন নামক শোষণের বিরুদ্ধে গণমানুষআবারো এক হতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন অনেকটাই দূর্বল হতে শুরু করে এবং উপনিবেশ থেকে আস্তে আস্তে শাসন গুটিয়ে নিতে থাকে। বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পায়।
বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব:
ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পৃথিবীর বিশাল অংশজুড়ে তাদের শাসন বহাল করেছে। বেশ লম্বা একটা সময়জুড়ে শাসন করায় উপনিবেশগুলোর উপর নিজস্ব প্রভাব ফেলতে তারা সফল হয়েছে। বাংলার ক্ষেত্রেও এর কিছু পরিবর্তন ঘটেনি। তারা বাংলার অর্থনীতি, শিক্ষাপদ্ধতি, যোগাযোগব্যবস্থা থেকে শুরু করে আচার-আচরণ এমনকি খাদ্যাভ্যাসেও বিশাল প্রভাব রেখেছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তন:
ইংরেজ শাসনের ফলে এদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তনকে ইতিবাচক বলা চলে। ইংরেজদের মাধ্যমে এ দেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন হয়। আগের টোল আর পাঠশালা ছাড়িয়ে শিক্ষা বিস্তারে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ছাপাখানার বিকাশে জ্ঞান বিস্তারের সুযোগ বাড়ে। আধুনিক ও ইংরেজি শিক্ষার ফলে এ দেশে ক্রমে একটা ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে ওঠে।
এদের একাংশের মধ্যে নতুন চেতনার বিকাশ ঘটতে থাকে। এরা নিজেদের সমাজে বহুকাল ধরে প্রচলিত নানা কুসংস্কার, কুপ্রথা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন। এদের হাত ধরেই উনিশ শতকে বাংলায় নবজাগরণ ঘটে। যার ফলে সামাজিক সংস্কারসহ শিক্ষা, সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসার ঘটে। নবজাগরণের কয়েকজন প্রধান ব্যক্তি ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রমুখ।
অর্থনীতিতে পরিবর্তন :
আগেই বলেছি, দেশে ইংরেজ শাসনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এদেশের মানুষকে শোষণ করে নিজেরা লাভ করা। প্রায় ২০০ বছরের এ শাসনকালে প্রচুর অর্থ ও সম্পদ এ দেশ থেকে তারা পাচার করে। বাংলার অর্থনীতির মেরুদণ্ড ছিলো কৃষি। ইংরেজদের সুবিধা অনুযায়ী ফসল ফলাতে বাধ্য করায় দেশের কৃষিব্যবস্থাইয় ধস নামে।
বাংলার গৌরবময় তাঁতশিল্প তাদের লোভ ও সুবিধাবাদের কারণে প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। বাংলার শিল্প, বাণিজ্য নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অসংখ্য কারিগর বেকার হয়ে যায়। পূর্বের ‘সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা’ বাংলা হয়ে পড়ে দরিদ্র, জীর্ণ-শীর্ণ একটি ভূখন্ডে।
সামাজিক পরিবর্তন:
ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলায় সমাজ কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। উপনিবেশিক শাসনের পরিনতিতে বাংলা তথা ভারতবর্ষের নাগরিকরা নিজ দেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে মুসলমানদের অবস্থা বেশি শোচনীয় হয়ে পড়ে বলে অনেকে মনে করেন।
বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করা থেকে বিরত থেকে মুসলমানরা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। অবশ্য ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ফলে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত, বিধবা বিবাহ চালু, বাল্য বিবাহ রোধ, আলীগড় আন্দোলন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। পরিবর্তন আসে বর্ণ প্রথার ভিত্তিতে গড়ে উঠা সামাজিক স্তর বিন্যাসে।
পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। ইংরেজি শিক্ষা, পুঁজিবাদের প্রসার ও নতুন রাজনৈতিক কাঠামোর কারণে বাংলার সামাজিক অব বিভেদ নীতিব্রিটিশ শাসনামলে বাংলায় সমাজ কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।
উপনিবেশিক শাসনের পরিনতিতে বাংলা তথা ভারতবর্ষের নাগরিকরা নিজ দেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে মুসলমানদের অবস্থা বেশি শোচনীয় হয়ে পড়ে বলে অনেকে মনে করেন। বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করা থেকে বিরত থেকে মুসলমানরা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে।
অবশ্য ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ফলে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত, বিধবা বিবাহ চালু, বাল্য বিবাহ রোধ, আলীগড় আন্দোলন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। পরিবর্তন আসে বর্ণ প্রথার ভিত্তিতে গড়ে উঠা সামাজিক স্তর বিন্যাসে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে।
ইংরেজি শিক্ষা, পুঁজিবাদের প্রসার ও নতুন রাজনৈতিক কাঠামোর কারণে বাংলার সামাজিক অবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। বিভিন্ন ঔপনিবেশীক কূটনীতির কারণে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায় মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায়। ব্রিটিশদের রোপিত সাম্প্রদায়িকতার বীজ বিশাল সমস্যায় পরিণত হয় যার ফলস্বরূপ শুধু বাংলা প্রদেশের বিভক্তি হয়নি, বিভক্ত হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশও।
এসব উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ছাড়াও ব্রিটিশরা বাংলায় এমন কিছু পরিবর্তন ঘটিয়েছে যার প্রভাব আজও বিদ্যমান।
শেষকথা:
বাংলায় ইউরোপীয়দের আগমন কিছু স্থায়ী পরিবর্তন নিয়ে আসে। হয়তো কিছু ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনগুলো ইতিবাচক হয়ে ঠেকেছে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঔপনিবেশিক শাসন বাংলার জন্য বয়ে এনেছে অন্তহীন দুঃসময়। সামগ্রীকভাবে তাদের সাধন করা ক্ষতি আজও পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি।
আপনার কমেন্ট লিখুন