পৃথিবীর শুরু থেকে কত হাজারও ঘটনা নিয়ে যুদ্ধ ও জীবন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ভাষার জন্য জীবন দেয়ার ইতিহাস একমাত্র আমাদেরই। এজন্যই ২১ শে ফেব্রুয়ারি আমাদের গর্ব ও অহংকার। আজ জানবো অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ঘটে যাওয়া সেই গল্প। একুশে ফেব্রুয়ারি ঘটে যাওয়া সে গল্পের দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। প্রাণের বিনিময়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার এক অনন্য গল্প। বাঙালির ইতিহাসের এক হার না মানা গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের গল্প।
২১ শে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস
২১ শে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস: পটভূমি
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যায় ভারত আর পাকিস্তান। ভারতের সাথে দেশ ভাগের পর ভাষা, সংস্কৃতি ও ভৌগলিক অবস্থান ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও শুধু মাত্র ধর্মীয় সংখ্যা গরিষ্ঠতার উপর ভিত্তি করে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান দুটি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়। সংষ্কৃতি,ভাষা, শিক্ষা, আচার আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে অমিল থাকার কারণে দুই প্রদেশের জনগণকে একই কাতারে কল্পনা করা যাচ্ছিলো না। জনসংখ্যার দিক দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও সিভিল সার্ভিস, মিলিটারি ও গুরত্বপূর্ণ সব রাষ্ট্রীয় পদে তাদের আধিপত্য বেশি ছিল। ক্রমে তারা নিজেদের শাসনকর্তা ও বাঙ্গালিদের প্রজা ভাবতে শুরু করলেন।
এতোকিছু করেও ক্ষ্যান্ত হননি তারা। নব গঠিত রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তারা উর্দূ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করতে থাকে। এই পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে ঢাকায় “তমদ্দুন মজলিশের” সেক্রেটারি অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে এক প্রতিবাদ সভা ও র্যালি বের করা হয়। সভায় বাংলাকে উর্দূর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা করার দাবী করা হয়। এবং এই অবস্থার প্রেক্ষিতে ১৯৪৭ এর ডিসেম্বর মাসে “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” গঠন করা হয়। এভাবে চলতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যকার শীতল যুদ্ধ।
পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন আত্নকেন্দ্রিক সিদ্ধান্তের কারনে আবারো সোচ্চার হয়ে উঠে বাঙ্গালী। ফলে ১১ই মার্চ ১৯৪৮ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবীতে পুনরায় মিছিল করা হয়। মিছিল করার অপরাধে গ্রেফতার হন শেখ মুজিবর রহমান, কাজী গোলাম মাহাবুব, অলি আহাদ, শওকত আলী, সামসুল হকসহ অনেকে।
২১ শে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস: মূল আন্দোলন
২১শে মার্চ, ১৯৪৮ সাল। ঢাকার রেসর্কোস ময়দান তৎকালীন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গভর্ণর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ দৃঢ় ভাষায় ঘোষনা করেন “উর্দূ, এবং উর্দূই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” এমন ঘোষণায় আবারো সোচ্চার হয়ে উঠে সমগ্র বাংলা। মায়ের মুখের ভাষা ছেড়ে অন্যভাষায় কথা বলার প্রশ্নই আসেনা। এভাবে অতিবাহিত হয় আরও ৪ বছর।
২৭শে জানুয়ারি, ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের নব নিযুক্ত গর্ভণর জেনারেল খাজা নাজিম উদ্দিন ঢাকায় এসে পুনঃরায় ঘোষনা দেন, “উর্দূই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” এই ঘোষনা শুনার পর আবার গর্জে উঠে বাঙ্গালী জাতি, প্রতিবাদে জ্বলে উঠে সারা বাংলা। ২১শে ফেব্রুয়ারী সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ র্কতৃক বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে হরতালের ডাক দেওয়া হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ সাল। সকাল হতে না হতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে জড়ো হতে লাগলো ছাত্র জনতা। পাকিস্তান সরকার ঐ দিন ঢাকায় ১৪৪ ধারা ঘোষনা করেন।
একসময় সমবেত ছাত্র জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন এবং গাজীউল হকের নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সবাই মিছিল নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মিছিল যখন ঢাকা মেডিক্যালের কাছাকাছি আসে তখন শুরু হয় পুলিশের এলোপাতাড়ি গোলাগুলি।
গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রফিক, জব্বার, সালাম ও বরকত। বুলেটের আঘাতে রফিকের মাথা ফেটে মগজ বের হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে জব্বার ও বরকত ঐ দিন রাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়নে। আহত অবস্থায় ২৫শে ফেব্রুয়ারী রাতে মারা যান সালাম। এই ২১শে ফেব্রুয়ারী বর্তমানে প্রতি বছর আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পৃথিবীর সব দেশে একযোগে পালিত হয়। ১৭ই নভেম্বর, ১৯৯৯ সালে ইউনোস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারীকে ‘আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা’ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং ২০০০ সাল থেকে সারা বিশ্ব এই দিবসটিকে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন শুরু করেন।
ফুল সিলেবাস কোর্সে যা যা থাকছে:
৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি অনলাইন ব্যাচ ২০২৪
২১ শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে কিছু কথা
অমর একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে বলা শুরু করলে শেষ করা সম্ভব নয়। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের শেকড়, আমাদের অহংকার। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল সব। তবে, ২১ শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। এখানে একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস নিয়ে রইল কিছু আলোচনা:
২১ শে ফেব্রুয়ারি শহীদদের নাম
২১ শে ফেব্রুয়ারি শহীদদের নাম নিচে দেয়া হলো:
ভাষা শহীদ আবদুস সালাম
ধর্মের দ্বৈরথে ভাঙ্গলো ভারত। মুসলিম জাতিসত্তার ভিত্তিতে গড়ে উঠলো পাকিস্তান রাষ্ট্র। কিন্তু এক ধর্মের মানুষে এত বৈষম্য কেন? ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের প্রশ্নে দুই প্রান্তে আকাশ পাতাল ব্যবধান। পশ্চিম পাকিস্তানিদের অন্যায় শাসন মেনে নেওয়া যাচ্ছে না আর। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে উর্দু ভাষা। মন ব্যথিত হয়ে ওঠে আবদুস সালামের। অভাবের সংসারে একটু সচ্ছলতা আনতে ঢাকায় এসেছেন তিনি। পড়ালেখার বড় শখ ছিল। অভাবের তাড়নায় ম্যাট্রিক ফাইনালটা দেওয়া হলো না। শিক্ষার চেয়ে পেট বাঁচানো আগে জরুরি। এখন ছোটখাটো একটা চাকরিতে আয়েশ না হোক, পরিবারের খরচটা জুটে যায়।
এই কদিন আগে গ্রাম থেকে ঘুরে এলেন। বিয়ের কথাবার্তা চলছে। মা নিজের হাতে পাত্রী পছন্দ করছেন। সামনের শীতে বিয়ে হবে। কাজের ফাঁকে সালামের বড় ভাল লাগে এসব ভাবতে।
ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন
মানিকগঞ্জের রফিক উদ্দিনের গল্পটা আবার অন্যরকম। জগন্নাথ কলেজে পড়ার পাশাপাশি বাবার সাথে প্রেসের ব্যবসা শুরু দিয়েছেন। অনেকের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে এই প্রেসে আদর্শলিপি ছাপান তিনি। প্রতিটা অক্ষর ছাপানোর সময় গভীর মমতায় ছুঁয়ে দেখেন। একদিন এই ভাষা ব্যবহারের উপর শাসকের বাধার কালো হাত থাকবে না। সে হাত ভেঙ্গে দিতে হবে। মায়ের ভাষার উপর কারো খবরদারি চলবে না। তাই তো ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় রফিক উদ্দিন। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি রাঙানো হয়েছে তার রক্তে।
ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার
ময়মনসিংহের আব্দুল জব্বারের পড়ালেখা একদমই আগায় নি। একদম ছেলেবেলায় ঘর পালিয়ে বার্মা পাড়ি জমান। এক যুগ পরবাসে কাটিয়ে দেশে ফিরেন তিনি। জীবনটাকে গুছিয়ে নিয়ে বিয়েটা করে সংসারী হলেন। একটা ফুটফুটে পুত্রসন্তান এলো ঘর আলো করে। এতটুকু পুতুলের মত একটা মানুষ! আব্দুল জব্বারের বুকটা মায়ায় ভরে যায় ছেলেকে কোলে নিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা যে বড় কঠিন। শাশুড়ির চিকিৎসা করাতে ঢাকায় আসেন তিনি। ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করান। চার মাস বয়সী দুধের সন্তানের কথা ভেবে বুকে অনবরত রক্তক্ষরণ হয় তাঁর।
ভাষা শহীদ আবুল বরকত
সদ্য তারুণ্যে পা দেওয়া আবুল বরকত বরাবরই পড়ালেখায় ভাল। উচ্চ পর্যায়ের পড়াশোনার জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে পাড়ি জমালেন তিনি। ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। অত্যন্ত মেধাবী বরকতকে আলোড়িত করলো ভাষা আন্দোলন। ভাষার টান যে প্রাণের প্রতি স্পন্দনে। আন্দোলন দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়লো সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অফিস আদালতে এবং রাজপথের সবখানে। ছাত্র জনতার সাথে মিছিলে নেমে পড়লেন বরকত। ভাষার দাবী যে সবার আগে!
ভাষা শহীদ শফিউর রহমান
ভাষা শহিদ শফিউর রহমান হাইকোর্টের একজন কর্মচারী। ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল দশটার দিকে রঘুনাথ দাস লেনের বাসা থেকে সাইকেলে চড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হন তিনি। সকাল প্রায় সাড়ে দশটায় নওয়াবপুর রোডে, দৈনিক সংবাদ’ অফিসের সামনে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া মিছিল সংগঠিত হয়। সেখানে পুলিশ ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের একটি গুলি সোজা অফিস গমনরত শফিউর রহমানের পিঠে এসে লাগে। দ্রুত তাকে তৎক্ষণাৎ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে তাঁকে ডা. অ্যালিনসন তার অপারেশন করেন। কিন্তু বিধি বাম! ঐদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার সময় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
২১ শে ফেব্রুয়ারি কি দিবস?
২১ শে ফেব্রুয়ারি কি দিবস তা তো আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আজ সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন মানুষদের নিজ ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। একুশে ফেব্রুয়ারির জন্যই মানুষ বুঝতে শিখছে, ভাষাটা একটি জাতির জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদের ৩০ তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়। ইউনেস্কোর ঘোষণা বলা হয়,
21st February is proclaimed International Mother
Language Day throughout the world to commemorate the martyrs who sacrificed
their lives on this day in 1952.
একুশে ফেব্রুয়ারি কবিতা
মহান একুশে ফেব্রুয়ারি কবিতা নিয়ে বললে অনেক কবিতার কথাই বলা যাবে। একুশে ফেব্রুয়ারি কবিতা হিসেবে কিছু কবিতা হলো:
- কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি (মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী)
- অমর একুশে (হাসান হাফিজুর রহমান)
- অভিশাপ দিচ্ছি (শামসুর রাহমান)
- কোন এক মাকে (আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ)
- একুশের কবিতা (সৈয়দ শামসুল হক)
কোর্সটি করে যা শিখবেন:
Communication Masterclass by Tahsan Khan
২১ শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। চলুন এবার জেনে নেই, কেন একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়?
একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস: জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস: পটভূমি
ঘটনা ১৯৯৮ সালের। কানাডায় বসবাসরত এক বাংলাদেশি রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় অবস্থিত মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্য সোসাইটি কর্তৃক জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। সেই প্রস্তাবনায় স্বাক্ষর করেছিলেন ভিন্ন ভাষাভাষী ১০ জন সদস্য। তবে জাতিসংঘের পরামর্শ অনুযায়ী বিষয়টি নিয়ে প্যারিসে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংগঠন ইউনেস্কোতে যোগাযোগ করা হয়।
এরপরে ১ বছরেও কোন সিদ্ধান্ত না আসায় কানাডাপ্রবাসী আরেক বাংলাদেশি আবদুস সালামকে নিয়ে ইউনেস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন রফিকুল ইসলাম। ১৯৯৯ সালের ৩ মার্চ আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার পথে যাত্রা শুরু করেন রফিকুল ইসলাম। ইউনেস্কো থেকে জানানো হয়, বিষয়টি ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হলে কয়েকটি দেশ থেকে প্রস্তাব পেশ করতে হবে।
তাই রফিকুল ইসলাম দ্রুত যোগাযোগ করেন বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সবকিছু উপেক্ষা করে ইউনেস্কোর সদর দফতরে পাঠিয়ে দেন সেই ঐতিহাসিক প্রস্তাব। যেটি প্যারিসে পৌঁছায় ৯ সেপ্টেম্বর। তবে উদযাপনের খরচসহ কয়েকটি কারণে ইউনেস্কোর নির্বাহী পরিষদের ১৫৭তম অধিবেশন ও ৩০তম সম্মেলনে বিষয়টি আটকে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তবে সেখানে বেশ বড় ভূমিকা রাখেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার পাশাপাশি অধিবেশনে সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, দিবসটি উদযাপনে সংস্থাটির কোনো খরচ বহন করতে হবে না।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস: স্বীকৃতির সেই দিন
সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর মহান একুশে ফেব্রুয়ারি পায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিশেষ সেই মর্যাদা। ইউনেস্কোর সেই অধিবেশনে এই দিবস পালনের মূল প্রস্তাবক ছিল বাংলাদেশ ও সৌদি আরব। তবে সমর্থন ছিল পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেরই। ২০০০ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি সর্বপ্রথম ইউনেস্কোর প্রধান কার্যালয় প্যারিসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি পালন করা হয়। সেবছর থেকে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোতেও মর্যাদার সঙ্গে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
রফিকুল ইসলাম ও মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্য সোসাইটি’র স্বীকৃতি
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বাস্তবায়ন করার এ মহৎ ভূমিকা রাখায় বাংলাদেশ সরকার ২০০১ সালে কানাডার সেই মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্য সোসাইটিকে একুশে পদকে ভূষিত করেন। সোসাইটির পেছনে নেতৃত্ব দেয়া রফিকুল ইসলাম ২০১৩ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ২০১৬ সালে রফিকুল ইসলামকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক ‘স্বাধীনতা পদক’-এ সম্মানিত করা হয়।
এই কোর্সটি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করবে?
সুন্দর ও দ্রুত বাংলা হাতের লেখা
একুশের যত প্রথম
আজ আমরা যে ভাষায় কথা বলছি, যে ভাষায় গান গাইছি, যে ভাষাকে ভালোবাসছি, যে ভাষায় কথা বলা আমাদের আত্মতৃপ্তি দান করছে, সেই ভাষা আমরা পেয়েছি কিছু আত্মত্যাগী মানুষের জন্যে। বিনম্র শ্রদ্ধাভরে আমরা স্মরণ করছি তাদের। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আমরা সবাই কমবেশি জানি। আজকে আমরা জানবো ভাষা আন্দোলনে যতোসব প্রথম:
- একুশের প্রথম ভাষা শহীদ
- প্রথম শহীদ মিনার
- ঢাকায় নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার
- প্রথম শহীদ দিবস
- প্রথম লিফলেট
- প্রথম কবিতা
- প্রথম গান
- প্রথম গল্প
- প্রথম সংকলন
- প্রথম নাটক
- প্রথম উপন্যাস
- প্রথম সিনেমা
- প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
একুশের প্রথম ভাষা শহীদ কে?
একুশের প্রথম ভাষা শহীদ রফিকউদ্দিন আহমদ। মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার পারিল গ্রামে ছিল তাঁদের বাড়ি। ঘটনার সময় শহীদ রফিকের বয়স ছিলো ২৬ বছর। ১৯৫২-র ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের রাস্তায় ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে বিক্ষোভ প্রদর্শনরত ছাত্র-জনতার মিছিলে রফিক অংশগ্রহণ করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হোস্টেল প্রাঙ্গনে পুলিশ গুলি চালালে সেই গুলি রফিকউদ্দিনের মাথায় লাগে। গুলিতে মাথার খুলি উড়ে গিয়ে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়।
প্রথম শহীদ মিনার কোনটি?
প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ হয়েছিলো রাজশাহীতে। ১৯৫২ সালের ২২ই ফেব্রুয়ারি পরিকল্পনা এবং ২৩শে ফেব্রুয়ারি তারিখ দিবাগত রাতে রাজশাহী কলেজ ছাত্রাবাস সংলগ্ন এলাকায় এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। এর মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন সাইদ হায়দার। এর দৈর্ঘ্য ছিলো দশ ফিট এবং প্রস্থ ছয় ফিট। এই মিনারটি উদ্বোধন করেন ভাষা শহীদ সফিউর রহমানের পিতা মৌলভী মাহাবুবুর রহমান। কিন্তু পরে পাকিস্তানি আর্মি-পুলিশরা এই মিনারটি ভেঙ্গে ফেলে।
ঢাকায় নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার কোনটি?
২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ গভীর রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ব্যারাক হোস্টেলের ১২নং গেটের সামনে মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের সম্মিলিত শ্রমে নির্মিত হয়েছিল প্রথম শহীদ মিনার।এর নকশাকার ছিলেন ডা. বদরুল আলম।
প্রথম শহীদ দিবস কবে?
১৯৫৩ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি প্রথম শহীদ দিবস এই দিনে প্রথমবারের মতো পালন করা হয় শহীদ দিবস। দীর্ঘ শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয় সেদিন। শোভাযাত্রীরা শোকজ্ঞাপক কালো ব্যাজ,কালো পতাকা ধারণ করে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিতে দিতে অগ্রসর হতে থাকে। সেবারই প্রথম উৎযাপিত হয় শহীদ দিবস।
ভাষা আন্দোলনের প্রথম লিফলেট কোনটি?
ভাষা আন্দোলনের প্রথম লিফলেট প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি বর্ষণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। গুলি বর্ষণের অল্প কিছুক্ষণ পরই হাসান হাফিজুর রহমান, আমীর আলীসহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের উল্টোদিকে ক্যাপিটাল প্রেসে চলে যান। সেখানে গিয়ে হাসান হাফিজুর রহমান লিফলেটের খসড়া তৈরি করেন। দুই তিন ঘণ্টার মধ্যেই লিফলেটটি ছাপার কাজ সম্পন্ন হয়। হাসান হাফিজুর রহমান লিফলেটটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসেন। প্রায় দুই/তিন হাজার লিফলেট ছাপানো হয়েছিল। উৎসাহী ছাত্ররাই এ লিফলেটগুলো চারদিকে ছড়িয়ে দেয়। আশেপাশের সমগ্র এলাকায় পৌঁছে যায় লিফলেটগুলো।
একুশের প্রথম কবিতা কোনটি?
১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে প্রথম কবিতা রচনা করেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী। নাম ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। পাকিস্তান সরকার সে কবিতা বাজেয়াপ্ত করল। হুলিয়া জারি হলো মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ওপর। তিনি এবং তাঁর কবিতা হয়ে গেল ইতিহাসের অংশ। ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি- একুশের প্রথম কবিতা।
একুশের প্রথম গান কোনটি?
একুশের গান হিসেবে অধিক সমাদৃত “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো” গানটি। তবে, এটি একুশের প্রথম গান নয়। ভাষা আন্দোলনভিত্তিক প্রথম গানটির প্রথম চরণ ‘ভুলব না, ভুলব না, একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’। যার রচয়িতা ভাষা সৈনিক আ ন ম গাজিউল হক। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আর্মানিটোলা ময়দানের জনসভায় গানটি গাওয়া হয়।
একুশ নিয়ে প্রথম গানটি কে রচনা করেন?
একুশ নিয়ে প্রথম গানটি রচনা করেন ভাষা সৈনিক আ ন ম গাজিউল হক।
একুশের প্রথম গল্প কোনটি?
১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রজনতা হত্যার পর রচিত একুশের প্রথম গল্পের নাম ‘মৌন নয়ন’। গল্পটির রচয়িতা বিশিষ্ট কবি ও কথাশিল্পী শওকত ওসমান। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত একুশের প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ গ্রন্থে গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়।
একুশের প্রথম সংকলন কোনটি?
১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে একুশের প্রথম সংকলন সম্পাদনা করেছিলেন বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম কৃতী পুরুষ কবি হাসান হাফিজুর রহমান। প্রকাশক ছিলেন অন্যতম ভাষাসৈনিক মুহাম্মদ সুলতান। পুঁথিপত্র প্রকাশনার মাধ্যমে প্রকাশিত এই সংকলনের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন আমিনুল ইসলাম। রেখাচিত্র এঁকেছিলেন মর্তুজা বশীর। সংকলনটি পাইওনিয়ার প্রেসের পক্ষ ছাপা হয়। এই সংকলনে স্থান পেয়েছিল একুশের প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, গান, নকশা ও ইতিহাস।
একুশের প্রথম নাটক কোনটি?
মুনির চৌধুরী এবং তার রচিত নাটক ‘কবর’ এর নাম শুনেনি এমন মানুষ বিরল। ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার ‘অপরাধে’ ’৫২ সালে জেলে আটক ছিলেন মুনির চৌধুরী, রণেশ দাশগুপ্তসহ অনেক লেখক- সাংবাদিক। মুনীর চৌধুরী ’৫৩ সালে জেলে বসেই কবর নাটকটি রচনা করেন । ওই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি, রাত ১০টায় জেলকক্ষগুলোর বাতি নিভিয়ে দেওয়ার পর হ্যারিকেনের আলো- আঁধারিতে মঞ্চস্থ হয় কবর।
একুশের প্রথম উপন্যাস কোনটি?
একুশের প্রথম উপন্যাস জহির রায়হান রচিত ‘আরেক ফাল্গুন’। শহীদ দিবস পালন, শহীদ মিনার নির্মাণ ভাষা আন্দোলনের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটানো হয় এই উপন্যাসে। ৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার মাত্র তিন মাস পর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে রচিত হয় এই উপন্যাসটি।
একুশের প্রথম সিনেমা কোনটি?
একুশের চেতনা নিয়ে প্রথম নির্মিত সিনেমা ‘জীবন থেকে নেয়া’। ১৯৭০ সালে জহির রায়হান সিনেমাটি পরিচালনা করেন। সিনেমাটি সে সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরবর্তিতে স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখে সিনেমাটি।
আরো পড়ুন: মহান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস: যেভাবে অর্জন করলাম বাংলায় কথা বলার অধিকার
প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কবে?
২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। জাতিসংঘের ১৮৮টি দেশ একসঙ্গে প্রথম ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে। এর আগে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কো আনুষ্ঠানিকভাবে দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশ ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনের ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে প্রস্তাবটির খসড়া পেশ করে। বাংলাদেশকে সমর্থন জানায় ২৭টি দেশ।
ভাষা দিবস নিয়ে কিছু কথা
ভাষা দিবস কত তারিখে?
ভাষা দিবস তথা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২১ শে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি -কে কেন্দ্র করে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস উৎযাপন করা হয়।
ভাষা দিবস কে আর কী নামে অভিহিত করা হয়?
ভাষা দিবসকে শহিদ দিবস, মাতৃভাষা দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বলে অভিহিত করা হয়।
ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদরা কারা ছিলেন?
ভাষা আন্দোলনের বীর শহিদ ছিলেন আবদুস সালাম, রফিক উদ্দিন, আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার ও শফিউর রহমান।
ভাষা দিবস উদযাপন করার দিনে কোন গানটি খুব প্রাসঙ্গিক?
ভাষা দিবস উদযাপন করার দিনে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি” গানটি সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক।
শেষ কথা
২১ শে ফেব্রুয়ারি ইতিহাস থেকে নিশ্চয়ই বোঝা যায় যে, ২১ শে ফেব্রুয়ারি কি দিবস আমাদের কাছে। এটি শুধুই ভাষা দিবস নয় বরং এটি আমাদের স্বাধীনতার প্রথম ধাপ। বাঙালি জাতি হিসেবে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রেরণা যোগায়।
আমাদের কোর্সগুলোতে ভর্তি হতে ক্লিক করুন:
১০ মিনিট স্কুলের ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে সরাসরি চলে যেতে পারো এই লিঙ্কে: www.10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন